কয়েক মুহূর্ত আমিসহ সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। আমি জানতাম বিজু পাটনায়েক অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং জনপ্রিয় একজন নেতা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি রাজনীতিতে নেমেছিলেন।
আমি তার চোখের দিকে সরাসরি দৃষ্টি রেখে বললাম, স্যার, আপনার উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অবশ্যই আমরা কাজ করব। আমি আপনার ইচ্ছের কথা দিল্লিকে জানাব।
যে সময়ের কথা বলছি তখন থেকে ৪০ বছর আগে অসমসাহসী বিজু পাটনায়েক কলিঙ্গ এয়ারওয়েজের পাইলট ছিলেন। ওই সময়ে প্রেসিডেন্ট সুকর্নের সংগে তার পরিচয় হয়। সুকর্নের স্ত্রী সবেমাত্র একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেছেন।
সুকর্ণ পরিবার কন্যার জন্য ভালো একটি নাম খুঁজছেন। এমন সময় বিজুদা ওই পরিবারের সংগে দেখা করেন।
সুকর্ন এই সমস্যার সমাধানের ভার দিলেন ভারতীয় নাগরিক বিজুকে। বিজু পাটনায়েক দেখলেন আকাশে ঘন মেঘ জমেছে। এই মেঘগুলো যেন নবজাতককে স্বাগত জানাবার জন্যই হাজির হয়েছে। তিনি মেঘের সংস্কৃত প্রতিশব্দের সংগে কন্যার নাম দিলেন মেঘবতী।
সুকর্নের মেয়ের নাম মেঘবতীই স্থির হল। আর এভাবেই ১০০ভাগ মুসলিম দেশের প্রধান নেতার কন্যাশিশু একটি হিন্দু নামে পরিচিত হয়ে উঠলো। যারা মহান, যারা বড়, তাদের কাছে ধর্ম হলো বন্ধুত্ব সৃষ্টির এক মধুর পন্থা। ক্ষুদ্র মানসিকতার লোকরাই ধর্মকে হানাহানির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে।
বহু বছর পরে অনেক রাজনীতির চড়াই উত্রাই পেরিয়ে সেদিনের সেই মেঘবতী সুকর্ণপুত্রী প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং পরে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।
আমার বন্ধুরা, আমাদের এই সকল অনন্য রাজনীতিবিদরা দেশ থেকে, সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেখে আমাদের বিলাপ করা উচিত। যে ভারতের আজ বিশ্বে নেতৃত্ব দেবার কথা ছিল আজও সেই ভারত অন্ধ বিবর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। অথচ এদেশের রয়েছে ১শ কোটি মানুষের বিপুল জনশক্তি, অসংখ্য সম্ভাবনাময় শিল্প-কারখানা, রয়েছে অসংখ্য বিজ্ঞানী। এমনকি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে যেভাবে উচিত ছিল সেভাবে উন্নত দেশগুলো বিবেচনা করছে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতকে যেভাবে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে তা পৃথিবীর কোন দেশের ক্ষেত্রে হয়নি।
পোখরানে দ্বিতীয় দফা পারমাণবিক পরীক্ষার পর পশ্চিমা দেশগুলো ভারত ও পাকিস্তানকে এক পাল্লায় মাপা শুরু করলো। এতে কি আমাদের জাতীয়ভাবে প্রতিবাদ করা উচিত নয়। আমাদের কি বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে বিক্ষোভ করে বলা উচিত নয় যে পাকিস্তানের বাইরেও আমাদের চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা রয়েছে; আমরা পাকিস্তানের চেয়ে বহুগুণে সবদিক থেকে উন্নত এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল?
২০০২ সালের মার্চ মাসে আন্না ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষের প্রায় ১শ ছাত্রের মধ্যে ক্লাস নিচ্ছিলাম। প্রযুক্তি ও তার ব্যাপ্তি এ বিষয়ে পর দশদিন ক্লাস নিলাম। শেষের দিনে প্রযুক্তির দ্বিমুখী ব্যবহার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সংগে বিস্তারিত আলোচনা শুরু হল। ওদের মধ্য থেকে একটি ছাত্র দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, সম্প্রতি আমি ড. অমর্ত্য সেনের একটি বিবৃতি পড়েছি যাতে তিনি বলেছেন ১৯৯৮ সালের মে মাসে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোয় ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ হয়েছে। অমর্ত্য সেন নোবেল বিজয়ী একজন বিরাট অর্থনীতিবিদ। উন্নয়ন পরিকল্পনাকারী হিসেবে সারাবিশ্বে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। তার মত একজন ব্যক্তির এ মন্তব্য মোটেই উপেক্ষা করা যায় না। তার এ মন্তব্য সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন?
আমি বললাম, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমি ড. অমর্ত্য সেনের বিশালত্বকে শ্রদ্ধা করি এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে দ্রুত অগ্রসর করার ক্ষেত্রে তিনি সরকারকে যে পরামর্শ দিয়েছেন আমি তার অকুণ্ঠ প্রশংসা করি। ঠিক একইভাবে আমার মনে হয় ড. অমর্ত্য সেন ভারতকে দেখেছেন পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে। তার মতে ভারতের উচিত সব দেশের সংগে সদ্ভাব বজায় রাখা যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। আমি তার সংগে একমত, তবে একই সংগে অতীতের ভারতের পূর্ব অভিজ্ঞতাও মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু জাতিসংঘে পরমাণু অস্ত্র বিস্তারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং সমস্ত দেশের পারমাণবিক অস্ত্র বিলুপ্ত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর ফলাফল কি হয়েছিল আমরা তা দেখেছি। আমরা দেখেছি তার এ জানে কোন দেশ সাড়া দেয়নি। আমেরিকার মাটিতে এখন ১০ হাজার পারমাণবিক ওয়ারহেড, রাশিয়ার মাটিতে আরও ১০ হাজার। এছাড়া ব্রিটেন, চীন, ফ্রান্স, পাকিস্তানসহ আরও বহু দেশে রয়েছে হাজার হাজার ওয়ারহেড। STSART-II এবং প্রত্যেকের ২ হাজার ওয়ারহেড ধ্বংস করার ব্যাপারে রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল তা থেকেও তারা পিছিয়ে এসেছে।
ওয়ারহেড হ্রাসের ব্যাপারে কেউ এখন পর্যন্ত কোন জোরালো পদক্ষেপ নেয়নি। আমাদের মনে রাখা দরকার যে আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটি দেশ ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আছে। এসব দেখেও কি ভারত নিরব দর্শক হয়ে বসে থাকবে?