টাটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মি. রতন টাটা নেমন্তন্ন করেছিলেন। পুনের টেলকো পরিদর্শনের। বিশেষ করে পুরোপুরি ভারতীয় একটি গাড়ি ইন্ডিকার ডিজাইন, উন্নয়ন ও তৈরির চ্যালেঞ্জ দেখার জন্য। পরিদর্শনের সূচি আমাকে পুলকিত করে। আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবো বলে ভাবলাম যা অনেক জায়গায় আমি জিজ্ঞাসা করেছি এর আগে।
১৯৮০ সালে আইএসআরওতে আমাদের টিম উৎক্ষেপণ করে স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেইকল আর রোহিনীকে স্থাপন করে কক্ষপথে। জাতির জন্য সেটা ছিল বিশাল ঘটনা। ৪ জানুয়ারি ২০০১ সালে আমি প্রথমবারের মত দেখি প্রটোটাইপ ফাইটার এয়ারক্র্যাফট– লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফট (এলসিও)। এর ডিজাইন ও উৎপাদন করেছিল অ্যারোনটিকাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সি (এডিএ)।
যানবাহন উৎপাদন খাতে ভারতকে বিশ্বের অন্যতম দেশ হিসেবে গড়ে তোলার তার স্বপ্নের কথা বললেন রতন টাটা আমাকে সেই পরিদর্শনের সময়। তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন দেশ থেকে গাড়ি তৈরির ইউনিট গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন টাটা। বর্তমানের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি উৎপাদনের দিকেই নজর দিয়েছিলেন তিনি, যাতে তা বিশ্বব্যাপি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম হয়। এটা সুন্দর একটা আইডিয়া। আমি আরেকটু যোগ করব যে, প্রথম ধাপ হিসেবে ভারতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ একটা কনসরশিয়ায় রূপান্তরিত হওয়া, তারপর তা বহুজাতিক কোম্পানি হয়ে উঠতে পারে।
আমি যেসব জাতীয় কর্মকান্ডের কথা উল্লেখ করেছি সেগুলোর অভিজ্ঞতা শুনতে আমাকে ও আমার টিমকে একগুচ্ছ বৈজ্ঞানিক, শিল্প, শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান দাওয়াত করত। মুম্বাইতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপকালে আমাকে একটা প্রশ্ন করা হয়েছিল যা আমার কানে বাজে আজও।
ড. কালাম, ভারত নিজের এসএলভি ও স্যাটেলাইট নিজেই নির্মাণ ও উৎপাদন করতে পারে দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তাছাড়া কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র, পারমাণবিক অস্ত্র ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে পারে দেখেও আমরা আনন্দিত। আপনি কি আমাকে বলতে পারেন, ভারত কবে নিজের ইঞ্জিনযুক্ত যাত্রীবাহী বগি তৈরি আর উৎপাদন করতে পারবে? যখন আমি টেলকোতে পরিদর্শন করি আর আমাকে বলা হয় যে এ কোম্পানি বার্ষিক প্রায় ৬০ হাজার গাড়ি তৈরি করছে, তখন আমার ওই প্রশ্নটা আবার মনে পড়েছিল। শুধু যে প্রশ্নটার উত্তর প্রত্যক্ষ করছিলাম তাই নয়, বরং আমাদের দেশের প্রযুক্তিগত শক্তির ছবিটাও দেখতে পাচ্ছিলাম।
