সেই অপূর্ব সুন্দর আর বীভৎস নারকীয় মুহূর্তে, সেই রজতশুভ্র জ্যোত্সাময়ী ও বিষাদক্লিষ্ট ক্ষণে বিশ্বপ্রকৃতি যেন কথা বলে উঠলো। জন্ম হলো অহিংস ধর্ম। সম্রাট অশোক সে মুহূর্তে কম্পিত ও অবনত মস্তকে ঈশ্বরের নির্দেশ আঁকড়ে ধরলেন। শেষ দিন পর্যন্ত মানব অহিংসার মন্ত্রে মানবপ্রেমের কথা প্রচারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। অশোকের পাশে দাঁড়িয়ে আমি শিউরে উঠলাম। আমি বোবা বিস্ময়ে ভাবছিলাম, কেন এই কলিঙ্গ যুদ্ধ? মহাত্মা গান্ধী আর আব্রাহাম লিংকনের এই গুপ্তহত্যা কার জন্য? তাদের মত আর কত কত মানুষ মারা যাচ্ছে তা কেন? ঈশ্বরের সৃষ্টিতত্ত্বে কি তাহলে কোন ভুল ছিল? না কি দ্বিতীয় প্রজন্মে প্রয়োজনে মানবজাতি নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করছে?
সেই নন্দিত নিস্তব্ধতা ভেঙে মহাত্মা কথা বলে উঠলেন, বন্ধুরা! আমরা যে স্বর্গীয় বাণী শুনতে পাচ্ছি, সে বাণী সৃষ্টির বাণী। যেহেতু পৃথিবী নামক এ গ্রহটি আমাদের, সেহেতু পৃথিবীর তাবৎ মানবসম্প্রদায়ের কাছে আমরা এ বাণী ছড়িয়ে দিতে পারি যাতে ভিন্ন জাতির, ভিন্ন ধর্মের আর ভিন্ন ভাষার মানুষ এক সংগে শান্তির সংগে বসবাস করতে পারে।
মহান ঈশ্বর আমাদের যা কিছু অনুপম আর কল্যাণকর তা দিয়েছিলেন আমাদের কাজের উপহার হিসেবে। আমরা মানবতার জন্য সে সব উপহার রেখে এসেছি। কিন্তু আমাদের সেই বার্তা, সেই বাণী কি এখন কাজ করছে? পৃথিবীতে কি এখন কোন শান্তির বাণী অথবা মতবাদ আছে? স্বর্গীয় সৌন্দর্য মানবাত্মায় প্রবেশ করবে আর মানুষের দেহ ও মনে প্রশান্তি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে করা হয়। চোখ তুললেন সম্রাট অশোক। বললেন, বন্ধুরা, এতদিনে একটা মন্ত্রই আমি বুঝেছি। অশান্তি ছড়িয়ে কখনও বিজয়ী হওয়া যায় না। শান্তিরাজ্য স্থাপনই প্রকৃত বিজয়।
.
খলিফা ওমর বললেন, জেরুজালেমে পা রাখার পরই আমি জেনেছি জগতের সকল মানুষ সমান। নিজের পথে অন্যকে পরিচালিত করতে কাউকে তুমি জোর করতে পার না। তুমি ততটুকুই পাবে যা তুমি অর্জন করতে পারবে। আল্লাহই একমাত্র শ্বাশত সার্বভৌমত্ত্বের মালিক।
খলিফা ওমর কখনও তার খেলাফতকে কোন বিশেষ পদাধিকার বলে বিবেচনা করেননি। তার কাছে সরকার ছিল এক পবিত্রতম আমানত। সে আমানতের খেয়ানত এড়াতে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন।
.
এবার আইনস্টাইনের পালা। তিনি বললেন, আজ আমার বন্ধু ওয়ার্নার হিন্সেনবার্গের কথাই বার বার মনে পড়ছে। ওয়ার্নার বলেছিলেন, আপনারা সবাই জানেন পশ্চিমারা সুবিশাল আর অমিত সৌন্দর্যদীপ্ত এক জাহাজ বানিয়েছে। জগতের সকল সুযোগ সুবিধা রয়েছে সে জাহাজে। কেবল একটি জিনিস হারিয়ে গেছে, আর তা হলো কম্পাস। নাবিক জানে না তারা কোথায় চলেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী আর তাদের মতানুসারীদের কাছে রয়েছে সেই কম্পাস। এই কম্পাস কেন মানবতা নামের সেই জাহাজে প্রতিস্থাপিত হবে না যাতে পূর্ব আর পশ্চিম একই সংগে উভয়ের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে বুঝতে পারে?
