প্রথম ভিজিট করার পরে আমি অরবিন্দ হাসপাতালে আরও বেশ কয়েকবার গেছি। আমার চিকিৎসক ডা. নাচিয়ারের ভাই ডা. জি ভেঙ্কটস্বামী ওই হাসপাতালে কর্মরত। তিনি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। মাদুরাইয়ে গেলে প্রতিবারই ভেঙ্কটস্বামীর সংগে দেখা করি।
এবার ভেঙ্কটস্বামী ও তার কাজ সম্পর্কে একটু বলি। ২০০১ সালে অরবিন্দ হাসপাতালে শুধু বহিরাগত রোগীর সংখ্যাই ছিল ১৩ লাখ। ওই হাসপাতালের পক্ষ থেকে সে বছর ১৫শ চক্ষু ক্যাম্প করা হয় এবং প্রায় ১১ হাজার চক্ষু অপারেশন করা হয়। এ কৃতিত্বের স্বীকৃতি বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ইতিমধ্যেই তাকে দিয়েছে।
বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিখ্যাত বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এ হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নেবার জন্য আসছে।
ডা. ভেঙ্কটস্বামীর হাত দুটি স্বাভাবিক না থাকলেও তিনি অস্ত্রোপচারে অপ্রতিদ্বন্দী অবস্থানে চলে এসেছেন। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় তার হাতের কয়েকটি আঙুল আথ্রাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শুকিয়ে কুঁকড়ে যায়।
একদিন আলোচনার সময় তিনি জানালেন, একদিন দিল্লি থেকে একজন শিল্পপতি ভেঙ্কটস্বামীর কাছে এসে বললেন, আমি দিল্লিতে নতুন একটি হাসপাতাল বানাতে চাই। আপনার হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনি কি আমাকে এই নতুন হাসপাতাল তৈরীতে সহায়তা করবেন? ডা, ভেঙ্কটস্বামী তাকে বললেন, আপনার অগাধ অর্থ রয়েছে। ইচ্ছে করলে এখনই তো কাজ শুরু করতে পারেন। কেন করছেন না? শিল্পপতি বললেন, না, আমি ঠিক এই অরবিন্দ হাসপাতালের মডেলে হাসপাতালটি করতে চাই। এখানকার লোকজন, চিকিৎসকরা অত্যন্ত আন্তরিক। তারা অর্থের চেয়ে মানুষকে বেশী সম্মান করে বলেই আমার মনে হয়েছে। আমি নতুন হাসপাতালে এখানকার আবহ প্রতিস্থাপন করতে চাই।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায়ও তাই মনে হয়েছে। অরবিন্দ হাসপাতালে থাকাকালীন আমি দেখেছি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সেখানকার চিকিৎসকরা কীভাবে আন্তরিকতার সংগে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছে।
চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি কৃষির মত আরও অনেক ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সমন্বিত প্রয়োগ আমরা অদূর ভবিষ্যতেই দেখতে পাব। কিন্তু সমস্ত কর্মপরিকল্পনার পূর্বশর্ত হতে হবে জনকল্যাণ ও তাদের অভাব মেটানো।
সমৃদ্ধ প্রজন্ম এবং সমৃদ্ধ নিরাপত্তা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ–এই বিবেচনাবোধ ধারণ করতে পারলেই আমরা উন্নত ভারতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বুঝতে পারবো। জনগণের শ্রম ও ঘামের সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করে সে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।
ভারতের ১৩ জন বৈষ্ণব কবির অন্যতম তামিল মহিলা কবি আন্দাল তার তিরুপ্লাভাই কবিতায় ঈশ্বরের প্রতি আহ্বান করেছেন ঈশ্বর যেন এ ধরীত্রীতে নিনগাথা সেলভাম (সম্পদের বৃষ্টি) বর্ষণ করেন। তার এ সম্পদের বর্ষণ হতে পারে শুধুমাত্র সবাই একত্রিত হয়ে উন্নতির ক্ষেত্রে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করলেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আলাদা আলাদাভাবে তাদের স্ব স্ব মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার অনুমোদন করছে। তা না করে যদি কয়েকটি মন্ত্রনালয় একত্রিত হয়ে বহুমুখী পরিকল্পনা অনুমোদন করে তাহলে তার ফলাফলও হবে বহুমুখী। আরও শক্তিগুলো এক হচ্ছে বেশী মানুষ বেশী সেবা পাবে। এজন্য দরকার সমন্বিত পরিকল্পনা। ঠিক একইভাবে অন্যান্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। যৌথ ও সমন্বিত উপায়ে ভারতের সর্বস্তরের উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত হলে ভারত দ্রুত উন্নত বিশ্বের সারিতে চলে আসবে।
উন্নত দেশের আরেকটি প্রধান উপজীব্য হল সে দেশের শিল্পকারখানা গুলোকে বিশ্ববাজারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সক্ষম হতে হবে। শুধু দেশের বাজারে প্রাধান্য বিস্তারের চিন্তা মাথায় রাখলে হবে না। বিশ্ববাজারের কথা চিন্তা করে এদেশের শিল্প কারখানাগুলোকে দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন করতে হবে।
জিডিপির ক্ষেত্রে এই রফতানীযোগ্য পণ্যের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। উন্নয়নের জন্য ভারতের এটা অতি অবশ্য জরুরী হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতকে প্রমাণ করতে হবে যে উন্নত দেশগুলোর মত পণ্য উৎপাদনে অভিনবত্ব আনার সক্ষমতা তার রয়েছে। এতে স্থানীয়ভাবেই আমরা বহুজাতিক পণ্য উৎপাদনে সক্ষম হব।
সত্যিকার উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য আরেকটি জিনিস দরকার। সেটি হল বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ভাষা ও শিক্ষা অর্জনের সক্ষমতা। এটি উন্নয়নের জন্য একটি মৌলিক চাহিদার পর্যায়ে চলে এসেছে। শিক্ষার মাধ্যমে একটি বিপুল শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরী করতে হবে যারা বিশ্ববাজারের সর্বশেষ প্রযুক্তি ও সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে পারে।
বর্তমানে দুঃখজনক হলেও সত্য ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে এখনও ব্যাপক ফারাক রয়ে গেছে। বহু শিক্ষার্থী আছে যারা উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করতে চায় কিন্তু সে অনুযায়ী এদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একেবারেই কম। এজন্য সুদক্ষ জনশক্তি এদেশের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, পরিবেশ প্রকৌশলবিদ্যা এবং প্রস্তুতকরণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতে উচ্চশিক্ষার মান আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। মুক্ত অর্থনীতির ক্ষেত্রে এ শিক্ষার ক্রমাগ্রগতি মোটেও প্রতুল নয়। আরও উন্নত সমাজ ও শিল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আরও শক্তিশালী ও উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া দরকার।