একটা ধারণার বাস্তব আকার গ্রহণ দেখার একটা সুযোগও আমি পেয়েছিলাম উইপরোর আমন্ত্রণে ব্যাঙ্গাললারে একটা ভ্রাম্যমাণ হার্ট কেয়ার ক্লিনিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে। সেটা ২০০০ সালের অক্টোবর মাসের কথা। এটা ছিল উইপরো-জিই, কেয়ার ফাউন্ডেশন ও ক্লেইনজেইডস-এর একটা সহযোগিতামূলক উদ্যোগ। আমার বন্ধু অরুণ তিওয়ারী এবং আমি এই প্রকল্পের ধারণাটা প্রথম চিন্তা করেছিলাম। উদ্বোধন শেষে আমি উইপরো-জিই সেন্টার পরিদর্শন করি–
অগ্রসর প্রযুক্তির সাহায্যে তারা তৈরি করে বিশেষায়িত চিকিৎসা সরঞ্জাম। আমি প্রবেশ করা মাত্রই এক তরুণ এগিয়ে এল আর আমার শার্টে পিন দিয়ে জাতীয় পতাকা এঁটে দিল। আমি করমর্দন করে তাকে বললাম, ওহে তরুণ, তুমি কী এই দেশের জন্য থাকবে আর কাজ করবে? . সে উত্তর দিল, ড, কালাম, ডায়াগনসিসের কাজে ব্যবহৃত চিকিৎসা
সরঞ্জামের ওপর কাজ করছি আমি। ওটাই আমার পেশা। আমি এমন এক পেশার সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ যেখানে বেদনা প্রশমনের চেষ্টা করা হয়। আমার প্রয়োজন এখানেই। আমি তার উত্তরে উৎফুল্ল হলাম।
অনুষ্ঠানের শেষে উইপনোর প্রধান আজিম প্রেমজী আমার সঙ্গে ডিআরডিওর অতিথিশালায় এলেন। আসার পথে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কর্নাটকের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতার জন্য তিনি কীরকম চেষ্টা করেছেন যাতে আরও অধিক বাচ্চা ছেলেমেয়েদের শ্রেণীকক্ষে নিয়ে আসা যায়।
অতিথিশালায় চা পান করার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যবসাজগতে উইপরো সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছল কীভাবে?
প্রেমজী স্মরণীয় উত্তর দিলেন, ড. কালাম, তিনটি বিষয় আমার মাথায় ছিল। এক : প্রজন্মের ঘাম আর টিমের কঠোর শ্রম। দুই : উইপরোতে আমরা কাজ করি ক্রেতার আনন্দের জন্য। তিন : ভাগ্য। প্রথম দুটি অর্জিত না হলে তৃতীয়টির অস্তিত্ব থাকত না।
এসব প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা একটি সুতোয় মিলে যায়। তাহল, আমরা উচ্চ প্রযুক্তি প্রচলন করতে সমর্থ। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের উপস্থিতি, মেধাবী সমাজ নেটওয়ার্কের সামর্থ আর তারুণ্যের দীপ্তিমান হৃদয় : একটা জ্ঞানের সমাজ বিনির্মাণে এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
যোগসূত্র মহাঋষি পতঞ্জলি বলেছেন, তুমি যখন কোনও মহৎ উদ্দেশ্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত, তখন তোমার সব ভাবনার বাধ ভেঙে যায় : তোমার মন সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে যায়, সবদিকে প্রসারিত হয় তোমার চেতনা, আর তুমি নিজেকে খুঁজে পাও এক নতুন, বিশাল বিস্ময়কর বিশ্বে। ধীশক্তি আর প্রতিভা জীবন্ত হয়ে ওঠে, এবং তুমি স্বপ্নে নিজেকে যতটা বড় বলে ভাব তার চেয়েও বেশি বড় দেখতে পাও নিজেকে।
আমাদের সবার জন্যই এই বাণী। জনগণই একটা দেশকে মহান করে তোলে। তাদের চেষ্টার দ্বারা জনগণ নাগরিকে পরিণত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ দীপ্তিমান হৃদয়, আর আমাদের জাতির এক বিলিয়ন হৃদয় অবশ্যই এক বিশাল শক্তি– যা ঝংকৃত হওয়ার অপেক্ষায়।
৭. শক্তিগুলো এক হচ্ছে
৭. শক্তিগুলো এক হচ্ছে