মহাত্মা গান্ধীর জন্মস্থান পোরবান্দারে অবস্থিত স্বামী বিবেকানন্দ হলে ধ্যান করার সময় আমার ভেতরে যে শিহরণ অনুভব করেছিলাম, এখানেও সেই আধ্যাত্মিক শিহরণ আমার সমস্ত দেহমনকে নাড়িয়ে গেল।
২০০১ সালের ৬ অক্টোবর কাঞ্চিতে প্রায় ১শ গ্রামের মানুষ, বিশেষ করে কৃষক পরিবার তাদের গ্রামীন উন্নয়নের উদ্দেশ্যে শঙ্করাচার্য নামের একটি সভার মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা আয়োজন করেছিল। আমাকে নেমন্তন্ন করা হলো এবং সে সভায় যোগ দিলাম আমি। ওই সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ তাদের গ্রামাঞ্চলে শহরকেন্দ্রীক নাগরিক সুবিধা সৃষ্টির লক্ষ্যে মিলিত হয়েছেন। স্থানীয় পঞ্চায়েত সভাটির সভাপতিত্ব করলেন। একটি বিষয় দেখে আমি খুব অবাক ও আনন্দিত হলাম যে উন্নয়নমুখী কার্যক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতারাও এগিয়ে এসেছেন।
সভাশেষ হলে প্রধান দুই আচার্য আমার সংগে একান্ত আলোচনায় বসলেন। স্বামী বিজয়েন্দ্র স্বরস্বতীগল হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার কথা জিজ্ঞেস করলেন, আমার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করলেন ও আশীর্বাদ করলেন।
স্বামী বিজয়েন্দ্র স্বরস্বতীগল আমাকে জানালেন, সেখানকার ৩শ বছরের পুরনো একটি বিখ্যাত মসজিদের ইমাম আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। স্বামীজি আমাকে মৌলভী সাহেবের দাওয়াত কবুল করার এবং সে মসজিদ পরিদর্শন করার পরামর্শ দিলেন।
তার কথা শুনে, সাবেক প্রেসিডেন্ট আর ভেঙ্কটরমনের কথা মনে পড়ে গেল। বছর দশেক আগে কাঞ্চি মঠের কাছে ভেঙ্কটরমন একবার আমাকে একটা বহু প্রাচীন মসজিদ দেখিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে মসজিদ কর্তৃপক্ষ এবং জেলা কর্তৃপক্ষ মসজিদটি আরেক জায়গায় স্থানান্তর করার সিদ্ধন্ত নেয় কারণ মসজিদ ও মঠের অবস্থান কাছাকাছি হওয়ায় উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিল। তাছাড়া প্রতিদিন ওই মসজিদে হাজার হাজার মানুষ ইবাদত করার জন্য আসে; অন্যদিকে মঠেও হিন্দু সম্প্রদায়ের বহু লোক আসে। এর ফলে ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মঠ কর্তৃপক্ষ ওই ঐতিহাসিক মসজিদটি অন্যত্র স্থানান্তর করবে তাদের অর্থায়নে। এ খবর পরমাচার্যের কাছে পৌঁছলে তিনি কঠিনভাবে এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন। পরমাচার্য বললেন, ভোর সাড়ে চারটায় যে ফজরের আযান হয় সে আযান আমাদেরও উপাসনা করার জন্য জাগিয়ে দেয়। এ ছাড়াও নানা কারণে তিনি মসজিদ সরিয়ে নেবার বিরোধীতা করেন। তিনি জেলা কর্তৃপক্ষ ও মঠ পরিচালকদের তার বক্তব্য বুঝিয়ে বললেন এবং মাওনাদিম বা গভীর ধ্যানে মনঃসংযোগ করলেন। অবশেষে তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়।
পরমাচার্যের মঠ থেকে আমি মসজিদ পরিদর্শনে এলাম। সেখানকার কাজী ও মৌলভীর সংগে দেখা করলাম। সেখানে নামাজ আদায় করলাম। সেখানে প্রায় পঞ্চাশজন তালবে এলেম কোরান শরীফ শিখছিল। আমি তাদের পাশে বসলাম এবং কোরান শরীফের আত্মাখ্যাত আলহামদু সুরা পড়ার জন্য তাদের অনুরোধ করলাম।
