অধ্যাপক কেএভি পান্ডালাই আমাকে শেখাতেন অ্যারোস্ট্রাকচার ডিজাইন ও বিশ্লেষণ। তিনি ছিলেন সদা উফুল, বন্ধু ভাবাপন্ন ও উদ্যমী শিক্ষক, প্রতি বছরের শিক্ষা কোর্সে তিনি নিয়ে আসতেন তরতাজা মনোভঙ্গি। অধ্যাপক পান্ডালাই ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি আমাদের কাছে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর গুপ্তবিষয় উন্মোচন করেছিলেন। এমনকি আজও আমি বিশ্বাস করি, অধ্যাপক পান্ডালাইয়ের শিক্ষা যারা পেয়েছে তারা সবাই একমত হবে যে তিনি ছিলেন মহান পন্ডিত ব্যক্তি, কিন্তু তার মধ্যে সামান্য পরিমাণ গর্বও পরিলক্ষিত হতো না। শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন পয়েন্টে তার সঙ্গে অমত পোষণ করার স্বাধীনতা ছিল তার ছাত্রদের।
অধ্যাপক নরসিংহ রাও গণিতবিদ, তিনি আমাদের পড়াতেন তাত্ত্বিক অ্যারোডাইনামিকস। আমি এখনও তার ফ্লুইড ডাইনামিকস শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি স্মরণ করতে পারি। তার ক্লাসগুলোয় হাজির হওয়ার পর, অন্য যে কোনো বিষয়ের তুলনায় আমি গাণিতিক পদার্থবিদ্যা বেশি পছন্দ করতে শুরু করলাম। প্রায়ই আমি অ্যারোনটিক্যাল ডিজাইন পর্যালোচনা করার জন্য একটা সার্জিক্যাল নাইফ বহন করি। অ্যারোডাইনামিক প্রবাহের সমীকরণ করতে প্রমাণাদি গ্রহণে অধ্যাপক রাওয়ের সদয় পরামর্শ যদি না পেতাম, তাহলে এই রূপক যন্ত্রটা আমি অর্জন করতে পারতাম না।
অ্যারোনটিকস একটা মোহনীয় বিষয়, এটা নিজের মধ্যে ধারণ করে আছে স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি। স্বাধীনতা ও পলায়নের মধ্যে, গতি ও আন্দোলনের মধ্যে, ধ্বস ও প্রবাহের মধ্যে যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে তা এই বিজ্ঞানের রহস্য। এই সত্য আমার সামনে উন্মোচন করেছিলেন আমার শিক্ষকরা। তাদের অমূল্য শিক্ষার ভেতর দিয়ে তারা আমার মধ্যে অ্যারোনটিকস সম্পর্কে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের মেধা, চিন্তার স্বচ্ছতা আর বিশুদ্ধতার জন্য কামনা আমাকে। চালিত করেছিল চাপ প্রয়োগযোগ্য মধ্যম গতির ফুইড ডাইনামিকস-মোডস, শক ওয়েভ সৃষ্টি ও শক, ক্রমবর্ধমান গতিতে ফ্লো, সেপারেশন উদ্দীপ্ত করা, শক স্টল ও শক-ওয়েভ ড্রাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পড়াশোনার মধ্যে ঢুকে যেতে।
.
