পিতামাতার অন্যপ্রান্তে বিদ্যালয় আর বিদ্যালয়ের অন্যপ্রান্তে বাড়ী–এই হলো শিশুর ঠিকানা। শিক্ষা এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ
আমাদের একজন রোলমডেল দাও থেকে না দেখে জাতীয় উন্নয়ন হিসেবে আমাদের দেখতে হবে। সঠিক শিক্ষা পেলে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আত্মসম্মান ও নৈতিক মূল্যবোধের জন্ম হবে। কোন আইন প্রয়োগ করে এই গুণাবলী সৃষ্টি করা যাবে না। আমাদেরই পরিচর্যা করে তা সৃষ্টি করতে হবে।
আমার মূল বক্তব্য অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কিনা জানি না, তবে আমার এ জবাবে বাচ্চারা খুব সন্তুষ্ট হয়েছিল বলে মনে হল।
আরেকটি মেয়ে খুব সিরিয়াসভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, প্রতিদিনই আমরা খবরের কাগজে পড়ি অথবা মা-বাবাকে আতঙ্ককারীদের বিষয়ে আলোচনা করতে শুনি। এরা কারা? তারা কি আমাদের দেশেরই লোক?
তার এ প্রশ্নটি সত্যিই আমাকে বিদ্ধ করলো। আমি নিজেই এর উত্তর খুঁজছিলাম।
তারা আমাদেরই লোক। কখনও কখনও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শূন্যতার মাধ্যমে আমরাই তাদের সৃষ্টি করেছি। কোন প্রতিক্রিয়াশীল জাতি স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার জন্য, সন্ত্রাসবাদীতার জন্য এদের ব্যবহার করছে। আমি এই ক্ষুদ্র বালিকার নিষ্ঠুর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উপস্থিত দর্শকদের দিকে, আমার পাশে বসা লোকদের দিকে, শিক্ষকদের দিকে এমন কি আকাশের দিকেও দৃষ্টির হাত বাড়ালাম। আমি বললাম, বাচ্চারা, এ মুহূর্তে আমার রামায়ন ও মহাভারত এ দুটি মহাকাব্যের কথা মনে পড়ছে। রামায়নে আমরা সত্যের পক্ষে ভগবান রামকে এবং মিথ্যা ও রিপুর পক্ষে রাজা রাবণকে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়তে দেখেছি। এটা ছিল সুদীর্ঘ এক জীবন-মরণ যুদ্ধ। কিন্তু শেষমেশ রামেরই জয় হয়েছে। মহাভারতে আমরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কথা পাই। সেখানেও ধর্ম ও অধর্মের লড়াই। সেখানেও ধর্মের জয় হয়েছিল। যুদ্ধ হয়েছে অনেক, অগনিত, অসংখ্য কিন্তু শান্তির জয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের সময়ে সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ভাল ও মন্দ দুটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে। আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে ভাল ও মন্দ স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উভয়ই জয়ী হয়েছে।
সর্বশক্তিমান ঈশ্বর উভয়কেই জ্ঞান ও সুচিন্তা দিয়ে সাহায্য করেছেন।
তামিল নাড়ুর ডিভিগুলে অবস্থিত সেন্ট মেরিস স্কুলের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত আরেকটি জনাকীর্ণ অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য রাখতে হয়েছিল। আমার সংগে দেখা করতে আসা অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে দুশিক্ষার্থী একটি প্রশ্নের জবাবের জন্য ভারী ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দুজনের একজন বলে উঠলো, আমি আপনার অগ্নি সিরাগুগাল (উইংস অব ফায়ারের তামিল সংস্করণ) বইটি পড়েছি। সেখানে আপনি কেবলই স্বপ্ন দেখার জন্য বাণী দিয়েছেন। এত কিছু থাকতে বার বার স্বপ্ন কেন?
জবাবে আমি উপস্থিত সমবেত শিক্ষার্থীদের এই বাণীটি আবৃত্তি করতে বললাম,
Dream, Dream, Dream.
Dream transform in to thoughts
Thoughts result in action.
আমি বললাম, বন্ধুরা, যেখানে কোন স্বপ্ন নেই, সেখানে বৈপ্লবিক কোন চেতনাও নেই। আর যেখানে চেতনা নেই, সেখানে কোন ভাল কাজও সংঘটিত হতে পারে না।
এ কারণেই পিতামাতা ও শিক্ষকের প্রধান কর্তব্য হলো তাদের শিশু কিশোরদের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করা। স্বপ্নের পথ পাড়ি দিয়েই সাফল্য আসে যদিও সেই পথে রয়েছে নানা বাধা বিপত্তি আর সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা।
ওই দিনই আরেকটি ছেলে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার, পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী কে? তার প্রশ্ন শুনে আমি সেদিন উপলব্ধি করেছিলাম অগনিত প্রশ্নের মধ্য দিয়েই বিজ্ঞানের জন্ম ও তার ক্রমবিকাশ। সমগ্র বিজ্ঞানের ভিত্তিই হল প্রশ্ন। পিতামাতা ও শিক্ষকরাই ভালো জানেন যে শিশুরাই সীমাহীন প্রশ্নের উৎসমুখ। আর এ কারণে আমি সেই ছেলের প্রশ্নের জবাবে বললাম, শিশুরাই পৃথিবীর প্রথম বিজ্ঞানী। আমার জবাব শুনে তুমুল করতালি বর্ষণ শুরু হল। ছেলেমেয়েরা আমার এ ভিন্নধর্মী চিন্তার বিষয়টিতে ভারি আনন্দ পেয়েছিল। আমার জবাব শুনে অভিভাবক ও শিক্ষক-শিক্ষিকাও হেসে ফেললেন।
আসাম সফরের সময় আমি তেজপুর পরিদর্শন করেছিলাম। তেজপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। সমাবর্তন শেষে আমি স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সংগে দেখা করতে গেলাম। আমার সামনে অসংখ্য শিশু কিশোরের জটলা। তাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া আমার সেদিনের বক্তব্যের প্রতিপাদ্য ছিল দুর্দর্ষণীয় শক্তি। বক্তব্য শেষ করতেই কচিকাঁচারা আমাকে অটোগ্রাফের জন্য ঘিরে ধরলো। অটোগ্রাফ দেওয়া শেষ হলে আমি আমাদের একজন রোলমডেল দাও দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম। এর একটি হলো : সারা বছরের থৈ থৈ ব্রহ্মপুত্রের স্রোত কেন বিশুষ্ক জলহীন রাজস্থান ও তামিল নাড়ু তে গতি পরিবর্তনের মাধ্যমে পাঠানো হয় না?
একমাত্র শিশুরাই এ ধরনের অভিনব ধারণার জন্ম দিতে পারে। বড় হওয়ার পর মানুষ তাদের আইডিয়া বাস্তবায়নের পথে নানা অসম্ভাব্যতা আবিষ্কার করে। এটি এত শক্তিশালী ও তীব্র প্রশ্ন ছিল যে আমি পুরোপুরি ধাক্কা খেলাম। আমি নিশ্চিত যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও এমন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন না। আমি ওই বাচ্চাটিকে কীভাবে বোঝাবো যে নদী হলো রাজ্য সরকারের সম্পত্তি এবং আমাদের সরকার ওই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।