মহাত্মা গান্ধীর মত সাদামাটা জীবন যাপনকারী দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার যোদ্ধা মহান আমেরিকান নেতা আব্রাহাম লিংকন এবার মন্ত্রসপ্তক কণ্ঠে বলে উঠলেন, একটি কথাই আমি বলতে চাই, পারিবারিক উন্নয়ন ও সুসম্পর্কের মাঝেই সুখ আর শান্তি লুকিয়ে আছে। ঈশ্বরের আশীর্বাদ মানুষকে প্রশান্তি দেয়। পৃথিবীতে উত্তম জীবন যাপনের জন্য সুখ আর প্রশান্তি দুই অপরিহার্য বিষয়। আমরা যখন নিজেদের মূল্যবোধ ভুলে সম্পদ আর ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যাই তখনই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। কিন্তু অবশ্যই আমাদের নিজেদেরকেই প্রশ্ন করতে হবে, মনুষ্যবিবেকের কাজ কী? এটা কি রাজনৈতিক চিন্তার অংশ, না কি বৈজ্ঞানিক চিন্তার অংশ, না কি এ বিবেক শুধুই ধর্মতাত্ত্বিক দর্শনের খণ্ডিত অংশ? প্রতিদিনের ব্যস্তজীবনের আধ্যাত্মিক মনস্তত্ত্বে মনুষ্য বিবেক কতটা গ্রহণযোগ্য?
.
মহাত্মা গান্ধী মহামতি অষ্টবক্রর বাণী শোনালেন, হে আমার সন্তানগণ! এই সহস্র উপাদানবেষ্টিত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য উপাদান তুমিও। তুমি তোমার বিবেকের বিষয়ে সতর্ক থাক। কোনটা গ্রহণীয় কোনটা বর্জণীয় তা তোমার বিবেকই তোমাকে নির্দেশ করবে। এসো এই নশ্বর জীবন শান্তি আর স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে তুলি। ধ্বংস আর সংঘাত ভুলে যাই।
এবার পাঁচজন সমস্বরে বললেন,
এই গ্রহের কাছে এই আমাদের বার্তা– আমরা যা কিছু করি, যে মতাবলম্বী হই তা যেন মানবতার জন্য কল্যাণকর হয়।
.
ঘুম থেকে উঠে সকালে চা খেয়ে গত রাতের স্বপ্নের কথা ভাবছিলাম।
যদি আরও উঁচুতে থাকতে হেলিকপ্টারটি বিকল হয়ে যেতো? আমার ওই দুর্ঘটনা ঘটার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে একজন উদীয়মান নেতা আর এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিক নিয়ে আরেকটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। আরোহী সবাই মারা পড়ে। সৌভাগ্যবশত আমি বেঁচে গেছি আর রাতের এক বিক্ষিপ্ত স্বপ্ন আমাকে কী এক বার্তা জানিয়ে গেল। আমি আনমনা হয়ে উঠি। এখন আমি কী করব? আমার আসলে কী করা উচিত?
আমি জানালার বাইরে তাকালাম। বেশ বেলা হয়েছে। ঝিরঝির বাতাস বইছে। প্রকৃতির কাছেই আমার থাকতে বেশী ভাল লাগে। প্রকৃতিই আমার প্রকৃত বন্ধু। প্রতিদিন একটি আমগাছকে প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে দেখি, যে গাছের ডাল মানুষ ভাঙে, পাতা মুড়ে নেয়। অথচ সে শ্রান্ত পথিককে ছায়া দিয়ে যায়। ক্ষুধার্তকে সুমিষ্ট ফলের আস্বাদে ক্ষুধামুক্ত প্রাণবন্ত করে তোলে। রামেশ্বরম, থুম্বা আর চণ্ডিপুরের সাগরসৈকত, পোখরানের মরুভূমি, হায়দরাবাদের বিস্তৃর্ণ আর বিশালকায় প্রস্তর ক্ষেত্র–যেখানেই আমি গেছি সবখানে প্রকৃতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতি টের পেয়েছি। এরা সবাই আমাকে সেই স্বর্গীয় শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে শক্তিই সমস্ত সৃষ্টির আধার।