.
নিদ্রাভঙ্গের পর এই স্বপ্নদৃশ্য আমার মগজে স্থির হয়ে রইল। আমি জানি বিশ্ব ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে সত্য আর ন্যায়ের শক্তিমানুষের জীবনকে সুখী আর স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোেলার জন্য কিভাবে সংগ্রাম করেছে। এই ইতিহাসই আমাদের দেখিয়েছে এই মানুষের হাতেই কী ভয়ঙ্কর বিধ্বংসী শক্তি রয়েছে। গান্ধীর মত বহু সাধক ও মুনিঋষি আমরা পেয়েছি যারা এক মহান ত্যাগের জীবন কাটিয়ে গেছেন। পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরমাণু-বোমার আঘাতে নগর বসতি ধ্বংস হয়ে কোটি কোটি মানুষকেও আমরা মরতে দেখেছি।
বসনিয়ার যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মরতে দেখেছি। ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘর্ষে অগনিত মানুষ মরেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্যভবন সন্ত্রাসীদের অভিনব হামলায় ধ্বসে যেতে দেখেছি। আমাদের এই ভারতের ভূগোলে একটি বহুজাতিক কোম্পানীর অসাবধানতার কারণে সংঘটিত গ্যাস বিস্ফোরণে ৩০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। কাশির উপত্যকায় চলমান সংঘর্ষে নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পার্লামেন্ট ভবনে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে দেশকে নিষ্ক্রিয় করতে চেয়েছিল। এ সংঘাতের শেষ কোথায়? আমাদের নিজেদের ধ্বংস করতেই কি আমরা ক্রমাগত ধ্বংসের পথে যাচ্ছি?
না, এই ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মুক্তির জন্য আমাদের চূড়ান্ত সমাধানের পথ এখনই খুঁজতে হবে।
.
কয়েক বছর আগে দি ট্রি অব লাইফ বা জীবনবৃক্ষ শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলাম–
আমার সৃষ্টির মাঝে মানুষ তুমিই তো সেরা
তুমিই থাকবে বেঁচে, বাঁচবে তুমি
যতক্ষণ তুমি যুথবদ্ধ, ততক্ষণ ক্রমাগত দিয়ে যাবে তুমি
সুখে আর দুঃখে
আমার শ্রদ্ধা জন্মাবে তোমার আত্মায়
ভালোবাসা অনাদি এক স্রোতবহমান ধারা
সেই তো চূড়ান্ত লক্ষ দীপ্ত মানবতার–
হররোজ, প্রতিদিন দেখ সেই জীবনতরু
মানুষ, তুমি সৃষ্টির সেরা
জানো আরো জানো, তুমি নিজেকে জানো।
মহাকালের বিভিন্ন সময়ে, পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে জন্ম নেওয়া ক্ষণজন্মা পাঁচ পুরুষোত্তমকে আমি স্বপ্নে আবিষ্কার করেছি। এই আধুনিক বিশ্বে খুব কম মানুষের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে যারা প্রকৃত মানব মনের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে পারেন। একবার একটি ছোট শিশু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল আমি মহাভারত পড়েছি কিনা, আর যদি পড়ে থাকি তাহলে এর কোন চরিত্রটি আমার ভাল লেগেছে। মহাভারতের বহুমুখী মহাকাব্যিক চরিত্রগুলো মানব প্রকৃতির বিভিন্ন দিকের প্রতিনিধিত্ব করে। ভালো ও মন্দ দুটোরই প্রতিনিধিত্ব করে ওই চরিত্রগুলো। আমি শিশুটিকে বললাম, মহাভারতের বিদুর চরিত্রটি আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছে।
এই চরিত্রটি রাজ্য পরিচালকের ভুল ও অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করার সাহস দেখিয়েছে এবং যখন অধর্মের উৎপীড়নের কাছে সকলে নতিস্বীকারে উদ্যত হয়েছিল তখন বিদুরই তাদের মতের বাইরে যাবার সাহস দেখিয়েছে।
আজ আমাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজন বিদুরকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। এমন আলোকিত মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। এমন আলোয় আলোকিত হওয়ার আশাও আজ দুরাশায় পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের সামাজিক ও প্রাত্যহিক জীবনে হতাশাই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। আমি বুঝতে পারি তুচ্ছ আর হীন আলোচনা, অহমিকা, ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা, হিংস্রতা, লালসা, ভয়, উদ্বিগ্নতা, মোহ আমার ভেতরে এক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়।
.
আমার জীবনের প্রধানতম লক্ষ্য ভারতের ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে সত্যিকার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটাতে সহায়তা করা, আমার সমস্ত কাজ এমন কি আমি নিজেও নিজেকে একাজে সমর্পন করেছি। আমার সব সায়েন্টিফিক ক্যারিয়ার, আমার বিশেষজ্ঞদল, আমার পুরস্কার-সম্মাননা সব এ লক্ষ্যের কাছে গৌণ। শিশুদের উজ্জ্বলতায় আমার সমস্ত সত্তা বিলীন করতে, তাদের আনন্দময় রাজ্যে আত্মসমর্পণ করতেই আমার যাবতীয় প্রত্যাশা পূর্ণতা পায়।
একজন মানুষকে সারাজীবনে কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। ড. ওয়াইন ডব্লিউ ডায়ার তার মেনিফেস্ট ইয়োর ডেস্টিনি বইতে মানবজীবনকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। তার ভাষায় জীবনের এই চারটি স্টেজ হলো অ্যাথলেট স্টেজ বা ক্রীড়াণক পর্যায়। ওয়ারিওর স্টেজ বা সগ্রামী পর্যায়, স্টেটসপার্সন স্টেজ বা দায়িত্বপ্রধান পর্যায় এবং স্পিরিট স্টেজ বা আধ্যাত্মিক তেজস্বী পর্যায়। আমার মনে হয় একটি জাতি ও মানুষের মত পরিবর্তনমূলক। আমি এ সাদৃশ্যটাকেই শিশুদের কাছে ব্যাখ্যা করি।
প্রথমত, অ্যাথলেট স্টেজে একটি জাতি সংগ্রাম ও সংঘাত থেকে মুক্ত থাকে। এই সময়টা জাতীয় কৃতিত্ব প্রদর্শন ও সাফল্য অর্জনের সময়। এ বিষয়টির প্রতিফলন ঘটেছে জাপান, সিংগাপুর ও মালয়েশিয়ায়।
.
জাতি যখন এ পর্যায় অতিক্রম করে, স্বাভাবিকভাবেই সে সগ্রামী পর্যায় বা ওয়ারিওর স্টেজে প্রবেশ করে। অর্জিত সাফল্য সামনে নিয়ে ওই গর্বিত জাতি তখন অন্যদের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য সংগ্রাম শুরু করে। হয়তো তার জন্য তাকে অন্য জাতির ওপর অভিযানও চালাতে হয়। দম্ভ ও অহমিকা তখন হয়ে ওঠে ওই জাতির চালিকা শক্তি। এ পর্যায়ে এসে সে জাতির মানুষ অন্যদের সংগে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নামে এবং দ্রুত সাফল্য অর্জনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যক্তি ক্ষেত্রে এ পর্যায়টি ডায়ারের মতে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। নিজের প্রাধান্য অন্যকে মেনে নিতে বাধ্য করাই এ পর্যায়ের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে ওঠে।