ঘটনা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম। চিন্তা করতে লাগলাম, ভারতের খনির বেরিলিয়াম নিম্নমানের লৌহআকর হিসেবে যাচ্ছে জাপানে, জাপান সেটা প্রসেসিং করে পাঠাচ্ছে আমেরিকায় আর সেই ভারতের কাছে প্রক্রিয়াজতকৃত দ্রব্য বেচতে অস্বীকার করেছে আমেরিকা। আমাদের চিন্তার পশ্চাৎপদতা দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। এ বিষয় নিয়ে পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি শুরু হল এবং বেরিলিয়াম রফতানি বন্ধ করা হল।
এই একই ঘটনার প্রতিফলন ঘটেছে অন্যান্য ক্ষেত্রেও। প্রচুর সম্পদ থাকার পরও ভারত অর্থনৈতিক সফলতা পাচ্ছে না এই মূল্য সংস্কার করতে না পারার কারণে।
এটা শুধু খনিজ সম্পদের কারণে তাই নয় বরং কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রেও ঘটছে একই ঘটনা। একেকটি পণ্যকে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীতে রূপান্তরের সংগে সংগে তার দাম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এমনকি বেরিলিয়ামের মত তা ১শ গুণ বেশী দামেও বিক্রি হতে পারে। আমাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের মূল্য সংস্কারের উপায় জানতে হবে, নয়তো আমাদেরই জিনিস ওরা পরিবর্তন করে অর্থাৎ মূল্য সংস্কার করে আমাদের কাছে কয়েকগুণ বেশী দামে বিক্রি করবে।
ওই একই মতবিনিময় সভায় আমাকে আরেকটি মজার প্রশ্ন করা হল, আপনি কি রাজনীতিতে স্বচ্ছতা তৈরী করা সম্ভব বলে মনে করেন? যদিও তাৎক্ষণিকভাবে আমি এ প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, তথাপি আমার মনে একটি জবাব ভেসে উঠলো। আমি বললাম, আমাদের দেশ রাজনীতি, শিল্প, বিজ্ঞান, সাহিত্য সর্বক্ষেত্রেই কৃতিত্ব দেখিয়েছে যে কারণে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। মহাত্মা গান্ধী, সি.ভি. রমন, জে. আর. ডি. টাটা, ফিরোজ শাহ বি. গোদরেজ, লক্ষনরাও কিরলস্কর, রামকৃষ্ণ বাজাজ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডি. আর. এস. রাধাকৃষ্ণন, মদনমোহন মালবী এসব মহাত্মার তালিকা অনেক দীর্ঘ।
সে সময় এতগুলো প্রতিভা একত্রিত হওয়ায় ভারতভূমি জেগে উঠেছিল। সে সময় ভারত স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছিল বলেই রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য সবক্ষেত্রে একটি আবহ তৈরী সম্ভব হয়েছিল।
আমি বিশ্বাস করি, স্বাধীনতার লক্ষ নিয়ে মানুষ যেভাবে জেগেছিল ঠিক সেভাবে যদি আরেকটি দ্বিতীয় গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায় তাহলে রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব।
পরের দিন আমি বোকাবরা স্টীল প্ল্যান্ট পরিদর্শনে গেলাম। এটি ভারতের সর্ববৃহৎ স্টীল প্ল্যান্ট। প্ল্যান্টের জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার তিওয়ারি আমার সংগে ছিলেন। প্ল্যান্টের আয়তন দেখে যে কারও ভিরমি খাওয়ার কথা। প্ল্যান্টের ভেতরে গিয়ে দেখলাম বিশাল ড্রেনের মত জায়গা দিয়ে গলিত লোহার স্রোত আগুনের নদীর মত বয়ে যাচ্ছে। কয়েক শ মানুষ সেই প্রচন্ড গরমের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের শরীর থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে।
মিস্টার তিওয়ারি জানালেন, এখানকার খনির লোহা শেষ হতে অনেক বছর লেগে যাবে। শুনে খুব ভাল লাগল। কিন্তু যখনই জানলাম এ প্ল্যান্টের ওপর ভিত্তি করে এখানে এখনও কোন কলকারখানা গড়ে ওঠেনি তখন কেমন খারাপ লাগল। আমি আমার সঙ্গীদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম এই লোহার ওপর ভিত্তি করে এখানে তো অনেক লৌহ ও লৌহজাতুদ্রব্যের কারখানা গড়ে ওঠার কথা ছিল, উঠছে না কেন? তারা জানালেন কেন্দ্রীয় সরকারের এখানে কারখানা গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাই স্থানীয়রা এগিয়ে আসছে না।
আমার মনে হল এটা কেন হবে? স্থানীয় কোম্পানীগুলো যদি প্ল্যান্টের আশে পাশে তাদের কারখানা গড়ে তুলতে পারে তাহলে তা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবার কথা।
দিল্লি ফিরে ভাবতে লাগলাম ঝাড়খন্ডকে কীভাবে সাহায্য করা যায়। আমার মনে হল একেকটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিয়ে ঝাড়খন্ডে কয়েকটি মিশন চালু করতে হবে। এই মিশনগুলো সফল করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একজোট হয়ে কাজ করবে। এটা কি সম্ভব?
২০০১ সালের অক্টোবর মাসে দিল্লির গুরু গোবিন্দ সিং ইন্দ্রপ্রস্থ বিশ্ববিদ্যালয় সফরের সুযোগ হয় আমার। ছাত্রদের প্রতি দেওয়া আমার ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল, দায়িত্বশীল তরুণ নাগরিক। এ বক্তব্যে আমি ভারতকে একটি নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমাজ হিসেবে গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলাম। আমার বক্তব্য শেষ হলে একটি ছাত্র জিজ্ঞেস করলো, আপনি কি বলবেন কেন ভারতীয়রা, বিশেষ করে শিক্ষিত ভারতীয়রা ইউরোপ আমেরিকায় গেলে খুব ভাল কৃতিত্ব প্রদর্শন করতে পারে? তারা কিন্তু সেসব দেশে গিয়ে ধনীও হচ্ছে।
আমি বললাম, সম্প্রতি আমি বিদ্যানন্দ রাজঘট্টের লেখা দি হর্স দ্যাট ফ্লিউ নামে একটি বই পড়েছি। যেসব ভারতীয় বিদেশে বিশেষ করে আমেরিকায় তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে এ বইটি তাদের নিয়ে লেখা।
আমি খুব গভীরভাবে খেয়াল করে দেখেছি বইয়ে বিদেশে অবস্থানরত যেসব সফল ভারতীয়র কথা বলা হয়েছে তারা কেউ এককভাবে কাজ করে উন্নতি লাভ করতে পারেনি। তারা সবাই একটা ভিন্ন দেশে, ভিন্ন মানুষের মধ্যে কাজ করার ঝুঁকি নিতে পেরেছে শুধু যুথবদ্ধ সাহসের কারণে।
একবার আমি বি. চন্দ্রশেখরের সংগে দেখা করেছিলাম। তিনি মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির প্রতিষ্ঠাতা। এখানেই প্রথম ভারতের ইন্টারনেট টেকনোলজি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়। একদিন সকালে চন্দ্রশেখর তার সমগ্র প্রতিষ্ঠান ১ হাজার কোটি ডলারে বিক্রি করে দিলেন এবং অন্য প্রতিষ্ঠান শুরু করার উদ্যোগ নিলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম নতুন প্রকল্প চালু করার জন্য কী করে তিনি এত বড় ঝুঁকি নিতে গেলেন?