গত ৩ হাজার বছর ধরে ব্রিটিশ, ফরাসী, ডাচ, পর্তুগীজসহ আরও বহু জাতির দ্বারা ভারত উপনিবেশিকতার শিকার হয়েছে।
এদের কেউ এসেছে তাদের রাজ্যসীমা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, কেউ এসেছে ধর্মীয় মতাদর্শ সম্প্রসারণের ফিকির নিয়ে, আবার কেউ এসেছে ভারতবর্ষের সম্পদ চুরি ও লুটপাট করে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ভারত কেন কোনদিন অন্যদেশে উপনিবেশ গড়েনি? এর কারণ কি এটা যে আমাদের রাজ্য শাসকরা সাহসী ছিলেন না? না। এর মূলকারণ ভারতবাসী চিরকালই একটি সহিষ্ণু জাতি। তারা কোন কালেই অন্য দেশে অভিযান চালিয়ে পরভূমে উপনিবেশ গড়তে চায়নি।
কিন্তু সুদীর্ঘ সংগ্রামের পর যখন আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, যখন ভারতের মানুষ এক হয়েছে, যখন আমরা একটি ভৌগলিক সীমারেখা সৃষ্টি করতে পেরেছি তখন শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নকেই কি আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে স্থির করতে পারি। আমাদের এদেশের শক্তি প্রদর্শনের একটিই পথ খোলা আছে। সেটি হল আমাদের প্রমাণ করতে হবে আত্মরক্ষার পূর্ণ সামর্থ্য আমাদের রয়েছে।
বলবান চিরকাল বলবানকেই সম্মান করে, দুর্বলকে নয়। রাষ্ট্রীয় শক্তি মানেই সামরিক সক্ষমতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ও পলিসি সেই সব দেশের সেবায় নিয়োজিত যারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। ইতিপূর্বে কেন আমাদের নিরাপত্তা পরিষদের আসন দেওয়া হয়নি আর কেনই বা এখন বিভিন্ন দেশ ভারতকে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য বানানোর জন্য নিরন্তর সুপারিশ করে যাচ্ছে?
এ প্রসংগে আরেকটা ঘটনার কথা বলি। আমার বন্ধু অ্যাডমিরাল এল, রামদাস, নৌ-বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যিনি অবসর নিয়েছেন, তিনি তার সমর্থকদের একটি দল নিয়ে ১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারতের পারমাণবিক পরীক্ষার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভ করতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম তারা যেন ভারতীয় পার্লামেন্ট ঘেরাও করার আগে হোয়াইট হাউস এবং ক্রেমলিন ঘেরাও করেন, সেখানে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক ওয়ারহেড ও আইসিবিএমের পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে।
আমি আমার দেশের জনগণকে জেগে উঠতে বলি। আমার এ আহ্বান সমস্ত ভারতবাসীর প্রতি। তারা যেন তাদের সর্বোচ্চ শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কোন শক্তি একটি জাতির উত্থান অথবা পতন ঘটায় এবং কোন বিষয়গুলো একটি দেশকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলে? এটা আমাদের ভাবতে হবে।
আমার বিবেচনায় তিনটি বিষয় একটি জাতিকে সুদৃঢ় ও সংহত করে : বিগত সাফল্যের গৌরব, একতাবদ্ধতা এবং যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের সক্ষমতা।
একটি জনগোষ্ঠী অথবা জাতিকে উন্নতির শীর্ষ চূড়ায় আরোহন করতে হলে অবশ্যই তাদের অতীতের মহান নায়কদের মনে রাখতে হবে; অতীতের গৌরবময় আন্দোলন ও বিজয়কে মনে রাখতে হবে। ব্রিটিশ জাতি যদি উন্নতির চরম শিখরে উঠে থাকে তাহলে তা সম্ভব হয়েছে লর্ড নেলসন অথবা ডিউক অব ওয়েলিংটনের মত নেতাদের গৌরবময় সাফল্য ধরে রাখার আকক্ষার কারণে। জাতীয়তাবোধের দৃষ্টান্ত দিতে গেলে জাপানের নাম এক নম্বরে উঠে আসে। জাপানীরা এক মানুষ, একদেশ, এক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী একটি জাতি। শুধু এই জাতীয়তাবোধের কারণেই তারা একটি চরম অপমানজনক সামরিক পরাজয়কে আজ অর্থনৈতিক বিজয় হিসেবে রূপ দিতে পেরেছে।
পৃথিবীতে যত জাতিই উন্নতি লাভ করেছে তাদের সবাই একটি লক্ষ্যে সব সময় সচেতন থেকেছে। জাপানের মত জার্মানিদের মানুষও তাদের লক্ষ্যে অবিচল ছিল। মাত্র তিন দশকের মধ্যে জার্মানি দুদুবার ধ্বংস হয়েছে।
কিন্তু জার্মানদের উন্নতির লক্ষ্য থেকে তারা সরে আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভস্মাবশেষ থেকে জার্মানি আবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে উত্থিত হয়েছে। জার্মানি যদি এত বিপদ কাটিয়ে উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে তাহলে ভারত পারবে না কেন?
ভারতের দুর্ভাগ্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শক্তি ভারতবাসীকে তাদের অতীত সহস্রাব্দের গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে আনবার মত সুযোগ সন্ধানী চেতনা দেয়নি। গত পঞ্চাশ বছরে তাদের ভেতরে ঐতিহাসিক চেতনা কেন্দ্রীভূত করার উল্লেখযোগ্য কোন প্রচেষ্টা করা হয়নি।
হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর থেকে গত ৭০ বছর ধরে আমাদের দেশের বিভিন্ন ধর্মের মৌলিক শিক্ষা গ্রহণের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এর মাধ্যমে আমি একটা বিষয় বুঝতে পেরেছি যেকোন ধর্মেরই মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মানুষের আত্মিক উন্নয়ন সাধন করা।
বস্তুত, আমাদের বুঝতে হবে আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা থেকেই ভারতে ধর্ম নিরপেক্ষতার ভিত্তি গড়তে হবে। কারণ জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় চেতনা জাগ্রত করা প্রয়োজন। এজন্য ধর্মের সমন্বিত ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা দিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষ এক একতাবদ্ধ সমাজ গড়তে হবে। আমরা যদি অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধারণ না করে ইতিহাসের দিকে না তাকাই, যদি অনিবার্য সাফল্যের বিশ্বাস নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে না তাকাই তাহলে হতাশা, দুঃখ, অভাব আর নৈরাশ্য ছাড়া আমাদের জন্য আর কি অপেক্ষা করতে পারে?
ভারতের মূলসংস্কৃতি সময়কে অতিক্রম করেছে। ইসলামের আবির্ভাবে এ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের আগমনে এ সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে। কেরালায় বসবাসরত বহু পূর্বে আসা সিরিয়ার খ্রিস্টানরা অত্যন্ত সম্ভ্রমের সংগে ভারতীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে।