২০০২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি অবু পাহাড়ে অবস্থিত ব্ৰহ্মকুমারী আশ্রমে ঘুরে আমার কিছু ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেখানে গিয়ে শুনলাম ধাধী গুর্জর নামে এক শিবভক্তের ওপর শিব ভর করেছে। ধাধী নামের সেই মহিলা আমাদের দিকে চাইল। তার চেহারা যেন একেবারে পাল্টে গেছে। মুখ রক্তিম হয়ে গেছে। জলদগম্ভীর কণ্ঠে সে জ্ঞান, যোগ, চরিত্র ও কর্ম, এই চারটি বিষয়ে আমাদের উপদেশ দেওয়া শুরু করলো।
আমাদের মানে আমি, শিবতনু পিল্লাই, ও সিলভামূর্তি এই তিনজনকে হঠাৎ সে কাছে ডাকল। ভয়ে ভয়ে তার কাছে গেলাম। সে গম্ভীর কণ্ঠে আমাদের আশীর্বাদ করে বললো, ভারতই হবে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দেশ।
ব্ৰহ্মকুমারী একাডেমী পরিচালিত গ্লোবাল হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ করতে আসা করোনারি আর্টারি ডিজিস (সিএডি)র রোগীদের সংগে আমি দেখা করলাম। এখানে একই সংগে রোগীর শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা সেবা দানের পাশাপাশি তাদের আধ্যাত্মিক শক্তি বৃদ্ধিরও চেষ্টা চালানো হয়। আমার বন্ধু ডক্টর ডব্লিউ সিলভামূর্তি দীর্ঘদিন চিকিৎসা বিদ্যা চর্চার পর স্বীকার করেছেন, যোগ সাধনা ও ধ্যান রোগীর ব্যথা উপশমে সাংঘাতিক কার্যকর।
আমি যখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বিজ্ঞান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তখন ডিআইপিএস (ডিফেন্স ইনস্টিটিউট অব ফিজিওলজি অ্যান্ড আলাইড সায়েন্স)-এ আমি মেডিটেশনের মাধ্যমে রোগীকে আরোগ্য করে তুলতে দেখেছি। কার্ডিয়াক রোগীদের চিকিৎসা করার জন্য ডা, প্রতাপ মৃধা ও ডা. সিলভামূর্তি দুজনে মেডিটেশন সংশ্লিষ্ট এক অভিনব চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। দুবছর পরে খোঁজ নিয়ে শুনেছি অন্তত ৪শ রোগী আরোগ্যের পথে এবং ৬০ জন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।
তাদের চিকিৎসা পদ্ধতির অংশ হিসেবে তারা রোগীদের প্রতিদিন যোগ সাধনা করাতেন, উচ্চ রক্তচাপ এড়ানোর জন্য স্বপ্নমাত্রার চর্বিযুক্ত খাবার দিতেন আর রোগিদের কার্ডিওভাসকুলার ও মেটাবোলিক এফিশিয়েন্সী বাড়ানোর জন্য কোন না কোন ব্যায়াম করাতেন। আমি আশা করি চিকিৎসাবিদ্যা শুধু শারীরিক রোগ উপসর্গ দূর করার প্রবণতা ছেড়ে মনের অসুখ সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সচেষ্ট হবে।
অবু পাহাড়ের ব্ৰহ্মকুমারী একাডেমী পরিদর্শনের সময় একাডেমীতে সদ্য যোগদানকারীনী ১৩ জন ব্ৰহ্মকুমারীর সংগে বাক বিনিময় করার সুযোগ দিয়েছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের সিস্টার ঊষা। রাতের খাবার শেষে তাদের সংগে আলোচনায় অংশ নিলাম। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছিলাম তাদের জীবনের লক্ষ্য কী? তারা জবাবে বলেছিল ধর্মীয় আদর্শের পথে থেকে বাকি জীবন তারা দেশবাসীর জন্য কাজ করে যেতে চায়। তাদের কথা শুনে আমি ও ডা. সিলভামূর্তি হাজার বছর আগে লেখা তামিল ভাষার কবি আওয়াইয়ারের লেখা একট কবিতা আবৃত্তি করলাম:
মানুষ হয়ে জন্মানোটা দুঃসাধ্য বটে
খুঁতহীন জন্ম নিয়েও নিখুঁত মানুষ
কজন হতে পারে?
অঢেল জ্ঞান আর শিক্ষা পেয়েও কজন
মানুষ শিক্ষিত আর জ্ঞানী?
সবার চেয়ে কঠিনতম কাজ
সত্যিকারের পুজো আর সত্যি আরাধনা
এ কাজ যারা করতে পারে
অথবা পেরেছিল–
তাদের জন্যে স্বর্গদুয়ার–চিরকালই খোলা
স্বর্গে তারা চিরকালই মহান অতিথি।
মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা। এর পর আমি ব্ৰহ্মকুমারীদের কাছে থাম্বার বিশপের ঘটনা খুলে বললাম, কেমন করে তিনি স্পেস রিসার্চ স্টেশনের জন্য তার উপসনালয় আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। (এ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে এ ঘটনা বলেছি আমি)।
বলার পর ব্রহ্মকুমারীদের কাছে প্রশ্ন করলাম, এ ঘটনা সম্পর্কে তোমাদের মন্তব্য কী?
তারা বললো, আমাদের জাতি অনেক উন্নত। আমাদের সমৃদ্ধ সভ্যতা আমাদের উদারভাবে, সমঝোতার দৃষ্টিতে সব কিছু দেখতে শিখিয়েছে। এমন একটি সম্ভ্রান্ত জাতি হয়ে কেন আমরা বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক সংঘাতে যাবো? আমি বিশ্বাস করি যখন কোন জাতির ভবিষ্যত লক্ষ্য থাকবে না তখন সে জাতি হীনম্মন্যতায় ঢেকে যাবে। হারিয়ে যাবে কালের অতল গর্ভে।
মানবতার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে উপযোগী করতে হলে বিজ্ঞান ও ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে। ১৯১১ সালে শ্রী অরবিন্দ তার মানবতার গানে বলেছিলেন, এমন একটা সময় আসবে যেদিন নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পূর্ণ মুক্তির জন্য গোটা ভারতবর্ষ তার দেহের ওপর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা অন্ধকারকে ঝাড়া দিয়ে ফেলে দেবে। দারিদ্র্যের এই শৃংখল থেকে মুক্তির জন্য আমাদের এখনই একযোগে কাজ করতে হবে।
আমি যতবার যেখানে গেছি, সবখানেই একটি সাধারণ মেসেজ প্রচারের চেষ্টা করেছি। সেটা হল তোমার মধ্যেই আরেকজন মহান তুমি রয়েছে যে এই দৃশ্যমান পৃথিবীর সীমান্ত ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমি আমার আব্বার মধ্যে এমন একটি সত্তার উপস্থিতি টের পেয়েছিলাম।
আব্বার কাছ থেকেই আমি পারিপার্শ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও মনকে প্রশান্ত রাখার বিষয়টি শিখেছি। বহু দুঃখ ও ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েও নিজেকে পরাজিত হিসেবে বিবেচনা করিনি। বাকি জীবনটা আমি আমার ও আমার চার পাশের মানুষের সংগে শান্তিতে কাটাতে চাই। অন্যদের সংগে বিতন্ডায় জড়ানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই।