গুজরাটের আনন্দতে শিশু সমাবেশে বক্তব্য দেবার পর চটপটে একটা ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের শত্রু কে? আমি তার প্রশ্নটি অন্য ছাত্র ছাত্রীদের দিকে ঘুরিয়ে দিলাম এবং তাদের কাছে উত্তর জানতে চাইলাম। ওদের একজন উত্তর দিল, দারিদ্র্য।
আমার কল্পনার আলোকিত শিশুদের মত তারা কি সুন্দর প্রজ্ঞাময় জবাব দিয়ে দিল।
সেখানকার শেষ প্রশ্নটি চমকাবার মতই। অন্য আরেকটি শিশু দাঁড়িয়ে বললো, স্যার, পাকিস্তানি অস্ত্র কি ভারতের চেয়ে শক্তিশালী? আমি ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম কেন তার মাথায় এ ধরনের চিন্তা এল? সে জানাল সংবাদমাধ্যমগুলোই তাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। আমি বললাম, শক্তি সামর্থ্য প্রদর্শন করা আমাদের দেশের চরিত্রের এক অনুপম দিক। এটা হয়তো আমাদের জেনেটিক কারণেও হতে পারে। আমি তাকে বললাম, ভারত যেকোন ধরনের মিসাইল ও পারমাণবিক বোমার ডিজাইন করতে, তা উন্নত করতে ও প্রস্তুত করতে সক্ষম। সারাপৃথিবীতে এ ক্ষমতা মাত্র ৪টি দেশের আছে। আমি তাকে মন থেকে সমস্ত সন্দেহ ও উদ্বেগ ঝেড়ে ফেলার জন্য বললাম। সে আমাকে খুব সুন্দর একটা বই উপহার দিয়েছিল।
আমি ভারতবর্ষের বহু স্কুল পরিদর্শন করে এ পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর মুখোমুখি হয়েছি। তারা আমাকে যে শত শত প্রশ্ন করেছিল তার থেকে বেছে বেছে মাত্র ১১টি প্রশ্নের কথা আমি উল্লেখ করলাম। এ প্রশ্নের মধ্যে তাদের সারল্য ফুটে উঠলেও পরিস্কারভাবে বোঝা যায় তারা একটি উন্নত জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য কত শক্তিশালী কল্পনা হৃদয়ে লালন করছে।
তাদের সংগে আলাপচারিতায় আরেকটি বিষয় আমি বুঝতে পারছি বিজ্ঞান, শিল্প বাণিজ্য, ক্রীড়া, বিনোদন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে শিশুদের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণযোগ্য রোল মডেল এখন কী ভয়ানক জরুরী।
এখন একটি প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা কি আমাদের সন্তানদের সামনে একজন রোল মডেল বা আদর্শ ব্যক্তিত্ব হাজির করতে পারব? যদি পারি তাহলে কীভাবে তা পারব?
