কিন্তু আমার আজকের এই অবস্থানের নেপথ্যে কী ছিল? কঠোর পরিশ্রম? উচ্চাকাক্ষা? কত উত্তরই তো আমার মনে আসে। তবে আমার মনে হয় এর নেপথ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল আমার কর্মসাধনার মূল্য পরিমাপের মানসিকতা। মূল কথা হলো, ঈশ্বর তোমাকে যে এত ঐশ্বর্য দান করেছেন, তোমাকে অবশ্যই তার মূল্য বুঝতে হবে। যদি আমাদের তরুণ ছাত্র ছাত্রীরা বিশ্বাস না করে যে তারা আগামী দিনের উন্নত দেশ ভারতের গর্বিত নাগরিক তাহলে কি করে তারা আলোকিত নাগরিক হয়ে উঠবে?
উন্নত বিশ্বের অমিত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ অর্জনের পেছনে কিছুমাত্র রহস্য নেই। এর নেপথ্যের ঐতিহাসিক সত্য হলো জি-৮ বলে পরিচিত উন্নত দেশগুলোর মানুষ যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি নিয়ে কল্পনা করেছে যে তারা একদিন উন্নত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এ কারণেই আমাদের একজন রোলমডেল দাও আজ তারা তাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। সম্পদ ও প্রজ্ঞা লাভের আকাঙ্খ করা, জাগতিক ধনসম্পত্তি অর্জনের চেষ্টা করা ভুল– একথা আমি বিশ্বাস করি না। যদিও আমি খুব স্বল্প পরিমাণ সম্পদ নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছি। তথাপি আমি সম্পদ অর্জনের প্রশংসা করি, কারণ এতে জাতির নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্জিত সম্পদ আমাদের স্বাধীনতা রক্ষায় সহায়তা করে। সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণেই সে লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়। তুমি চারপাশে লক্ষ্য করলে দেখবে প্রকৃতিও নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে কিছু দেয় না। বাগানে গেলে দেখবে, বসন্ত মৌসুমে সারা বাগান ফুলে ফুলে ভরে যায়। আসমানের দিকে তাকাও- দেখ, এ মহাবিশ্ব তোমার কল্পনার চেয়েও বড় অসীম বিশাল।
পৃথিবীতে যা কিছু আমরা দেখি– এর সবই শক্তির প্রতীক। শ্রী অরবিন্দর ভাষায়, এ মহাবিশ্বের অসংখ্য শক্তির মত আমরাও একটি শক্তি। বহু দার্শনিক বলেছেন, আত্মা ও দেহের সম্মিলনেই অস্তিত্বের সৃষ্টি। শক্তি ও বস্তু একে অপরের পরিপূরক। আমরা যদি যুক্তি বিশ্বাস করি তাহলে বুঝতে পারবো প্রজ্ঞা ও ধী শক্তির পাশাপাশি বস্তুগত সম্পদ লাভের আকাঙ্ক্ষা করা ভুল বা অপরাধ নয়, বরং জরুরী।
এজন্য এই দর্শনেই আমাদের বিশ্বাসী হতে হবে। আবার এটাও খেয়াল রাখতে হবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু সম্পদ নিয়ে জীবনযাপনের ধারণাও ভুল নয়। মহাত্মা গান্ধীও এ ধরনের জীবন যাপন করতেন। সেটা তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তুমিও চাইলে তাকে অনুসরণ করতে পার। তার মত জীবন যাপন করলে তুমিও সত্যিকার অভাব জিনিসটাকে উপলব্ধি করতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে ত্যাগের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে দারিদ্রকে বরণ করা আর সত্যিকার দারিদ্র্যে পতিত হওয়ার মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। এই বিষয়টিকে বোঝানোর জন্যই আমি বারবার স্কুল কলেজের তরুণ শিক্ষার্থী বন্ধুদের কাছে ছুটে যাই। তাদের স্বপ্নগুলো
জানার জন্য ছুটে যাই। তাদের বলতে যাই সুখ সমৃদ্ধি আর দারিদ্র্যমুক্ত স্বর্ণযুগের প্রত্যাশায় তাদের স্বপ্ন দেখতে হবে। কাজ করতে হবে। তাদের বলতে চাই, তোমাদের অন্তরে ভালোবাসা ও আনন্দের যে স্রোতধারা রয়েছে তা ছড়িয়ে দাও।
প্রথমবারের মত আমি ত্রিপুরার একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে প্রায় শপাঁচেক শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রী জড়ো হয়েছিল। ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন ও উদ্যোগ বিষয়ক আমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর আমার কাছে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে একের পর এক বেশ কয়েকটি প্রশ্ন আসতে লাগলো।
এ বিষয়ে একটু বলতে চাই। আমার প্রতি তাদের প্রথম প্রশ্ন ছিল, আমরা কোত্থেকে অনুসরণযোগ্য একটি রোল মডেল বা আদর্শ পাব, আপনি কীভাবে সেই মডেল পাবেন?
আমরা এ বিষয়ে সচেতন থাকি বা নাই থাকি, ছোটবেলা থেকেই জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রমণের সময় আমরা কিন্তু কাউকে না কাউকে মনের মধ্যে আদর্শ ব্যক্তির মডেল হিসেবে দাঁড় করাই।
আমি তাদের প্রশ্নের জবাবে বললাম, যতক্ষণ তোমরা বড় হচ্ছে, এই ধরো ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত, তোমাদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রোল মডেল হবেন তোমাদের বাবা, মা এবং তোমাদের শিক্ষকরা। আমি মনে করি পিতামাতা ও শিক্ষক একটি শিশুর সর্বোত্তম পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন।
আমি শিশুদের ওপর থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে উপস্থিত অভিভাবক ও শিক্ষক শিক্ষিকার দিকে চাইলাম। শিশুদের প্রতি তাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু কথা বললাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি এই মানুষগুলোর মাধ্যমেই শিশু প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব। শৈশবে আমার নিজের পরিবারে বড় হয়ে উঠতে উঠতে আব্বা আম্মাকে দেখেছি তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আমাদেরও নামাজের জন্য উপদেশ দিতেন।
নিজেরা দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও আশে পাশের গরীব মানুষকে সাহায্য করতেন। আমার শিক্ষাগুরু শিবসুহ্মমানিয়া আয়ার আব্বাকে পরামর্শ দিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যাবস্থা করেন। প্রত্যেক বাবা-মার উচিত তাদের সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা যাতে তারা ভবিষ্যতে কঠোর পরিশ্রমী এক একজন আলোকিত মানুষ হয়ে উঠতে পারে।
একজন শিক্ষক একটি শিশুর প্রজ্ঞা ও জ্ঞানলাভের দরোজা। শিশুর ভেতরে সৃষ্টিশীলতা জাগ্রত করতে শিক্ষককে অনুসরণীয় মডেল হিসেবে আবির্ভূত হতে হবে। আমার বিশ্বাস বাবা, মা ও শিক্ষক এই তিনজনই একটি শিশুর ত্রি-মাত্রিক রোল মডেল। আর একটু বৃহৎ পরিসরে বলতে চাইলে বলা যায়, এরা যদি সম্মিলিতভাবে শিশুদের মনে সাধনার বীজ বুনে দিতে পারেন তাহলে এই ভারতবর্ষ নিঃসন্দেহে এক নবজন্ম লাভ করবে। যেমন বলা হয়ে থাকে?