Site icon BnBoi.Com

ট্রাজেডি – উইলিয়াম শেকসপিয়র

ট্রাজেডি - উইলিয়াম শেকসপিয়র

ট্রাজেডি

কিং লিয়ার

দেশ শাসনের দায়ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্য ইংলন্ডের বৃদ্ধ রাজা লিয়ার যখন তার তিন মেয়ে, দুই জামাই ও অমাতাদের সাথে নিয়ে রাজসভায় প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন লর্ড অব কেন্ট এবং লর্ড অব গ্লস্টার। কথার ফাঁকে একসময় গ্লস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন্ট, আচ্ছা মাননীয় গ্লস্টার, আলবেনিয়ার ডিউক আর কর্নওয়ালের ডিউক, এই দুই জামাইয়ের মধ্যে রাজার কাছে কে সবচেয়ে প্রিয় তা কি আপনি আন্দাজ করতে পারেন?

না, প্রিয় বন্ধু মাথা নেড়ে বললেন গ্লস্টার, এ ব্যাপারে সঠিক অনুমান করা কঠিন, কারণ দুজনেই সমান গুণী, কেউ কারও চেয়ে কম বা বেশি নন।

সে সময় গ্লস্টারের পাশে বসে থাকা এক তরুণকে দেখে বললেন কেন্ট, ওই যুবকটি কি আপনার পুত্ৰ?

গ্লস্টার বললেন, হ্যা। তবে ওকে ছেলে বলে মেনে নিতে আমার লজ্জা হয়। তারপর একটু দোনোমোনোভাবে বললেন, ওর আচার-আচরণ খুবই খারাপ। তবে ওর বড়ো ভাই আমার প্রিয়পাত্র। এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন এডমন্ড, ইনি হচ্ছেন আমার প্রিয় বন্ধু, কেন্টের লর্ড!

আপনি যখন বাবার বন্ধু, তখন আমারও পূজনীয়, বললেন এডমন্ড।

কেন্ট বললেন, আশা করি ভবিষ্যতে তোমার উপর আমার স্নেহ আরও বেড়ে যাবে।

বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে রাজা ঘরে ঢুকেই চলে যেতে বললেন গ্লস্টার ও এডমন্ডকে। তারা চলে যাবার পর রাজা কিছুক্ষণ চোখ বুলোলেন সাথে নিয়ে আসা সীমানাসহ অঙ্কিত রাজ্যের মানচিত্রের উপর। তারপর উপস্থিত সবার সামনে তিন মেয়ে ও দুই জামাইকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার মেয়ে জামাইরা! আমি স্থির করেছি। রাজার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়ে আমার বুড়ো বয়স অর্থাৎ শেষ জীবনটা আনন্দে কাটাব। সে জন্য আমি সমান তিন ভাগে ভাগ করেছি আমার সাম্রাজ্যকে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে তোমাদের মধ্যে বিবাদ না হয় তাই এই তিন ভাগ আমি দান করে দিতে চাই আমার তিন কন্যাকে। সেই সাথে কর্ডেলিয়ার পাণিপ্রার্থী ফ্রান্স ও বাগন্ডির রাজকুমারের প্রতীক্ষার অবসানও করতে চাই আমি। কিন্তু তার আগে বল, তোমরা আমায় কে কতটুকু ভালোবাস?

রাজার বড়ো মেয়ে গনেরিল বলল সবার আগে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হল অন্ধত্ব, বন্দিদশা এবং মৃত্যু। এ জীবনে যদি আপনার স্নেহ না পাই, তাহলে স্নেহহীন সে জীবন আমার কাছে ভীষণ কষ্টকর বলে মনে হবে। সস্তানের প্রতি আমার স্নেহ-ভালোবাসা যে কোনও সন্তানই কামনা করে।

এ কথা শুনে খুব খুশি হলেন রাজা। আনন্দের চোখে তিনি মেয়েকে দান করে বসলেন। শস্যশ্যামলা এক বিশাল রাজ্য। তারপর মেজ মেয়ে রিগানকে বললেন, এবার বল, তুমি আমায় কতটুকু ভালোবাস?

রিগান উত্তর দিলে, বাবা, আমার প্রতি আপনার যে ভালোবাসা তার পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই, আর আমি সে চেষ্টাও করব না। তবে জেনে রাখুন, মানুষের জীবনে যত কিছু আনন্দ আছে, সে সবই আমার কাছে বিষের মতোই মনে হবে, যদি আমি বঞ্চিত হই। আপনার স্নেহ থেকে।

স্নেহ-দুর্বল বাবা খুব খুশি হলেন মেয়ের কথা শুনে। তিনি রিগানকেও দান করলেন সাম্রাজ্যের এক সমৃদ্ধিশালী অংশ। সবশেষে তিনি উৎসাহ আর আনন্দের সাথে আদরের ছোটো মেয়েকে বললেন সে যেন জানায় বাবাকে সে কতটুকু ভালোবাসে।

কর্ডেলিয়া বলল, মেয়ে হিসেবে বাবাকে যতটুকু ভালোবাসা দরকার, আমি ততটাই ভালোবাসি আপনাকে।

আদুরে ছোটো মেয়ের মুখে শোনা কথা কেন জানি অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল রাজা লিয়ারের। তার মনে হল এক ঝটিকায় তিনি যেন স্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়েছেন শক্ত মাটিতে। তিনি ছোটো মেয়েকে বললেন, আরও একবার ভেবে বল কর্ডেলিয়া, তুমি কি এর চেয়ে বেশি ভালোবাস না আমায়?

দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল কর্ডেলিয়া, আমার যা বলার ছিল তা আমি ভেবে-চিন্তেই বলেছি। যদি আপনাকেই মন-প্ৰাণ দিয়ে ভালোবাসতে হয়, তাহলে স্বামী ও অন্যান্যদের প্রতি আমার ভালোবাসাকর্তব্য বলে কিছুই থাকে না। আর সেটা হবে খুব অন্যায় কাজ। তাই আমি পারি না সমস্ত মন-প্ৰাণ দিয়ে আপনাকে ভালোবাসতে।

কর্ডেলিয়ার কথা বোধগম্য না হওয়ায় রাজা রেগে গিয়ে বললেন তাকে, তোমার মনের কথা যদি এই হয়, তাহলে ঈশ্বরের দোহাই, আজ থেকে তোমার-আমার সম্পর্ক শেষ। তোমার সাথে আমার আচরণও সেরূপ নির্মম হোক, যে আচরণ অসভ্য স্কাইলিয়া করেছিল রানির সাথে। তুমি এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।

এর মধ্যে প্ৰভুভক্ত কেন্ট কিছু বলতে যেতেই চিৎকার করে তাকে থামিয়ে দিলেন রাজা লিয়ার। তারপর বললেন জামাইদের, প্রিয় ছেলেরা, এবার শেষ তৃতীয় ভাগটা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নাও তোমরা। আমি পালা করে তোমাদের দুজনের সাথে থাকব একশো অনুচর নিয়ে। আমার মাথায় মুকুটটাকে দু-ভাগ করে সমস্ত সম্পদ ও ক্ষমতা তোমাদের দান করলাম। আমার জন্য রইল। শুধু রাজা উপাধিটা। তারপর সভাসদদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা যে কেউ একজন গিয়ে ডেকে আন ফ্রান্স ও বাৰ্গান্ডির দুই যুবরাজকে।

কেন্ট বললেন, এরূপ অবিবেচকের মতো কােজ আপনি করবেন না প্ৰভু! একটু ভেবে দেখুন, তাহলে বুঝতে পারবেন। আপনার প্রিয় ছোটো মেয়ে আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে।

কর্ডেলিয়া সম্পর্কে এ কথা বলতেই রাজা তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেলতে চাইলেন কেন্টকে। কেন্ট বললেন, প্রাণের ভয়ে আমি কিছুতেই মিথ্যে, কথা বলতে পারব না প্ৰভু! আপনি যে ভুল করছেন সে কথা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহে প্ৰাণ আছে আমি বলে যাব।

এত রেগে গেছেন রাজা লিয়ার যে স্বাভাবিক জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাই তিনি তার পরম বন্ধু কেন্টকে বলতে পারলেন, তুমি একটা রাজদ্রোহী দুৰ্বত্ত ছাড়া আর কিছু নও। দেশ থেকে আমি তোমাকে নির্বাসিত করলাম তোমার উদ্ধত আচরণের জন্য। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তোমায় এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, অন্যথায় মৃত্যু হবে তোমার।

কন্যাসম কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ করে চোখের জল মুছতে মুছতে রাজসভা থেকে বিদায় নিলেন কেন্ট।

এ সময় শোনা গেল নেপথ্যে কথাবাতাঁর আওয়াজ। দুই যুবরাজ আর তাদের অনুচরদের নিয়ে প্রবেশ করলেন গ্লস্টার।

রাজালিয়ার তাদের দেখে বললেন, হে বাগন্ডির যুবরাজ! আমার ছোটো মেয়ের পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে তুমি অন্যতম। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ। আমার ছোটো মেয়েকে সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ যৌতুক হিসাবে দেব বলে আমি পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সে প্রতিশ্রুতি অর্থহীন। এখন সে পিতার মেহবঞ্চিত ঘৃণ্য এক তুচ্ছ নারী। এবার তুমি বল, এই বঞ্চিত, নিঃস্ব অভিশপ্ত মেয়েকে তুমি কি আগের মতোই বিয়ে করতে আগ্রহী?

সব শোনার পর বাৰ্গান্ডির যুবরাজ অস্বীকার করলেন কর্ডেলিয়াকে বিয়ে করতে। এবার ফ্রান্সের যুবরাজকে উদ্দেশ করে বললেন রাজা, প্রিয় যুবরাজ, এবার বল কর্ডেলিয়া সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?

ফ্রান্সের যুবরাজ বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে কিছুক্ষণ আগে যে ছিল পিতার প্ৰাণস্বরূপ, এমন কী কারণ ঘটল যে এই অল্প সময়ের মধ্যে সে বঞ্চিত হল পিতার স্নেহ থেকে।

সে যাই হোক, প্রকৃত ভালোবাসা স্বর্থহীন। কর্ডেলিয়ার প্রতি আমার প্রেম যে কত নিবিড় তা প্রমাণ করার জন্য কর্ডেলিয়ার মতো প্ৰেম-ধন্যা, সততার পূজারি, সবার অবজ্ঞার পাত্ৰ, নিঃস্ব অথচ সুন্দরী মেয়েকে আমি ফ্রান্সের রানি এবং চিরসঙ্গিনী হিসাবে আনন্দের সাথে গ্ৰহণ করছি— বললেন ফ্রান্সের যুবরাজ।

রাজা বললেন, বেশ, তাই হোক। তারপর কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ না করেই তিনি চলে গেলেন রাজসভা ছেড়ে। আর তার সাথে সাথে বেড়িয়ে গেল বাগন্ডি, কর্নওয়াল, আলবেনি, গ্লস্টার ও তার অনুচরেরা।

প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে যেতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন কর্ডেলিয়া, আমার দুর্ভাগ্য এই যে বাবা ভুল বুঝলেন আমায়। হে আমার বড়ো বোনেরা! তোমাদের প্রতিশ্রুতির উপরই নির্ভর করছে বাবার ভবিষ্যৎ জীবন। আশা করি কর্তব্য পালনে তোমাদের কোনও ত্রুটি হবে না।

একথা বলেই তিনি চলে গেলেন ফ্রান্সের যুবরাজের সাথে। তারা চলে যাবার পর গনেরিল চুপি চুপি বলল তার বোন রিগানকে, দাখ, বুড়ো হয়ে আমাদের পিতা মানসিক দিক দিয়ে খুবই দুর্বল আর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তার পক্ষে সম্ভব হল প্রিয় কন্যার সাথে এরকম ব্যবহার করার। এটা সত্যিই তার অবিবেচক মনের পরিচায়ক।

রিগান বলল, আর বলিস না! এটাই ওর চিরকেলে স্বভাব।

রিগানের কথা শুনে গনেরিল বলল, সেটা তো তাহলে আরও ভয়ের ব্যাপার। বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে তার এই অভ্যোসটা বেড়ে যাবে আর সেটা সহ্য করতে হবে আমাদের। আয়, আমরা দুজনে পরামর্শ করি ভবিষ্যতে কী ভাবে এর হাত থেকে রক্ষণ পাওয়া যায়।

রিগান বলল, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। খুব তাড়াতাড়িই পরামর্শটা করতে হবে আমাদের।

অন্যদিকে গ্লস্টারের প্রাসাদে সে সময় দুভাইয়ের মধ্যে লড়াই চলছিল সম্পত্তি নিয়ে। হে ঈশ্বর! সমাজে এমন নিয়ম কেন তুমি করেছ যে বংশের বড়ো ছেলেই সব কিছুরই মালিক হবে? অথচ দেখ, এই বড়ো ভাইয়ের চেয়ে বয়সে আমি হয়তো এক বছর কিংবা তার চেয়ে কম ছোটো, কিন্তু গুণে আর শক্তিতে কম নই। তাহলে আমি কেন বঞ্চিত হব সম্পত্তি থেকে। যদি তোমার এই নিয়ম হয়, তাহলে জেনে রেখ… বলেই চুপ করে যায় এডমন্ড। এরপর বড়োভাইয়ের উদ্দেশে বলল সে, বুদ্ধির জোরে আমিও অধিকার করব তোমার সম্পত্তি। চিঠির মাধ্যমে কৌশলে পিতার মেহ থেকে দূরে সরিয়ে দেব তোমাকে–এই আমার প্রতিজ্ঞা।

মনে মনে এডমন্ড যখন এরূপ মতলব আটিছিল সে সময় প্রবেশ করলেন তার বাবা গ্লস্টার।

ঘরে ঢুকেই এডমন্ডকে বললেন গ্লস্টার, শুনতে পেলাম রাজা নাকি নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন কেন্টকে? তিনি নাকি সমস্ত সম্পত্তি এবং রাজক্ষমতা দু জামাইয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন সামান্য একটা বৃত্তি? ব্যাপার কী এডমন্ড? এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ তুমি?

এডমন্ড বললেন, ও কিছু নয় বাবা, ভাই এডগারের পাঠানো চিঠিটা পড়ছি।

নিশ্চয়ই ওটা বিশেষ গোপনীয়, বললেন গ্লস্টার, তা না হলে তুমি আমার কাছ থেকে ওটা লুকোতে না। দেখি চিঠিটা?

এডমন্ডের হাত থেকে সেই জাল চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন গ্লস্টার। পড়তে পড়তে এক সময় রাগে। লাল হয়ে উঠল গ্লস্টারের মুখ। চিঠিটাতে লেখা ছিল, ভাই এডমন্ড, তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে বৃদ্ধরা আমাদের বঞ্চিত করে ধন-সম্পত্তি থেকে, ব্যর্থ করে দেয় আমাদের জীবন-যৌবন। তাই এস আমরা দুজন বুড়ো বাবাকে মেরে ফেলে তার সমস্ত সম্পত্তি সমান দু-ভাগে ভাগ করি আর সেই সাথে সার্থক করে তুলি আমাদের জীবন-ইতি এডগার।

বাবার প্রশ্নের উত্তরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল এডমন্ড, আগে আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝে এডগার এরূপ একটা ইঙ্গিত দিত বটে, তবে মনে হচ্ছে। এ চিঠিটা তার লেখা নয়। কেননা জানিলা গলিয়ে এ চিঠিটা কে যেন ভেতরে ফেলে গেছে।

গ্লস্টার বললেন, আমি বলছি চিঠিটা ওরই লেখা। এই এডগারকেই আমি সবচেয়ে বেশি। ভালোবাসতাম। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও যে এত বড়ো শয়তান। যাও, ধরে নিয়ে এস সেই বর্বরটাকে।

এডমন্ড বলল, আপনি অত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আগে আড়াল থেকে আপনি নিজে সব কথা শুনুন, তারপর না হয় তাকে শাস্তি দেবেন। নইলে তার প্রতি ঘোরতর অন্যায় করা হবে বাবা।

ঠিক আছে, সেই ব্যবস্থাই কর, বললেন গ্লস্টার, ওর আসল ইচ্ছেটা জানার পর তুমি স্বর্গমর্ত-পাতাল-যেখান থেকেই হোক সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের করে আন। পৃথিবীটা বডড পাপে ভরে গেছে। মেহের মধুর সম্পর্কগুলি একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা–সব ক্ষেত্রেই আজ এত চক্রান্ত, শঠতা আর প্রতারণা। বাবার বিরুদ্ধে ছেলে, ছেলের বিরুদ্ধে বাবার বিদ্রোহ, চক্রান্ত আজ ঘোরতর অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েছে। পূর্বে করা ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে আজ। কোনও দাম নেই সততার। আমি বলছি এডমন্ড, নিৰ্ভয়ে এগিয়ে যাও তুমি। যেভাবেই হোক, সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের কর তুমি। কঠিন শাস্তি দেব আমি তাকে। দায়িত্ব এড়াবার জন্য অধিকাংশ মানুষ দোষারোপ করে তাদের ভাগ্যকে। কিন্তু চোর, জোচোর, মাতাল, বদমাশ হবার পেছনে মানুষ নিজেই দায়ী।

বলেই গ্লস্টার চলে গেলেন সেখান থেকে। ঠিক তখনই এডমন্ড দেখতে পেল এডগার এদিকেই আসছে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে।

এডগার বলল ছোটোভাইকে, কী হল এডমন্ড, তুমি এত গম্ভীর কেন?

