তাদের বিবাহিত নারীরা মঙ্গলসূত্র পরার কারণে, তাদের পুরুষেরা কেরালা স্টাইলে ধুতি পরার কারণে কি তাদের খ্রিস্টানত্ত্ব খাটো হয়ে গেছে? কেরালার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে, অ্যান্টনি নব্য তান্ত্রিক নন কারণ তিনি এবং তার সম্প্রদায়ের লোকজন এখন কেরালার সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছেন। খ্রিস্টান হওয়ায় তিনি সেখানে ম্লেচ্ছ হয়ে যাননি। বরং এটা তার ভারতীয়ত্বে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ আর রহমান একজন মুসলমান হতে পারেন কিন্তু তিনি যখন গেয়ে ওঠেন বন্দে মাতরম্ তখন তার সে সংগীত ভারতের প্রত্যেকটি মানুষের মনে অনুরণনের সৃষ্টি করে, তা তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন।
কিন্তু আমাদের একতাবদ্ধতার চেতনা ও লক্ষ্য অর্জনের চেতনার ক্ষেত্রে সেই সকল মতাবলম্বীরা সবচে বড় বাধা যারা মানুষের মধ্যে বিভেদ ঘটাতে চায়। প্রত্যেকটি নাগরিককে সমান নিরাপত্তার ছত্রছায়ায় রাখার অঙ্গীকার নিয়ে ভারতের সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এখন ধর্মীয় চেতনার অপব্যবহার করে গণমানুষে বিভাজন তৈরীর যে চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা সত্যিই উদ্বেগজনক। কিন্তু কেন আমরা সংস্কৃতিকে (ধর্মকে নয়) আমাদের ঐতিহ্যের খাতিরে ধারণ করে একতাবদ্ধ হচ্ছি না? বিভেদ ভুলে যাবার সময় এখন আমাদের সামনে। এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত কী করে আমরা এক হতে পারব তার উপায় খুঁজে বের করা।
আমাদের গৌরবময় অতীত আমাদের সংগে প্রবহমান। এটি আমাদের শুদ্ধ বিশ্বাসে পরিচর্যা করতে হবে। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে তা ধ্বংস করলে চলবে না।
উন্নত ভারতের লক্ষ্য শহরে শহরে এ দেশটা ছেয়ে ফেলা নয়। বরং প্রযুক্তিকেন্দ্রীক টেলিমেডিসিন, টেলিএডুকেশন আর ই-কমার্স চালুর মাধ্যমে এ গ্রামগুলোকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসা।
কৃষিবিজ্ঞান ও শিল্পোন্নয়ন এবং জৈবপ্রযুক্তি ও জৈববিজ্ঞানের সমন্বয় থেকে নতুন ভারতের উদ্ভব হবে। সে ভারতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই চেতনা ধারণ করে তাদের কাজ করবে যে ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলের স্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। এতে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য হ্রাস পাবে। গ্রামে আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তি সুবিধা পৌঁছে গেলে শহরপ্রিয় মানুষও গ্রামের উন্নত দ্রব্য সামগ্রীর জন্য গ্রামের দিকে মনোযোগী হবে।
এই লক্ষ্য অর্জনে এখন সবচেয়ে বড় প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বে গঠনমূলক পরিবর্তন আনা এবং উন্নয়নকামী রাজনীতিক তৈরী করা যাদের ভবিষ্যত উন্নয়নের স্বপ্ন রয়েছে। ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের, বিভিন্ন ধর্মের প্রায় ১শ কোটি লোক বাস করে। বিচিত্র ভৌগলিক সমাজ কাঠামো ও বিভিন্ন দর্শনে বিশ্বাসী এখানকার মানুষ। কিন্তু এটা আমাদের জন্য নেতিবাচক নয়। এই বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষেই এক অসাম্প্রদায়িক একতাবদ্ধ ভারত গড়ে তুলতে হবে।
৬. মেধাবী সমাজ
৬. মেধাবী সমাজ
Wisedome is a weapon to ward off destruction; It is an inner fortress which enemies can not destroy.
— Thirukkural 421 (200BC)
প্রাচীন ভারতবর্ষ ছিল তৎকালীন বিশ্বের সর্বাধুনিক শিক্ষিতদের দেশ। আগ্রাসন ও উপনিবেশের ধ্বংসাত্মক শোষণে সেই ভারতবর্ষের আদি প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। একই সংগে ধ্বংস হয় সম্মিলিত মানুষের বৃহত্তর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এ অঞ্চলের মানুষকে বহু বছর ধরে সুপরিকল্পিতভাবে নিম্নস্তরের সমাজে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার সময় আমাদের তরুণদের মনমানসিকতা এত নিম্নমুখী পর্যায়ে চলে এসেছিল যে দুটো ডালভাত খেয়ে কোন রকমে জীবনযাপন করার চেয়ে বড় কোন আকাঙ্ক্ষাই তারা করতে পারত না।
ভারত ঐতিহাসিকভাবেই আধুনিক জ্ঞানের পীঠস্থান। সেই জ্ঞানের ঐতিহ্য আবার ভারতকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। যেদিন ভারত তার গৌরবময় ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার লাভে সক্ষম হবে সেদিন একটি উন্নত দেশের সার্বভৌমত্ব, উন্নতমানের জীবন ব্যবস্থা অর্জনে ভারতবাসীকে বেশী বেগ পেতে হবে না।
শিক্ষা বা জ্ঞানের হরেক রকম আঙ্গিক, নানা ধরনের আদল রয়েছে। প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতি, তথ্য সংগ্রহ, বুদ্ধিমত্তা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। আমরা জ্ঞানার্জন করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছ থেকে, লাইব্রেরী থেকে, গবেষণাপত্র থেকে, সেমিনারের আলোচনা থেকে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠন ও কর্মক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিক, ব্যবস্থাপক, কর্মচারিদের ড্রইং, প্রসেস শীট থেকে এমনকি দোকানের মেঝে থেকেও জ্ঞান অর্জিত হতে পারে। যদিও জ্ঞান অর্জনের সাধারণ ক্ষেত্র বলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ভাবা হয়। এর মেধাবী সমাজ পাশাপাশি শিল্পী, ভাষ্কর, হেকিম, বৈদ্য, দার্শনিক, সাধক, কবি– এদের কাছ থেকেও সমানভাবে জ্ঞান আহরণ করে মানুষ। সার্বিক জ্ঞান মানুষকে সর্বোচ্চ কৃতিত্ব প্রদর্শনে সক্ষম করে তোলে।
গ্রন্থাগার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেমন আমাদের জ্ঞান আহরণের উৎস তেমনি আমাদের ঐতিহ্য ও ইতিহাস, আমাদের প্রত্নতত্ত্ব ও মহাকাব্যও আমাদের কাছে এক একটা বিশাল লাইব্রেরী। আমাদের অজ গ্রামগুলোতেও বহু গোঁড়ামিহীন জ্ঞানের বিষয় রয়েছে। আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ, আমাদের সুবিশাল মহাসাগর, আমাদের মরুভূমি আর বৃক্ষ ও প্রাণীজগতের জীবন প্রণালীর মধ্যে সীমাহীন গুপ্ত জ্ঞানের ঐশ্বর্য রয়ে গেছে। আমাদের দেশের প্রত্যেক রাজ্যেরই নলেজ সোসাইটি বা সুশীল সমজ হিসেবে নিজেদের গড়ার মত অন্তস্থ যোগ্যতা রয়েছে।