ধীরে ধীরে আমার মনে জায়গা নিল তথ্যের বিপুল ভান্ডার। এরোপ্লেনের কাঠামগত অবয়ব নতুন অর্থ নিতে লাগল-বাইপ্লেন, মনোপ্লেন, টেইললেস প্লেন, ক্যানার্ড। কনফিগারড প্লেন, ডেল্টা-উইং প্লেন, এ সমস্ত কিছু আমার জন্য ধারণ করতে আরম্ভ করল ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব। তিন শিক্ষক, স্ব স্ব ক্ষেত্রে তারা সবাই ছিলেন কর্তাব্যক্তি, আমাকে সাহায্য করেছিলেন একটা যৌগিক জ্ঞান সন্নিবিষ্ট করতে।
এমআইটিতে আমার তৃতীয় ও শেষ বছরটি ছিল উত্তরণের একটি বছর এবং আমার পরবর্তী জীবনের ওপর এর প্রভাব পড়েছিল। সেই সব দিনে, রাজনৈতিক আলোকবর্তিকার একটা নতুন আবহাওয়া ও শিল্প স্থাপনার চেষ্টা ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে। স্রষ্টায় আমার বিশ্বাস পরীক্ষা করতে হয়েছিল আমাকে এবং দেখতে হয়েছিল যে সেটা বৈজ্ঞানিক চিন্তার ছাঁচে খাপ খায় কিনা। গৃহীত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একটা বিশ্বাস ছিল জ্ঞানের প্রতি একমাত্র বৈধ অভিগমন। যদি তাই হয়, আমি ভেবেছিলাম, তাহলে বস্তুই একমাত্র বাস্তবতা আর আধ্যাত্মিক প্রপঞ্চ বস্তুর একটা প্রকাশ ছাড়া আর কি? সমস্ত নৈতিক মূল্য কি আপেক্ষিক, এবং সংবেদজ উপলব্ধি সত্য ও জ্ঞানের একমাত্র উত্স? এসব বিষয়ে আমি ভাবতাম, বৈজ্ঞানিক মেজাজ ও আমার নিজের আধ্যাত্মিক আগ্রহের প্রশ্ন আলাদা করার চেষ্টা চালাতাম। যে মূল্যবোধের ধারায় আমি রেড়ে উঠেছিলাম তা গভীরভাবে ছিল ধর্মীয়। আমি এই শিক্ষা পেয়েছিলাম যে আধ্যাত্মিক এলাকার মধ্যে আসল বাস্তবতা রয়েছে জড় বিশ্ব ছাড়িয়ে, এবং জ্ঞান আহরণ করা যায় কেবল অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
ইতোমধ্যে আমার কোর্সের কাজ যখন শেষ করে ফেলেছি, তখন আমাকে একটা প্রকল্পে কাজে লাগানো হলো আরও চারজন সহকর্মীর সঙ্গে মিলে একটা লোলেভেল অ্যাটাক এয়ারক্র্যাফটের নকশা করার জন্য। আমি অ্যারোডাইনামিক ডিজাইন অংকন ও প্রস্তুতের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। বিমানের প্রপালসন, স্ট্রাকচার, কন্ট্রোল ও ইট্রুমেন্টেশন নকশার কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল আমার টিম মেটরা। একদিন আমার ডিজাইন শিক্ষক অধ্যাপক শ্রীনিবাসন, তখন এমআইটির পরিচালক, আমার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে হতাশাব্যাঞ্জক বলে ঘোষণা করলেন। বিলম্বের কারণ হিসাবে এক ডজন অজুহাত দিলাম আমি, কিন্তু তার কোনোটিই মনে ধরল না অধ্যাপক শ্রীনিবাসনের। আমি শেষ পর্যন্ত তার কাছে কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য এক মাসের সময় চাইলাম। অধ্যাপক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, দেখ, আজ শুক্রবার বিকেল। আমি তোমাকে তিন দিন সময় দিচ্ছি। সোমবার সকালে যদি ড্রয়িং না পাই তাহলে তোমার বৃত্তি বন্ধ হয়ে যাবে। আমি একেবারে বোবা হয়ে গেলাম। বৃত্তিটা ছিল আমার লাইফলাইন, সেটা যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে একেবারে অসহায় হয়ে পড়ব। যেভাবে বলা হয়েছে সেই মতো কাজটা শেষ করা ছাড়া আর কোনো পথ দেখতে পেলাম না। সেই রাতে আমি ড্রয়িং বোর্ড নিয়েই পড়ে থাকলাম, বাদ দিয়ে গেলাম নৈশভোজ। পরবর্তী সকালে মাত্র এক ঘন্টার বিরতি দিলাম পরিষ্কার হয়ে সামান্য কিছু মুখে দেবার জন্য। রোববার সকালে, কাজ শেষ করে আনার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি তখন, হঠাৎ করে কামরায় কারো উপস্থিতি অনুভব করলাম। একটু দূর থেকে আমাকে লক্ষ করছিলেন অধ্যাপক শ্রীনিবাসন। জিমখানা থেকে সরাসরি এসেছিলেন, তাই তার পরনে ছিল টেনিসের পোশাক। আমার অগ্রগতি দেখতে এসেছিলেন তিনি। আমার কাজ পরীক্ষা করার পর অধ্যাপক শ্রীনিবাসন সস্নেহে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আর পিঠ চাপড়ে দিলেন। তিনি বললেন, আমি জানি তোমাকে কঠিন চাপের মধ্যে রাখছিলাম আর অসম্ভব এক ডেডলাইনের মধ্যে কাজ সম্পূর্ণ করতে বলছিলাম। এত চমৎকার পারফর্ম করবে তুমি তা আমি কখনও প্রত্যাশা করিনি।