নিরীহ মুখে বলল এডমন্ড, সে সব ভবিষ্যৎবাণীর কথাই আমি ভাবছি। যাতে লেখা আছে পিতা-পুত্রের সম্পর্কছেদ, মৃত্যু। এছাড়াও আরও কত কথা। যাক, সে সব কথা ছেড়ে দাও। বলতো বাবার সাথে শেষ দেখা তোমার কবে হয়েছে? তার সাথে তোমার আচরণে কি কোনও অসন্তোষের ভাব প্রকাশ পেয়েছিল? এসব আমি জানতে চাইছি কারণ বাবা তোমার উপর খুবই রেগে আছেন। এর কারণ কী হতে পারে?

এডগার খুবই অবাক হল এডমন্ডের মুখে এ কথা শুনে। তারপর বলল, আমার এমন ক্ষতি কে করল? গতকাল রাতেই তো আমি দু-ঘণ্টা ধরে তার সাথে কথা বলেছি। কই, তখন তো তার মুখে কোনও রাগের চিহ্ন দেখিনি!

এডমন্ড বললেন, এতে তুমি ভয় পেও না। বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্ত না হন, তুমি আমার ঘরে এসে বিশ্রাম করবে। তারপর তোমাকে আমি নিয়ে যাব তার কাছে। আমি ফিরে আসার পূর্বে যদি তোমার বাইরে যাবার দরকার হয় তাহলে অস্ত্র নিয়ে যেও সাথে। তোমার ভালোর জন্যই বলছি এ কথা। নাও, আর দেরি করো না। আমার ঘরের চাবিটা নাও আর এ জায়গা ছেড়ে শীঘ্ৰ পালাও।

এডগার আটকে পড়ল মায়াজালে। সে চলে যাবার পর মনে মনে খুব খুশি হয়ে বলতে লাগল এডমন্ড, আমার বুদ্ধির জোর বেশি আর তোমার আছে শুধু বোকা সততা। সেই সততার সুযোগ নিয়েই আমায় হস্তগত করতে হচ্ছে তোমার সম্পত্তি। তুমি একটা বোকা, নির্বোধ আর তাই ঈশ্বরের কাছে তুমি করুণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নও।

রাজার বড়ো মেয়ে তার প্রাসাদে সে সময় ব্যস্ত ছিলেন প্রধান অনুচরদের সাথে আলোচনায়। দুঃখের সাথে বললেন গনেরিল, অসওয়াল্ড! একথা কি সত্য যে তার বিদূষককে অপমান করার জন্য বাবা মেরেছেন আমার অনুচরকে? ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন অসওয়ান্ড। তখন  গনেরিল বলল, সত্যিই অসহ্য হয়ে উঠছে বাবার এই নিত্যনতুন অত্যাচার। আর তার নাইটরাও ৪ হয়েছে তেমনি অসভ্য, বর্বর। বুঝলে অসওয়াল্ড, এবার থেকে তুমি আর অন্য চরেরা সবসময় তার সাথে এমন ভাব-ভঙ্গি করবে যাতে তিনি রেগে গিয়ে বোনের বাড়ি চলে যান। আর আমিও নিষ্কৃতি পাব তাতে। অসুস্থতার ভান করে আমিও কথা বলব না তার সাথে। বোনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেব সে যেন বাবার সাথে আমার মতোই ব্যবহার করে। আর সহ্য হচ্ছে; না। সব বিষয়ে তার অকারণ তিরস্কার। যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে বাচ্চাদের মতো বুড়ে। বাবার এরূপ আচরণ। ঐ শোন, দূর থেকে আওয়াজ আসছে তার আগমনের বাদ্যধ্বনির। এবার তোমরা যাও, আমার আদেশ অনুযায়ী তার সাথে ভালো বা খারাপ ব্যবহার করবে।

তুমি কে? কী তোমার পেশা? সামনে দাঁড়ান ছদ্মবেশী ডিউক অব কেন্টকে প্রশ্ন করলেন। রাজা লিয়ার স্বয়ং।

কেন্ট বললেন, মহারাজ, আমার পোশাকই বহন করছে আমার কর্মদক্ষতার পরিচয়। আমি খুব দরিদ্র তবে কখনও বিশ্বাসের অমর্যাদা করি না। আমি সৎ আর জ্ঞানী লোকদের পছন্দ করি। সামান্য কারণে যুদ্ধ করি না। আর মদও খাই না।

কেন্টের কথা শুনে করুণায় ভরে গেল রাজার মন। কেন্টকে তিনি বললেন, তুমি সত্যিই গরিব। কী চাও তুমি আমার কাছে?

আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি আপনার মুখে প্ৰভুত্বের দীপ্তি দেখে, বললেন কেন্ট, আমি চাই আপনার অধীনে কাজ করতে।

রাজা জানতে চাইলেন, কি কাজ করতে পারবে তুমি?

কেন্ট উত্তর দিলেন, আমি জানি দরকারি কথার গোপনীয়তা রক্ষা করতে, দ্রুত ঘোড়ায় চড়তে। এছাড়া সাধারণ মানুষের অন্যান্য গুণেরও অধিকারী আমি। আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পেছপা নাই, বয়সও সহজে কাবু করতে পারে না আমায়।

কেন্টের কথা শুনে রাজা বললেন, আমার ভূত্য হিসেবে আমি তোমায় মনোনীত করলাম। এরপর তিনি অসওয়াল্ডকে বললেন গনেরিলকে ডেকে আনতে। এমন সময় জনৈক নাইট এসে জানাল যে রাজার মেয়ে অসুস্থ। লিয়ার জানতে চাইলেন, গনেরিলকি আসবে না! নাইট বলল, আমার অপরাধ নেবেন না প্ৰভু! আমার মনে হয় আপনার মেয়ে-জামাই আর তাদের লোকেরা আগের মতো শ্রদ্ধা করে না। আপনাকে। আপনি এখন তাদের কাছে বোঝা ছাড়া আর কিছু নন।

ঠিকই বলেছ তুমি বললেন লিয়ার, আমিও লক্ষ করেছি যে ওরা কর্তব্যে অবহেলা করছে। তবে মনে করেছিলাম যে ওটা আমার মনের ভুল, ভবিষ্যতে এবিষয়ে তীক্ষ দৃষ্টি রাখব। যাই হোক, আমার বিদূষক কোথায়?

নাইট বললেন, কৰ্ডেলিয়ার দুঃখে তিনি খুবই দুঃখিত মহারাজ। এ দুদিন তাই তিনি আসেননি।

তাকে নিরস্ত করে লিয়ার বললেন, থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি স্থির করেছি মেয়ের সাথে কথা বলব। যাও, তাকে ডেকে আন তুমি।

এসময় ঢুকে পড়ল। অসওয়ান্ড। তাকে দেখে লিয়ার বললেন, তুমি জান আমি কে?

অসওয়াল্ড উত্তর দিলেন, জানি। আপনি আমার প্রভুপত্নীর পিতা।

রেগে বললেন লিয়ার, কী বললে? এছাড়া আমার আলাদা কোনও পরিচয় নেই? তোমার এত দুঃসাহস আমার মুখের উপর কথা বলছ? এজন্য আমি তোমায় শাস্তি দেব। বলেই রাজা

শুরু করলেন তাকে মারতে।

তখন কেন্ট বললেন অসওয়াল্ডকে, এই মুহূর্তে এখান থেকে দূর হয়ে যাও নির্বোধি। তোমার কি কাণ্ড-জ্ঞান লোপ পেয়েছে? কার সাথে কীরূপ ব্যবহার করতে হয় তা কি তুমি জান না? বলেই কেন্ট গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল অসওয়াল্ডকে। কেন্টের এই আচরণে রাজা খুব খুশি হয়ে উপহার দিলেন তাকে।

এমন সময় বিদূষক এসে প্রবেশ করল। তাকে দেখে রাজা ব্যগ্র হয়ে বললেন, তুমি কেমন আছে বিদূষক?

কেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল বিদূষক, স্যার, আমার টুপিটা আপনি নিন। কারণ যার অধীনে আপনি কাজ করেন। তিনি স্বয়ং তার দুই মেয়েকে নির্বাসন দিয়েছেন আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তৃতীয় মেয়েটিকে আশীৰ্বাদ করেছেন। ভগবান যদি আমায় দুটো মেয়ে আর দুটো টুপি দেন—

তার কথা শেষ না হতেই রাজা জানতে চাইলেন, তাহলে?

তাহলে বিষয়-সম্পত্তি তাদের দিয়ে দেবার পর অন্তত একটা টুপি আমার জন্য রেখে দিতাম–বলল বিদূষক, আপনাকে এখন অন্য মেয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

রেগে গিয়ে লিয়ার বললেন তাকে, এর জন্য কিন্তু তোমায় শাস্তি পেতে হবে।

বিদূষক বললেন, মহারাজ, ভয় পেয়ে যে নির্বোধ সত্যকে এড়িয়ে যায়, সে শুধু মিথ্যাকেই আরও বেশি প্রশ্রয় দেয়। এবার আপনি শুনুন, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার সঞ্চায়ের পরিমাণ বাইরের কাউকে জানায় না। সে কম কথা বলে, ব্যয়ের চেয়ে তার আয় বেশি। হাঁটাপথে না গিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে, কোনও কিছুতেই সে দমে না। আর বাজি রাখে বিশেষ বিবেচনার সাথে।

রাজা বললেন, এখানে এ সব কথার কোনও মানে হয় না, খুবই শক্ত তোমার কথাগুলি।

এবার বিদূষক বলল, যে লোকটি আপনাকে বিষয়-সম্পত্তি দান করার পরামর্শ দিয়েছিল তাকে আপনি ডাকুন নয়তো নিজে দাঁড়ান। তার জায়গায়, তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন তেতো ভাঁড় আর মিষ্টি ভাঁড়ের পার্থক্য।

ভাঁড়ের কথা শুনে বললেন কেন্ট, তুমি মোটেও বোকা নও।

ভাঁড় বলল, মোটেও নই, কারণ বোকা হলে চলবে না আমার। এই পৃথিবীর কেউ পুরোপুরি বোকা নয়, রাজার উদ্দেশে বলেই চললেন বিদূষক, আপনি কিন্তু বোকামি করে আপনার সম্পদ ও ক্ষমতা দুভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। এরপর বিদূষক তার কথার সারমর্ম বোঝাতে লাগল একটি গান গেয়ে।

লিয়ার বললেন, কবে থেকে তুমি গান গাইছ?

ভাঁড় বলল, যবে থেকে সবকিছু কন্যাদের দান করে নিঃস্ব হয়েছেন আপনি।

রেগে গিয়ে বললেন লিয়ার, তুমি একটা মিথ্যেবাদী। আমি চাবুক মারব তোমাকে।

ভাঁড় বলল, সত্যি কথা বলার জন্য চাবুক মারে আপনার মেয়েরা। আপনি মারেন মিথ্যে কথা বলার জন্য। কী আশ্চর্য মিল আপনাদের মধ্যে। ওই যে আসছে আপনার বুদ্ধির দুর্ভাগ্যের একজন।

গনেরিলকে আসতে দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন রাজা, কী ব্যাপার গনেরিল! আজিকাল প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি। তোমার গম্ভীর মুখ। এর কারণটা বলবে কি?

বিদূষক বলল রাজাকে, মহারাজ, উনি হলেন মটরডালের ভূসি। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মধ্যে।

রেগে গিয়ে বলল গনেরিল, শুধুমাত্র ও নয়, আপনার প্রশ্ৰয় পেয়ে আপনার অনুচরেরা পর্যন্ত আমার সাথে ঝগড়া করার সাহস পায়, অভদ্র হয়ে ওঠে তাদের আচরণ। একটু আগে আপনি যে ব্যবহার আমার সাথে করলেন, আমি ভয় পাচ্ছি। এই ভেবে যে আপনার সমর্থনেই ওরা এতটা বেড়ে ওঠার সাহস পেয়েছে। যদিও একথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে, তবুও অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়েই বলছি। এর জন্য আপনার শাস্তি পাওয়া উচিত। তাতে হয়তো অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষণ পাওয়া যাবে।

বিদূষক বলল, কোকিল। যেমন তার পালক পিতা কাককে মেরে ফেলে, ঠিক সেইরকম।

গনেরিলের কথা শুনে রাজা খুব দুঃখ পেলেন মনে। তিনি বললেন, আমি কে তা কি তুমি ভুলে গেছ?

উদ্ধত স্বরে জবাব দিল গনেরিল, বাবা, আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।

লিয়ার বললেন, তাহলে কি পাগল হয়ে গেছি আমি? আমি কি আর সেই পূর্বের রাজা লিয়ার নই? কেন এমন পালটে গেছে আমার হাঁটার ধরন? কোথায় আমার সেই দৃষ্টিশক্তি? হায়! আমার বিচার শক্তিও আজ স্নেহবশত দুর্বল হয়ে গেছে? আমি তাহলে কে?

বিদূষক উত্তর দিল, আপনি লিয়ারের ছায়া।

রাজা বললেন, তবে যে লোকে বলছে আমি সেই তিন মেয়ের বাবা রাজা লিয়ার আর তুমি গনেরিল?

গনেরিল বলল, বয়সের কারণেই আপনার এই ভ্ৰাস্তিজনিত মানসিক দুর্বলতা। আপনি বৃদ্ধ ও সম্মানিত। সে কারণে আপনার বোঝা উচিত যে আপনার অনুগত একশো নাইটের আচরণ খুবই অশোভন। সব সময় তারা মদ খেয়ে বাজে কাজে লিপ্ত থাকে। গোটা রাজসভাটা এজন্য পরিণত হয়েছে এক বিলাস কেন্দ্রে। সে কারণে এখনই আমাদের উচিত ওই বিশৃঙ্খলাকারীদের অপমান করা। আমার কথা শুনুন বাবা। বয়স অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত সঙ্গী আর অনুচরদের রেখে তাড়িয়ে দিন বাকিদের। আপনি না করলে বাধ্য হয়েই এ কাজ করতে হবে আমায়।

খুবই অপমানিত বোধ করলেন রাজা লিয়ার। তিনি বেজায় রেগে গেলেন এত বড়ো একটা অপমানের আঘাতে। চিৎকার করে তিনি বললেন, অকৃতজ্ঞ মেয়ে, আমি এ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভুলে যেও না, আমার আরও সস্তান আছে।

গনেরিল, আমার লোকজনের উপর নিন্দনীয় আচরণ করছে আপনার অনুচরেরা।

এমন সময় প্রবেশ করল আলবেনি। কিন্তু তাকে দেখেও থামলেন না। রাজা। সজোরে প্রতিবাদ করে তিনি বললেন, গনেরিল, তুমি শুধু লোভী নও, মিথ্যেবাদীও বটে আমার অনুচরেরা সবাই জ্ঞানী ও গুণী। কোনওরূপ অশোভনীয় আচরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর অনুতপ্ত রাজা নিজের মাথায় হাত চাপড়িয়ে বলতে লাগলেন, হায়! হায় কর্ডেলিয়ার চরিত্রের যে সমস্ত দোষ আমার চেতনাকে নষ্ট করে দেয়, তার প্রতি ঘৃণা আর তিরস্কারের মধ্য দিয়ে মুখামি প্রবেশ করে বিষাক্ত করে তোলে আমায়, সেই বোধকে আজ ধিক্কার জানাচ্ছে রাজা লিয়ার।

আলবেনি বলল, আপনি অযথা উত্তেজিত হবেন না মহারাজ। অনুগ্রহ করে শাস্ত হোন। আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ।

লিয়ার বললেন, হয়তো তাই। তবুও তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি গনেরিল তোমার এই কদৰ্য নোংরা দেহ বঞ্চিত হবে সন্তান ধারণের গৌরব আর আনন্দ থেকে। আর সন্তান জন্মালেও তা হবে অদ্ভুত ধরনের। তার জন্য দুশ্চিন্তায় বিশ্ৰী হয়ে যাবে তোমার এই সুন্দর মুখ, শুকোবে না। চোখের জলও। তোমার পক্ষে তীক্ষ্ণ আর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে বিষাক্ত সাপের দাঁতের মতো সেই সন্তান। আমি চলে যাচ্ছি। কারণ আমায় যেতেই হবে।

রাজা লিয়ার চলে যাবার পর আলবেনি বলল, এর অর্থ কী গনেরিল? গনেরিল বলল, জেনে রেখ, এটা ওর বুড়ো বয়সের হঠকারিত।

লিয়ার আবার ফিরে এসে গনেরিলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার এত দুঃসাহস যে আমার অনুমতি ছাড়াই পঞ্চাশ জন অনুচরকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাসাদ ছেড়ে যাবার আদেশ দিয়েছ তুমি? ছিঃ গনেরিল, বৃদ্ধ বাবাকে অপমান করে তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরানোর প্রবৃত্তি দেখে আমি যত না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি পেয়েছি লজ্জা। মনে রেখ, দয়া-মমতাময়ী আমার আর এক কন্যা আছে! এর শাস্তি সে তোমাকে দেবে! আমি অভিশাপ দিচ্ছি, অনুশোচনায় দগ্ধ হবে তোমার সমস্ত মন।

রাজা লিয়ারের পেছু পেছু চলে গেল কেন্ট ও অন্যান্য অনুচরেরা।

গনেরিল বলল তার স্বামীকে, দেখলে ওর ব্যবহারটা?

