আর্টিলারির মহাপরিচালক লে. জেনারেল রমেশ খোশলা জানালেন, ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্রের আসল পরীক্ষা করতে হবে যে পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত লক্ষ্যে আঘাতের পর চারপাশের ১৫০ মিটার জায়গায় কী প্রভাব পড়ে তা জানা যাবে। টেকনিক্যাল টার্ম অনুযায়ী এটাকে বলা হয়, সিইপি (সার্কুলার এরর প্রোবাবিলিটি)।
ভূমির ওপর দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা আগে হয়নি। (ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এর আগে করা হয়েছে সমুদ্রের ওপর)।
আমরা উপযুক্ত পরীক্ষা ক্ষেত্র খোঁজার জন্য ভারতের ভৌগলিক মানচিত্র নিয়ে বসলাম। ম্যাপে দেখলাম আইটিআরের ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে বেশ কয়েকটি বিন্দুর মত দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। এগুলো আসলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ মিলে একটি ছোট দ্বীপপুঞ্জ। অনিবার্য কারণেই এ পরীক্ষার জন্য আমরা রাজস্থানের মরুভূমিতে যেতে পারছি না। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপও আইটিআর থেকে অনেক দূরে। রাত দুটোয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হল এই ছোট দ্বীপপুঞ্জের কোন একটি দ্বীপেই আমাদের মিসাইল ইমপ্যাক্ট টেস্ট হবে। সবচেয়ে ভাল পরীক্ষা উপযোগী দ্বীপ খোঁজা শুরু হল।
একটি হেলিকপ্টার পাঠানো হল এলাকা পর্যবেক্ষণের জন্য। কেউ একজন প্রস্তাব করলো জেলেদের গাইড হিসেবে নিয়ে দ্বীপগুলো সশরীরে দেখে আসা যায়।
লোকেশন সার্ভে করার প্রাথমিক দায়িত্ব পড়লো আমার দুই সহকর্মী সরসবাত ও সালবানের ওপর। তারা দুজন উড়িষ্যার ধর্ম নামের একটি জায়গায় গাড়িতে চড়ে গেলেন। সেখান থেকে সারাদিনের জন্য আড়াইশ টাকায় মাঝিসহ নৌকা ভাড়া করে ওই দ্বীপে পৌঁছলেন। কিন্তু দ্বীপে পৌঁছতেই রাত হয়ে গেল। সালবান যাত্রাপথে খাওয়ার জন্য সংগে কিছু ফল নিয়েছিলেন। তাই দিয়েই রাতের খাবার সারতে হল। দ্বীপে রাত কাটানো ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। এদিকে দুজনের কেউই সাগর অথবা মরুভূমির সংগে পূর্ব-পরিচিত নন। ফলে সারারাত ভয়ে ভয়ে নৌকোয় শুয়ে কাটিয়ে দিলেন। ভোরে উঠেই তারা ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৮শ মিটার প্রশস্ত দ্বীপটি সার্ভে করা শুরু করলেন। হঠাৎ তারা দেখলেন দ্বীপের পূর্ব পাশে একটা গাছের ওপরে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। তার নিচে বেশ কয়েকটা কুঁড়ে ঘর। এটা সম্ভবত প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে আসা জেলেদের কাণ্ড। আমার বন্ধুরা তাড়াতাড়ি সে পতাকা সরিয়ে ফেললেন।
ওরা দুজন ফিরে এসে দ্বীপটিকে পরীক্ষার উপযোগী হিসেবে রিপোর্ট করার পর পরবর্তী পদক্ষেপগুলো খুব দ্রুত নেওয়া হল। বন ও পরিবেশ কর্মকর্তারাসহ জেলাকর্তৃপক্ষ দ্বীপটি পরিদর্শন করে এলেন। খুব সহজেই দ্বীপটি অধিগ্রহণের ব্যাপারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অনুমোদন পাওয়া গেল।
বাকি থাকলো উড়িষ্যা সরকার ও বন মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর প্রক্রিয়ার কাজ। উড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রীর ডেস্কে যাতে আমাদের ফাইলটি দ্রুত পাঠানো হয় সেজন্য আমি তার অফিসের কর্তব্যরত কর্মকর্তাদের সংগে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করলাম। এছাড়া আমার জবানবন্দীতে মুখ্যমন্ত্রী বরাবরে একটি চিঠি লিখে দিলাম। ডিআরডিওর কোন কোন কাজের জন্য দ্বীপগুলো আমাদের তা চিঠিতে উল্লেখ করলাম। চিঠিতে আমি খোলাখুলিভাবেই তাকে জানালাম যে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার জন্য রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আমাদের দ্বীপটি প্রয়োজন।
মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদনের আগেই আমরা যাবতীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে রেখেছিলাম। আমাদের কাজের ব্যাপারে ছোটখাটো কিছু প্রশ্ন উঠবে জানতাম। যেমন দ্বীপগুলোর পাশে মাছ ধরা হয়, সেটা রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহৃত হলে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া কচ্ছপদের চলাচলেও বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। তাছাড়া দ্বীপের মূল্য তো চাওয়া হতেই পারে। যাহোক, ১০ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রীর সংগে দেখা করার সুযোগ পাওয়া গেল। আমি ইতিপূর্বেই মুখ্যমন্ত্রী বিজু পাটনায়েক সম্পর্কে মোটামুটি জানতাম। বিশেষ করে তার পাইলট জীবন ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুকর্নের সংগে তার বন্ধুত্বের কথা আগেই শুনেছিলাম।
মেজর জেনারেল কে, এন, সিং এবং সালবানকে সংগে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে ঢুকতেই তিনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। তিনি প্রচ্ছন্ন উচ্ছ্বাসে বললেন, কালাম, আমার বন্ধু, ড. সারাভাই থেকে এপর্যন্ত আমি সব সময় তোমার কাজের খোঁজ খবর রাখি। তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।
আমাদের সামনেই তিনি উড়িষ্যার চারটি দ্বীপই ডিআরডিও তাদের পরীক্ষার কাজের জন্য রেঞ্জ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে–এই মর্মে সরকারী অনুমোদনপত্রে সই করে দিলেন। তিনি আমার দিকে চেয়ে বললেন, কালাম, তুমি আমার কাছে যা চাইলে তা তোমাকে দিয়েছি। আমি জানি তুমি এর সদ্ব্যবহার করবে। তোমার মিশন–এই মিসাইল প্রোগ্রাম এখন দেশের জন্য সাংঘাতিক জরুরী হয়ে পড়েছে। তোমার কাজে লাগবে উড়িষ্যার এমন সব কিছু এখন থেকে তোমার। একথা বলে তিনি গভীর আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আব্দারের স্বরে বললেন, কালাম, আমাকে তোমার প্রতিশ্রুতি দিতেই হবে আর এ জাতিকে আশ্বস্ত করতেই হবে যে তুমি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভারতকে উপহার দেবে। যেদিন ভারত নিজে আইসিবিএম তৈরী করবে সেদিন একজন ভারতীয় হিসেবে আমি নিজেকে অনেক বেশী শক্তিশালী মনে করবো।