যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে এসেছে তারা নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তবে এসব কাজ হতে হবে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে। মিশন মুড নিয়ে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এগিয়ে না আসলে সামগ্রিকভাবে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
২০০০ সালের ১৫ অক্টোবর পোন গ্রুপের বন্ধুরা আমার জন্য একটি ওয়েব সাইটের ডিজাইন করেছিল। IISc.র অধ্যাপক বলকৃষ্ণর উপস্থিতিতে পোন গ্রুপের চেয়ারম্যান এন.আর, নারায়ণমূর্তি ওই ওয়েবসাইটের উদ্বোধন করেন। আমার কয়েকজন বন্ধু ওই ওয়েবসাইটে আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন জুড়ে দিতে বলেন। সাইটে আমার তিনটি প্রশ্ন ছিল। প্রথম প্রশ্ন হল, পঞ্চাশ বছর ধরে ভারত উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। তোমরা যারা তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থী তারা উন্নত ভারত গঠনে কী কী করণীয় আছে বলে মনে করছ? দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কখন, কবে আমি ভারতের জয়গান গাইতে পারব? তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল, বিশ্বের অন্য দেশগুলো যেখানে তাদের তৈরী পণ্যের প্রশংসা করছে সেখানে আমরা কেন বিদেশের সবকিছু পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি? আমার ওয়েব সাইটে আমি উল্লেখ করেছি উত্তরদাতাদের বয়স হতে হবে ২০ বছরের নিচে। কয়েকদিনের মধ্যে দেশের ও দেশের বাইরে থেকে শতাধিক উত্তর ও পরামর্শ পাওয়া গেল। এদের মধ্যে পাঁচটি উত্তর আমার কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে।
চন্ডিগড়ের এক তরুণ তার উত্তরে লিখেছে, আমি বড় হয়ে একজন শিক্ষক হতে চাই (বিশেষ করে প্রকৌশলবিদ্যার অধ্যাপক হতে চাই), কারণ শিক্ষকতার বিষয়টি আমার কাছে উপভোগ্য এবং আমি বিশ্বাস করি জাতির সর্বোচ্চ সেবা করার দুটি মাধ্যম রয়েছে। হয় শিক্ষকতা নয়তো সেনাবাহিনীতে যোগদান করা। পন্ডিচেরী থেকে একটি মেয়ে লিখেছে, আমি জানি একটি ফুলে মালা গাঁথা হয় না। ভারতকে উন্নত দেশে পরিণত করতে গাঁথা মালার মত অগণিত মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমিও নিজেকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করতে চাই। গোয়া থেকে ২০ বছরের এক তরুণ উত্তর দিয়েছে, ইলেক্ট্রন তার সুক্ষ্ম কক্ষপথে যেভাবে ঘুরতে থাকে, আজ থেকে আমিও আমার দেশের উন্নয়নের জন্য বিরামহীনভাবে ঘুরতে থাকবো।
আমি কবে ভারতের জয়গান গাইতে পারব?–এ প্রশ্নের জবাবে আটলান্টা থেকে এক তরুণ লিখেছে, যেদিন প্রয়োজনবোধে ভারত যে কোন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে সেদিন আমি ভারতের গান গাইব। অর্থাৎ সে তরুণ বোঝাতে চেয়েছে রাষ্ট্ৰীয় শক্তির সংগে অর্থনৈতিক শক্তি মিলিত হয়েই উন্নত ভারতভূমি গড়ে তোলা সম্ভব। প্রায় ৩০ শতাংশ উত্তরদাতা লিখেছে, আমাদের ভারতে ৩৫ বছরের কম বয়সের লোকের সংখ্যা প্রায় ৭০ কোটি। এই ৭০ কোটি জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও কর্মক্ষমতার পূর্ণবিকাশ ঘটিয়ে তাদের একতাবদ্ধ করতে পারলেই ভারত উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল শক্তি।
এখন কথা হলো তরুণ মনগুলেকে কিভাবে জাগিয়ে তোলা যাবে? জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার আগ্রহ কীভাবে তাদের মধ্যে সৃষ্টি করা যাবে? শুধুমাত্র সম্মিলিত ও একতাবদ্ধ একটি নবায়িত চেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের পুনর্জাগরণ ঘটানো সম্ভব। তারাই দুর্নীতিমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে।
দুর্নীতিহীন স্বচ্ছতা ও মূল্যায়নের শিক্ষাও আমি গান্ধীর জীবন থেকে পেয়েছি। একবার দিল্লিতে গান্ধীজির নাতি সুমিত্রা কুলকার্নির সংগে আমাকে দেখা করতে হয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সুমিত্রাজি, আপনার ঠাকুরদার এমন কোন জীবনাচরণের কথা কি আমাদের বলবেন যা আপনি সব সময় স্মরণ করেন?
তিনি উত্তর দিতে গিয়ে একটা গল্প বললেন। তিনি বললেন, আপনার মত সকলেই জানেন, তিনি প্রতিদিন সন্ধ্যায় প্রার্থনায় বসতেন। প্রার্থনার পর হরিজন সম্প্রদায়সহ অন্যান্যদের জন্য সাহায্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি জনগণের স্বেচ্ছাসেবামূলক দান গ্রহণ করতেন। গান্ধীজির সেবকদের কয়েকজন সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছ থেকে সংগৃহিত ওই সাহায্য অর্থ রাতে হিসাবনিকাশ করে রাখতেন। রাতের খাবারের আগে সারাদিনে কত অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে তা গান্ধীজিকে জানানো হত। পরের দিন ওই অর্থ ব্যাংকে জমা রাখার জন্য ব্যাংক থেকে লোক আসত।
একদিন ব্যাংকের লোক এসে গান্ধীজিকে বললেন, গতরাতে তিনি যে পরিমাণ অর্থের কথা জানিয়েছেন তার চেয়ে সামান্য কিছু কম পয়সা ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। কারণ সেবকদের একজন ওই পয়সা ধার হিসেবে রেখে দিয়েছেন। পরে তা ফেরত দেবার আশ্বাস দিয়ে তিনি ওই অর্থ গ্রহণ করেছেন। এটা শুনে গান্ধীজি সাংঘাতিক আঘাত পেলেন এবং বললেন, এ টাকা জনগণের। এ থেকে এক কানাকড়ি খরচ করারও অধিকার আমাদের নেই।
সাধারণ জীবনের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এ ঘটনা নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমরা আজ সেই গান্ধীজির দেশেই সততা ও দুর্নীতি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের সবাইকে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে স্বচ্ছভারত গড়ে তোলার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে; যেভাবে আমাদের পূর্বসূরীরা করে গেছেন। উন্নয়নের অপরিহার্য ভিত্তি হল অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা।