তুমি এখানে আসাতে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছি। আমাদের অতীতের ঋষি মুনিরা আমাদের বিজ্ঞান দিয়ে গেছেন, তুমিও দিচ্ছ। তুমিও অনেক বড় সাধক, তুমিও ঋষি।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আজমিরের সুফি সাধক গরীবে নওয়াজ খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাহ শরীফে গিয়েছিলাম। ১২৫৬ সালে ১১৪ বছর বয়সে তার ইন্তেকালের কিছুদিন আগে এই বুজর্গ ৬ দিনব্যাপী ইবাদতের জন্য এখানে নির্মিত তার প্রকোষ্ঠে ঢুকেছিলেন। আমি যখন দরগাহ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম, তখন মাজারের প্রতীকী স্থাপনার সৌন্দর্য দেখে বিমুগ্ধ ও হতবাক হয়েছিলাম।
আটশ বছর আগে শশ মাইল পাড়ি দিয়ে সৌদি আরব থেকে আজমির এসেছিলেন এই ওলী। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ তার মাজারের চারপাশে সম্প্রীতির সাথে বাস করছে।
খাজা গরীব নওয়াজের শিক্ষা ও বাণী তাকে এক অনন্য চরিত্রে রূপায়িত করেছে। তার সাধারণ অছিয়ত পাথর হৃদয়ের মানুষকেও দ্রবীভূত করতো। তার স্নেহশীল দৃষ্টি তার জানের দুশমনকেও প্রশান্ত করে ফেলতো। তিনি বিশ্বশান্তি ও ভালোবাসার বার্তা নিয়ে এসেছিলেন ভারতবাসীর জন্য। চিশতী সুফিরা তার সে শিক্ষাকে এখনও ধারণ করে আছেন। জাতীয় সম্প্রীতির ক্ষেত্রে তাদের অবদান ভুলবার নয়।
বিভিন্ন বইয়ে খাজা সাহেবের বাণী ও শিক্ষা লিপিবদ্ধ রয়েছে। খাজা সাহেব বলতেন, সেই ব্যক্তিই উত্তম চরিত্রের লোক যে দারিদ্র্য নিয়েও অবিচল, দুঃখের মধ্যেও সুখী, ক্ষুধার্ত থেকেও তৃপ্ত ও আক্রান্ত হয়েও বন্ধুবৎসল। এই ওলীকুল শিয়োমনির মতে, জাহান্নাম থেকে নিশ্চিত পরিত্রানের উপায় হলো ক্ষুধার্তকে মহামানব ও দ্রষ্টাদের শিক্ষা খাওয়ানো, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান এবং পীড়িতকে সেবাদান করা। খাজা সাহেব ছিলেন সত্যিকার ঈমানদার বা আরিফের একজন রোল মডেল : যিনি শত্রুর মাঝেও শংকামুক্ত ছিলেন এবং সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করতেন। একজন আরিফ আল্লাহভীত হন। লজ্জাবোধ তার চরিত্রের বিশেষ অলঙ্কার।
আমি চিন্তা করতে লাগলাম, আমরা কেন নিজেদের আরিফ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি না?