আলবেনি বলল, তোমার প্রতি আমার আকৃত্রিম ভালোবাসাই আমায় বলতে বাধ্য করছে যে কাজটা তুমি ঠিক করনি।

তুমি চুপ কর— বলে স্বামীকে থামিয়ে দিলেন গনেরিল। তারপর বিদূষককে বললেন, শয়তান, মুখ! তুমিও দূর হয়ে যাও বাবার সাথে। ওর বার্ধক্যজনিত এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার আরও বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সুসজ্জিত একশো নাইটের শক্তিবলে, আর দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অত্যাচার সহ্য করা নিশ্চয়ই আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

তোমার ভয় নিতান্তই অমূলক–বলল আলবেনি।

তা হয় হোক, বলল গনেরিল, আসলে ভয় থেকে মুক্ত হতে গেলে আগে থেকেই জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন, নইলে ভবিষ্যতে সেখান থেকেই বীর বংশের বীজ উৎপন্ন হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি আমার বোন একশো নাইট সহ বাবাকে আশ্রয় দেয়, তাহলে— এই যে অসওয়াল্ড, লিখেছ সেই চিঠি? জানতে চাইল গনেরিল।

অসওয়াল্ড উত্তর দিল, হ্যাঁ, লিখেছি।

গনেরিল নির্দেশ দিল অসওয়াল্ডকে, তাহলে ঘোড়ায় চেপে এখনই এই চিঠি নিয়ে চলে যাও বোনের কাছে। আরও কিছু কারণ দেখিয়ে জোরদার করে তোেল আমার যুক্তিগুলিকে-যাতে সেও ভয় পায়! যাও, এবার চলে যাও। অসওয়াল্ড চলে যাবার পর আলবেনিকে উদ্দেশ করে। বলল গনেরিল, তুমি যত না দুর্বল তার চেয়ে বেশি বোকা।

স্ত্রীর মুখে একথা শুনে আলবেনি বলল, তুমি জান তো অনেক সময় অধিক লোকের দ্বারা ঠকে গিয়ে মানুষ বঞ্চিত হয় তার প্রাপ্যবস্তু থেকে।

তাহলে কী বলতে চাও তুমি? জানতে চাইলে গনেরিল।

আলবেনি তার উত্তরে বলল, কিছুই বলতে চাই না আমি। ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে সব কিছু।

কেন্টের হাতে একটা চিঠি দিয়ে লিয়ার বললেন তাকে, এই চিঠিটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও গ্লস্টারের হাতে। চিঠিতে যা লেখা আছে আর আমার মেয়ে যা জানতে চায়, ঠিক সেটুকুরই উত্তর দেবে, বেশি কিছু মোটেও বলবে না। এটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। নইলে তার আগেই আমি গিয়ে পৌঁছাব সেখানে।

তাই হবে প্রভু বলল কেন্ট, আপনার আদেশ পালনের আগে আমি অন্য কিছুতে মন দেব না।

এবার বিদূষক বলল, সত্যি কথা বলার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন মহারাজ। আপনার কন্যার আচরণ কী হবে সে তো আপনি ভালেই জানেন।

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে লিয়ার বললেন, বলতো, কী হবে?

বিদূষক উত্তর দিল, দিদির মতোই উপযুক্ত হবে তার আচরণ। সোজাপথে না গিয়ে মানুষ যেমন ঘুরপথে গোপনীয় খবর সংগ্রহ করে, তেমনি মানুষের এক চোখ যাতে অন্য চোখকে দেখতে না পায় সেজন্যই ঈশ্বর ব্যবধান তৈরি করেছেন নাসিকা সৃষ্টির মাধ্যমে।

কর্ডেলিয়ার প্রতি আমার আচরণ ঠিক নয় তা আমি জানি, বললেন লিয়ার।

বিদূষক বলল, যাতে শামুকরা আশ্রয়হীন না হয় তাই একটি খোলা তৈরি আছে তাদের মাথা গোঁজার জন্য।

লিয়ার বললেন, ও কথা আর আমাকে মনে করিয়ে দিও না। জোর করে আমি কেড়ে নেব সব।

বিদূষক বলল, মহারাজ, বয়স বাড়ার আগেই আপনার এ বুদ্ধি হওয়া উচিত ছিল।

লিয়ার বললেন, দোহাই তোমাদের, আমাকে তোমরা পাগল করে দিওনা। হে ঈশ্বর! আমার বিবেক-বুদ্ধিকে চঞ্চল করে তুলোনা তুমি। আমি পাগল হতে চাইনা! না, কখনই না।

 

০২.

সুপ্ৰভাত কিউরান, বলল এডমন্ড।

প্রতি উত্তরে বলল কিউরান, সুপ্ৰভাত এডমন্ড। আমি এইমাত্রই এলাম। আপনার বাবার কাছ থেকে। আমি আগে থেকেই তাকে সতর্ক করে দিয়েছি ডিউক অফ কর্নওয়াল ও রিগানের আসার ব্যাপারে। ভালো কথা, আপনি কি শুনেছেন একটা খবর?

কী খবর কিউরান? জানতে চাইল এডমন্ড।

কিউরান বলল, আলবেনি আর কর্নওয়ালের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। উভয়েই গোপনে যুদ্ধের আয়োজন করছেন।

না, সে কথা শুনিনি তো, বলল এডমন্ড।

কিউরান বলল, এবার তাহলে আমি চলি স্যার।

ঠিক আছে, তুমি এস, এডমন্ড বলল।

কিউরান চলে যাবার পর মনে মনে চিস্তা করতে লাগল এডমন্ড, ডিউক আসছেন, সে তো খুব ভালো কথা। ভাগ্যের উপর নির্ভর এবার আমার পরিকল্পনামাফিক কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি। গলাটা একটু উঁচু করে ভাইকে বললেন তিনি, নেমে এস, একটা কথা আছে তোমার সাথে। এই অন্ধকারের মাঝে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও তুমি। বাবা জানতে পেরেছেন তুমি কোথায় লুকিয়ে আছি। ঐ বাবার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। তলোয়ার বের করে আত্মহত্যার ভান করি। ও রে কে আছিস; আলো আন। যাও, শীঘ্ৰ পালিয়ে যাও।

এডমন্ড চলে যাবার পর নিজের চক্রান্তকে আরও যুক্তিপূৰ্ণ করে তুলতে নিজেই আঘাত করল নিজেকে। তারপর সেই রক্তাক্ত হাত নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, কে আছ, বাঁচাও আমাকে। বাবা, কোথায় তুমি?

ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলে উঠলেন গ্লস্টার, কী হয়েছে, এডমন্ড? এত রক্ত কেন তোমার হাতে?

এডমন্ড বলল, এই অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনমনে কী সব যেন বলছিল এডগার। আপনার শব্দ শুনেই সে পালিয়ে গেল এই রাস্তা দিয়ে।

কোথায় পালাবে সে শয়তানটা! ভাবেই হোক তা থেকে খুঁজে বের কর তোমরা — বলে অনুচরদের নির্দেশ দিলেন গ্লস্টার। তারপর জানতে চাইলেন এডমন্ডের কাছে, তোমার কাছে কেন সে এসেছিল?

এডমন্ড উত্তর দিলে, সে আমার কাছে এসেছিল। আপনাকে হত্যা করার উপদেশ দিতে। কিন্তু আমি মন থেকে কিছুতেই সায় দিইনি। পিতৃহত্যার মতো জঘন্য কাজে। তাই সে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে আমায়। যখন আমি তার অসৎ উদ্দেশ্যের জোর প্রতিবাদ করছি আর প্রতি আক্রমণে উদ্যত হয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছি, ঠিক তখনই সে পালিয়ে গেল ভয় পেয়ে।

স্নেহশীল পিতা কিন্তু বুঝতে পারল না এডমন্ডের চালাকি, উপরন্তু তার প্রতি করুণায় বিগলিত হয়ে তিনি বললেন, রাজার আদেশ নিয়ে আমি সারা রাজ্যে ঘোষণা করে দেব যে তাকে ধরে আনতে পারবে, তাকে প্রচুর পুরস্কার দেওয়া হবে। আর তার আশ্রয়কারীকে দেওয়া হবে প্ৰাণদণ্ড।

এডগারের প্রতি পিতার অবিশ্বাসকে আরও জোরদার করার জন্য বলল এডমন্ড, বাবা, সে আমায় ভয় দেখিয়ে গেছে। যদি আমি এই ষড়যন্ত্রের কথা প্ৰকাশ করি, তাহলে সে বলবে। আমিই নাকি সেই ষড়যন্ত্রের কারণ। সে নাকি আমার প্ররোচনাতেই পিতৃসম্পত্তি গ্ৰাস করার ষড়যন্ত্র করেছে। তার মৃত্যুতে আমার পক্ষে সম্পত্তি লাভ সহজ হবে জেনেই আমি নাকি মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছি।

গ্লস্টার বললেন, কোনও ভয় নেই তোমার। ওর হাতের লেখাই প্রমাণ করবে ওর ষড়যন্ত্রের কথা। ঐ শোন মহামান্য ডিউকের আগমনের বাদ্যধ্বনি। শয়তানটা যাতে আমার রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। সেজন্য সমস্ত শহর ও বন্দরের পথ বন্ধ করে দেব আমি। রাজ্যের সর্বত্র পথে-ঘাটে ওরা ছবি ছাপিয়ে দেব আমি। সন্তানের উপযুক্ত কাজই করেছ তুমি। ওকে আর আমি সস্তান বলে স্বীকার করব না। আমার একমাত্র সন্তান তুমিই আর সমস্ত সম্পত্তি আমি তোমাকেই দিয়ে যাব।

এ সময় কর্নওয়াল প্রবেশ করে বললেন গ্লস্টারকে, কেমন আছ বন্ধু? ভারি একটা আশ্চর্য খবর শুনলাম। এখানে এসে।

এ কথা সত্যি হলে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া কঠিন হবে–বলল রিগান, আচ্ছা, বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী কি ওর নাম রাখা হয়েছিল?

সে কথা বলতে আমার বুক দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম–বলল গ্লস্টার।

রিগান বলল, আচ্ছা, ওকি আমার বাবার উচ্ছঙ্খল নাইটদের মধ্যে একজন?

এডমন্ড জানাল, হ্যাঁ ম্যাডাম, ও ছিল তাদেরই একজন।

একথা শুনে রিগান বলল, এবার বেশ বুঝতে পারছি আমি। বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করতে ঐ শয়তান নাইটরাই প্ররোচিত করেছে তাকে। এডগারের সাথে সাথে তাহলে তারাও ভোগ করতে পারবে সম্পত্তি। আজ সন্ধ্যায় আমি দিদির পাঠানো একটা চিঠি পেয়েছি। যাতে এদের সম্পর্কে আমায় সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। সে চিঠিতে দিদি লিখেছে ওরা আসার আগেই আমি যেন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই।

কর্নওয়াল বলল, তুমি ঠিক কথাই বলেছ প্রিয়তম। আর এডমন্ড, যথার্থ পুত্রের মতোই আন্তরিক তোমার কর্তব্যবোধ।

আনন্দে গদগদ স্বরে উত্তর দিল গ্লস্টার, ঠিক সে কারণে সে আহত হওয়া সত্ত্বেও সমঝোতা করেনি। অন্যায়ের সাথে।

কর্নওয়াল বলল, ওর খোঁজে আপনি চর পাঠান চারিদিকে। এ ব্যাপারে সবরকম সাহায্য আপনি পাবেন আমার কাছ থেকে। আর এডমন্ড, আমাদের এখন প্রয়োজন তোমার মতো সৎ, কর্তব্যপরায়ণ, বিশ্বাসী, বীর যুবকের। আমাদের আন্তরিক ইচ্ছা তুমি সহচর রূপে আমাদের কাছাকাছি থাকো।

এই যদি আপনাদের ইচ্ছা হয়, তাহলে সততা আর বিশ্বাসযোগ্যতার গুণে আপনাদের স্নেহভাজন হতে পেরে আমি ধন্য মনে করছি নিজেকে, বলল এডমন্ড।

আনন্দের সাথে গ্লস্টারও সায় দিলেন তার কথায়।

রিগান বলল, হে মাননীয় আর্ল অফ গ্লস্টার। আপনি আমাদের পুরনো বন্ধু। এই অন্ধকার রাতে আমরা এখানে এসেছি একটা গুরুতর বিষয়ে আপনার পরামর্শ নিতে। আমাদের পিতাকন্যার বিরোধের ব্যাপারে কোনটি গ্রহণযোগ্য সে ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত জানালে বাধিত হব।

আগে আমার বাড়িতে চলুন। তারপর সবাই মিলে না হয় পরামর্শ করা যাবে–বলল গ্লস্টার।

রিগান বলল, বেশ, তাই চলুন।

 

অসওয়ান্ড বলল, নমস্কার বন্ধু। আমার প্রতি যদি তোমার বিন্দুমাত্ৰও ভালোবাসা থাকে, তবে সে ভালোবাসার দোহাই, দয়া করে আস্তাবলটা দেখিয়ে দাও আমাকে।

কেন্ট বলল, তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্রও ভালোবাসা নেই।

তাতে আমার কিছু এসে যায় না, উত্তর দিল অসওয়ান্ড।

লিপসবেরি পাউন্ডে গেলে কিন্তু গ্রাহ্য করাটা প্রয়োজন হবে, বলল কেন্ট।

অসওয়াল্ড বলল, আমার সাথে এভাবে ঝগড়া করছি কেন? আমি মোটেও চিনি না তোমাকে।

তবে আমরা কিন্তু দুজনে দুজনকে চিনি। তুমি হচ্ছ.পরান্নে পালিত একটা নিঃস্ব, দুৰ্বত্ত, কাপুরুষ ক্রীতদাস। মনে নেই কদিন আগে আমারই আঘাতে রাজার সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিলে তুমি। এবার অস্ত্র ধর শয়তান— চিৎকার করে বলে উঠল কেন্ট।

অসওয়াল্ড বলল, চলে যাও তুমি। আমার কোনও শত্রুতা নেই তোমার সাথে।

রাগের সাথে কেন্ট বলতে লাগল, তোমার একমাত্র দোষ এই যে তুমি রাজার বিরুদ্ধে উদ্ধত, ঘৃণিত গনেরিলের লেখা চিঠি বয়ে নিয়ে এসেছী। পাঁজি শয়তান, তলোয়ার না বের করলে তোমার পা দুটোই কেটে নেব আমি।

ভয় পেয়ে অসওয়াল্ড যতই সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগল, ছদ্মবেশী কেন্ট ততই আঘাত করতে লাগল তাকে।

খোলা তলোয়ার হাতে ঘরে ঢুকে এডমন্ড ছাড়িয়ে দিল তাদের দুজনকে। ত্রুদ্ধ কেন্ট বলতে লাগল, লড়াই করতে ভয় পোচ্ছ কেন হে ছোকরা!

অসওয়াল্ড বলল, যদি প্ৰাণের মায়া না থাকে। তবে ভয় পাচ্ছিস কেন? আমাদের উভয়ের মধ্যে লড়াইয়ের কারণটাই বা কী?

