- বইয়ের নামঃ ইগনাইটেড মাইন্ডস
- লেখকের নামঃ এ পি জে আবদুল কালাম
- প্রকাশনাঃ অন্যধারা
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, আত্মজীবনী
ইগনাইটেড মাইন্ডস
১. স্বপ্ন ও বাণী
ইগনাইটেড মাইন্ডস – এ পি জে আবদুল কালাম / অনুবাদ : সারফুদ্দিন আহমেদ
মিসাইল ম্যান খ্যাত বিজ্ঞানী রাষ্ট্রপতির আলোচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ
.
ইগনাইটেড মাইন্ডস্ অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি দুটো কারণে। এক. মূল গ্রন্থকার একই সংগে একজন বিজ্ঞানী, কবি, সংগীতজ্ঞ, সর্বোপরি একজন সত্যিকার দেশপ্রেমিক। এ পি জে আব্দুল কালামের বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত আগ্রহ এ কাজটি করতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।
দ্বিতীয় কারণ, ভারতের উন্নত দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সম্ভাবনার নেপথ্যে যে সুদূরপরিকল্পনা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা রয়েছে তার প্রায় সবগুলো দিক শনাক্ত করেছেন কালাম। একটি ভয়াবহ দুর্নীতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশের নাগরিক হিসেবে তার এ বইয়ের বক্তব্য আমাদের দেশের জন্যও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে আমার। উন্নত দেশ হিসেবে না হলেও আমাকে একটি স্থিতিশীল দেশের নাগরিক হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন কালাম।
ইগনাইটেড মাইন্ডস বইটিতে ভারতের বহু দুর্লভ ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার তথ্য দিয়েছেন লেখক।
আমি আমার সর্বোচ্চ শব্দ সক্ষমতা দিয়ে বইটি অনুবাদের চেষ্টা করেছি।
এক্ষেত্রে আমাকে উৎসাহ, প্রেরণা ও সার্বিক সহায়তা দিয়েছেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক ও অনুবাদক প্রমিত হোসেন। আমি তার কাছে ঋণী।
এছাড়াও নানাভাবে যাদের সহযোগীতা পেয়েছি তাদের মধ্যে পীযুষকান্তি বিশ্বাস, এহসান শিকদার রনি, মাহমুদ খান, বাদল আহমেদ, মাসুদ সেজান, তরিক রহমানের নাম মনে পড়ছে।
আমি আশা করি স্বচ্ছ জাতীয়তাবোধ ও স্থিতিশীল অর্থনীতিসমৃদ্ধ জাতি গঠনে এপিজে আবদুল কালামের ইগনাইটেড মাইন্ডস বইটি শুধু ভারতীয়দের জন্যই নয়, বাংলাদেশী পাঠকদের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ
৪৩/৪/১ জিগাতলা,
ধানমন্ডি, ঢাকা।
২৭.০২.০৬
.
উৎসর্গ
দ্বাদশ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এক শিশুকে আমি এ বই উৎসর্গ করছি। তার নাম স্নেহাল ঠাক্কার। ২০০২ সালের ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় সড়কপথে আমি আনন্দে পৌঁছাই, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় তখন কার্ফিউ চলছে। পরদিন আনন্দালয় হাই স্কুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটা প্রশ্ন এল, আমাদের শত্রু কে?
অনেক রকম উত্তর শোনা গেল। কিন্তু সঠিক বলে আমরা সবাই যে উত্তরটি বিনাবাক্যে গ্রহণ করলাম, সেই উত্তরটি এল স্নেহালের কাছ থেকে, আমাদের শত্রু দারিদ্র্য।
হ্যাঁ, এটাই আমাদের সব সমস্যার মূল কারণ এবং নিজেদের মধ্যে হানাহানি না করে আমাদের উচিৎ এটার বিরুদ্ধেই লড়াই করা।
.
১. স্বপ্ন ও বাণী
Dream, Dream, Dream
Dream transformin to thoughts
And thoughts result in action.
