রামানুজ এমন এক বিস্ময়কর মেধা যিনি কিনা ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জিএইচ হার্ডির মত পণ্ডিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এটা মোটেই অতিরঞ্জিত বক্তব্য নয় যে জিএইচ হার্ডিই রামানুজকে বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা কেন আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আরেকটি রামানুজকে আবিষ্কার করতে পারছে না। ওহ আমার বন্ধুরা, তোমরা কেন তোমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্র অন্তর দিয়ে আঁকড়ে ধরছে না আর কেন মহীরুহের মত আত্মপ্রকাশ করছে না?
কোন একজন গণিতজ্ঞ রামানুজের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, প্রত্যেকটি পূর্ণ সংখ্যাই রামানুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার এ কথা মোটেই অতিরঞ্জিত ফাপা বক্তব্য নয়। অধ্যাপক হার্ডি একবার সর্বোচ্চ মাত্রা ১০০ ধরে বিভিন্ন বিজ্ঞানীকে নম্বর দিয়েছিলেন। অধিকাংশই হার্ডির বিবেচনায় পেয়েছিলেন ৩০ নম্বর। শুধু রামানুজই পেয়েছিলেন ১০০র মধ্যে ৬০ নম্বর। হার্ডির মতে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা শাখার যেকোন ক্ষেত্রেই রামানুজ ১০০ শতাংশ উপযোগী। রামানুজ অথবা ভারতীয় ঐতিহ্যকে এত বড় সম্মান সম্ভবত আর কেউ দেয়নি।
রামানুজের পদচারণ ক্ষেত্র ছিল বিস্তীর্ণ ও বিশাল। মৌলিক সংখ্যা, জটিল জ্যামিতিক সিরিজ, কম্পিউটারের সংযোজনে ব্যবহৃত ইলেক্ট্রনিক গঠন উপাদানের একক বা মডিউলার ফাংশান, ম্যাজিক স্কোয়ার, উপবৃত্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে রামানুজের সূত্র অনুকরণ করা হয়।
আমি আশা করি আমাদের পণ্ডিত শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের শিক্ষকতার জীবন শেষ করে সরকারী উচ্চ পদে আসীন হলে তারা সেখানেও তাদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেবেন এবং স্ব স্ব বিষয়গুলোর অনুশীলন চালিয়ে যাবেন। এমনই একজন মানুষ অধ্যাপক এস, চন্দ্রশেখর। তিনি তার কাজের বাইরেও ভারতীয় ঐতিহ্যের গণিত চর্চা করেন। গণিত সন্দেহাতীতভাবেই বিশ্বজনীন। এখন আমাদের ঐতিহ্য অধ্যাপক সি, এস. শেষার্দি, অধ্যাপক জে. ভি. নারলিকর, অধ্যাপক এম. এস. নরসিমা, অধ্যাপক এস. আর. এস, বর্ধন, অধ্যাপক এম. এস, রঘুনাথ, অধ্যাপক নরেন্দ্র কর্মকার এবং অধ্যাপক অশোক সেনের মত জ্ঞানতাপসদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বিকশিত হচ্ছে।
স্যার সি, ভি, রমন কলকাতার একটি অফিসে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেছিলন। কিন্তু তার হৃদয়ের মধ্যে যে আরেকজন বিজ্ঞানী সি. ভি. রমন ছিল তাকে তিনি বিশ্রাম নিতে দেননি। যেসব রহস্যময় সমস্যা ও প্রশ্ন তাকে আগ্রহী করেছে তিনি অসীম ধৈর্যের সংগে তা সমাধানের পথ খুঁজেছেন। সৌভাগ্যবশত তিনি মহান শিক্ষাবিদ স্বর্গীয় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। তিনি সি. ভি. রমনকে তার গবেষণা চালিয়ে যেতে অনিবার উৎসাহ যোগাতেন।
একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, স্যার সি, ভি. রমন যে আবিষ্কারের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পেলেন সেই রমন ইফেক্ট কিন্তু বিশাল ব্যায়বহুল কোন প্রতিষ্ঠিত গবেষণাগার থেকে আসেনি। একই ঘটনা দেখেছি আমরা অধ্যাপক এস, চন্দ্রশেখরের বেলাতেও। তিনিও নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ব্ল্যাকহোল বিষয়ে কাজ করার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে তিনিও ব্যায়বহুল প্রযুক্তি ও গবেষণাগার ব্যবহার করেননি। কামেশ্বর সি, ওয়ালীর লেখা চন্দ্রশেখরের জীবনী গ্রন্থ চন্দ্রতে কিছু মজার তথ্য ও বিবৃতি পাওয়া যায়।
যেমন, বইটির এক জায়গায় বলা হয়েছে, চন্দ্র বড় হয়ে ছিলো এমন এক সময়ে যখন ভারতবর্ষ বিজ্ঞান, কলা ও সাহিত্যে এক স্বর্ণালী অবস্থানে ছিল, পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠেছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল। সে সময় জে. সি. বোস, সি. ভি. রমন, মেঘনাদ সাহা, শ্রীবাস রামানুজ এবং রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধীর মত বহু মহাত্মা তাদের বৈজ্ঞানিক ও সৃজনশীল সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় বীর হয়ে উঠেছিলেন।
তাদের সুবিশাল সাফল্যসমূহ তখন ভারতে সৃষ্টিশীলতার পরিবেশ তৈরী করেছিল। চন্দ্রশেখরই ওই সময়টাকে সম্ভবত সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ভাষায়, ১৯১০ সালের আগের সেই আধুনিক যুগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন (ভারতীয়) বিজ্ঞানীও ছিলেন না। ১৯২০ ও ১৯২৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এসে আমরা হঠাৎই পাঁচ ছয়জন বিশ্বখ্যাত (ভারতীয়) বিজ্ঞানীর সন্ধান পাই।
আমার আত্মপ্রকাশের প্রয়োজনেই আমি ওই সময়কার উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের সংগে যুক্ত হয়েছিলাম। আমার সময়ে তরুণরা জেগে উঠেছিল জাতীয় বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়ে। বিজ্ঞান সাধনায় আত্মনিয়োগ করাও তখন জাতীয় বিপ্লবের অংশ হয়ে উঠেছিল। ভারত সে সময় পরাধীন দেশ ছিল কিন্তু…. বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা তখন বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমরা তাদের চেয়ে কম নই।
এখানে আমি সি. ভি. রমনের একটি উদ্ধৃতি টানতে চাই। ১৯৬৯ সালে তরুণ স্নাতক ডিগ্রিধারীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, আমার সামনে উপস্থিত তরুণ-তরুণীদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতে চাই যে তারা যেন আশাহত না হয়, তারা যেন সাহস হারিয়ে না ফেলে। সাহসের সাথে সাধনা করলে সফলতা তোমাদের সামনে এসে ধরা দেবে। আমি সমস্ত মতবিরোধের ভয়কে প্রত্যাখ্যান করে, সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলতে চাই ভারতীয়দের মেধা যে কোন টিউটোনিক, নর্ডিক অথবা অ্যাংলো-স্যাক্সনের মেধার সমান। কিন্তু আমাদের যে জিনিসের অভাব রয়েছে সেটি হল সাহস।