রিগান বলল, এদের চিনতে পেরেছি আমি। এরা আমার বোন ও বাবার দূত।

তাহলে তোমাদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধিল কেন? আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইল কর্নওয়াল।

অসওয়াল্ড বলল, এই বুড়োটা বেজায় পাজি। শুধু ওর সাদা দাড়ির খাতিরে আমি ছেড়ে দিয়েছি। ওকে।

ফের মিথ্যে কথা, গজে উঠে বলল কেন্ট।

চুপ কর, তুমি কি ভদ্রতাবোধও ভুলে গেছ? বলল অসওয়ান্ড।

কর্নওয়ালকে উদ্দেশ করে কেন্ট বলল, স্যার, এ ধরনের লোকেরা মানুষের ভেতরের কোমল ও পবিত্র সম্বন্ধের অবসান ঘটায়। ভূতের মতো এরা প্রভুকে নির্মল তোষামোদ করে তাকে আরও ভয়ংকর করে তোলে। আবার হাসছিস; মৃগী রোগীর মতো তোর ওই বিবৰ্ণ মুখটায় নেমে আসুক অভিশাপ। এর মতো বদমাশ লোক আমি কখনও দেখিনি।

ও বদমাস কীসে হল? জানতে চাইল কর্নওয়াল।

ওর মুখই তার প্রমাণ, উত্তর দিল কেন্ট।

অসওয়াল্ড বলল, স্পষ্টবাদী হবার দরুন। এ জাতীয় লোকেরা সরল হলেও খুব ভয়ানক বা ধূর্ত হয়, সে কথা আমি জানি।

আমার কিন্তু আপনার প্রতি সেরূপ কোনও বদমতলব নেই, বলল কেন্ট, আমি সরল তবে প্ৰতারক নই। আমার মতো সাধারণ শ্রেণির সরল ও সৎ লোক কখনও পর হয় না।

অসওয়ান্ড বলল, ওর বিরুদ্ধে আমার কোনও ব্যক্তিগত অভিযোগ নেই প্ৰভু। তবে কিছুদিন আগে ভুল বুঝে রাজা লিয়ার আমায় আঘাত করলে এই লোকটাও আমাকে আঘাত করে পেছন দিক থেকে। রাজার প্রশংসা কুড়েবার জন্য এই হীন জঘন্য লোকটা আমায় যাচ্ছেতাই গালাগাল আর অপমান করে।

রেগে গিয়ে অসওয়াল্ড আদেশ দিলেন তার অনুচরদের, বদমাশ মিথ্যেবাদী শয়তান এই বুড়োটার দুপায়ে কাঠের খুটো পরিয়ে দাও। ওকে আমি এমন শাস্তি দেব যে-

স্যার, আমি কিন্তু রাজার দূত। রাজদূতের পায়ে খুঁটো পরালে পরোক্ষভাবে রাজারই অপমান হবে, বলল কেন্ট।

রিগান বলল, ও সব কিছু শুনতে চাই না আমি। পায়ে খুঁটো বেঁধে ও দুপুর পর্যন্ত, না রাত পর্যন্ত থাকবে।

তাহলে এই সেই অন্যতম বদমাশ, যার কথা বলেছিল। গনেরিল, বলল কর্নওয়াল।

গ্লাস্টর বলল, মাননীয় ডিউক, চোরের মতো কঠিন শাস্তি আপনি ওকে দেবেন না। ওর প্রভুর উপরেই আপনি ছেড়ে দিন ওর শাস্তির ভার। রাজদূতকে এভাবে অপমান করলে রাজা রুষ্ট হবেন আপনার উপর।

রিগান বলল, কিন্তু মাননীয় গ্লস্টার, ওকে শাস্তি না দিলে যে আমার অনুচরদের প্রতি অন্যায় করা হবে। তাই আপনার অনুরোধ রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। এবার কর্নওয়ালের দিকে ফিরে সে বলল, চলুন, আমরা সবাই এখান থেকে চলে যাই।

সবাই চলে যাবার পর গ্লস্টার বলল কেন্টকে, আমি অবশ্য ডিউককে অনুরোধ করব তার এই অন্যায় খেয়ালের পরিবর্তনের জন্য।

না স্যার, আপনি করবেন না, বলল কেন্ট, এই সুযোগে আমি কাটিয়ে দেব পথের ক্লান্তি।

গ্লস্টার চলে যাবার পর আপন মনে বলতে লাগল কেন্ট, হে মুখ, আমার এ চিঠি পাঠ করতে সাহায্য করুক তোমার প্রখর কিরণ রাশি। আমি কর্ডেলিয়াকে বিশদভাবে জানিয়েছি আমার সমস্ত কার্যকলাপ। আশা করছি যে কোনও মুহূর্তে তিনি এসে উদ্ধার করবেন আমাদের মহান রাজাকে। হে আমার দুনিয়ন, দীর্ঘদিনের পথশ্রমে তোমরা যে ধ্বস্ত ও ক্লাস্ত তা আমি জানি। এবার সময় এসেছে তোমাদের ভালোমতন বিশ্রাম নেবার। হে সৌভাগ্যের দেবী, তুমি আমাদের উপর বুলিয়ে দাও তোমার প্রসন্ন দৃষ্টি।

 

ঘরে ঢুকে পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলতে লাগল এডগার, ভাইকে বিশ্বাস করে আজ আমার এই অবস্থা। পলাতক আসামীর মতো ঘৃণ্য পোশাকে,গরিবের মতো নগ্নপদে, রুক্ষ, অবিন্যস্ত চুল নিয়ে, গাছের কোটরে দিন যাপন করে, ছদ্মবেশে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আমাকে। আমার অবস্থােটা সেই গরিবভিখারি টম টার্লিগদের মতো, যারা নিরাশ্রয়–পরের উপর নির্ভরশীল। তাদেরও কিছু মূল্য আছে, কিন্তু আমার তাও নেই।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাজা লিয়ার, এতক্ষণে তো আমার অনুচরদের এখানে এসে যাবার কথা, অথচ তুমি বলছি কাল রাতেই হঠাৎ এ বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছে আমার মেয়ে-জামাই। হঠাৎ তার চোখে পড়ল বন্দি অবস্থায় সামনে দাঁড়ান কেন্টকে। বিস্মিত হয়ে তিনি বললেন, এরূপ নির্মমভাবে কে তোমায় বন্দি করেছে?

বিদূষক বলল, এ ধরনের যন্ত্রণাদায়ক কাঠের লাগাম কেবল পরানো হয় ঘোড়ার মাথায় কুকুর, ভালুকের গলা নতুবা রাজদ্রোহীর পায়ে।

লিয়ার জানতে চাইলেন, বল, কে তোমায় আটকে রেখেছে। এ অবস্থায়?

কেন্ট উত্তর দিলে, প্ৰভু, সে অপরাধী আপনার মেয়ে-জামাই।

লিয়ার বললেন, না, না, এ কখনই হতে পারে না। ঈশ্বরের নামে শপথ নিয়ে বলছি, এরূপ ভয়ংকর কাজ করার সাহস তাদের কখনই হবে না।

কেন্ট বলল, হে প্ৰভু, আপনার প্রতি শ্ৰদ্ধা নিয়েই বলছি, তারাই করেছে এ কাজ।

লিয়ার বললেন, হায় ভগবান! এত মানুষ খুন করার চেয়েও জঘন্য কাজ। আমি তো তোমায় পাঠিয়েছিলাম। শুধু একটা চিঠি পৌঁছে দিতে। কিন্তু তুমি এমন কী করেছ যার জন্য তারা এই কঠিন

কেন্ট বলল, আমার চিঠি পাবার পর পরই গনেরিলের পক্ষ থেকে একজন দূত এসে তাকে চিঠি দিল একটা। দ্বিতীয় চিঠিটা পড়ার পরই আমার প্রতি চরম অবজ্ঞা দেখিয়ে তিনি চলে গেলেন ঘোড়ায় চড়ে। ওরা চলে যাবার পর আমি লোকটাকে চিনতে পেরে রাগের মাথায় তলোয়ার বের করে হত্যা করতে যাই ওকে। ওর চিৎকার শুনে আপনার মেয়ে-জামাই ফিরে এসে এই কঠিন শাস্তি দিয়েছেন আমায়।

বাবার টাকা-পয়সা কমে যাবার সাথে সাথে সস্তানের ভালোবাসাও ওঠা-নমা করে–বলল বিদূষক।

গভীর দুঃখে ভেঙে পড়ল রাজার লিয়ারের মন। দুঃখের সাথে তিনি বললেন, তোমরা দুজনে শান্ত হও। এভাবে অস্থির করে তুলোনা আমায়! আমি মিনতি করছি, তোমরা দুজনে শান্ত হও। কিন্তু আমার মেয়ে কোথায় গেল কেন্ট? বলে ফিরে গেলেন তিনি। তিনি ফিরে যাবার পর কেন্ট উৎসুক হয়ে বলল বিদূষককে, আচ্ছা, রাজার অন্যান্য অনুচরেরা কোথায় গেল?

বিদূষক হেঁয়ালি করে বলল, একটা পিঁপড়েও শীতকালে কাজ করে না। যার চোখ আছে রাস্তায় সে কখনও সোজাসুজি হাঁটে না। আর যে বুদ্ধিমান, সে কখনও পাহাড়ের ঢালু পথ বেয়ে নেমে আসা চাকার গতি রোধ করে সহজে বিপদে পড়তে চায় না। আর লোভী ও স্বার্থপর লোকেরা বিপদের গন্ধ পেলেই বন্ধুকে ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমি তো সামান্য একজন বিদূষক মাত্র। কাজেই সে পথ যারা অনুসরণ করেছে তারা আমার পক্ষে উপযুক্ত নন।

এ কথা শুনে চমৎকৃত হয়ে বললেন কেন্ট, ভারি সুন্দর তোমার উপমাগুলি।

গ্লস্টারের সাথে একত্র ঢুকে আপন মনে বলতে লাগলেন লিয়ার, মিথ্যে কথা, অসুস্থতার ভান করে তারা বিদ্রোহ করেছে আমার বিরুদ্ধে। এবার বলে দাও আমি কী করব?

উঃ এত বড়ো অকৃতজ্ঞ ওরা! বলে দাও গ্লস্টার, রিগান আর কর্নওয়ালকে— আমার হুকুম, তারা যেখানেই থাকি যেন এখানে চলে আসে। আর সেই রাগী ডিউককেও বলে দিও, সে যেন এই রাগী বৃদ্ধ স্নেহময় সম্রাটের আদেশ অবিলম্বে পালন করে, নইলে.। তারপর যে কী ভেবে তিনি বললেন, না, না, আমি একী বলছি! হয়তো সে সত্যিই অসুস্থ। আর এত সবাই জানে যে মানুষ অসুস্থ হলে তার পূর্বের স্বভাবের কিছু পরিবর্তন হয়। কাজেই আমার মেজাজকে সংবরণ করে আমি অপেক্ষা করব তাদের সুস্থতার জন্য।

এরপর হঠাৎ কেন্টের দিকে তাকিয়ে পালটে গেল। লিয়ারের মনোভাব–হায় কী নির্বোধি আমি।আমার এই বৃদ্ধ ভূত্যের অবস্থা দেখেই বুঝতে পারছি,ইচ্ছাকৃত ভাবে চলে গেছে তারা। পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক এটা তাদের একটা চাল। কে আছ, ডিউক ও তার স্ত্রীকে শীঘ্ৰ ডেকে নিয়ে এস এখানে। তারা স্বইচ্ছায় না এলে, আমি নিজে গিয়ে তাদের টেনে আনিব এখানে।

আপনি এত উত্তেজিত হবেন না প্ৰভু। আমি যাচ্ছি—বলে চলে গেলেন গ্লস্টার।

লিয়ার বলতে লাগলেন, হে আমার মন! এত সহজেই তুমি ধৈর্যহারা হয়ে চঞ্চল করে তুলো না। আমাকে। রাজা লিয়ার করুণ মিনতি জানাচ্ছে তোমার কাছে, তুমি শান্ত হও, থামো।

বিদূষক বলল রাজাকে, গরম কড়াইতে গোটা মাছ ছেড়ে দিয়ে মেয়েরা যেমন তার মৃত্যু কামনা করে, ঘোড়া তৈলাক্ত জিনিস খায় না জেনেও যে নির্বোধি তার বিচালিতে তেল মেশায়, তেমনি আপনিও নির্বোধের মতো বৃথা চেষ্টা করছেন আপনার ক্রোধকে প্রমাণ করতে।

রিগান বলল, বাবা আপনি আমার শ্রদ্ধা নেবেন।

পূর্বের সবকিছু ভুলে গিয়ে লিয়ার বললেন, আমি জানি তোমরা উভয়েই খুশি হয়েছ আমি আসায়।

রিগান বলল, প্রিয় বাবা, আমার বিবেচনায় সে যদি আপনার উদ্ধত উচ্ছঙ্খল নাইটদের আচরণের প্রতিবাদ করে থাকে, তাহলে সে ঠিকই করেছে। আপনার এই মানসিক অসুস্থত। আর দোষহীন দুর্বলতা, যা বার্ধক্যের কারণে হয়েছে বলে আপনি মনে করেন, তার একমাত্র প্রতিকার কারও কাছে অনুগত হয়ে থাকা। তাই বলছি আপনি অন্যায় স্বীকার করে ফিরে যান তার কাছে।

অবাক হয়ে বললেন লিয়ার, কী বলছি, আমি ক্ষমা চাইব? তুমি কি আমায় দীন-হীন ভিখারির বেশে দেখতে চাও? এই বলে নতজানু হয়ে রাজা বললেন, আমি করজোড়ে তোমার কাছে পোশাক, খাদ্য এবং আশ্রয় ভিক্ষা চাইছি! ভেঙে পড়লেন রাজা লিয়ার।

রিগান বলল, না সেটা সম্ভব নয়।

লিয়ার বললেন, আমার অনুচরের সংখ্যা কমিয়ে দেবার কথা বলে গনেরিল অপমান করেছে আমায়। রূপ আর শক্তির গর্বেই সে সাহস পেয়েছে। এরূপ কাজ করার। সে ধ্বংস হয়ে যাবে ভগবানের অভিশাপে।

কিন্তু তুমি এক মধুর স্বভাবের মেয়ে। আমার শাখ-আহ্রদ বন্ধ করে দিয়ে আমায় অপমান করতে তুমি সাহসী হবে না। আর সে ইচ্ছাও তোমার নেই, তা আমি জানি। আমি তোমার বাবা আর তুমি আমার অর্ধেক সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী— সেকথা তুমি নিশ্চয়ই ভুলে যাবে না। এই কথা বলে থেমে গেলেন রাজা।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কেন্টের কথা মনে পড়ল রাজা লিয়ারের। তিনি বললেন, আমি জানতে চাই কার এত দুঃসাহস যে আমার দূতের পায়ে এই যন্ত্রণাদায়ক কাঠের খুঁটোটা পরিয়েছে?

এমন সময় দূর থেকে জোরদার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে কর্নওয়াল জিজ্ঞেস করল রিগানকে, কে এল?

বোধ হয় আমার দিদি। তারই আসার কথা ছিল, বলল রিগান। তারপর অসওয়াল্ডকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করল, দিদি কি আসছেন?

অসওয়াল্ডকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন রাজা লিয়ার, আমার সামনে থেকে তুই দূর হয়ে যা ঘৃণ্য গনেরিলের প্রশ্রয় পাওয়া পাজি শয়তান চাকর কোথাকার! তারপর রিগানকে বললেন, আমার দূতের পায়ে কে খুঁটা পরিয়েছে। আশা করি তুমি তা জান না। হে ঈশ্বর, মানুষের প্রতি তোমার মমতা সাহায্য করুক আমায়। হায় রিগান, এই ঘৃণ্য নারী গনেরিল তোমার এত প্রিয়, যে তুমি ওর হাত ধরেছ।

উদ্ধতভাবে উত্তর দিল গনেরিল, অবুঝের মতো তোমার কাজ-কৰ্মই বিচারের শেষ কথা।।।

লিয়ার বললেন, আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আমার সহ্যশক্তির সীমা দেখে। বল, কে আমার দূতের এ অবস্থা করেছে?

আমি করেছি, বলল কর্নওয়াল, কিন্তু তাতেও ওর উপযুক্ত শাস্তি হয়নি।

অবাক হয়ে বললেন লিয়ার, তুমি, তুমি করেছ এ কাজ?