কোনও কাজ করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হয়, যা বলতে যাচ্ছি বা করতে যাচ্ছি তা কি আমার জন্য শান্তি বয়ে আনবে? ডায়ার বলেছেন, উত্তরটা যদি হ্যাঁ হয় তাহলে প্রাণমন দিয়ে সে কাজে এগিয়ে যাও। আর যদি না হয় তাহলে তুমি তোমার অহংবোধ থেকে সাবধানী হও। কারণ অহংবোধ বা আমিত্ব তোমাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলবে, এমনকি আল্লাহ থেকেও। খাজা সাহেবের মাজারে আমি সেদিন শুধু একটি ধ্বনিই শুনেছি, সর্বাবস্থায় তোমরা শান্তিতে থাকো।
দরগাহ শরীফের পাশেই পবিত্র পুষ্করণী নামে একটা লেকের মত জলাশয় রয়েছে। এ দুটি পবিত্র জায়গাকে আমার ভারতের ধর্ম সহিষ্ণু অসাম্প্রদায়িকতার প্রতীক বলে মনে হল। আজমির শান্তিপূর্ণ সমাজের আদর্শতম মডেল। আমি মাজারে শোকরানা নামাজ আদায় করলাম। এ দরগাহ শরীফের দৃশ্য আমাকে আরও দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কথা মনে করিয়ে দিল। এর একটি হলো নগর দরগাহ, আরেকটি ভেলানকান্নি গীর্জা।
২০০১ সালের ২ অক্টোবর ভিএসএসসির পরিচালক জি, মধুবন নায়ার এবং IISc-এর প্রফেসর এন বালাকৃষ্ণর সংগে কেরালার অমৃত ইনস্টিটিউট অব কম্পিউটার টেকনোলজি পরিদর্শন করতে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রায় ১হাজার তরুণ শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্রহ্মচারী ও স্বামীদের মধ্যে আমি বক্তব্য রেখেছিলাম।
আমার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল, জ্ঞানের বহুমুখী ব্যবহার। আমি দেখলাম ছাত্রদের মধ্যে নতুন আইডিয়া গ্রহণের সাংঘাতিক প্রবণতা রয়েছে। আমার প্রতি তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্য দিয়ে তারা শুধু প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয় বরং সঞ্জীবন যাপনের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করলো। তাদের সংগে কথাবার্তা শেষ করে আমি আম্মার সংগে দেখা করলাম। এটি আমার জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা।
সেখানকার প্রধান সাধ্বীকে সবাই আম্মা বলে ডাকে। একজন মানুষ কীভাবে নিজেকে ঈশ্বরের নিকটবর্তী করে গড়ে তুলতে পারে তিনি লোকজনের কাছে সেই বাণীই প্রচার করে থাকেন। ধর্মোপদেশদান ছাড়াও তিনি হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ নিয়েছেন, প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি উচ্চশিক্ষাদানকারী ব্যবস্থাপনা কলেজ। পরিদর্শনের এক পর্যায়ে আশ্রমের প্রধান আম্মা এবং অন্যান্য সন্ন্যাসীদের সংগে কথা হল। যদিও তার এ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক সকল শিক্ষাই দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে প্রতিবছর অসংখ্য প্রকৌশলী, চিকিৎসক, ব্যবস্থাপনা ও বিজ্ঞানের উচ্চতম ডিগ্রিধারী বেরিয়ে আসছে তারপরও তারা তাদের আধ্যাত্মিক শিক্ষার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থেকে বিচ্যুৎ হননি।
কথা বলার এক পর্যায়ে আম্মা বললেন, কিছু একটা হারিয়ে যাচ্ছে। এই কিছু একটা আসলে কী? এই কিছু একটা বলতে তিনি পার্থিব ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয়কে বোঝাতে চাইছিলেন।
আমি যখন রাজকোটের খ্রীস্ট কলেজ পরিদর্শন করছিলাম, সে সময় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে স্বামী নিখিলেশ্বরানন্দ আমাকে নেমন্তন্ন জানালেন। স্বামীজি তার আশ্রমটাতে একবার ঘুরে যাবার জন্য অনুরোধ পাঠালেন। আমিও না গিয়ে পারলাম না। খ্রীস্ট কলেজের অনুষ্ঠান শেষ করে আশ্রমে হাজির হলাম। আমি যখন আশ্রমে পৌঁছেছি তখন আশ্রমের সান্ধ্য আরতি ও ভজন শুরু হয়েছে। ভজন সংগীতের মুচ্ছনা আমাকে এত আপুত করলো যে প্রায় পনের মিনিট আমি তাদের সংগে বসে এক অতিলৌকিক ধ্যানের জগতে চলে গেলাম।