আমি বললাম, ইণ্ডিয়া ভিশন ২০২০ তোমাদের মত তরুণ কিশোরদের কাছে প্রত্যাশা করে তারা ২০২০ সালের মধ্যে রাজ্যগুলোর মধ্যে কৃত্রি করে এক নদীর সংগে আরেকটিকে সংযুক্ত করবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি তরুণদের মধ্যে সর্বোচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মেধা রয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য আত্মকেন্দ্রীক নীতি ও নেতিবাচক পুঁজিবাদী চিন্তা পরিহারের শক্তি তরুণদের কাছে সবচে বেশী। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের সংগে রাজ্য সরকারগুলোর সমন্বয় প্রক্রিয়া তারাই উন্নত করতে পারে। আর অবশ্যই তারা তা করবেও।
আরেকজন ছাত্র আমাকে এমন একটি প্রশ্ন করেছিল যার জবাব দেবার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। সে বলেছিল, স্যার, বড় বড় নেতারা আমাদের কাছে আসেন না, আমাদের সংগে কথাও বলেন না। প্রধানমন্ত্রীজি প্রায়ই চেন্নাই, লক্ষ্ণৌ, আরও কত কত জায়গায় যান কিন্তু এখানে তো আসেন না। আমরা এখানে তাকে চাই, তার সংগে কথা বলতে চাই। আমি দেশনেতাদের সংগে তার যোগাযোগের স্পৃহা দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, দিল্লি পৌঁছে আমি নেতাদেরকে তোমার স্বপ্নের কথা বলবো। তোমার স্বপ্ন অবশ্যই সত্যি হবে।
দিল্লি ফিরে আমি সত্যি সত্যি প্রধানমন্ত্রীকে এ ঘটনা খুলে বললাম। তিনি বিনীতভাবে বিষয়টি স্বীকার করে বললেন, আসলেই বাচ্চারা আমার সংগে কখনও কথা বলার সুযোগ পায় না। হয়তো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই তাদের সংগে আমার দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সৃষ্টির স্বার্থে শিশুদের সংগে বেশী বেশী যোগাযোগ রাখার জন্য আমি প্রায়ই বিভিন্ন ক্ষেত্রের নেতৃবৃন্দকে পরামর্শ দিয়ে থাকি।
ঝাড়খণ্ড সংস্কার উদ্যোগী হওয়ার পর আমি বহুবার সেখানে সফর করেছি। যতবার আমি সেখানে গেছি ততবারই সেখানকার উন্নয়ন ধারা দেখে হতবাক হয়েছি। বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের উদ্যোগ দেখে ভেবেছি এবার সেখানে কত সম্পদের সদ্ব্যবহার হবে। বোকারোতে অবস্থিত রামকৃষ্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে একবার ৩ হাজার ছাত্রছাত্রীর মাঝে বক্তব্য দিয়েছিলাম। সেখানে ছাত্রছাত্রীদের হাতে আঁকা পেইন্টিং, পুতুল, খেলনা সামগ্রীর প্রদর্শনী দেখে তাদের সৃজনশীলতায় অবাক হয়েছি। তাদের সংগে কথোপকথনের এক পর্যায়ে এক ছাত্র আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমাদের এই ঝাড়খণ্ডের সবখানেই সবুজের সমারোহ। এখানে অরণ্য, নদী, পাহাড় সবই আছে। কিন্তু রাজস্থানে কেন মরুভূমি? তার এ প্রশ্ন আসামের সেই ছাত্রের প্রশ্নটির কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল। কেন ব্রহ্মপুত্রের পানি তামিলনাড় ও রাজস্থানে নেওয়া হচ্ছে না?