রিগান বলল, বাবা, আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন, আগের মতো আর সবল নন। এখন আপনার উচিত ভাগাভাগি করে একবার আমার কাছে অন্যবার দিদির কাছে গিয়ে থাকা। বর্তমান অবস্থায় আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় আপনাকে আশ্রয় দেওয়া।

লিয়ার বললেন, তার চেয়ে আমি বন্য জন্তুর সাথে বাস করব, সহ্য করব দারিদ্র্যের চরম কশাঘাত, প্রয়োজনে আশ্রয় ভিক্ষা চাইব ফ্রান্সের রাজার কাছে–তবুও আমি সেখানে যাব না অনুচরদের ছেড়ে। সেরূপ পরিস্থিতি হলে আমি বরং ক্রীতদাসটার অবশ্য হয়ে থাকব, তবুও সেখানে যাব না। আশা করি তুমি আমায় সেরূপ দুর্ভাগ্যের মুখে ঠেলে দেবে না। রিগান। আমার দেহের দুষ্ট ক্ষত হলেও আমি তো জানি তুমি আমারই মেয়ে। আমি তোমায় অভিশাপ দেব না। নিজের ভুল একদিন তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।

আমি বরঞ্চ আমার অন্য মেয়ে রিগানের কাছেই থাকব। আর সাথে রইবে একশোজন নাইট।

রিগান বলল, আমার কিন্তু ইচ্ছে নয় বাবা যে আপনি আমার কাছে থাকেন। বুড়ো হয়ে আপনার জ্ঞান-গাম্যি সব লোপ পেয়েছে। একমাত্র আমার দিদিই সঠিক জানে সে কী করেছে।

লিয়ার বললেন, তোমার কি মনে হয় তুমি যা বলছি তা সত্য?

রিগান বলল, হ্যাঁ, আমি সত্যি কথাই বলছি। খুব বিপদের দিনেও পাঁচিশজন লোক রাখার কোনও অর্থ হয় না। আর মালিকানা যেখানে ভাগ হয়ে গেছে, সেখানে এত লোকের মাঝে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

এবার গনেরিল আর রিগান দুজনেই একসাথে বলল, বাবা, আমাদের সাথে না থাকার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণই আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা তীক্ষ নজর রাখব যাতে আপনার প্রতি কোনও অন্যায় না হয়।

রিগান বলল, পাচিশ জনের বেশি নাইট কিন্তু আপনি সাথে রাখতে পারবেন না।

লিয়ার বললেন, ওরে অকৃতজ্ঞ মেয়েরা, তোরা কি ভুলে গেছিস যে সব সম্পত্তি আমারই?

আপনার যথাসর্বস্ব। আপনি দান করেছেন আমাদের, উত্তর দিল রিগান।

লিয়ার বললেন, আমি চাই না সে সব সম্পত্তি ফেরত নিতে। কিন্তু কোন সাহসে তোরা বলছিস আমার অনুচরের সংখ্যা কমাতে?

উদ্ধতভাবে আবারও তার মতামত ব্যক্ত করল রিগান।

ভেতরে ভেতরে রেগে গেলেও অসহায়ভাবে বললেন রাজা, উপরে ভালোমানুষির নিচে তোর এই নীচ মনের কথা আগে জানা ছিল না। গনেরিল, একশোর অর্ধেক পঞ্চাশ হলেও তা কিন্তু পাঁচিশের দ্বিগুণ। আজ থেকে তোর প্রতি আমার ভালোবাসাও দ্বিগুণ হল, আমি তোর কাছেই থাকব।

গনেরিল বলল, এখানে যা লোক আছে তার ডবল লোক সেখানে সেবা করবে আপনার। কিন্তু আপনার অনুচরদের সেখানে নিয়ে যাবার কোনও দরকার নেই।

লিয়ার বললেন, কেউ জানে না, প্রয়োজনের সীমা কোথায়। শীতনিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক থাকা সত্ত্বেও যেমন তুমি অতিরিক্ত কিছু পরেছ, তেমনি মনে রেখ প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছু মানুষকে পশুদের চেয়ে আলাদা করে তা হল সহনশীলতা। এই সহনশীলতাই এখন আমার দরকার। হে ঈশ্বর, তুমি করুণা করে এই বুড়ো লোকটির সহ্যের সীমা বাড়িয়ে দাও। তোমার চক্রান্তেই যদি আমার মেয়েদের মন বিষিয়ে ওঠে তাহলে তোমার কাছে আমার মিনতি, চোখের জলে আমায় নাভিজিয়ে সাহায্য কর আমার রাজ্যকে জ্বলে উঠতে। তাই কাঁদব না। আমি, ফেলব না চোখের জল। এই ঝড়জলের মাঝে যদিও আমায় আশ্রয়হীন হয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে হবে, তবুও কেঁদে কেঁদে আমি ভারাক্রাস্ত হতে দেব না। আমার মনকে। সব কষ্ট সহ্য করব আমি। কী বোকা আমি। এই অসহ্য যাতনা পাগল করে তুলেছে আমায়–বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলেন রাজা। সেই সাথে গ্লস্টার ও বিদূষকও চলে গেলেন সে স্থান ছেড়ে।

রিগান বলল, এই ছোটো বাড়িটাতে একসাথে থাকার জায়গা হত না বুড়ো আর তার অনুচরদের।

সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে এই ঝড়ের রাতে দুর্ভোগ পোহাবার জন্য দায়ী তার নিজের বোকামি, বলল গনেরিল।

রিগান বলল, লোকজন ছাড়া তার নিজের ঢোকার ব্যাপারে তো কোনও বাধা ছিল না।

নিশ্চয়, বলল গনেরিল; কিন্তু গ্লস্টারকে দেখছি না কেন?

কর্নওয়ালের ডিউক বলল, তিনি গেছেন রাজার সাথে। আবার ফিরে আসবেন।

এ সময় গ্লস্টার ফিরে এসে বলল, রাগে পাগল হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যেতে চান রাজা।

কোথায়? জানতে চাইল রিগান।

গ্লস্টার উত্তর দিলে, জানি না।

তার চলে যাওয়াই উচিত, বলল অসওয়াল্ড।

সায় দিয়ে বলল গনেরিল, তাকে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করা আমাদের উচিত নয়।

কিন্তু বিষণ্ণতার ছায়া পড়ল গ্লস্টারের মুখে। তিনি বললেন, একেই এই ঝড়-জলের রাত, তায় ঘন অন্ধকার। এর মধ্যে কী করে বাইরে যাবেন তিনি?

অমনি তাড়াতাড়ি বলল রিগান, একগুয়ে লোকদের স্বভাবই এই। আর গুণের দিক দিয়ে ওর সঙ্গী-সাথীরা আরও এককাঠি উপরে। যাইহোক, দরজাটা দিয়ে দাও যাতে তারা কেউ ঢুকতে না। পারে।

 

চিৎকার করে জানতে চাইল কেন্ট, এই দুর্যোগপূর্ণ রাতে কে ওখানে?

উত্তর এল, আমি ওই লোক যার কাছে প্ৰচণ্ড ঝড় কোনও নতুন কথা নয়।

কেন্ট বলল, গলা শুনে আমি তোমায় চিনতে পারছি না। তুমি তো রাজার অনুচর। তাহলে বল রাজা কোথায়?

রাজানুচর বলল, পাগল হয়ে তিনি আজ ছুটে বেড়াচ্ছেন গুহায় গুহায়। এই পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে ফেলার জন্য তিনি ব্যথিত হৃদয়ে অনুরোধ করছেন সমুদ্রের জলরাশিকে। প্রবল ঝড়বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে দুহাতে মাথার চুল উপরে তুলে বিপদের বাতাবরণকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি মেতে উঠেছেন এক বিকৃত বীভৎস খেলায়। শুধুমাত্র বিদূষককে সাথে নিয়ে অনবরত চিৎকার করে চলেছেন তিনি।

বিদূষক ছাড়া আর কি কেউ তার সাথে নেই? জানতে চাইল কেন্ট।

না, আর কেউ নেই। শুধু সেই চেষ্টা করছে হালকা হাসির মধ্যে দিয়ে রাজার শোক কমিয়ে দেবার, উত্তর দিল অনুচর।

কেন্ট বলল, শোন, তুমি আমার বিশেষ পরিচয়। তোমাকে একটা গোপন কথা বলতে চাই আমি। কথাটা বাইরে প্রকাশ না পেলেও জেনে রেখা একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে আলবেনি আর কর্নওয়ালের মাঝে। তারা একে অপরকে ঠকিয়ে রাজ্যের উন্নতি করতে চাইলেও তাদের ভূত্য ও অনুচরেরা রাজার উপর আরোপিত ষড়যন্ত্র, তার প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের যে খবর শুনছে। দেখছে–তা সবই গোপনে পাঠিয়ে দিচ্ছে ফ্রান্সে। একদল ফরাসি সৈন্যও গোপনে রয়েছে বন্দরে। আমার নির্দেশ অনুযায়ী তুমি তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে রাজার দুরবস্থার কথা। একজন লোককে জানাবে। পারিশ্রমিক হিসেবে এই থলিটা আমি তোমায় দিচ্ছি। আর ফ্রান্সের রানি কার্ডলিয়ার সাথে দেখা করে এই আংটিটা তাকে দিলেই তিনি তোমায়ে জানিয়ে দেবেন। আমার পরিচয়। এবার তুমি যাও।

অনুচরটি কিছুদূর যাবার পর ফের তাকে ডাকলেন কেন্ট, বললেন, ওহে শোন, আগের চেয়েও একটা বেশি গোপনীয় কথা আছে তোমার সাথে। কথাটা হল, যত শীঘ্র সম্ভব আমাদের রাজাকে খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের উভয়ের মধ্যে যেই আগে খবরটা পাক, সে তা জানিয়ে দেবে অন্যদের। খুব সাবধান, এ কথা যেন কেউ জানতে না পারে।

আপনার আদেশ যথারীতি পালিত হবে— বলে অনুচর বিদায় নিল।

লিয়ার বললেন, হে বাতাস, তুমি সমস্ত শক্তি দিয়ে চূর্ণ করে দাও এ পৃথিবীটাকে। আমার রাজ্যের আগুনকে বাড়িয়ে দিয়ে তুমি তৈরি কর দাবানল। হে মেঘ, অঝোর ধারায় বর্ষিত হয়ে তুমি নেমে এস পৃথিবীতে, ধুয়ে মুছে শেষ করে দাও সবকিছু। অবিশ্রান্ত আঘাত হানো গির্জাগুলির চুড়ার উপর। হে আগুন, দ্রুতগতিতে নেমে এসে তুমি জ্বালিয়ে দাও আমার সাদা দাড়ির গোছগুলি আর তোমার প্রভু কঠিন বজকে বলো যেন তার আমোঘ শক্তিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এই পৃথিবীটা আর সে যেন ধ্বংস করে দেয় অকৃতজ্ঞ মানুষের বাসস্থান-মোয়াজলে ঘেরা এই বিশ্বকে।

বিদূষক বলল, আপনি বরং ঘরে এসে ওদের তোষামোদ করুন। আজকের রাতটা বড়োই দুৰ্যোগপূর্ণ।

আপন মনে বললেন লিয়ার, হে প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ! তোমরা নিশ্চয়ই আমার মেয়ের মতো অকৃতজ্ঞ নও কিংবা আমার অধীনও নও। এক অসহায় দুর্বল বৃদ্ধ করজোড়ে মিনতি জানাচ্ছে তোমাদের কাছে–আরও প্রবল এবং প্রচণ্ড হয়ে ওঠ তোমরা। হে বিদ্যুৎ, আগুন, বাতাস, তোমরা সবাই নেমে এস আমার মাথার উপর। তোমরা আর দেরি করো না। এই দেখ, এক ক্রীতদাসের মতো আমি তোমাদের করুণাপ্রার্থী। আমায় দয়া করে তোমরা।

একটু থেকে কান পেতে বজের গর্জন ও আওয়াজ শুনে বললেন লিয়ার, ঐ দূর আকাশের বজ, বিদ্যুৎ, বৃষ্টি — ওদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও আমার মতো বুড়োর প্রতি অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিবাদে তারা সবলে রুখে দাঁড়িয়েছে আমার দু-মেয়ের বিরুদ্ধে, সত্যিই এ খুব আশ্চর্যের ব্যাপার।

বিদূষক বলল, মহাশয়, একটা প্রচলিত প্ৰবাদ আছে যে শিরস্ত্ৰণ তারই সাজে যার মাথার উপর আছে একটা বাড়ি—যে লোক পায়ের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মনের কাজ করে, কাঁটা তার পায়ে না। ফুটে অন্তরে বেঁধে আর দুঃস্বপ্নে ভরিয়ে তোলে তার সারা রাত। আর যে প্রকৃতই সুন্দরী, আয়না কখনও বিকৃত করে দেখায় না। তার সারা মুখ।

এ সময় দূর থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, কে ওখানে? সাড়া দাও! তারপর কাছে এসে চিনতে পেরে বলল, হায় ভগবান, এই দুর্যোগপূর্ণ রাতে নিশাচর প্রাণীরাও আশ্রয় নিয়েছে তাদের বাসস্থানে, আর রাজা লিয়ার, এই দুর্যোগের রাতে আপনি রয়েছেন বাইরে?

লিয়ার বললেন, গোপনে গোপনে নানা পাপ কাজের দ্বারা যে সমস্ত হতভাগা তাদের হাতকে কলঙ্কিত করে মানুষের রক্তে, মিথ্যা শপথ নিয়ে বাইরে যারা সৎ ও ধাৰ্মিকের ভান করে, বন্ধুত্বের ভান করে। কিন্তু লিপ্ত হয় নানা ষড়যন্ত্ৰে— অথচ শাস্তি পায়নি তারা এসব জঘন্য কাজের জন্য। আজ সময় এসেছে তাদের নিজেকে ঈশ্বরের কাঠগড়ায় সঁপে দেবার। আমিও সেইসব হতভাগাদের একজন যার শাস্তির পরিমাণ ছাপিয়ে গেছে পাপের পরিমাণকেও।

লোকটি বলল, মহারাজ, আমার বিনীত অনুরোধ বিশ্বস্ত কয়েকজনকে নিয়ে আপনি ঢুকে পড়ুন ওই কুটিরে। আর আমি যাচ্ছি কিছুক্ষণ আগে প্রত্যাখ্যাত পরিশ্রান্ত ঐ নিষ্ঠুর মানুষগুলির প্রাসাদে।

লিয়ার বললেন, তই চল ছোকরা। ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়ছে আমার শরীর, লোপ পাচ্ছে আমার বুদ্ধি। আমার শোবার ঘরটা কোথায়? বিদূষক, তুমি শুয়ে পড়া ঐ বাক্সটায়। ঈশ্বরের কী আশ্চর্য করুণা! এখনও পর্যন্ত ও আমায় ছেড়ে যাননি।

তবে যাবার আগে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করে যাই– বামন এবং পূজারিরা যখন বেশি কথা বলবে, বেশি জল মেশানো হবে মদে, যখন সামন্তরা করবে দর্জির কাজ, নাস্তিকদের শাস্তি ভোগ করবে শ্রমিকেরা, ধনীরা ভুলে যাবে ধার করতে, দুর্লভ হবে গরিব নাইটের সংখ্যা, মানুষ ভুলে যাবে মিথ্যা কথা বলা আর চোর ও মানুষের মাঝে থাকবে না কোনও পার্থক্য–ঠিক তখনই ঘটবে মানুষের আত্মসাক্ষাৎ। তবে ব্রিটেন। কিন্তু বিপর্যস্ত হবে দারুণ বিশৃঙ্খলায়।

হতাশায় ভেঙে পড়ে গ্লস্টার বলল, শোন এডমন্ড, আমার প্রভু ও প্রভুপত্নী এমনই নির্দয় যে তারা আমার সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে যাতে আমি বৃদ্ধ রাজাকে আশ্রয় দিতে না পারি। আর তারা কড়াভাবে আমায় শাসিয়ে গেছে এসব সত্ত্বেও আমি যদি রাজার সাথে যোগাযোগ করি, তাহলে চিরকালের মতো এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে আমায়।

নিরীহের ভান করে এডমন্ড বলল, সত্যিই বাবা, এ কাজটা ওদের পক্ষে খুবই দোষণীয়। * গ্লস্টার বলল, চুপ এডমন্ড, কেউ শুনতে পাবে। কারও চোখে যাতে না পড়ে সেজন্য আমি বিশ্বাস করে তার ছেলেকে রেখেছি। আর শোন, রাজার প্রতি অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য সেনাবাহিনীর একটা অংশ বাইরে থেকে এখানে গোপনে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সম্পর্কে ওরা কিছু জানতে চাইলে তুমি বলবে যে আমি অসুস্থ। তবে জেনে রেখ, ওদের নিষেধ সত্ত্বেও আমার প্রাক্তন মনিবকে খুঁজে বের করে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করব আমি। এডমন্ড, তুমি সাবধানে থেক?