নতুন সহস্রাব্দের সূচনালগ্ন জিন প্রযুক্তির সুসংবাদ বয়ে এনেছে। মানুষ যে বিশেষ ধরনের ৩০ হাজার জিন তার দেহে বহন করছে তা হাজার হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া প্রস্তর যুগের পূর্বপুরুষদের চরিত্র বহন করে।
লক্ষণ প্রকাশ পায় আমাদের সমৃদ্ধজীবন লাভের চেষ্টার মাধ্যমে। আমাদের পূর্বপুরুষদের মত আমরাও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য, একটি স্বচ্ছল জীবন অর্জনের জন্য লড়াই করে চলেছি।
বলা হয় প্রকৃতিই এত প্রয়োজন ও অভাবের সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনের প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে, খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি করেছে, নিঃশ্বাস নেবার প্রয়োজনীয়তা তৈরী করেছে। ইতিহাসে দেখা যায় ক্ষুধার জন্যই মানুষকে সবচেয়ে বেশী সংগ্রাম করতে হয়েছে। আমরা হয়তো আমাদের পেছনের করুণ ইতিহাস ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস মনে রাখতেই হবে।
আমি তিন দশক ধরে ডক্টর বিক্রম সারাভাইর সাফল্য অর্জনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা দেখেছি। তার সংগে যারা কাজ করেছে তাদের সবারই স্বপ্ন ছিল বিক্রমকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার। আমরা তাকে রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করে কাজ করেছি। বিক্রম সারাভাইর কর্মস্পৃহা এত প্রখর ও শক্তিশালী ছিল যে মৃত্যুর বহু বছর পরেও তার ছাত্রছাত্রী তার স্বপ্নকে সফল করেছিল। তোমার জীবনের রোল আমাদের একজন রোলমডেল দাও মডেল হবে এমন কেউ যাকে তুমি সবচেয়ে বেশী ভালবাস ও যার কাজ তোমার সবচে বেশী ভাল লাগে– সে হতে পারে ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক অথবা, যে কোনও সফল মানুষ।
সম্প্রতি একজন মূর্তিমান রোল মডেল ও জীবিত লিজেন্ড চরিত্রের সংগে আমার দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি ভারতের কীংবদন্তি শিল্পী লতা মুঙ্গেশকর।
লতার বাবা স্বর্গীয় ওস্তাদ দীননাথ মুঙ্গেশকরের স্মরণ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি। ভারতরত্ন উপাধিতে ভূষিত লতাজি আমাকে তার বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত ৪৫০ শয্যার দীননাথ হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানানোয় আমি গর্ববোধ করেছিলাম। উদ্বোধনের কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালটি ঘুরে দেখেছি। দেখলাম হাসপাতালের প্রায় ৩০ শতাংশ রোগী সেখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে। এ ঘটনা আমাকে মুগ্ধ করলো এজন্য যে অঢেল ঐশ্বর্য ও খ্যাতি পাওয়া সত্ত্বেও লতা মুঙ্গেশকর একজনের সহায়তায় দশজনের দুঃখ লাঘব হতে পারে। যুগ যুগ ধরে রেডিওতে তার গান শুনে অগনিত মানুষ আনন্দ উপভোগ করছে। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন সংঘাতের সময় তার অ্যায় মেরে বাতান কি লোগো গানটি পুরো জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। এমন আনন্দপূর্ণ উপায়ে লাখ লাখ মানুষকে খুব কম লোকই প্রভাবিত করতে পারে।
আদর্শ ব্যক্তিত্বরা বা (আমার ভাষায়) রোল মডেলরা আমাদেরকে ব্যক্তি হিসেবে দল হিসেবে এবং অবশ্যই জাতি হিসেবে কী করণীয় তার দিক নির্দেশনা দেন। সুবিশাল সাফল্যের ক্ষেত্রেও তারাই নেতৃত্ব দেন। তথ্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমরা মোটামুটি সফলতার পথে আসতে পেরেছি বলে মনে হয়। কিন্তু এর সংগে অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনা করা ঠিক হবে না বা বলা যাবে না আমরা অমুক অমুক ক্ষেত্রে পিছিয়ে।
প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল আদ্যোপান্ত একটি জ্ঞান সম্ভারপূর্ণ সমাজ। গণিতবিদ্যা, চিকিৎসা শাস্ত্র, মহাকাশতত্ত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমাদের অতুলনীয় নেতৃত্বের ইতিহাস রয়েছে। এই উচ্চ প্রযুক্তির যুগে সাধারণ শ্রমিকের কাজে আটকে না থেকে ভারতে এখনই এমন এক শিক্ষা বিপ্লব ঘটানো দরকার যাতে আবার আমরা জ্ঞানে ও মেধায় বিশেষ একটি সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারি।
৩. দূরদর্শী শিক্ষাগুরু–দূরদর্শী বিজ্ঞানী
৩. দূরদর্শী শিক্ষাগুরু–দূরদর্শী বিজ্ঞানী