আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনগুলো, রাজনৈতিক প্লটফর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চেম্বার অব কমার্স একের পর এক সভা সেমিনার, আলোচনা, বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে আলোচনার নামে আসলে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি আর গলাবাজিই হচ্ছে বেশী। অবিরাম সেখানে তত্ত্ব, মহাতত্ত্ব, থিওরি নিয়ে আলোচনা করেও অগ্রগতি হচ্ছে খুবই সামান্য।
আমার বক্তব্য হল বোর্ড রুম আর প্রযুক্তি সম্মেলনে উন্নত ভারত গঠনের আলোচনা, বিতর্ক ও থিওরি কপচালে চলবে না। এ আলোচনা হতে হবে সমস্ত প্রতিষ্ঠানে, সংগঠনে, পরিবারে এমন কি ব্যক্তি পর্যায়েও। সমাজের প্রত্যেকটি পর্যায়কে দেশের ভালমন্দের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। দেশের জন্য কোনটা ভাল কোনটা খারাপ সমাজের প্রত্যেককেই তা বুঝতে হবে।
আমি সমগ্র বইয়ে একটা বিষয়ই তুলে ধরতে চেয়েছি। সেটা হল আমাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে আর নিজেদেরকে উন্নত ভারতের নাগরিক হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে। আমরা একটা বিশাল উন্নত সভ্যতার মধ্যে জন্ম নিয়েছি আর এই সভ্যতার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আমাদের পূর্ণবিশ্বাসী হওয়া দরকার। আমাদের দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে উন্নত বিশ্ব ও আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আমাদের অন্তর্জগতে যে বিশ্ব রয়েছে সেটাই আমাদের কাছে বড় সত্য।
স্বাধীনতা কেউ এসে আমাদের উপহার দিয়ে যায়নি। সমগ্র জাতি যুগের পর যুগ সংগ্রাম করে এ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সুতরাং এ স্বাধীনতা রক্ষার দায় দায়িত্ব আমাদের সকলের। এদেশের প্রতিরক্ষা ও উন্নয়নের চেয়ে বড় কোন মতাদর্শ নেই।
জনগণের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার চেয়ে বড় কোন ইসু আমাদের সামাজিক জীবনে থাকতে পারে না।
উন্নত ভারত গড়ে ছাত্র শিক্ষার্থীদের এখনই তৈরী হতে হবে। তাদের প্রতি আমার জোরালো আহবান, তোমাদের হৃদয়কে উচ্চাকাঙ্ক্ষার আগুনে প্রজ্জ্বলিত করো। বড় বড় স্বপ্ন দেখো, বৃহৎ চিন্তায় নিজেকে সমর্পণ কর।
এক শিক্ষককে একদিন বলতে শুনেছিলাম, আমাকে পাঁচ বছরের একটি শিশু দাও। সাত বছর শিক্ষা দেবার পরে কোন ঈশ্বর অথবা শয়তানের ক্ষমতা নেই–তাকে আদর্শচ্যুত করে। আমাদের সমস্ত শিক্ষকরা সেই গুরুর মত হতে পারবে?
আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকদের সামনে দেশের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। জনগণের সার্বিক মঙ্গল সাধিত হয় এমন সিদ্ধান্তই তাদের নিতে হবে।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেলেও বিজ্ঞানের আশীর্বাদ আমরা এখনও সফলভাবে গ্রামে ছড়িয়ে দিতে পারিনি। গ্রামাঞ্চলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সেবা দ্রুত পৌঁছে দেবার এখনই সময়।
বিশ্বের তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চগুলো ইতিমধ্যে ভারতের আইটি সেক্টরকে সম্মানজনক স্বীকৃতি দিয়েছে। আজকে ভারত আইটি ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ। টেলিমেডিসিন, ই-গভর্নেন্স এবং টেলিএডুকেশন সারা দেশে চালু করার ক্ষেত্রে এই আইটি ক্ষেত্রকে ব্যবহার করতে হবে।
কৃষি ক্ষেত্রে আমাদের একযোগে কাজ করে কৃষকদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ভারতের কৃষিজাত পণ্যের মান ও উৎপাদন বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিদ্বন্দ্বীতা সক্ষম করে তুলতে হবে। একই সংগে পণ্য বাজারজাত করণের ক্ষেত্রেও সচেতন হতে হবে যাতে কৃষকরা তাদের বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায়।
সর্ব শেষে পরমকরুণাময়ের কাছে আমার প্রার্থনা তিনি যেন আমার দেশের মানুষকে কর্মঠ করে তোলেন। তিনি যেন তাদের আরও অসংখ্য অগ্নি তৈরীর সক্ষমতা দেন যাতে তারা শয়তানের বিষদৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারে।
তার কাছে আমার অন্তিম প্রার্থনা, হে আল্লাহ! আমার জনগণকে তুমি সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরের সংগে বেঁধে দাও। ভারতের একটা ধুলিকণা হয়ে আমাকে গর্ব করার সুযোগ দাও, যে ধুলিকণা আবার জেগে উঠবে। পূর্ণ স্বাধীনতায় আবার যে উড়ে বেড়াতে পারবে।
.
শেষকথা
আমার ব্যক্তিগত চিন্তা ও দর্শনের সার সংক্ষেপ এ বইয়ে তুলে ধরেছি। আমার মনে পড়ছে ইন্টারনেট থেকে একবার একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটি রূপক। মাতৃগর্ভে থাকা দুটি চরিত্র অহঙ্কার ও তেজস্বী আত্মার কথোপকথনে লেখা হয়েছে এ গল্পের কাহিনী।
তেজস্বী আত্মার নাম স্পিরিট আর অহঙ্কারের নাম ইগো। স্পিরিট ইগোকে বললো, আমি জানি একথা তোর বুঝতে কষ্ট হবে, কিন্তু তবু বলছি, শোন্– জন্মের পর কিন্তু আমাদের একটা নতুন জীবন শুরু হবে।
ইগো বললো, বোকার মত কথা বলবি না। তোর চারপাশে চেয়ে দ্যাখ। এখানে যা দেখছিস এটাই জীবন, এটাই বাস্তবতা। কেন মিছেমিছি এই বাস্তবতার বাইরে ভাবতে যা? এই জীবন নিয়েই সুখী হ।
ইগোর কথায় স্পিরিট খানিকক্ষণের জন্য দমে গেল, কিন্তু বেশীক্ষণের জন্য নয়। স্পিরিট বললো, দ্যাখ ইগো, তুই রাগ করিস না। আমার মনে হচ্ছে আমাদের মা বলে কিছু একটা আছে।
ইগো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল, মা! একথা তুই ভাবছিস কি করে? তুই কোনদিন মাকে দেখিসনি, মা কী জিনিস তাও জানিস না! তোর এই জীবন নিয়ে কেন সুখী হতে পারছিস না? এখানে তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। এটাই তোর বাস্তব জীবন।
ইগো, স্পিরিট মরিয়া হয়ে বলে, খেয়াল করে শোন। মাঝে মাঝে দুজনই কি একধরনের চাপ অনুভব করি না? আমাদের ব্যথা লাগে। আমার ধারণা এটা আমাদের জন্ম নেবার পূর্বলক্ষণ। আমার মনে হয় আমরা শীগগিরই কোন নতুন জীবনে পা রাখতে যাচ্ছি। তখন আমরা আলো দেখতে পাব।