গ্লস্টার চলে যাবার পর এডমন্ড ছুরি শানাতে বসল। তার উদ্দেশে। মনে মনে সে ঠিক করল বাবার পরিকল্পনার সব কথা ডিউককে জানিয়ে দিয়ে সে হাত করবে। বাবার সম্পত্তি। কারণ যুবকদের উন্নতির জন্য প্রয়োজন বৃদ্ধদের হটানো।

বিনীতভাবে রাজাকে অনুরোধ করল কেন্ট, প্ৰভু, দয়া করে আপনি এ কুটিরে প্রবেশ করুন।

আমায় একটু একা থাকতে দাও কেন্ট, বললেন লিয়ার, আমার হৃদয়টা ভেঙে যাক তাই কি তুমি চাও? তুমি ভাবছ। এই প্রচণ্ড ঝড়ের কষ্ট আমার কাছে দুঃসহ বলে মনে হচ্ছে? না, এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট আমি সয়েছি। এই দেহে। আমার মনের এই কষ্ট, সমুদ্র ঝড়ের আঘাতে সম্পূর্ণভাবে অসাড় করে দিয়েছে আমার অনুভূতিগুলিকে। আমি আর চোখের জল ফেলব না, প্রতিশোধ নেব। আমার সন্তানদের অকৃতজ্ঞতার। মেয়েদের সব কিছু দান করে নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে গেল বাবা, আর তাকেই কিনা নিরাশ্রয় করে তাড়িয়ে দিল মেয়েরা? যাকগে, আমি ভুলে যাব সে কথা! তুমি চলে যাও কেন্ট। এর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির হাত থেকে আমায় রক্ষা করবে। এ ঝড়; তুমিও ঘরে চলে যাও বিদূষক। হে ভগবান, তুমি পরম দয়াবান! কোনও দিন সে কথা ভাবিনি। আজ তুমি আমায় ভাববার সুযোগ দিয়েছ। কী করে দরিদ্র নিরাশ্রয় মানুষগুলি প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির আঘাত সহ্য করে। হে ধনী লোকেরা, ঈশ্বরের কৃপালাভের জন্য তোমাদের উচিত প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা গরিব জনসাধারণের জন্য দান করা।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দ শুনে গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বিদূষক, বলল, টম নামে একটা ভূত আছে গুহায়। ওগো, কে কোথায় আছ আমায় বাঁচাও।

কেন্ট এগিয়ে এসে বললেন, কে আছ, বেরিয়ে এস গুহার ভেতর থেকে।

পাগলের মতো গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল এডগার, বলল, পালিয়ে যাও তোমরা। একটা শয়তান সবসময় আমার পেছু তাড়া করছে।

রাজা লিয়ার জানতে চাইলেন, আচ্ছা, তুমি কি নিঃস্ব হয়ে পড়েছ সবকিছু মেয়েদের দান করে?

আমার কী আছে? বলল। টম, জলে-স্থলে, স্বপনে-জাগরণে, সবসময় একটা শয়তান আমায় তাড়া করে ফিরছে। যার পথ নির্দিষ্ট করা আছে বিপদের মধ্য দিয়ে, তার কীই বা থাকতে পারে? ঈশ্বরের দোহাই, ক্ষুধার্ত টমকে কিছু খেতে দাও। শয়তান অবিরাম জ্বালাতন করছে তাকে। হয়তো সেই শয়তানটা এখানেই থাকে।

লিয়ার বললেন, আচ্ছ টম, তোমার এ অবস্থা কে করেছে? তোমার মেয়েরা কি সবকিছু কেড়ে নিয়েছে?

না মহারাজ, এর মধ্যে আমি একটা কলঙ্কের ব্যাপার দেখছি, বলল বিদূষক।

লিয়ার বললেন, তাহলে আমি অভিশাপ দিচ্ছি, যথাসময়ে পতন হবে ওর মেয়েদের।

ছদ্মবেশী কেন্ট বলল, মহারাজ ওর কোনও মেয়ে নেই।। তুমি একটা মিথ্যেবাদী, চিৎকার করে বললেন লিয়ার, মেয়ে না থাকলে কখনো ওর এই অবস্থা হত? দেখছি না, আমার মেয়েরাও তো এভাবেই আমার রক্ত শোষণ করেছে।

বিদূষক বলল, এ অসহ্য পরিবেশকে মেনে নেওয়া আমার মতো নির্বোধের পক্ষে সম্ভব নয়।

ব্যগ্র কণ্ঠে রাজা জিজ্ঞেস করলেন টমকে, আগে কী করতে তুমি?

টম উত্তর দিল, আগে আমি খুব অহংকারী ছিলাম। কথায় কথায় মিথ্যে শপথ নিতাম। যৌবনের নানা খেলায় ব্যস্ত রাখতাম নিজেকে। নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হীন কাজ করতেও পেছ-পা হতাম না। মদ খেতাম, জুয়ো খেলতাম প্রেম নিয়ে। অলসতা, লুব্ধতা, ধূর্তমি আর নানারূপ পাপ কাজে সিদ্ধহস্ত ছিলাম আমি। এসব কাজে আমি ছিলাম পশুরও উপরে। কিন্তু সাবধান, হৰ্মন বনের বাতাসের রূপ ধরে আসছে। ঐ শয়তান।

হে ভগবান, মানুষের কি কোনও দাম নেই? বললেন লিয়ার, এই গুহায় বাস করছি আমরা তিনটি দু-পেয়ে প্রাণী, অথচ কেউই স্বাভাবিক নই। তারপর হঠাৎ তিনি দু-হাতে নিজের জামাকাপড় ছিড়ে ফেলে অনাবৃত করতে লাগলেন দেহকে।

বিদূষক বলল, মহাশয়, এই শীতের রাতে গায়ের পোশাক খুলবেন না। ঐদিকে দেখুন, কে যেন মশাল হাতে এগিয়ে আসছে।

এডগার বলল, ও হচ্ছে শয়তান কিবাগিগিবেট। সন্ধ্যার পর মানুষের দুরবস্থার নকল করে সে নানাভাবে বিভ্রান্ত করে তাদের।

নেপথ্যে পায়ের আওয়াজ শুনে রাজা বললেন, কে ওখানে? কার গলা শোনা গেল পেছনে? কে তুমি? আগে তোমার নাম বল।

আমি সেই হতভাগ্য টম যার খাদ্য হল কোলাব্যাং, বিষাক্ত সাপ, টিকটিকি আর মরা কুকুর। আমার পানীয় হল শ্যাওলা পচা জল, সম্বল জামা-কাপড়, একটা ঘোড়া আর তলোয়ার। আমি সেই শয়তান যাকে অহরহ তাড়া করছে আর একটা শয়তান। নরক আর অন্ধকারের রাজাই আমার একমাত্র বন্ধু।

গ্লস্টার বলল, জানো, আমার ছেলেদের কাছে আজ। আমি একটা ঘৃণিত জীব মাত্র।

রাজা লিয়ার বললেন, আপনার কন্যাদের বারণ সত্ত্বেও আমি এসেছি আপনাকে নিয়ে যাব বলে। এর পরপরই তিনি বললেন, বজের উদ্দেশ্য কী? আচ্ছা!টম, তোমারই বা জ্ঞানের উদ্দেশ্য কি?

রাজার এরূপ অবস্থা দেখে দুঃখের সাথে কেন্ট বললেন, গ্লস্টারকে, স্যার, ওর মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে।

গ্লস্টার বললেন, সেজন্য দায়ী ওর মেয়েরাই! জানো বন্ধু, এই কিছুদিন আগে আমার প্রিয় পুত্ৰও হত্যা করতে চেয়েছিল আমাকে। আমিও রাজার মতোই এক হতভাগ্য। তারপর লিয়ারকে উদ্দেশ করে বললেন, আজকের রাতটা খুবই দুর্যোগের। আমার কথাটা শুনুন মহারাজ।

লিয়ার বললেন, আমি ক্ষমা চাইছি তোমাদের কাছে। এস, সবাই ভেতরে যাই। ওহে যুবক, এস, বিশ্রাম করবে। আমাকেও তোমার সঙ্গী করে নাও।

গ্লস্টার বলল, চুপ, ধীরে ধীরে। তারপর ছদ্মবেশী কেন্টকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন সে যেন সবাইকে ভেতরে নিয়ে যায়। সবাই যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকছে, তখন টমর্যাপী ছদ্মবেশী এডগার বলে উঠল, ধিক ধিক, আমি টের পাচ্ছি এক ব্রিটিশ বীরের উপস্থিতি।

কর্নওয়াল বলল, তাহলে তো গ্লস্টারকে হত্যা করার চেষ্টা করে ঠিকই করেছে তোমার ভাই। এ বাড়ি ছেড়ে যাবার পূর্বে আমিও প্রতিশোধ নেব তার উপর।

এডমন্ড ছিল খুব চতুর। সে বলল, না। হুজুর, তা করবেন না। তাহলে সবাই আমায় অপবাদ দেবে পিতৃহত্যার। আমার ভাগটো সত্যিই খুব খারাপ। কারণ আমার বাবা চেষ্টা করছেন ফরাসিদের অনুকূল সুযোগ দেবার। আর এ চিঠিটাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, বাবা যেন এ কাজ থেকে বিরত হন। কিন্তু এ চিঠিটা যদি সত্যি হয় তাহলে….।

কর্নওয়াল বলল, সত্যি মিথ্যে যাই হোক না কেন, তোমার বাবাকে খুঁজে বের করে গ্রেপ্তার করতে পারলে তুমিই হবে আর্ল অফ গ্লস্টার।

কথাটা শুনে মনে মনে ভাবতে লাগল এডমন্ড, যদি সত্যিই এরকম হয়, তাহলে তো রাজার প্রতি–বাবার সাস্তুনা বাণীই দূর করে দেবে ডিউকের সন্দেহ আর সেই সাথে সফল হবে। আমার উদ্দেশ্য! হে ঈশ্বর, আমার উদেশ্য যেন সফল হয়।

গ্লস্টার কেন্টকে বলল, আপনি এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি দেখছি অন্য আর কিছু করা যায় কিনা। গ্লস্টারের মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন কেন্ট। রাজার প্রতি তার এই মমতাময় আচরণের জন্য তিনি গ্লস্টারের মঙ্গল কামনার প্রার্থনা করলেন ঈশ্বরের কাছে।

এডগারকে দেখিয়ে বিদূষক প্রশ্ন করলেন লিয়ারকে, মহারাজ, এই লোকটি কে?

লিয়ার বললেন, উনি এক রাজা।

বিদূষক বলল, উহুঁ, ছেলেকে ভদ্র হতে দেখলে নিচু শ্রেণির মানুষও পাগল হয়ে যায়। উনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। যে কোনও ঠুনকে জিনিস এখন সহজেই ওর বিশ্বাস ভেঙে দিতে পারে।

লিয়ার বললেন, আমি সামনাসামনি বিচার করব তাদের। ওহে যুবক আর বিদূষক, তোমরা দুজনেই বস এক জায়গায়, আর অকৃতজ্ঞের দল, আমি বিচার করব তোমাদের।

এডগার বলল, আবার নাইটিংগেলের পাখির সুরে গান গাইছে জঘন্য শয়তানটা। ওহে শয়তান, তুমি চুপ কর। এখন আমার কাছে কোনও খাবার নেই।

ওহে যুবক, তুমি আর তোমার সঙ্গী এই বেঞ্চের উপর বাস বিচারক হিসাবে— তারপর কেন্টের দিকে তাকিয়ে বললেন লিয়ার, আচ্ছা, তুমিও বস এদের সাথে। আমি দেখব বিচার করে। আগে গনেরিলের বিচার হবে। সে তার বৃদ্ধ পিতাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে বাড়ি থেকে।

অদৃশ্য মহিলার উদ্দেশে বলল বিদূষক, তুমিই গনেরিল? আমি ভেবেছিলাম তুমি এক নোংরা। আবর্জনা। চিৎকার করে বলে উঠলেন। লিয়ার, এই নারীর মন যে কত ক্রুর তা ওর চোখ দেখলেই বোঝা যায়। তোমরা তাড়াতাড়ি অস্ত্ৰ নিয়ে এস। তোমরা এরূপ অবিশ্বস্ত যে তাকে পালিয়ে যেতে দিলে?

রাজা আজ ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন, বাধা মানছে না কেন্টের চোখের জলও।

আচ্ছা, ট্রে, সুইটহার্ট আর ব্রাট, এই তিনটে কুকুরকি আমার দিকে তাকিয়ে ঘেউঘেউ করছে? জানতে চাইলেন। লিয়ার।

টম বলল, ভাববেন না, তাড়া করলেই তারা পালিয়ে যাবে।

আবার বললেন লিয়ার, তোমরা রিগানকে কেটে দেখ কী দিয়ে তার হৃদয়টা সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতি। যাও, তোমরা আর চিৎকার করো না, আমি এবার বিশ্রাম নেব।

গ্লস্টার তাড়াতাড়ি এসে পৌছল। সেখানে। সে কেন্টকে বলল, বন্ধু, বাইরে যে ঘোড়ার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, তাতে মহারাজকে চাপিয়ে যত শীঘ্র সম্ভব তোমরা তাকে নিয়ে যাও ডোভারে আমার নিরাপদ আশ্রয়ে! আর আধঘণ্টা দেরি হলেই বিপন্ন হবে তার জীবন! আমাকে অনুসরণ করে তোমরা তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও নিরাপদ স্থানে।

হয়তো ওর আত্মা এই ঘুমের মাঝে বিশ্রাম পাচ্ছে, বলল কেন্ট; যাই হোক, তুমি এস বিদূষক। আমরা সাহায্য করব রাজাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে।

 

সবাই চলে যাবার পর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এডগার। মনে মনে সে ভাবল, হয়তো পৃথিবীর নিয়মই এই। মহান ব্যক্তির দুঃখ ভুলিয়ে দেয় তুচ্ছ ব্যক্তিগত দুঃখকে। দীর্ঘদিন সুখে থাকার পর হঠাৎ দুঃখ পেলে তা সহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর দুঃখী লোকের পক্ষে দীর্ঘদিন দুঃখভরা জীবন কাটানোর কষ্টও প্রচুর। আমি আর আমাদের মহান রাজা, উভয়েই কষ্ট পাচ্ছি পিতা আর সস্তানের মাঝে ভুল বোঝাবুঝির দরুন না। টম, এসব নিয়ে তোমার আর ভাবার দরকার নেই। যখন দেখবে সবকিছু বাধা দূর হয়ে বাপ-ছেলের মিলন ঘটবে, ঠিক তখনই সবার সামনে আত্মপ্রকাশ করবে তুমি। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, মহারাজ যেন নিরাপদে ডোভারে যেতে পারেন।

ফ্রান্সের সৈন্যরা যে এসে পড়েছে সে খবর দিদি তাড়াতাড়ি পাঠিয়েছিলেন আলবেনির কাছে। চাকরেরা চলে যাবার পর কর্নওয়াল বলল এডমন্ডকে, সেই বিশ্বাসঘাতক গ্লস্টারকে খুঁজে বের করে তার উপর প্রচণ্ড প্রতিশোধ নেব আমি। তার আগে এডমন্ড, তুমি গনেরিলের কাছে গিয়ে দ্রুত সব ব্যবস্থা কর।

এ সময় ছুটতে ছুটতে এসে বলল অসওয়াল্ড, প্ৰভু, আগে থেকেই ষড়যন্ত্র করে রাজা ও তার সামন্ত এবং অনুচরবর্গকে ডোভারে পাঠিয়ে দিয়েছেন লর্ড গ্লস্টার।

একথা শুনে তৎপর হয়ে উঠল কর্নওয়াল। সে বলল, আপনি তাড়াতাড়ি ঘোড়ায় চেপে চলে যান। আর আমার অনুচরবর্গ, তোমরা সবাই খুঁজে বের তাকে। কে? কে দাঁড়িয়ে ওখানে?

অনুচরসহ গ্লস্টারকে বন্দি অবস্থায় দেখে বেজায় খুশি হলেন কর্নওয়াল আর রিগান। এরপর সবাই পৈশাচিক আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, অকৃতজ্ঞ শয়তান, তোরা বেঁধে ফেল ওর হাত দুটো।

তাদের আচরণে অবাক হয়ে বললেন গ্লস্টার, সে কি? আমিই আপনাদের আশ্রয় দিয়েছি আর আশ্রয়দাতাকে আপনারা এভাবে অপমান করছেন? মনে রাখবেন, আমি বিশ্বাসঘাতক নই। রিগান, তুমি এরূপ অন্যায়ভাবে আমার দাড়ি ছিড়ে না।

বুড়ো শয়তান, তুমি একটা পাজি বদমাশ বলল রিগান।

গ্লস্টার জ্বলে উঠল এ কথা শুনে। সে বলল, নিষ্ঠুর নারী, আমি তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি অতিথির প্রতি এরূপ অন্যায় আচরণের জন্য। ভবিষ্যতে আমার এ দাড়ির প্রতিটি লোম চরম শাস্তি দেবে তোমায়। বল, কেন তোমরা এরূপভাবে অপমান করছ তোমাদের আশ্রয়দাতাকে?

