ওই সফরের সময়ই আমরা সেখানে উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আয়ুর্বেদীয় ওষুধ কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করলাম। আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল হার্বাল ওষুধ ও প্রসাধনী পণ্য সেখানেই উৎপাদন করে সেখান থেকে সরাসরি বাজারজাতকরণের মাধ্যমে এলাকাবাসীর রোজগার ও জীবনযাত্রার মান বাড়ানো। আমাদের এ উদ্যোগ এলাকাবাসীর জন্য ছিল একটা নতুন পরীক্ষামূলক বিষয় এবং আমাদের জন্য ছিল নতুন পরীক্ষামূলক মিশন। কিন্তু এই মিশন পরিচালনা করতে গিয়ে দেখলাম ঝাড়খন্ডে ঔষধি দ্রব্য সামগ্রী, আয়ুর্বেদিক ওষুধ ও প্রসাধনীর সুবিশাল সম্ভাবনা।
রাঁচির বৈঠক শেষ করে ঝাড়খন্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হব হব করছি, এমন সময় দেখলাম আকাশে মেঘ। ফ্লাইট বাতিল করা হবে কি হবে না তা নিয়ে ইতিমধ্যে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়ে গেছে। হলোও তাই। খবর এল খারাপ আবহাওয়ার কারণে রাচি থেকে ফ্লাইট চলাচল আপাতত বন্ধ। রাজ্য সরকার আমার যাবার জন্য একটা পবন হ্যাঁন্স হেলিকপ্টার ভাড়া করে আনল। এ আবহাওয়ায় চালানো যাবে কি না আমি পাইলটকে এ প্রশ্ন করতেই সে সহ সবাই উষ্ণ হাসিতে আমার সকল ভাগ্যবিড়ম্বনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিলেন। পাইলট আমাকে খুব ভাল একটি ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি দিলেন। খুব ঝক্কিহীনভাবে আমিসহ আমার বেশকয়েকজন সাথী নিয়ে উড়ল কপ্টারটি।
আমাকে প্রায়ই হেলিকপ্টারে চড়তে হয়। কিন্তু এ ধরনের মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ায় কখনও আমাকে পড়তে হয়নি।
কপ্টারটির পাইলটকে খুব দক্ষ মনে হল। ছন্দময়ভাবে, ঝাঁকির হাত এড়িয়ে চালানোর জন্য বেশ কয়েকবার তাকে ধন্যবাদও দিলাম। অরণ্য, পাহাড় আর নদী ছুঁই ছুঁই করে আমরা যখন এগুচ্ছিলাম সে দৃশ্য আমার কাছে এক বিরল অভিজ্ঞতা। আমি বিভোর হয়ে এই নির্মল শ্যামল শোভা দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, সাময়িক লাভের আশায় যারা আমাদের এই বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করছে তাদের হাত থেকে এ সম্পদরাশি আমাদের বাঁচাতেই হবে। ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল আমরা নিচের দিকে নামা শুরু করেছি।
হঠাৎ খেয়াল করলাম পাইলট দুজন আরপিএম পতনের বিষয় নিয়ে উত্তেজিত ভাবে কী যেন বলাবলি করছে। আমি সতর্ক হয়ে বসলাম। নিচে তাকিয়ে দেখি অসংখ্য গাড়ি। আর চারদিকে পিঁপড়েসারির মত মানুষ। ঠিক পরমুহূর্তেই ক্র্যাশ করলো কপ্টারটি। কপ্টারটি বিকটশব্দে মাটিতে আঘাত করলো। ভাঙাচোরা যন্ত্রাংশ আশপাশ দিয়ে উড়ে গেল। দেখলাম আমাদের দিকে ছুটে আসছে অগ্নি নির্বাপনী কয়েকটি গাড়ি।
আমি স্বাভাবিকভাবেই হেলিকপ্টার থেকে নেমে এলাম। একেবারে মরা মানুষের মত ধপাস করে মাটিতে পড়েছিল কপ্টারটি।
