চন্দ্রশেখর আমাকে জানালেন, তিনি ঝুঁকি নিতেই ভালবাসেন। তবে সে ঝুঁকিকে অবশ্যই পরিকল্পিত হতে হবে।
১৯৫৫ সালে মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে আমি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার বিষয় ছিল অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। আমাদের পরিচালক ছিলেন ড. শ্রীনিবাস। শ্রীনিবাস নিজেও বড় অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। আমরা তার তত্ত্বাবধানে থেকে একটি ছোট যুদ্ধ বিমানের ডিজাইন করছিলাম। এর মধ্যে বিবেকানন্দ, মহাবলেশ্বর ভাট এবং আমি এই তিনজনের দায়িত্ব ছিল একটি সিস্টেম ইনটিগ্রেশনের কাজ। তিন মাসের মধ্যে আমাদের ডিজাইন জমা দিতে হবে এবং সেটা এক্সটারনাল শিক্ষকরা পরীক্ষা করবেন।
ইঞ্জিন, কন্ট্রোল সিস্টেম এবং আরও কিছু সাব সিস্টেমের তথ্য বন্ধুরা দুই সপ্তাহ দেরীতে জমা দিল। ফলে ড্রইং জমা দিতে আমারও দেরী হয়ে গেল।
আগস্ট মাসের এক আদ্ৰ সন্ধ্যায় আমি ড্রইং বোর্ডে কাজ করছি। ড. শ্রীনিবাস তার টেনিস কোর্টে যাবার সময় উঁকি দিয়ে আমার কাজ দেখছিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন আমার কাজ শেষ হতে এখনও অনেক বাকি। তিনি বললেন, কালাম, তিন দিনের মধ্যে ড্রইং শেষ না হলে তোমার স্কলারশীপ বন্ধ হয়ে যাবে।
তার এ কথায় আমি প্রচণ্ডভাবে নাড়া খেলাম। স্কলারশীপ আমার জীবনের প্রধান সাধনা। এমআইটিতে পড়ানোর সামর্থ্য আমার বাবার নেই। কাজটা তিনদিনের মধ্যে আমাকে শেষ করতেই হবে। এ চিন্তা মাথায় রেখে একটানা কাজ শুরু করলাম। শুধু খাওয়া ছাড়া ওই তিনদিন আমি রুমের বাইরে যাইনি এবং ঘুম এলে বেঞ্চিতে বসে ঘুমিয়ে নিয়েছি। এভাবে রাতদিন পরিশ্রমের পর অবশেষে আমি ড্রইং শেষ করলাম।
তিনদিন পরে ড. শ্রীনিবাস ড্রইংবোর্ড দেখতে এলেন। এক ঘন্টা ধরে পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর বললেন, খুব ভাল হয়েছে, যে কাজ করতে কয়েক সপ্তাহ লাগার কথা, তুমি তা কয়েক দিনে করলে। তার একথা আমার কাজের বিরাট স্বীকৃতি বলে আমি সেদিন বিবেচনা করেছি।
সেদিনই আমি বুঝেছি প্রচন্ড মানসিক শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করলে হাজারও ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও সফলতা অনিবার্য। ভাল কিছু করতে হলে ঝুঁকি মোকাবেলা করতেই হবে। জন্মের প্রক্রিয়াটাই তো ঝুঁকির। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ দিয়ে একটা শিশু সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে জন্ম নেয়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস চালু হলে, যখন সে কান্নার মাধ্যমে স্বীয় অস্তিত্ব ঘোষণা করে তখন সবাই স্বস্তি পায়। সকলের মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। এজন্য সাফল্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে কাজ করলেও সফলতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
৯. দেশবাসীর প্রতি
৯. দেশবাসীর প্রতি
Where the mind is without fear and
the head is held high
Where knowledge is free Where the world has not been broken up in to fragments…
My father let my Country awake.
-Rabindranath Tagore
সমগ্র বইটিতে আমি ইচ্ছা শক্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এটি সৃজনশীল কাজের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং এটিই আমাদের জীবনের খুব প্রয়োজনীয় অংশ; এর একত্রিত শক্তি আমাদের আকাংখার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। এই শক্তিই বিজয়ী এবং বিজেতার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। আমি আগামী বিশ বছরের মধ্যে ভারতকে শিক্ষিত এবং দারিদ্র্যমুক্ত জাতি হিসেবে দেখতে চাই। আমি আদর্শ নেতাদের পরিচালিত ভারতের স্বপ্ন দেখি। আমি এমন এক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যেখানে বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদের কর্মকান্ড পরিচালিত হবে সাধারণ মানুষের মঙ্গলার্থে। কিভাবে এই স্বপ্ন সত্যি হবে?
আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মিশন কোন সংগঠনের চেয়ে অনেক বড়, যেমন একটা সংগঠন তার পরিচালকের চেয়ে বড়। কোন মিশন পরিচালনার জন্য দরকার উদ্যম এবং তা আমাদেরকে সরবরাহ করে মন। ভেবে দেখুন, কোন বিভাগ বা মন্ত্রণালয় কি মানুষকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে সেখানে বসতি গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারবে? ২ লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তির উৎপাদন কি তাপশক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, পারমাণবিক শক্তি এবং অনিয়মতান্ত্রিক ক্ষেত্রগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম ছাড়া সম্ভব? কৃষি বিজ্ঞানী, জীব প্রযুক্তিবিদ এবং সেচ বিশেষজ্ঞদের একত্রিত কর্মকান্ডের সমন্বয় ছাড়া কি দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সম্ভব?
আমাদের ক্লিনিকগুলোতে সঠিক ডায়াগনোসিস সুবিধা এবং সাধারণের ক্রয়যোগ্য ওষুধ না রাখতে পারলে এই জৈব প্রযুক্তির গবেষণাগার আর মেডিকেল কাউন্সিল গঠন করে কোন লাভ নেই। এসব নির্মাণের মূল উদ্দেশ্যই হল সর্বাধুনিক চিকিৎসা সেবার আবিষ্কার এবং ন্যুনতম অর্থের বিনিময়ে সে সেবা রোগীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
আমার অভিজ্ঞতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমি সচেতন থেকেছি। ভবিষ্যত লক্ষ্য স্থির করে সামনে চলার শক্তি আমার মধ্যে এক প্রবল আশাব্যঞ্জক তেজ সৃষ্টি করেছে। এ এমনই এক শক্তি যা তোমার ভেতর থেকে জ্বলে ওঠে। স্বাধীনতার সময় এই শক্তিকে আমরা জ্বলে উঠতে দেখেছিলাম। যখনই কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই তখনই স্বাধীনতার সেই সময়ের শক্তিকে আমি ধারণ করি।
আজকের ভারতের পুনর্জাগরণের জন্য স্বাধীনতার সময়কালীন সেই তেজদীপ্ততার আজ বড় প্রয়োজন।