কর্নওয়াল বলল, আমিও সে কথা বলতে চাই তোমায়। বল, কোথায় রেখেছি ফ্রান্সের রাজার চিঠিটা? কী ধরনের ষড়যন্ত্ৰ তুমি করেছ বিদেশিদের সাথে?

রিগান বলল, আর তাও বল এইসাথে যে উন্মাদ রাজা এখন কোথায়?

গ্লস্টার বলল, আমার কাছে যে চিঠিটা আছে তা বিরোধী পক্ষের নয়, ওটা এসেছে। একজন নিরপেক্ষ লোকের কাছ থেকে। আমি শুধু রাজাকে সাহায্য করেছি। ডোভারে পালিয়ে যেতে।

কর্নওয়াল বলল, কোন তুমি এ কাজ করেছ? আমরা যে তোমায় বারণ করেছিলাম। সে কথা কি তুমি ভুলে গেছ?

গ্লস্টার উত্তর দিল, না, ভুলিনি। তবে আজ আমি মরতে বসেছি। তাই কোনো ভয়ই আমায় বাধ্য করতে পারবে না। অন্যায় কাজ করতে।

রিগান জানতে চাইল, কেন তুমি রাজাকে ডোভারে পাঠিয়েছে?

গ্লস্টার বলল, তোমাদের হিংস্ৰ নখ আর দাঁতের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেই আমি পাঠিয়ে দিয়েছি তাকে। যে দুৰ্য্যোগপূর্ণ রাতে তোমরা তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছ, সে রাতে তোমাদের ধ্বংস করার জন্য দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। অথচ তার স্নেহময় অন্তর কামনা করছিল বৃষ্টিপাতের। আমি চাই যত শীঘ্ৰ হোক ঈশ্বরের অভিশাপ নেমে আসুক তোমাদের উপর, ধবংস হয়ে যাও তোমরা?

রিগান বলল কর্নওয়ালকে, নষ্ট করে দাও ওর চোখ দুটো।

গ্লস্টার বলে উঠল, কী নিষ্ঠুর তোমরা! অন্তত মানবিকতার খাতিরে এই বুড়োটাকে তোমরা রক্ষা কর।

গ্লস্টারের এই কাতর আবেদনে স্থির থাকতে না পেরে একজন ভৃত্য এসে বাধা দিল কর্নওয়ালকে। ভূত্যের এই দুঃসাহস দেখে রিগান তাকে মেরে ফেলল তলোয়ার দিয়ে। মৃত্যুর আগে সে ভৃত্য বলে গেল, হে আমার প্রভু, আমি মারা গেলাম। আপনি দেখবেন ঘৃণিত এই নারীর জীবনের পরিণাম।।

যাতে আর তা দেখতে না হয়, সে ব্যবস্থাই আমি করছি, বলেই তলোয়ার দিয়ে গ্লস্টারের দুচোখ অন্ধ করে দিল কর্নওয়াল। তারপর দূর করে তাড়িয়ে দিল তাকে।

চোখের যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল গ্লস্টার, বলল, পুত্ৰ এডমন্ড, অন্যায়কারীদের তুমি উপযুক্ত শাস্তি দিও যখন তুমি শুনবে তোমার বাবার উপর এরূপ অত্যাচার হয়েছে।

গ্লস্টারের কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠল দুজনে। তারপর ব্যঙ্গের সুরে বলল রিগান, তোমার বিশ্বাসঘাতকতার কথা এডমন্ড ফাস করে দিয়েছে আমাদের কাছে। তোমার মত অবিবেচক বিশ্বাসঘাতক সে নয় যে তোমায় দয়া করবে।

ও কি নির্বোধি আমি, বলল গ্লস্টার, এডমন্ডের কথায় বিশ্বাস করে আমি চরম অন্যায় করেছি এডগারের প্রতি। ঈশ্বর, তারা যেন মঙ্গল হয়।

চাকরকে ডেকে রিগান বলল, বের করে দাও এ লোকটাকে। তারপর বলল কর্নওয়ালকে, আঘাতটায় কি খুব যন্ত্রণা হচ্ছে?

হাঁ প্রিয়তমা, বলুল কর্নওয়াল, অসতর্কমুহূর্তে আমায় আঘাত করেছে তৃত্যটা। চল, ভেতরে যাই।

ওরা চলে যাবার পর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ভৃত্য স্থির করল তারা রাজার কাছে এখানেই থেকে যাবে। তাদের মধ্যে একজন চলে গেল গ্লস্টারের আহত চোখে লাগাবার জন্য প্রলেপের খোঁজে। অন্যজন বলল, চল, বুড়ো আর্লকে অনুসরণ করে আমরাও যাই এডগারের খোঁজে। ঈশ্বর যেন তাকে ভালো রাখেন।

 

কোনও কাজে ব্যর্থ হলেও মানুষ সর্বদা একটা-না-একটা আশার দ্বারা পরিচালিত হয়। কিন্তু সবচেয়ে শোচনীয় ব্যাপার সৌভাগ্য থেকে দূর্ভাগ্যের কবলে পড়াটা। এখন যিনি দুর্ভাগ্যের কবলে পড়েছেন। অথচ ভবিষ্যৎ সুখের আশায় সে দুঃখকে অম্লান বদনে মেনে নিয়েছেন, সেরূপ লোকদের মধ্যে আমিও একজন-– মনে মনে নিজেকে এরূপ ভেবে নিল এডগার। একজন বুড়ো লোকের সাহায্যে বাবাকে আসতে দেখে এডগার বলল, কী আশ্চর্য! আমার বাবা আসছেন এক বুড়ো লোককে অবলম্বন করে!

বুড়ো লোকটি গ্লস্টারকে উদ্দেশ করে বলল, হুজুর, আশি বছর ধরে আমি আপনার অধীনস্থ একজন প্ৰজা!

গ্লস্টার বলল, ঈশ্বর তোমার কল্যাণ করুন। তুমি চলে যাও, নইলে বিপদ হতে পারে তোমার। আমার সামনে এখন শুধুই অন্ধকার। পথ চলার জন্য কোনও সাখীর প্রয়োজন নেই আমার। হে প্রিয় এডগার, ভুলবশত যে অন্যায় আমি তোমার উপর করেছি, তার জন্য আজ ক্ষত-বিক্ষত আমার হৃদয়। এই অন্ধত্ব দশা থেকে আমার মুক্তি হবে। যদি কখনও তোমার স্পর্শ পাই।

পিতার এই শোচনীয় অবস্থা থেকে এডগার মনে মনে ভাবতে লাগল এর চেয়ে খারাপ আর কিছুই হতে পারে না।

এডগারকে দেখে বৃদ্ধ বলল, ওহে যুবক, কোথায় যাচ্ছ তুমি?

গ্লস্টার বলল, কে উনি? উনি কি একজন ভিক্ষুক? মনে হয় না ও পুরোপুরি পাগল। গত রাতে ঝড়ে বিপর্যস্ত একটা লোককে দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলের কথা। কিন্তু সে সময় নিবুদ্ধিতাবশত আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বিজাতীয় ক্ৰোধ। তাই মনে হয়েছিল মানুষ সামান্য কীটমাত্র। আজ বেশ বুঝতে পারছি মানুষ কত অসহায়— ঈশ্বরের হাতে ক্রীড়ানক মাত্র। আমায় বল, লোকটির কি নগ্নদেহ?

হ্যাঁ প্রভু, বলল বৃদ্ধ।

গ্লস্টার বলল, তাহলে এখনি গিয়ে তার জন্য কিছু পোশাক নিয়ে এস। এখন সেই হবে। অন্ধের যষ্টি স্বরূপ।

কিন্তু প্ৰভু, উনি তো সম্পূর্ণ পাগল, বলল বৃদ্ধ।

তা হোক বলল গ্রেস্টার, আমি যা বললাম। তাই করো। শীঘ্ৰ চলে যাও। বৃদ্ধ লোকটি চলে গেল। বাবার দুঃখে এডগার এত কাতর হয়ে পড়েছে যে তার কথা বলার শক্তি নেই। কিন্তু অন্ধ গ্লস্টার চিনতে পারেনি তাকে। তিনি বললেন, যুবক, তুমি বলতে পারডোভারের পথ কোন দিকে?

ওদিকে হতভাগ্যটমের বুকে তখন অনবরত নাচছে পাঁচ শয়তানী— ওবিডিকাঠ, হবিডিডাম্প, মৃদু, মোদো আর বিকারটি গিরোট। সুতরাং অর্থহীন তার কথা। তবুও সে বলল, ঈশ্বর আপনাদের মঙ্গল করুন। আমি জানি ডোভারের পথ।

উৎসুক হয়ে তাকিয়ে গ্লস্টার বলল, হে প্রিয় বন্ধু, এই নাও টাকা। দুঃখময় জীবনে অন্তত কিছুটা শান্তি ভোগ কর। জীবনে যাদের কাছে সুখটাই বড়ো, তোমার দুঃখ তাদের কাছে সৃষ্টি করবে। ঘৃণা। তুমি সুস্থ হও।

আলবেনিকে জিজ্ঞেস করলেন গনেরিল, তোমার প্রভু কোথায়?

উত্তর দিল আলবেনি, তিনি খুবই পালটে গেছেন ম্যাডাম। তিনি বিশ্বাসই করলেন না ফরাসি সৈন্যের আগমন-বার্তা আর গ্লস্টারের বিশ্বাসঘাতকতার কথা। উল্টে ভাবলেন যে আমিই মিথ্যেবাদী।

এ কথা শুনে গর্জে উঠে গনেরিল বলল, একমাত্র তোমার মতো নির্বোধ, দুর্বল, কাপুরুষরাই পারে দেশদ্রোহিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে থাকতে।

আলবেনি বলল, তুমি এক অকৃতজ্ঞ দুনীতিপরায়ণ নারী। এখনও সময় আছে পাপবোধ সম্পর্কে তোমার সচেতন হবার। এখনও বলছি আমি, নিজেকে ধ্বংস করার আগে তাকে ধ্বংস কর, নইলে অচিরেই শেষ হয়ে যাবে তুমি।

এমন সময় একজন দূত এসে প্রবেশ করল। আলবেনি জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর দূত?

দূত বলল, হুজুর গ্লস্টারের চোখ তুলে নেবার সময় সে যে আঘাত পায় তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে। এক ভূত্য সে সময় তাকে বাধা দিলে তিনি রেগে গিয়ে তাকে হত্যা করেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে ওই ভূত্যের তলোয়ারের আঘাতে তার বুকে ওই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।

গনেরিল বলল, পাপের পরিণতি হয় তার শাস্তিতে। আচ্ছা, গ্লস্টারের কি দু-চোখই নষ্ট হয়ে গেছে?

হ্যাঁ, উত্তর দিল দূত, আপনার বোনের একটা চিঠি আছে। তাড়াতাড়ি তার উত্তর দিতে হবে।

চিঠিটা নিয়ে মনে মনে ভাবল গনেরিল, এর উত্তর তো তৈরিই আছে। ঠিক আছে, এর উত্তর দিচ্ছি। আমি—বলে চলে গেল। গনেরিল।

গনেরিল চলে যাবার পর আলবেনি জিজ্ঞেস করল দূতকে, বলতে পোর, যখন গ্লস্টারের চোখ তোলা হচ্ছিল, তখন কোথায় ছিল এডমন্ড?

দূত বলল, ইচ্ছে করেই তিনি সে সময় বাড়ি ছিলেন না। বাবার পরিকল্পনার কথা তিনিই তো ফাস করে দিয়েছেন। ডিউককে।

আলবেনি বলল, তুমি ধন্য গ্লস্টার। তোমার প্রভুভক্তি সত্যিই দেখার মতো। আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমার উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারের প্রতিশোধ আমি নেব্বই। এস বন্ধু, যা জানি আমায় নিৰ্ভয়ে বল। চলো, ভেতরে চল।

কেন্ট জিজ্ঞেস করল, বলতে পার কাউকে সেনাপতির পদ না দিয়েই কেন চলে গেলেন ফ্রান্সের রাজা?

বোধহয় বিশেষ প্রয়োজনেই তাকে চলে যেতে হয়েছে–বলল দূত।

কেন্ট জানতে চাইল, চিঠিটা পেয়ে রাজা কী করলেন?

বারবার তার চোখ জলে ভরে উঠছিল চিঠিটা পড়তে পড়তে। একটা বদ্ধ আবেগ যেন মোহিত করেছিল তার মনকে, বলল দূত।

কেন্ট বলল, উনি কি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন তোমায়?

অন্তর মন্থন করে অতিকষ্টে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছিল পিতা শব্দটি। একবার তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন তোমরা মেয়ে জাতির কলঙ্ক — হায় সেই ঝড়ের রাতে–তারপরই হঠাৎ চুপ করে গেলেন তিনি–বলল দূত।

আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। এই ভেবে যে একই পিতার ঔরসে কীভাবে পরস্পরবিরোধী সস্তানের জন্ম হয়, বলল কেন্ট।

এ সময় একজন দূত এসে বলল যে ব্রিটিশ সেনাদল এদিকেই এগিয়ে আসছে।

আচ্ছা অসওয়াল্ড, আমার ভগ্নীপতির কি স্বয়ং যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা করবেন? জানতে চাইল রিগান।

হ্যাঁ, বলল অসওয়াল্ড, তবে সৈনিক হিসাবে আপনার বোন তার চেয়েও দক্ষ।

রিগান বলল, আচ্ছা অসওয়াল্ড, দিদির চিঠিতে কী লেখা ছিল? নিশ্চয়ই কোনও প্রয়োজনীয় কাজের জন্য তাকে ডাকা হয়েছে। তুমি এখানেই থাকবে। আগামীকাল থেকে শুরু হবে আমাদের অভিযান।

আমার পক্ষে তা সম্ভবপর নয়, উত্তর দিল অসওয়াল্ড।

কেন? কী এমন কথা আছে যা মুখে না বলে চিঠিতে লিখলেন দিদি? জানতে চাইল রিগান।

 

এডগার বলল, মহাশয়, আপনার নির্দেশমতোই আমরা হাঁটতে শুরু করেছি। খাড়া পাহাড়টার উপর দিয়ে।

কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে বনের উপর দিয়ে হাঁটছি। কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না।। তোমার গলার আওয়াজটা যেন আগের চেয়ে ভিন্ন মনে হচ্ছে, বলল গ্লস্টার।

এডগার বলল, চোখের দারুণ যন্ত্রণাই দুর্বল করে দিয়েছে আপনার ইন্দ্ৰিয়গুলিকে। আমার যা পরিবর্তন হয়েছে তা একমাত্র পোশাকে। পাহাড়ের খুব বিপদজনক জায়গায় এখন এসে পৌঁছেছি আমরা। ভাসমান জাহাজগুলিকে খুবই ছোটো দেখাচ্ছে এখান থেকে। মাথা ঘুরে যাবে নিচের দিকে তাকালে। এখান থেকে মাত্র একফুট দূরে শেষে কিনারা।

ঠিক আছে বন্ধু–বলল গ্লস্টার, এবার আমায় ছেড়ে দিয়ে এই মূল্যবান রত্নটাকে তুমি নাও। হে ঈশ্বর, তিলতিল করে ক্ষয়ে যাওয়া দুঃখের বোঝা কমানোর জন্য আমি স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করব। বিদায় এডগার! ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। বলেই শূন্যে লাফিয়ে উঠলেন গ্লস্টার। তাই দেখে ভাবল এডগার, মানুষ কি এভাবেই নিজেকে শেষ করে। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যেই তার কাছে গিয়ে বলল, ও মশাই! আপনি কি জীবিত না মৃত?

মরতে দাও আমাকে, চিৎকার করে বলল গ্লস্টার।

এডগার বলল, এত উঁচু থেকে পড়ে গিয়েও আপনি যখন অক্ষত রয়েছেন, তখনই বোঝা যায় আপনার শরীরটা শক্ত ধাতু দিয়ে গড়া।

ক্ষুন্ন মনে জানতে চাইল গ্লস্টার, সত্যি করে বল তো আমি কি সত্যিই পাহাড় থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছি? তারপর করুণায় ভেঙে পড়ে সে বলল, আমার আর মর্যা হল না। মৃত্যুও এখন ব্যঙ্গ করছে আমায় নিয়ে।

এডগার বলল, কী আশ্চর্যের ব্যাপার! কোনও ব্যথাই অনুভব করছেন না আপনি। বলুন তো, এই পাহাড়ের মাথায় কে নিয়ে এসেছে আপনাকে?

একটা ভিখারি। আমায় নিয়ে এসেছে। এখানে। কিন্তু কেন জানতে চাইছ তার কথা? বলল গ্লসটার।

এডগার উত্তর দিল, নিচে থেকে তাকে দেখে আমার মনে হল তার মুখে হাজারটা নাক আর অসংখ্য শিং। তার গায়ে সমুদ্র তরঙ্গের মতো অসংখ্য পাহাড়। আর মুখের মধ্যে বড়ো বড়ো দুটো চোখ। নিশ্চয়ই সে কোনও শয়তান?

