স্বাধীনতার পর থেকে আমরা অগ্রগতির কথা বলে আসছি। কৃষিক্ষেত্রে আমরা এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। দুগ্ধ উৎপাদনকারী হিসেবে বিশ্ববাজারে আমরা প্রথম শ্রেণীতে রয়েছি। এমন বহু ক্ষেত্রে আমাদের শিল্পকারখানা এগিয়ে এসেছে। এর পরেও আমরা শ শ উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ভুক্ত দেশ।
আমাদের এখন বিবেচনা করে দেখতে হবে বিশ্বের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে রয়েছে। একটি দেশের প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক অবস্থান নির্ধারিত হয় তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিচার করে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্ব প্রতিযোগীতার দৌড়ে সিংগাপুর প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়, হংকং তৃতীয়, তাইওয়ান চতুর্থ, কানাডা পঞ্চম, ব্রিটেন অষ্টম, ফ্রান্স তেইশতম, জার্মানি পঁচিশতম এবং ভারত উনষাটতম অবস্থানে রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল এ বিশ্বপ্রতিদ্বন্দ্বীতা নির্ধারণ করে কে? এটা আসলে শিল্প কারখানার উন্নয়নমুখীতা, উন্নত প্রযুক্তির অগ্রসরতা, সরকারের সুস্থির চালিকাশক্তির একটি সম্মিলিত ফলাফল। গড় জিডিপি অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বে আমাদের অবস্থান দ্বাদশ পর্যায়ে। পার ক্যাপিটা জিডিপির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সাতান্নতম।
এ অবস্থান কি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য? বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে? আমি বিশ্বাস করি আমাদের এমনভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো উচিত যাতে জিডিপির ক্ষেত্রে চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে আমরা চলে আসতে পারি। একই সংগে বিশ্ব প্রতিযোগীতার দৌড়েও আমরা চতুর্থ থেকে পঞ্চম অবস্থানে শক্তিগুলো এক হচ্ছে আসতে চাই। আর এ সাফল্য অর্জনের জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি ২০২০ সাল। এ সাফল্য অর্জনের জন্য আমরা আগেই বেশ কয়েকটি পন্থা সম্পর্কে আলোচনা করেছি।
এ সকল সমাজ গড়ার জন্য আমাদের একটি বলিষ্ঠ শিক্ষিত সমাজ গডে তুলতে হবে। আমি প্ল্যানিং কমিশনের এই শিক্ষিত প্রজন্ম সৃষ্টির রোডম্যাপ প্রণয়নের উদ্যোগে খুব খুশি হয়েছি।
আমরা কোত্থেকে আমাদের কার্যক্রম শুরু করব? সম্প্রতি নতুন কিছু রাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। সেসব অঞ্চল থেকেই আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারি। অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও এই অঞ্চলগুলোর খুব কমই উন্নতি হয়েছে। সেখানকার মানুষ অনেক পরিশ্রম করছে কিন্তু দারিদ্র তাদের ছাড়ছে না। এই চরম বঞ্চনাপূর্ণ দারিদ্র্যের পথ থেকে কে আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেবে? কে আমাদের এ পরিস্থিতিতে রেখেছে সেটি বড় প্রশ্ন নয়। এখন আমাদের সামনে মুখ্য জিজ্ঞাসা, কে এই দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটাতে পারে?
৮. নতুনভাবে দেশগঠন
৮. নতুনভাবে দেশগঠন
If I were to look over the whole world to find out the country most richly endowet with all the wealth, power and beauty that nature can bestow- is some parts a very paradise on earth–I should point to India.
–F. Max muller
২০০১ সালের ঝাড়খণ্ড সফরের উল্লেখ করে এ বইয়ের লেখা শুরু করেছিলাম। যে সফরটির কথা বইয়ের শুরুতে উল্লেখ করেছি সেটা ছিল চতুর্থবারের মত আমার ঝাড়খণ্ড সফর। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে যে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক উন্নয়ন বিপ্লব চলছে, প্রথম দুই সফরেই আমি তা টের পেয়েছিলাম। এ রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কাউন্সিল গঠনে আমি পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলাম।
চতুর্থবারের মত আমার ঝাড়খণ্ড সফরের উদ্দেশ্য ছিল এ রাজ্যের পল্লী ও বনজ সম্পদসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ উন্নয়নের বিষয়ে একটি প্রকল্প চালু করা। এ কারণে আমি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বাবুলাল মারান্ডি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী সমরেশ সিং এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সংগে বৈঠক করি। ঝাড়খন্ডের আগে আমার সফর ছিল রাচিতে। রাঁচিতে পৌঁছানো মাত্র ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আমাকে ফুল দিয়ে অভিবাদন জানাল। আমার মত একজন সাধারণ তুচ্ছ বিজ্ঞানী এবং তার স্বপ্নের প্রতি তাদের এত আস্থা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত হলাম।
এছাড়া ওই সফরের সময় আমি ঝাড়খন্ডের গভর্ণর প্রভাত কুমারের সংগে দেখা করলাম। তিনি আমাকে এ এলাকার প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিশ্রমী মানুষদের ব্যাপারে নানা তথ্য দিলেন।
তারও আগে আমি রাচি থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরবর্তী একটি পাহাড়ি গ্রামে গিয়েছিলাম। শিশুদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিষয়ক একটি প্রকল্প পরিদর্শনের জন্য প্রফেসর বসু আমাকে সেখানে নিয়ে যান। যখন আমি সেই পাহাড়ি আবাল বৃদ্ধবণিতার সংগে মাটিতে বসে কথা বলছিলাম তখন আমার পরিষ্কার মনে হচ্ছিল সেখানে আমার উপস্থিতি ছিল একেবারে ভবিতব্য। উন্নয়নের উপযোগী এক একজন সাহসী সৈনিক আমার সামনে। ওখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। সারা এলাকা জুড়ে আকাশ ছোঁয়া বৃক্ষরাজি আর ঊর্বর ফসলের মাঠ। সবচেয়ে বড় কথা হলো ওই মানুষগুলো সবাই কৃষির জন্য নিবেদিত প্রাণ পরিশ্রমী কৃষক।
তাদের চোখেমুখে যে অকৃত্রিম হাসির ঝিলিক আমি দেখেছিলাম তা সচরাচর আর চোখে পড়ে না। অন্তত এই শহুরে জীবনে তো নয়ই। তবে সেই হাসির আড়ালেও ঢের বোঝা যাচ্ছিল, বেঁচে থাকার তাগিদে সহ্যক্ষমতার চেয়ে বেশী তারা পরিশ্রম করছিল।