এই কাঞ্চিতে এসেই আমি ছাত্রদের কোরান ও বেদ পাশাপাশি বসে পড়তে দেখেছি।
এখানেই ভারতের প্রকৃত মহত্ব লুকিয়ে আছে। কাঞ্চির এই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা আমাদের জন্য এবং পরবর্তী পৃথিবীর জন্য এক মহান শিক্ষা।
শঙ্কর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক, ছাত্র ও শিক্ষকদের এক আলোচনায় আমি উপস্থিত ছিলাম। বক্তাদের আলোচনায় সেদিন একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছিল যে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য বিজ্ঞান চেতনার এক অপূর্ব সম্ভার। এই সংস্কৃত সাহিত্যেই বিমান আবিষ্কারের ধারণা রয়েছে।
এছাড়া পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, আয়ুর্বেদীর বহু সূত্র রয়েছে সংস্কৃত পুঁথি ও পূরাণে। সে আলোচনায় তারা আমাদের প্রাচীন পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের মতামত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের সংগে সমন্বয় ঘটানোর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
হোয়াইটফিল্ডে অবস্থিত শ্ৰী সত্যসাঈ ইনস্টিটিউট থেকে একবার প্রফেসর রমা রাও ও আমাকে দাওয়াত করা হয়েছিল।
ফজরের নামাজ শেষে আনুষঙ্গিক ইবাদত শেষ করে সকাল ৭টায় একটা কাব্যিক আবহে সেখানে ধর্মালোচনা শুরু হল। আলোচনার বিষয় ছিল কিভাবে অন্তর থেকে অহংকার উপড়ে ফেলে সেখানে ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা যায়। দেখলাম, সঈ বাবা যখন তার অনুসারীদের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলেন তখন তার চেহারা মোবারকের নূরানী তাজাল্লিতে ভক্তকুলের সব দুঃখ কষ্ট যেন মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।
২০০২ সালের জানুয়ারিতে হোয়াইটফিল্ডের একটি চিকিৎসা প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সকাল সাড়ে নটায় আলোচনা শুরু হল, শেষ হল রাত আটটায়। ওই সম্মেলনের পুরো আলোচনা অনুষ্ঠানে শ্রী সাঈ সত্যবাবা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেক আলোচকের বক্তব্যেই তিনি সাধুবাদ
মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা জানাচ্ছিলেন। আমি আমার পাঁচ মিনিটের বক্তৃতায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম কীভাবে প্রযুক্তি মানুষের কাজে এসেছে–দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের আবিষ্কৃত কার্ডিয়াক স্টেন্টের উল্লেখ করলাম যা পঙ্গু রোগীদের হাঁটা-চলায় সাহায্য করে।
আমার বক্তব্য শেষ হতেই সত্যবাবা দর্শকদের চেয়ারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে হাত তুলে আমাকে আশীর্বাদ জানাতে লাগলেন। হোয়াইটফিল্ডের আগে তার আখড়ায় গিয়ে অভূতপূর্ব আতিথেয়তা পেয়েছি, বিস্মিত হয়েছি। এখানে এই আলোচনার প্রতি সাঈজীর আগ্রহ দেখে আবার বিস্মিত হলাম। আলোচনার আগে তিনি বলেছিলেন, চেন্নাইয়ে পানির আকাল চলছে। বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানুষ ভারী সমস্যায় পড়েছে। তিনি যখন তার বক্তব্যে ঘোষণা করলেন তিনি চেন্নাইয়ের এ জলসংকট নিরসন করবেন, তখন মনটা তার প্রতি শ্রদ্ধায় ভরে গেল।