.
এর পরেই আসে স্টেটস্পার্সন স্টেজ বা বড়ভাইসুলভ পর্যায়। এ পর্যায়ে আত্মঅহমিকা নিয়ন্ত্রণ করে একটি দেশ একটি গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিণতি লাভ করে এবং তার নেতৃত্বসূলভ আচরণকে অন্য দেশ ও সমাজের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। বড়ভাইসূলভ এ পর্যায়ের জাতিটি সত্যিকার অর্থে সফল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু তার শক্তি প্রদর্শনের মোহ কমে না। তার উদ্ধত কার্যক্রম অন্যদের আরো ভালো কিছু অর্জনের শক্তি যোগায়। মহাশক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন কিছু দেশে তার উন্নয়নমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে সহায়তা করেছিল।
ব্যক্তি ও জাতির উভয় ক্ষেত্রেই সংগ্রামী পর্যায় থেকে বড়ভাইসুলভ পর্যায়ে উত্তরণ সম্মানজনক কিন্তু এ পর্যায়ের ক্ষমতা ব্যবহার খুবই কঠিন।
.
কিন্তু এই বড়ভাইসুলভ পর্যায়ের ওপরেও আরেকটি পর্যায় রয়েছে। এ পর্যায়ে একটি দেশ তার সত্যিকার ক্ষমতাসীমা সম্পর্কে সজাগ হয়। এ পর্যায়ে এসে সব দিক থেকে উন্নত দেশটির মধ্যে পরিণত প্রাজ্ঞতা জন্ম নেয়। দেশটি বুঝতে পারে পৃথিবী কেবল কোন নির্দিষ্ট একটি দেশের সম্পদ নয় বরং এ পৃথিবী সব দেশের সকল মানুষের। তখন দেশটি বিশ্বমানবতার প্রতি দায়িত্বপালনে ব্রতী হয়। এ পর্যায়ে উপলব্ধির পর্যায় বলা যেতে পারে এবং ভারত সে পর্যায়ে উন্নীত হতে পারে।
.
আমার তেতাল্লিশ বছরের কর্মজীবনে আমি বহুবার প্রতিষ্ঠান বদল করেছি। কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়। নতুন ভাবনা অভিনব কাজের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
২০০১ সালের ১৫ আগস্ট আমি কার্যক্ষেত্র পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম। উনি আমাকে আবার ভেবে দেখতে বললেন। দায়িত্ব থেকে কিছুদিন মুক্ত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম তার কাছে কিন্তু তিনি আমাকে অবশেষে ছাড়লেন না।
.
একজন রকেট চালক হিসেবেও আমি ধারাবাহিক পর্যায়গুলো অতিক্রম করেছি। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান আই এস আর ও (ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন) তে কাজ করেছি। ১৯৮০ সালে ভারত প্রথমবারের মত সফলভাবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে এবং কক্ষপথে রোহিনী স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপন করে বিশ্বের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ স্পেস ক্লাবের সদস্য হয়। এসএলভি-৩ এর ওই মিশনে আমি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। আমাদের সেই সকল অভিযান জাতিকে স্যাটেলাইট প্রতিস্থাপক প্রযুক্তি অর্জনের গৌরব উপহার দিয়েছিল। স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণ, গাইডেন্স, জেট ইঞ্জিনের দ্বারা প্রচালন এবং বায়ু গতিবিদ্যার বিষয়েও ওই অভিযান আমাদের অভিজ্ঞ করে তোলে। এছাড়া বিভিন্ন রকেট সিস্টেম ডিজাইনেও এ অভিযান সহায়তা করেছে। সর্বোপরি আর অ্যান্ড ডি ল্যাবরেটরি, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তথ্য প্রযুক্তি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের এ প্রজেক্টটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে।
আজ তারা বিভিন্ন স্পেস ও প্রতিরক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। আমার শ্রদ্ধেয় তিন গুরু ড. বিক্রম সারাভাই, অধ্যাপক সতীশ ধাওয়ান এবং ড. ব্ৰহ্ম প্রকাশ-এর কাছ থেকে আমি নেতৃত্বের শিক্ষা পেয়েছিলাম। এসময় আমি ছিলাম শিক্ষানবীশ। এটাই ছিল আমার অ্যাথলেট স্টেজ।
.
আমার দ্বিতীয় পর্যায় ধরা যেতে পারে ১৯৮২ সাল থেকে, যখন আমি ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশন)তে যোগ দেই।
ডিআরডিওতে যোগদানের মধ্য দিয়ে দুটি স্ট্র্যাটেজিক মিসাইলের ডিজাইন করা, এর তৈরী পদ্ধতির উন্নয়ন ঘটানো, উৎপাদন এবং তা উৎক্ষেপণের যাবতীয় কাজে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য হয় আমার। এই দুটি সুকৌশলী ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি কোনওদিন কোন দেশকেই দেওয়া হবে না, তা সে যতই বন্ধুপ্রতীম দেশ হোক না কেন। এসময়ে আরও তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণাগার ও স্থাপনা তৈরী হয়। এর মধ্যে হায়দ্রাবাদে আরডিও (রিসার্চ সেন্টার ইমারত) নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়।
আর দুটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপিত হয় বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী চণ্ডিপুরে। এ দুটি পরীক্ষা কেন্দ্রের একটি চণ্ডিপুরের প্রাণকেন্দ্রে, আরেকটি হল চণ্ডিপুর এলাকাভুক্ত একটি দ্বীপে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হওয়ায় ভারত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উপরন্তু ভারতের এই গবেষণাগার ও একাডেমিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু জটিল প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয় যা এমটিসিআর (মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রিগাইম) ও এনপিটি (ননপ্রলিফারেশন ট্রিটি)র চাপ থেকে ভারতকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে। আমার অধীনস্থ ওই মিসাইল টিম আইসিবিএম (ইন্টারন্যাশনাল ব্যালিস্টিক মিসাইল) সহ বিশ্বের সর্বাধুনিক যেকোনও ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে সক্ষমতা অর্জন করে।
.
এ পর্যায়ে এসে আমাকে অনেক সফলতা ও ব্যর্থতার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ব্যর্থতা থেকে আমি শিক্ষা নিয়েছি। আবার সাহস নিয়ে সেই ব্যর্থতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। এটি ছিল আমার দ্বিতীয় পর্যায় যা আমাকে ব্যর্থতা সামলানোর মত জটিল ও কঠিন শিক্ষা দিয়েছিল।