উন্নতি ও ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে চিরকালই জ্ঞান অপরিহার্য অংশ হিসেবে কাজ করছে।
জ্ঞান অথবা শিক্ষার ধর্মই হল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া। পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে জ্ঞানের আদান-প্রদান চর্চা হয়ে আসছে। এ আদান-প্রদান যে শুধু গুরু-শিষ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তা নয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে আশা শিক্ষার্থীরা ভারতীয় জ্ঞান আত্মস্থ করছে। পরবর্তীতে তারা সে জ্ঞান ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
অজস্র প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য আর প্রতিদ্বন্দ্বীতাসক্ষম পরিবেশে ভারত বহু পূর্ব থেকেই বিভূষিত। কিন্তু আমাদের এই সুযোগ সুবিধা আর প্রাকৃতিক সম্পদরাশি অবিন্যস্ত, ছড়ানো ছিটানো। গত শতকে শুধু কায়িক শ্রমনির্ভর কৃষিব্যবস্থা থেকে আধুনিক বিশ্ব শিল্প ভিত্তিক সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে যেখানে প্রযুক্তি, আধুনিক ব্যবস্থাপনা এবং শ্রমের সমন্বয় ঘটিয়ে পণ্যের সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়।
প্রযুক্তি ভিত্তিক এই কৃষি ব্যবস্থাপনার সামনে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের কৃষিপণ্য দাঁড়াতে পারেনি। একুশ শতকে এসে একটি নতুন সমাজ ব্যবস্থার উদ্ভব হচ্ছে যেখানে মূলধন এবং শ্রমের পরিবর্তে মেধাকে প্রাথমিক উৎপাদন উপকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আমাদের মেধাকে সার্বিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে এই মেধাই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়নের অন্যান্য সহযোগী বিষয়কে সমৃদ্ধ করবে। মেধাসম্পন্ন শিক্ষা অবকাঠামো সৃষ্টি এবং তা সামাল দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করলে আমাদের উৎপাদনের পরিমাণও গুণগতমান বাড়বে। উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা সক্ষম পণ্য উৎপাদনের কোন বিকল্প রাস্তা নেই। একটি জাতি কতখানি মেধা সৃষ্টি করতে পারছে এবং সেই মেধাকে কাজে লাগাতে পারছে তার ওপর ভিত্তি করেই জাতিটি নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমাজ কীনা তা বিচার করা হয়।
নলেজ সোসাইটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। এর একটি হলো উন্নত সমাজ ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং অগ্রসর প্রজন্ম।
উন্নত সমাজ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য দরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং প্রশাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো। এগুলোর উন্নয়ন ঘটানো গেলেই কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো ও সর্বোচ্চ উৎপাদন বাড়ানো যাবে। একই সংগে গ্রামোন্নয়ন সম্ভব হবে।
দেশের জন্য অগ্রসর প্রজন্মের প্রধান কাজ দেশের বিক্ষিপ্ত সম্পদকে এ করা। নলেজ সোসাইটি হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য কয়েকটি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে টিআইএফএসি। সেগুলো হল তথ্য প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, স্পেস প্রযুক্তি, ওয়েদার ফোরকাস্টিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন এবং টেলিএডুকেশন। এ সমস্ত ক্ষেত্রগুলো দাঁড়িয়ে গেলে দেশে বহুমুখী প্রযুক্তি এবং যুৎসই ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো তৈরী হবে; এ দুয়ের সম্মিলিত উদ্যোগ আমাদের নলেজ সোসাইটি গঠন করতে সক্ষম হবে।
২০২০ সালের মধ্যে ভারতকে বিশ্বের শক্তিশালী মেধাবী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার মিশন হাতে নিতে হবে। যখন ভারত উন্নত সমাজপ্রবর্তন ও মেধাবী প্রজন্ম গঠনের দ্বিমাত্রিক মিশনে সফল হবে তখন নলেজ সুপার পাওয়ার হিসেবে তৃতীয় আরেকটি মাত্রা যোগ হবে। তখন ভারতের মিশন হবে নলেজ প্রোটেকশন বা মেধা সংরক্ষণ এবং এটিই সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ মিশন।
আমাদের কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এবং ইনফরমেশন জেনারেটরকে ইলেক্ট্রনিক বা অনলাইন হামলা থেকে রক্ষা করা চরম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন সার্বক্ষণিক মনিটরিং।
তখন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। একইভাবে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য ও জ্ঞানকেও আমাদের সম্পদ হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।
মনিপাল একাডেমি অব হায়ার এডুকেশনের আয়োজনে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে তারা আমাকে, সবুজ বিপ্লবের জনক সি, সুব্রামানিয়াম ও খ্যাতিমান আইনজীবী এন.এ.পালখিভালাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে নব্বই বছর বয়েসি সুব্রামানিয়ামের সঙ্গে কথা বলেছিলাম তার দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব সম্পর্কে। তিনি একটা জাতীয় কৃষি ফাউন্ডেশন বিষয়ে তার স্বপ্নের কথা মেধাবী সমাজ বলেছিলেন আমাকে, যেখানে উৎপাদন করা হবে হাইব্রিড বীজ। তার ফাউন্ডেশন পৃষ্ঠপোষকতা দেবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের এবং তাদের মৃত্তিকা পরীক্ষার জন্য গবেষণাগারের সুবিধা দেবে আর আবহাওয়া ও বাজার সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করবে। যাতে করে তারা উৎপাদিত ফসলের ভাল মূল্য পায় এবং অধিক পরিমাণ অর্থ উপার্জন করতে পারে। এই স্কিমের অধীনে দশ লাখ চাষীকে নিয়ে আসার লক্ষ্য তার। স্বপ্নদ্রষ্টারা বুড়ো হন না!
আরেকবার আমি কথা বলছিলাম কৈম্বাটুরের নিকটবর্তী পল্লাচিতে অবস্থিত ড. মহালিঙ্গম কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। মহান শিল্পপতি ও অ্যাকাডেমিসিয়ান ড. এন. মহালিঙ্গম বসে ছিলেন আমার পাশেই। কৃষি, রসায়ন ও টেক্সটাইল শিল্পের মাধ্যমে দেশ কীভাবে সমৃদ্ধশালী হতে পারে সে কথাই তিনি বলছিলেন আমাকে। শিল্পকারখানা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে তার সাফল্যে অভিভূত হয়ে আমি বিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আপনার পরবর্তী মিশন কী? এ কথা বলার পর আমি উপলব্ধি করলাম যে প্রশ্নটা করছি এমন একজনকে যার বয়স প্রায় আশি বছর!