Whatever you can do or dream you can, begin it. Boldness has genius, power and magic in it. Begin it now.
–Goethe.
এদেশের ক্ষণজন্মা মহাত্মাদের এমন কিছু ক্ষমতা ছিল যা দিয়ে তারা সাধারণ জনগণের মধ্যে নিজেদের আদর্শ প্রতিস্থাপন করে মোহনীয় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতে পারতেন। তাদের কাছে আপনার চেয়ে বড়, নিজের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশ ও জাতি। স্বপ্নকে তারা হাজারবার বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন।
২০০০ সালের ডিসেম্বরে আধিয়াপাকা রত্ন টি, তোতাদ্রি আয়েঙ্গারের জন্মশতবর্ষ পূর্তি উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। ১৯৫৪ সালে তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। তরুণ ছাত্রবয়সে আমি অধ্যাপক টি. তোতাদ্রি আয়েঙ্গারকে দেখেছি। অনুপম আর ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ মানুষটি প্রতিদিন কী দৃপ্ত পদক্ষেপে কলেজ চত্ত্বর দিয়ে হেঁটে যেতেন। বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসির ছাত্রছাত্রীদের গণিত ক্লাস নিতেন তোতাদি স্যার। ছাত্ররা পরম শ্রদ্ধা ও সমীহ নিয়ে তাদের গুরু হিসেবে তার দিকে চেয়ে থাকতো। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেনও তাই। তিনি যখন হাঁটতেন, মনে হতো তার চারপাশে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ঝলমল করে উঠতো। ক্যালকুলাস শ্রীনিবাস ছিলেন আমাদের গণিতের শিক্ষক। তিনি প্রায়ই অধ্যাপক তোতাদ্রি আয়েঙ্গারের কথা বলতেন গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে।
তিনি চাইতেন বিএসসি (সম্মান)র প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা যেন তোতাদ্রি স্যারের সংস্পর্শে আসে, তার ক্লাসে ঠিকমত উপস্থিত হয়। তার বেশ কয়েকটি ক্লাসে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, বিশেষ করে আধুনিক আলজেব্রা ও পরিসংখ্যানের ক্লাসগুলোতে।
আমরা যখন বিএসসি প্রথম বর্ষে তখন ক্যালকুলাস শ্রীনিবাস স্যার আমাদের ক্লাস থেকে শীর্ষস্থানীয় দশজন মেধাবী ছাত্রকে বেছে নিয়ে সেন্ট জোসেফ কলেজের গণিত ক্লাবের সদস্য করান। তাদের মধ্যে তোতাদ্রী বেশ কয়েকটি লেকচার দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, ওই সদস্যদের মধ্যে আমিও ছিলাম।
১৯৫২ সালের কোন একদিন প্রাচীন ভারতবর্ষের গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিদদের বিষয়ে একটি লেকচার দিয়েছিলেন। তিনি কথা বলেছিলেন টানা একঘণ্টা। তার সে বক্তব্য আজও আমার কানে বাজে। আমার শিক্ষক তোতাদ্রির মত প্রাচীন ভারতের অসংখ্য গণিতবিদ ও তাদের কর্মশক্তির ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা চেতনা পাঠকের সংগে শেয়ার করা যাক–
৪৭৬ সালে কুসুমপুরে (বর্তমান পাটনা) আর্যভট্ট নামে একজন জ্যোতির্বিদ ও গণিতজ্ঞের জন্ম হয়েছিল। তখনকার সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত গণিতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ছিল অগাধ জ্ঞান। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি দুই খণ্ডে সমাপ্ত বই আর্যভট্টম লিখেছিলেন। এ বইয়ের বিষয় ছিল অ্যারিথমেটিক, অ্যালজেবরা, ত্রিকোণমিতি এবং অবশ্যই জ্যোতির্বিদ্যা। তিনি ত্রিভূজ ও বৃত্তের ক্ষেত্রফল সম্পর্কে ফর্মুলা দেন। এছাড়া গোলক ও পিরামিডের আয়তন ও ঘনত্ব পরিমাপের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এ বিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম বৃত্তের জ্যা ও ব্যাসের অনুপাত হিসেবে ৩,১৪১৬ সংখ্যাটি উদ্ভাবন করেন। এই মহান জ্যোতির্বিদের স্মরণে ভারত ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মত যে স্যাটেলাইটটি মহাকাশে পাঠিয়েছিল তার নাম দেওয়া হয় আর্যভট্ট।
রাজা হর্ষদত্তের শাসনামলে রাজস্থানের বিল্পমালায় ৫৯৮ সালে জন্মেছিলেন ব্রহ্মগুপ্ত নামের আরেক বিজ্ঞানী। তিরিশ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক বই ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত।
তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি সাধন করেন। এছাড়া গণিত ও জ্যামিতিক্ষেত্রেও তার ছিল অগাধ জ্ঞান। গণিত শাস্ত্রের বহু অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। একই সংগে চতুর্ভুজ সংক্রান্ত জটিল জ্যামিতিক সমস্যারও সমাধান দেন তিনি।
ভাস্করাচার্য নামের আরেক ভারতীয় বিজ্ঞানী তার সময়ের সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এখনকার কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সীমান্তবর্তী অঞ্চল বিজ্জলবাড়াতে ১৯১৪ সালে জন্মেছিলেন এই মহান পুরুষ। চারটি অধ্যায় সম্বলিত তার লেখা বিখ্যাত বই সিদ্ধান্তশিরোমনি! জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বীজগণিত ছিল তার অধীত বিষয়। ভাস্করাচার্যই হলেন সেই ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি আর্যভট্টর আবিষ্কারগুলোর ভিত্তিতে সর্বপ্রথম গণিতে জিরো বা শূন্য সংখ্যাটির ধারণা দেন। তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আইএসআরওর দ্বিতীয় দফায় নির্মিত দুটি স্যাটেলাইটের নাম রাখা হয় ভাস্কর-১ ও ভাস্কর-২ (প্রথমটি নির্মিত হয় ১৯৭৯ সালে, দ্বিতীয়টি ১৯৮১ সালে)।
এই তিন ভারতীয় গণিতজ্ঞের কথা মাথায় রেখেই অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন, আমরা ভারতীয়দের কাছে বহুলাংশে ঋণী যারা আমাদের গুনতে শিখিয়েছে, যা ছাড়া আজকের এই বিশাল বিশাল জিনিসের আবিষ্কার কিছুতেই সম্ভব হতো না।
এদের পরে যার নাম আমার মনে আসছে তিনি উনবিংশ শতকের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও সর্বস্বীকত বিজ্ঞানী শ্রীনিবাস রামানুজ। মাত্র ৩৩ বছরের আয় নিয়ে। জন্মেছিলেন রামানুজ (১৮৮৭-১৯২০) এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ছিল না তার। তারপরেও শুধুমাত্র তার অবিচল আগ্রহ ও গণিতের প্রতি ভালোবাসা তাকে গণিত শাস্ত্রের গবেষণায় অমূল্য অবদান রাখতে সহায়তা করেছিল। তার বহু সূত্র আনুষ্ঠানিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের জন্য গণিতজ্ঞরা অক্লান্ত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।