ইগো বললো, তুই কোনদিন আলো কী জিনিস তা দেখিসনি। তাহলে কেমন করে জানলি আলো দেখবো? এই পার্শ্বচাপ আর অন্ধকার আমাদের জীবনের অংশ। এটা মেনে নে। স্পিরিট ইগোকে বিরক্ত করতে চাইল না। আবার কথা না বলেও পারলো না। সে বললো, ইগো, আমার ধারণা এই পার্শ্ব-চাপ শেষ হবার পর আমরা শুধু আলোই নয় আমাদের মাকেও দেখতে পাব।
ইগো বললো, তোর মাথা সত্যিই গ্যাছে।
এ গল্পের উদ্ধৃতি দিয়ে আমি আমার দেশবাসীকে বলতে চাই তারা যেন স্বাধীনতার পর থেকে পঞ্চাশ বছরের এই প্রাপ্তি নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে বিভোর হয়ে না যায়। এ বই যখন লেখা প্রায় শেষ করে এনেছি তখন কেউ কেউ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। চেন্নাইয়ের প্রেসিডেন্সী কলেজের ১৫শ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রত্যেক জাতির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকতে হবে এ বিষয়ে বক্তব্য দেবার পর জাতীয় উন্নয়ন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান, শিক্ষা লাভের উপায় বিভিন্ন বিষয়ে আমাকে অসংখ্য প্রশ্ন করা হল। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হবার পর অসংখ্য ছাত্রছাত্রী ঠেলাঠেলি করে আমার সংগে করমর্দন করছিল। যখন আমি তাদের মধুর উপদ্রব থেকে মুক্তি নিয়ে বের হতে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম একটা ছেলে সবল হাতে ভীড় সরিয়ে দ্রুত আমার কাছে চলে এল এবং আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। চিরকুটটি আমি পকেটে রেখে দিলাম।
গাড়িতে বসে যেতে যেতে প্রেসিডেন্সী কলেজে জুলজিতে এমফিল পর্যায়ে অধ্যয়নরত টি, সরাভানানের চিঠিটা পড়লাম। তার চিঠি পড়ে আমি এত মানসিক শক্তি পেয়েছি যে চিঠিটা উল্লেখ না করে পারছি না। সরাভানান লিখেছে, প্রিয় স্যার, মহামহীরুহ বটবৃক্ষের শক্তি আর তার বীজের সুপ্ত দ্রুণবৃক্ষের শক্তি একই। এদিক থেকে আপনি এবং আমি এ দুজনের ক্ষমতাই সমান সমান। আমরা দুজনে আলাদা আলাদাভাবে আমাদের মেধার বিকাশ ঘটাচ্ছি।
সামান্য কিছু বীজ অঙ্কুরিত হয়ে বড় হয়ে ওঠে আর বেশীর ভাগ মারা যায়। প্রতিকূল পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে বড় হতে না পেরে মারা যায়। কিন্তু তাদের শক্তি শেষ হয় না। তারা মরে গিয়ে সার হয় এবং ভবিষ্যত বৃক্ষটির শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এভাবেই সে তার বিশালত্বের আকাক্ষার মাঝে বেঁচে থাকে। আপনি দেশের জন্য সারাজীবন কাজ করেছেন এবং বহু বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমিকদের সহায়তা করেছেন। আপনি কি মনে করেন তাদের এই কর্মদক্ষতা ও পরিশ্রম বিফলে যাবে না? এক্ষেত্রে আপনি তাদের কাছ থেকে কত শতাংশ সাফল্য আশা করেন?
ওই দিনই সরাভানানকে একটি জবাব লিখলাম,
প্রিয় সরাভানান,
আমি বেশ কয়েকবার তোমার চিঠি ও প্রশ্নটি পড়েছি। আমি দীর্ঘ কুড়ি বছর আইএসআরওতে কাজ করেছি। রকেট তৈরী, লঞ্চ ভেইকল এবং মিসাইল তৈরীর ব্যাপারে আরও কুড়ি বছর ডিআরডিওতে কাজ করেছি। আমি জীবনে বহু সাফল্য দেখেছি। কিছু ব্যর্থতার সম্মুখীনও আমাকে হতে হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে সাফল্য অর্জনের জন্য আমি অনেক বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং টেকনিশিয়ানের সংগে কাজ করেছি। একতাবদ্ধ ওই দল ওই সাফল্য দেখেছে এবং ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছে। আমারই এমন বহু শিক্ষানবীশ আজ জ্ঞানে ও মেধায় আমাকে ছাড়িয়ে গ্যাছে। এ আমার জন্য বড় আনন্দের।
সরাভানানের চিঠি আমাদের এক কঠিন দায়িত্বে ফেলে দিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠদের বুঝতে হবে তাদের চেয়ে পরবর্তী প্রজন্ম অনেক বেশী মেধাবী ও এগিয়ে। তাদের এগিয়ে যাবার কোন বাধা সৃষ্টি করা নেতৃস্থানীয়দের জন্য শোভনীয় নয়। পরন্তু বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা যেন ব্যর্থ না হয় সে চেষ্টা করতে হবে। বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদদের এই নতুন প্রজন্ম আকস্মিক ব্যর্থতায় যেন হতাশ না হয়, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও বড়দের।
আইডিতে আমাকে যেসব প্রশ্ন করা হয়েছিল তার শেষ প্রশ্নটি উল্লেখ করে আমি এ বইয়ের সমাপ্তি টানতে চাই। প্রশ্নটি ছিল, আপনার লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনি কী কী প্রার্থনা করেন?
উত্তরে আমার শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাক্ষিদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি দোআ করতে লাগলাম, হে সর্বশক্তিমান, আমার দেশের মানুষের মনে সৃজনশীলতা ও কর্মস্পৃহা দাও যাতে তারা একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারে।
বিভাজন ও ভেদাভেদের বিরুদ্ধে জনগণকে যুদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমার দেশের ধর্মীয় নেতাদের সাহায্য কর।
আমাদের জননেতাদের মনে এই মন্ত্র গেঁথে দাও ব্যক্তির চেয়ে দেশ অনেক অনেক বড়।
হে আল্লাহ! আমার দেশের মানুষের কাজের ওপর রহমত বর্ষণ কর আর এ দেশকে উন্নত দেশে পরিণত কর।
আমার এ বার্তা চেন্নাই, পোরবন্দর, রাজকোট, জামশেদপুর, ভুবনেশ্বর, ডিঙ্গিগাল, অবু রোড, আনন্দ, উদিরপুর ও আরও বহু জায়গার প্রায় ৪০ হাজার স্কুল শিশুকে পৌঁছে দিয়েছি। আমি আগামী ২০০৪ সালের আগস্টের মধ্যে এ সংখ্যা ১ লাখে নিয়ে যেতে চাই।
যেদিন এদেশের হাজার হাজার তরুণের এ প্রার্থনাবাণী ভারতের আকাশে বাতার্সে ধ্বনিত হবে, সেদিনই আমরা ভারতবর্ষকে উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে পারবো।
.
যৌবনের গান
আমি আর আমার ভারতবর্ষ
ভারতের এক তরুণ নাগরিক হিসেবে
প্রযুক্তি, জ্ঞান আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ
আমি উপলব্ধি করি, ক্ষুদ্র লক্ষ্য একটা অপরাধ।