আমি বললাম, তোমরা জান, মাত্র ২০ বছর আগেও রাজস্থানে এখন যে চাষাবাদ হয় তাও হতো না। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী খাল খননের পর সেখানকার অনেক জায়গায় চাষাবাদ সম্ভব হয়েছে। মানুষের পক্ষেই একটি মরুভূমিকে উর্বর ভূমিতে পরিণত করা সম্ভব। আসামের ছাত্রদের যে কথা বলেছিলাম, এখানেও তার পুনরাবৃত্তি করলাম, ভারতের নদী সংযোগ বিষয়ক পরিকল্পনা আছে যাতে জলশূন্য এলাকায় পর্যাপ্ত পানি পৌঁছে দেওয়া যায়। তোমরা বড় হয়ে সরকারের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত করবে।
একটি ছোট্ট সোনামণি গুটি গুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে খুব সিরিয়াস এক্সপ্রেশন নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনার বানানো অগি মিসাইল কি সাগর পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আঘাত করতে পারবে?
তার এ কথায় আমি হোঁচট খেলাম। আমি বললাম, আমাদের এমন কোন শত্রু দেশ নেই যেখানে অগ্নি মিসাইল দিয়ে আঘাত করতে হবে। তাছাড়া আমেরিকা আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। অগ্নি আমাদের শক্তির প্রতীক। অগ্নি শুধু এটুকু প্রমাণের জন্য যে ভারতের সব ধরনের ক্ষমতা রয়েছে।
কটক সফরের সময় আমি স্বর্গীয় বিচারপতি হরিহর মহাপাত্রর জন্মদিন উদযাপন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। বিচারপতি রঙ্গনাথ মিশ্রর নিমন্ত্রণে মূলত সেখানে যাই। সেখানে গিয়ে আমি মানবজীবনকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। বিচারপতি হরিহর মহাপাত্র সেখানে মৃত্যুকে জয় করে যেন সবার মাঝে বেঁচে আছেন। ৯২ বছরের জীবনে কটকে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন-কটক চক্ষু হাসপাতাল, উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দারিদ্র্যবিমোচন বিষয়ক কয়েকটি
আমাদের একজন রোলমডেল দাও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। ইতিমধ্যে উড়িয়া ভাষায় আমার আত্মজীবনী প্রকাশ পেয়েছিল। আমার বক্তব্য শেষ হতেই কিশোর তরুণরা আমাকে ঘিরে ধরলো।
তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, স্যার কোন কোন বই আপনার প্রিয় যা আপনার মনন গঠনে সহায়তা করেছে?
আমি বললাম, আমার পড়া চারটি বই আমার আত্মার খুব কাছাকাছি। প্রথমটি হলো, নোবেল জয়ী লেখক ডক্টর অ্যালেন্সিস ক্যারেলের লেখা ম্যান দ্য আনোন। যেহেতু মন ও শরীর অবিচ্ছেদ্য বিষয় সেহেতু রোগীর চিকিৎসার জন্য মন ও শরীরের চিকিৎসা যুগপৎভাবে হওয়া উচিত। এ বইয়ে রোগীকে সারিয়ে তুলতে কীভাবে মন ও শরীরের চিকিৎসা করা দরকার তা নির্দেশ করা হয়েছে। একটিকে অবহেলা করে অপরটি সারিয়ে তোলা যায় না। যারা বড় হয়ে চিকিৎসক হবার স্বপ্ন দেখছে তাদের এটা পড়া উচিত। এটিপড়লে জানা যাবে মানবদেহ কোন যান্ত্রিক কাঠামো নয় বরং অত্যন্ত মেধাদীপ্ত উপায়ে নির্মিত ও স্পর্শকাতর ফিডব্যাক সিস্টেমে পরিচালিত একটি অর্গানিজম। দ্বিতীয় প্রিয় বইটি হল, তিরুভালুভারর লেখা থিরুকুরাল। এতে জীবনের অপূর্ব কিছু দিক নির্দেশনা রয়েছে। তৃতীয় বইটি হচ্ছে লিলিয়ান ইখলার ওয়াটসনের লেখা বই লাইট ফ্রম মেনি ল্যাম্পস্। আমাদের কীভাবে বাঁচতে হবে তার নির্দেশনা রয়েছে এ বইটিতে। গত পঞ্চাশ বছর ধরে বইটি আমার অমূল্য পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। সর্বোপরি পবিত্র কোরান শরীফ আমার সার্বক্ষণিক সংগী।