আমাদের ভাগ্য ভাল ল্যান্ড করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে কপ্টারে যান্ত্রিক জটিলতা দেখা দিয়েছিল। ভূমি থেকে সামান্য ওপরে থাকতে ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ায় সেদিন আমরা বেঁচে গেছি।
পাইলট দুজন অসহায়ের মত আমার দিকে তাকালো। তারাও এ ঘটনায় বড় ধরনের মানসিক ধাক্কা খেয়েছে। আমি তাদের সংগে করমর্দন করে বললাম ফ্লাইং মেশিন চালাতে গেলে এরকম দুএকটা দুর্ঘটনা তো ফেস করতেই হবে।
সেদিন রাঁচিতে চিন্ময় বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সংগে আমার দেখা করার কথা ছিল। তাদের সংগে যোগ দিতে কপ্টার দুর্ঘটনার আঘাত ও ভয় ফেলে ছুটলাম চিন্ময় বিদ্যালয়ে। স্কুলের প্রিন্সিপাল কৃষ্ণস্বামী আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন এবং অডিটরিয়ামের মাঝখান দিয়ে বক্তব্য মঞ্চে যাবার সময় ছেলে মেয়েরা আমার মাথায় বৃষ্টির মত গোলাপের পাপড়ি ছড়াতে লাগলো। আমি আসার আগেই কপ্টার ক্র্যাশের খবর চলে এসেছিল। বাচ্চারা সব পিনপতন নিরবতায় আমার সামনে বসেছিল।
পরিস্থিতি সহজ করার উদ্দেশ্যে শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে বললাম, বন্ধুরা, রাচি থেকে এখানে আসবার সময় আমি তোমাদের প্রতি ঈশ্বরের দেওয়া উপহার দেখতে দেখতে তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম।
তোমাদের পায়ের নিচে এবং পায়ের ওপরে ঈশ্বর তোমাদের সীমাহীন সম্পদ দিয়েছেন। ঝাড়খন্ডের উর্বর মাঠ তোমাদের শস্যের সম্পদ দিতে পারে। যখন আমি তোমাদের পাহাড়, উপত্যকা, অরণ্য আর নদীর ওপর দিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে উড়ে আসছিলাম তখনই ভাবছিলাম তোমাদের এ এলাকা হার্বাল সামগ্রী উৎপাদনের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক। তোমাদের এখানে দেখলাম পুরোমাত্রায় চলছে একটি সম্ভাবনাময় স্টীল প্ল্যান্ট। আমি আমার দিব্যদৃষ্টিতে এ এলাকাকে একটি উন্নত শিল্প এলাকা হিসেবে দেখতে পাচ্ছি। উন্নত ও সমৃদ্ধ রাজ্যের জন্য যা যা থাকা দরকার তার সবই এখানে আছে। এখানকার ভূমিগুলোকে শুধু সেই পর্যায়ে পরিবর্তন করা দরকার। আমি দেখতে পাচ্ছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তোমাদের গ্রামগুলো শহরের যাবতীয় সুযোগসুবিধা অর্জন করতে পারবে। আজকের এই দুর্ঘটনা আমাকে বাকি জীবনের মিশন নির্ধারণে আরও বেশী প্রেরণা দিয়েছে। তোমাদের সামনে সমৃদ্ধির অপার সম্ভাবনা। উন্নত রাজ্য হিসেবে তোমাদের রাজ্যকে গড়ে তুলতে কীভাবে তোমরা সমন্বিত প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামবে? এ সফলতার জন্য সবাইকে মিশন মুড নিয়ে কাজ করতে হবে।
একদিন এই শিশুগুলোই বড় হবে। বিভিন্ন পদে আসীন হবে। এরাই সুশীল সমাজের অংশ হয়ে উঠবে। দেশের প্রতি তাদের অবদান তখন উন্নত রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে। একদিন এদেরই প্রধান লক্ষ্য হবে ঝাড়খণ্ডকে মহান ও উন্নত রাজ্যে পরিণত করা।