২০০১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি থেকে হেলিকপ্টার যোগে বোকারো যাচ্ছিলাম। ল্যান্ড করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই আমাদের কপ্টারটি ক্র্যাশ করলো। যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কপ্টারটি বিকট শব্দে ভূমিতে আঘাত করলো। অলৌকিকভাবে কপ্টারের সবাই সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এ ঘটনা সত্ত্বেও আমি পূর্বনির্ধারিত কাৰ্যসূচী অনুযায়ী, বোকারোতে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গেলাম।
.
রাতে শারীরিক ও মানসিক আঘাত উপশমের জন্য একদল ডাক্তার আমাকে নিদ্রা উদ্রেককারী ওষুধ দিয়ে গেল। সাধারণত আমি রাত একটায় ঘুমাই। সেদিন ঘুমের ওষুধের কারণে তার কয়েক ঘণ্টা আগেই ঘুম এসে গেল। সাধারণত ঘুম থেকে উঠি ভোর ৬টায়। সেদিন উঠলাম সাড়ে আটটারও পরে। ওইদিন রাতে আমার কেমন জানি বিক্ষিপ্ত নিদ্রা হয়েছিল। ঘুমের মধ্যেই আমার বারবার মনে হচ্ছিল, এই যে মানব সম্প্রদায়, আশরাফুল মাখলুকাত এই মানুষ কেন হানাহানি করে এত ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়? আমার কল্পনায় আমি যেন পাঁচজন সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ চরিত্রের মানুষের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলাম। তাদের ওই কথোপকথনের মধ্যে আমি আমার প্রশ্নের জবাব খুঁজছিলাম। আমার তখনকার সেই কল্পনার জগৎটা ছিল স্বপ্নের চেয়েও বেশী উজ্জ্বল, আরও বাস্তবময়। আমি দেখলাম আমি যেন সহস্ৰমাইলব্যাপী উষর মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে। আমার চারপাশে ধু ধু বালি। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। গলে পড়া জোৎস্নায় সমস্ত মরুভূমি যেন এক স্নানোৎসবে মেতে উঠেছে। আমি দেখলাম ওই ধবল জ্যোৎস্নার মধ্যে পাঁচটি পবিত্র মানুষ মহাত্মা গান্ধী, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, সম্রাট অশোক, আব্রাহাম লিঙ্কন এবং খলিফা ওমর। তারা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছেন? জোৎস্নার মধ্যে দাঁড়ানো মানুষগুলোর শ্বেতশুভ্র বসন এলোমেলো বাতাসে উড়ছে।
সম্রাট অশোকের পাশে খর্বাকৃতির বামনের মত দাঁড়ালাম আমি। দিগ্বিজয়ী মহাপরাক্রমশালী সম্রাট অশোক। দুই ধরনের জীবন যাপন করতেন অশোক। একটি নিষ্ঠুর অভিযাত্রীর জীবন, আরেকটি হলো করুণাময় এক স্নেহশীল শাসকের জীবন। যে মুহূর্তে আমি অশোকের পাশে দাঁড়ানো সে সময় তিনি সবেমাত্র রাজ্যজয় করে ফিরেছেন। কিন্তু সে জয় এসেছে বহুমূল্যের বিনিময়ে। সদ্য অধিকৃত কলিঙ্গ রাজ্য জয় করতে ৩ লাখ সৈনিকের প্রাণহানি হয়েছে, আহত হয়েছে আরও ৩ লাখ। আমি দেখলাম উপস্থিত সবাই অশোকের দিকে চেয়ে আছেন। সম্রাট হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। শরীর থেকে বর্ম আর মাথার মুকুট খুলে ফেললেন। তার সারা মুখ বিবর্ণ, মৃত্যুর বিষণ্ণতা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি আকাশের দিকে চাইলেন। তিনি দেখলেন, ঈশ্বরের নিস্তব্ধ পৃথিবীতে উঁকি দিচ্ছে প্রশান্ত পূর্ণিমার চাঁদ। ঈশ্বরের আশীর্বাদ এই স্বর্বংসহা জননীরূপী ধরিত্রীর বুকে গলে গলে পড়ছে। তিনি এবার নিচে তাকালেন– দেখলেন, ধরীত্রীবক্ষে তিনি কী ভয়ানক শোণিত স্রোত বইয়ে দিয়েছেন, কী বীভৎস রক্তসাগর বয়ে চলেছে তার চারপাশে।