শিশুদের হাতে তৈরী বিভিন্ন খেলনা, আঁকা ছবির প্রদর্শনী দেখে এবং তাদের পরিবেশিত ময়ূরনাচ সহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখে আমার মনে হচ্ছিল সৃষ্টিশীলতা বিকাশ ও উন্নত শিক্ষার জন্য তাদের এ কার্যক্রম খুবই আশাবহ অবদান রাখবে। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এমন একটি সম্ভাবনাময় রাজ্যের সংগে অবশ্যই আমি কাজ করে যাবো।
চিন্ময় বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে টাউন হলের একটি পূর্ব নির্ধারিত মিটিংয়ে যোগ দিতে গেলাম। অবশ্য বোকারো স্টিল প্লান্টের জেনারেল ম্যানেজারের পাঠানো একদল ডাক্তার আমাকে সেখানে না গিয়ে বারবার বিশ্রাম নেবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমি তাদের অনুরোধ উপেক্ষা করেই টাউন হলের মিটিংয়ে উপস্থিত হই। সেখানে আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু ছিল, ঝাড়খন্ডের সুপ্ত সামর্থ্য ও শিল্প কারখানা। পরবর্তী আলোচনা ও বাকবিনিময়ে আলোচ্য বিষয়ের গভীরতা তলিয়ে দেখা যাবে একথা বিবেচনা করেই আমি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলাম।
ইতিমধ্যেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া যা করার করে ফেলেছে। আমাদের আগমন। উপলক্ষ্যে বাছা বাছা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা আমাদের সংগে এসেছিলেন। ফলে হেলিকপ্টার ক্র্যাশের ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে সারা দেশে প্রচারিত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর পর আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠতে লাগল। আমি সুস্থ্য আছি কিনা তা জানার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন করছিলেন। আমি মিটিংয়ের আলোচনায় ব্যাঘাত না ঘটিয়ে রাচি থেকে আমার সহগামী হওয়া বন্ধু ড. বিজয় রাঘবনকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, কলগুলো রিসিভ করে তিনি যেন সবাইকে জানিয়ে দেন আমি সুস্থ্য আছি। একই সংগে রামেশ্বরমে বসবাসরত আমার ছিয়াশি বছর বয়স্ক বড়ভাইকে ফোন করে আমার সুস্থতার কথা জানাতে বললাম। দিল্লিতে অবস্থানরত আমার আরেকজন একান্ত সচিব শেরিডনকে ফোন করে জানাতে বললাম সে যেন বাইরের ফোনগুলো রিসিভ করে আমার সুস্থ্যতার খবর সবাইকে জানায়।
আমি মিটিংয়ে কথা বলছি, এ সময় বিজয় রাঘবন আমার সামনে একটা চিরকুট রাখলেন, তাতে লেখা, আপনার ভাই কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে আপনি সুস্থ্য। তিনি আপনার সংগে কথা বলতে চাইছেন। বড় ভাইরা চিরকালই বড়ভাই থেকে গেলেন। আলোচনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার সংগে কথা বলতে হল আমাকে।
মত বিনিময় সভায় একজন প্রশ্নকারী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ড. কালাম, আপনি আমাদের বলবেন কেন বিশেষ পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমাদের বন্দরগুলো থেকে কাঁচামাল রফতানি করা হচ্ছে?
এই ঝাড়খন্ডে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ থাকায় এবং তা বাইরের দেশে রফতানি করায় প্রশ্নটি প্রাসংগিক ও সময়োপযোগী হয়েছে। তার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে আমি গোয়াতে বন্ধুদের সংগে আলোচনার একটি বিষয় খুলে বললাম। একবার গোয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিলাম, আমার সহগামী হয়েছিলেন ড. হোসে পল। তিনি গোঁয়ার মারগুয়াও বন্দরের চেয়ারম্যান।
আমরা আমাদের ভারতের লোহা রফতানির বিষয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের কথাবার্তার মূল বিষয় ছিল ভারতের অপরিশোধিত লৌহ আকর জাপানে রফতানি নিয়ে। পল জানালেন, প্রতি বছর ৩ কোটি টন লৌহ আকর চারটি বন্দর থেকে জাপানে রফতানি করা হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৭০ লাখ টন রফতানি হয় এই মারগুয়াও বন্দর থেকে। বিদেশী ক্রেতা দেশগুলো এই কাঁচা লোহাকে অত্যন্ত নিম্নমানের বিবেচনা করায় প্রতিটন লোহা মাত্র কয়েক ডলারে বিক্রি করা হয়। অথচ ওই কাঁচা লোহা রফতানি না করে যদি তা দেশে কাজে লাগানো যায় তাহলে তাকে আরও বেশী স্থানীয় আয় বাড়বে। তবে এর জন্য সঠিক মূল্য সংস্কার করা দরকার।
এটুকু বলতেই বোকারোর মতবিনিময় সভার একজন দাঁড়িয়ে বললো, মূল্য সংস্কার বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? একটা উদাহরণ দেবেন কি?
আমার একটা সুন্দর উদাহরণের কথা মনে পড়লো।
১৯৭০ সালের স্যাটেলাইট অভিযানের জন্য আমরা যখন কাজ করছিলাম, তখন বেরিলিয়াম ডায়াফ্রাজমস নামের একটি জিনিসের দরকার পড়লো। এটি এক ধরনের তাপনিয়ন্ত্রক সাদা ধাতুতে তৈরী হয়। রকেট অথবা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপনের পর তার গতি এবং প্রকৃতি সম্বন্ধে তথ্য দানকারী জোরাস্কোপ ও সেন্সর মেশিনে এ বিশেষ ধাতু ব্যবহৃত হয়। যেহেতু আমাদের দেশে ওই ধাতু ছিল না সেজন্য আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তা কিনে আনবার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা হল।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশানের নেতৃত্বে মাধব নায়ার, ড. এস. সি. গুপ্ত এবং আমি বেরিলিয়াম কেনার জন্য নিউইয়র্কের একটি কোম্পানীর কাছ থেকে ১শ বেরিলিয়াম ডায়াফ্রামের আমদানির চুক্তি করলাম।
তিন মাস পর ওই কোম্পানী থেকে একটি মেসেজ এল যাতে বলা হয়েছে, যেহেতু বেরিলিয়াম ধাতুটি উপমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইলে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, সেহেতু ভারতে তা রফতানির অনুমতি দিচ্ছে না মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সমস্যা সমাধানে আমরা তড়িঘড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কোন একটা উপায় খুঁজে বের করতেই হবে।
অবশেষে প্রযুক্তির প্রত্যাখ্যানই আমাদের প্রযুক্তি সফলতার পথ দেখাল।
একটি খবর বেরুল ভারতে বিশ্বের সবচে বড় বেরিলিয়াম আরকের খনি রয়েছে। ভারত থেকে যে কাঁচা লোহার আরক জাপানে রফতানি হচ্ছে, তারা তা শোধন করে বেরিলিয়াম রড অথবা শীট তৈরী করছে। জাপান আবার সেই শীটগুলো বিক্রি করছে আমেরিকার কাছে। আমেরিকান কোম্পানী সেগুলো দিয়ে ডায়াফ্রাজম চোঙসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র বানাচ্ছে।