হ্যাঁ, সে বারবার বলছিল বটে শয়তান। তবে আমি ভেবেছিলাম সে মানুষ। ওই আমায়। সে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। এবার আমার সব কথা মনে পড়ছে। আনন্দের সাথে বলে ওঠে। গ্লস্টার।

এডগার বলল, হ্যাঁ, ভালো করে ভাবুন আপনি। এদিক পানে কে যেন আসছে? নিশ্চয়ই লোকটি অসুস্থ।

কেউ আর এখন টাকার লোভে বন্দি করতে আসবে না আমায়। কারণ এখন আমিই যে রাজা –মনে মনে ভাবতে লাগলেন রাজা লিয়ার।

উঃ কী ভয়ংকর দৃশ্য! দেখে মনে হচ্ছে উনিই রাজা লিয়ার, যন্ত্রণায় কেঁপে উঠে বলল এডগার।

লিয়ার বলতে লাগলেন, চেয়ে দেখা ওই লোকটার দিকে। মনে হচ্ছে ও যেন মাঠে কাক তাড়াচ্ছে। দেখ দেখা ঐ একটা ইদুর। আমি দৈত্যের উপর পরীক্ষা করব। এই সেকা রুটিটা দিয়ে। বাদামি রং-এর টাঙ্গি আর বর্শাটা নিয়ে এস, তিরটা অব্যর্থভাবে লেগেছে ওর বুকে।

এর গলার আওয়াজ শুনে তো রাজা বলেই মনে হচ্ছে–বলল গ্লস্টার।

ঠিকই বলেছেন, আমিই রাজা। ঐ তুষারের মত সাদা মেয়েটাকে দেখুন। ওর নারীত্বের আবরণে ঢাকা রয়েছে নরকের ঘন অন্ধকার, সৰ্ব্বনাশী আগুনের জুলন্ত শিখা সবকিছুকে পুড়িয়ে দিয়ে ছাই করে দেয়। শতাধিক সে মেয়েকে। হে রাজবৈদ্য, আমার দূষিত কল্পনাকে হঠিয়ে দিতে একফোঁটা সুগন্ধী দাও আমাকে, বললেন লিয়ার।

গ্লস্টার বলল, সত্যিই আশ্চর্য, নিয়তির হাতে নিগৃহীত আপনার মতো একজন মহান ব্যক্তি আমাকে চেনেন।

তোমার চোখের ওই চাউনিকে আমি ভালো করেই চিনি, বললেন। লিয়ার, কিন্তু আমি কিছুতেই ভালোবাসব না তোমায়। উঃ তুমিও কি নিঃস্ব ও দৃষ্টিহীন আমারই মতো। তাহলে কীভাবে তুমি বুঝতে পারছি পৃথিবীর গতি কোন দিকে।

মনে মনে বলল। এডগার, স্বচক্ষে না দেখলে মর্মান্তিক অবিশ্বাস্য বলে মনে হত এ দৃশ্যকে।

লিয়ার বললেন, তুমিই বল কে পাগল আর কে চোর। আমি তোমায় বলছি বন্ধু, জমকালো পোশাকের আড়ালে যে পাপ সহজেই লুকিয়ে আছে,মিথ্যেবাদী রাজনীতিকের নকল চোখে তাকাবার ভান করলে তা সব কিছুই দেখতে পাবে তুমি। এবার সুতো খুলে দাও, বডড লাগছে পায়ে।

রাজার কথা শুনে অবাক হয়ে মনে মনে ভাবল এডগার, আশ্চর্য, রাজার কথার এই আঘাতউন্মত্ততার মাঝেও রয়েছে একটা খুশির ভাব।

লিয়ার বললেন, গ্লস্টার, তুমি যদি সমবেদনা দেখাতে চাও, তাহলে চোখটাকে ধার করতে হবে তোমায়। আমি তোমায় চিনি, অধৈর্য হয়ে না তুমি, কারণ চোখের জল ফেলাটা আমাদের উভয়ের জীবনের নিয়তি। পরে আমি তোমায় সব বুঝিয়ে বলব।

উঃ মানুষের কী ভয়ংকর পরিণতি, বলল গ্লস্টার।

লিয়ার বলতে লাগলেন, আমরা বোকার মতে কাঁদি যখন এ পৃথিবীতে প্রথম আসি। মাথার টুপি অশ্বারোহী সৈনিকের ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়িয়ে পরীক্ষা করব আমি। চুপি চুপি একবার জামাইয়ের কাছে পৌছতে পারলেই একবারে মেরে ফেলবে তাকে।

আমি এখন অসহায়। যাবে আমৃত্যুর সাথে? একজন ডাক্তারকে দিয়ে মাথার চিকিৎসা করব। সেখানে তোমরা কেউ যাবে না, শুধু আমি একা থাকব। কিন্তু না, শোন তোমরা, রাজার মতো বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করব আমি। এত সহজ নয়। আমাকে ধরা, আমি ছুটব— বলেই ছুটতে শুরু করলেন রাজা লিয়ার। রাজাকে ধরার জন্য তার অনুচররাও পেছু পেছু ছুটতে লাগল।

একজন অনুচর বলল, রাজার এ অবস্থা আর চোখে দেখা যায় না।

কেন্ট বললেন তাকে, ওহে, আসন্ন যুদ্ধের কোনও খবর রাখা তুমি? কতদূর এগিয়ে এসেছে শক্ৰ সৈন্যেরা?

অনুচর উত্তর দিলে, খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে তারা। আর আধঘণ্টার মধ্যেই এখানে এসে পড়বে প্রধান সৈন্যদল। রানি বিশেষ কারণে রয়ে গেছেন। কিন্তু সৈন্যরা চলে গেছে।

গ্লস্টার বলল, আমার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। বল যুবক, কে তুমি?

জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিপর্যস্ত এক যুবক আমি, যে ভালোবাসি মানুষকে সহানুভূতি দেখাতে–বলল। এডগার। তারপর যত্নের সাথে গ্লস্টারের শীর্ণ হাত ধরে সে বেরিয়ে গেল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

দূর থেকে গ্লস্টারকে আসতে দেখে মনে মনে খুব খুশি হল অসওয়াল্ড। সে গ্লস্টারকে বলল, ওঃ কী ভাগ্যবান আমি। ওহে বুড়ো, এবার এই তলোয়ারের আঘাতেই মারা যাবে তুমি, বলেই তলোয়ার বের করল সে।

অসওয়াল্ডকে বাধা দিয়ে বলল, খবরদার বলছি, এই হতভাগ্য বুড়োটার কাছে এস না। তোমরা সরে যাও, যেতে দাও একে। নইলে তোমার জীবন বিপন্ন হবে এই লাঠির ঘায়ে।

দূর হয়ে যা ঘৃণ্য চাষি, বলল অসওয়ান্ড।

তবে রে হতচ্ছাড়া পাজি! দেখাচ্ছি। তোকে মজা, বলেই লাঠি তুলল এডগার।

এরপর শুরু হয়ে গেল দু-জনের লড়াই। কিছুক্ষণ বাদেই এডগারের লাঠির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল আসওয়ান্ড। তার পকেট হাতড়িয়ে পাওয়া গেল একটা চিঠি, যাতে লেখা আছে—

আমাদের একে অন্যকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা মনে রেখে যত শীঘ্র সম্ভব মেরে ফেল তাকে। আর আমাকে অন্যের শয্যাসঙ্গিনী না করে দয়া করে যত তাড়াতাড়ি পার তোমার শয্যাসঙ্গিনী করে নাও।

ইতি–তোমার প্ৰিয়তমা স্ত্রী গনেরিল।

গ্লস্টার বলল, হে ঈশ্বর, এই দুঃখ-কষ্ট থেকে আমাকে বাঁচাবার জন্য পৃথিবীটাকে অসংলগ্ন করে পাগল করে দাও আমায়।

দূর থেকে রণদামামার আওয়াজ কানে আসতেই চঞ্চল হয়ে উঠল এডগার, আপনি তাড়াতাড়ি হাত ধরুন আমার। আমি আপনাকে নিয়ে যাব আমার বন্ধুর নিরাপদ আশ্রয়ে।

 

হে মহানুভব কেন্ট! আপনার ঋণ আমি জীবনেও শোধ করতে পারব না, বিনয়ের সাথে বলল কর্ডেলিয়া, আপনার ওই ছেড়া পোশাক ফেলে দিয়ে নূতন পোশাক পরুন।

কেন্ট বলল, আপনি আমায় ক্ষমা করবেন। ম্যাডাম। আমার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রয়োজন আছে। এ ছদ্মবেশের। অনুগ্রহ করে আমার পরিচয় প্রকাশ করবেন না।

বেশ, করব না, বলে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলেন কর্ডেলিয়া, এখন কেমন আছেন রাজা?

ডাক্তার বললেন, তিনি ঘুমোচ্ছেন।

হে ঈশ্বর, সস্তানের দ্বারা প্ৰপীড়িত ওর আত্মাকে শান্তি দাও। আচ্ছা, ওকে কি নতুন পোশাক পরানো হয়েছে? জানতে চাইলেন কর্ডেলিয়া।

হ্যাঁ ম্যাডাম, উত্তর দিলেন ডাক্তার। উনি এখনও অসুস্থ। আপনি থাকুন ওর কাছে।

কর্ডেলিয়া মনে মনে বলতে লাগল, হে আমার প্রিয় পিতা, আমার এই চুম্বন যেন সারিয়ে তোলে আপনার দুরারোগ্য ব্যাধিকে। তারপর রাজাকে দেখেই বলে উঠল, হায় পিতা, রাজা হয়েও আপনি কীভাবে এই বাজে লোকদের সাথে শুয়োরের খোয়াড়ে শুয়ে আছেন? এইতো, জেগে উঠেছেন উনি।

ডাক্তার বললেন, আপনি তাড়াতাড়ি কথা বলুন।

ব্যগ্র কণ্ঠে বলল কর্ডেলিয়া, আপনি কেমন আছেন মহারাজ?

তুমি এক স্বর্গীয় আত্মা, কিন্তু আমি কাঁদছি, পুড়ে যাচ্ছি নরকের আগুনে–চিৎকার করে বলে উঠলেন। লিয়ার।

কর্ডেলিয়া বলল, আপনি আমায় চিনতে পারছেন না বাবা? ডাক্তার! উনি যে এখনও উন্মাদ।

চিৎকার করে বলতে লাগলেন লিয়ার, এখন আমি কোথায়? সবাই ঠকিয়েছে আমায়, জানি না। আমি কী বলব। এ হাত তো আমার নয়! না, না, এই তো আঘাতের বেদনা অনুভব করছি হাতে। আমার মতো এরূপ অবস্থায় কেউ যেন না পড়ে।

করুণ স্বরে বলল কর্ডেলিয়া, বাবা, আমার দিকে চেয়ে আশীৰ্বাদ করুন আমায়।

লিয়ার বললেন, তুমি কি আমার সাথে পরিহাস করছ? আমি এক নির্বোধ মেহদুর্বল আশি বছরের বুড়ো। কিন্তু তোমায় যেন কোথাও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে। গতরাতে আমি কোথায় ছিলাম আর আজই বা কোথায়। বুদ্ধি-সুদ্ধি বলে কিছু নেই আমার। দয়া করি আমায়, পরিহাস করে আমার অস্তরে ব্যথা দিও না। তুমি কি আমার মেয়ে কর্ডেলিয়া? তুমি আর কেঁদো না মা। বিনাদোষে তোমার বোন আমার উপর অন্যায়-অত্যাচার করেছে। বিষ খেয়ে মরব আমি। আচ্ছা! মা, আমি কি ফ্রান্সে রয়েছি?

বাবাকে সাস্তুনা দিয়ে বলল কর্ডেলিয়া, না বাবা, এ আপনারই রাজ্য।

ডাক্তার বলল, পাগলামির জন্য পূর্বের কোনও কথা ওর মনে নেই। আপনি একটু ধৈর্য ধরুন भJivठभ। w

কর্ডেলিয়ার দু-হাত ধরে বললেন লিয়ার, কর্ডেলিয়া, মা আমার, এই বুড়ো বাবার সব দোষ ভুলে গিয়ে ক্ষমা কর তাকে।

বাবা ও ডাক্তারকে নিয়ে কর্ডেলিয়া অন্য জায়গায় চলে যাবার পর কেন্ট বলল তার চাকরকে, তাহলে কর্নওয়ালের রাজ্য চালাচ্ছে প্রস্টারের ছেলে এডমন্ড, ডিউকের সম্বন্ধে যা গুজব রটেছে তা সত্যি। কিন্তু গ্লস্টারের নির্বাসিত ছেলে কি জার্মানিতে রয়েছে?

 

আগে থাকতেই কিছু বলা যাচ্ছে না, সৈনাদল দ্রুত এগিয়ে আসছে। আজকের যুদ্ধে জয়পরাজয়ের উপরই নির্ভর করছে আমাদের পরিকল্পনার সফলতা, বলল এডমন্ড।তারপর একজন অফিসারকে ডেকে সে বলল, যাও, তুমি গিয়ে জেনে এস অস্থিরচিত্ত ডিউকের শেষ সিদ্ধান্তটা।

অফিসার চলে যাবার পর রিগান বলল, ওগো আমার প্রিয় এডমন্ড! তুমি সত্যি করে বলতো আমার বোনকে ভালোবাস কিনা?

চালাক এডমন্ড সাথে সাথেই বলে উঠল, না ম্যাডাম, কথাটা মোটেও সত্যি নয়।

তার সাথে তোমার ঘনিষ্ঠ হওয়াটা আমি কিছুতেই সহ্য করব না, বলল রিগান।

মনে মনে মতলব ভাজতে লাগল। গনেরিল, বোনের সাথে এডমন্ডের বিয়ে হলে আমার পক্ষে তা হবে যুদ্ধে পরাজয়ের সামিল।

এ সময় ঘরে ঢুকে বলল আলবেনি, সুপ্ৰভাত। আমাদের দ্বারা বিতাড়িত হয়ে রাজা এখন তৃতীয় মেয়ের আশ্রয়ে। সততার অভাবেই আমরা ভালোভাবে যুদ্ধ করতে পারছি না। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে।

ব্যঙ্গ করে বলল রিগান, এটা কি কোনও যুক্তির কথা?

এডমন্ড বলল, আসুন মহামান্য আলবেনি, তাবুতে গিয়ে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করি।

কেন? জানতে চাইলেন আলবেনি।

বিশেষ প্রয়োজন আছে। চল আমাদের সাথে, বলল রিগান।

কিছুক্ষণ ভেবে বলল আলবেনি, বেশ, চল।

ছদ্মবেশী এডগার ঘরে ঢুকে বলল আলবেনিকে, আমার মত গরিবের কথা শোনার ইচ্ছে কি আপনার আছে?

আলবেনি আর এডগারকে রেখে দিয়ে চলে গেল ওরা সবাই। তখন এডগার বলল, যুদ্ধে নামার আগে আপনি পড়ে দেখুন। এ চিঠিটা। বাইরের এই নোংরা পোশাক সত্ত্বেও আমি জানি কীভাবে সম্মান রক্ষা করতে হয়। আমি বলছি আপনাকে, এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে আপনার বিরুদ্ধে। এখন আমি বিদায় নিচ্ছি। সময় হলে আবার আসব আমি।

এডগার চলে যেতেই আবার এল এডমন্ড, সে ডিউককে বলল, আমাদের শত্রু সৈন্যরা এখনও দুর্বল। তাড়াতাড়ি চলুন যাতে সৈন্যদের একজোট করতে পারি–বলেই তাড়া দিতে লাগল। ডিউককে। আলবেনি চলে যাবার পর মনে মনে একবার তার প্ল্যানটাকে ঝালিয়ে নিল এডমন্ড। ওদের দু-বোনের সাথেই আমি ভালোবাসার অভিনয় করব কিন্তু বিয়ে কাউকে করব না। ওদের আর আমার বাবার সমস্ত সম্পত্তি দখল করতে হলে আমার প্রয়োজন ওদের সমর্থন আর সহযোগিতা। আমি ছেড়ে দেব না লিয়ার আর কর্ডেলিয়ার সাহায্যকারী আলবেনিকে। আর ওরা দু-বোন নিজেদের মধ্যে হিংসার ফলেই মারা যাবে। চালাকি করে এখন থেকে আমি ঝগড়া এড়িয়ে চলব।

বাবা, এই গাছের তলায় বসে আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন, বলেই চলে গেল এডগার। আবার কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে এল সে। ኦ

আমার হাত ধরে তাড়াতাড়ি আসুন, আমার সাথে; পরাজিত হয়ে রাজা লিয়ার বন্দি হয়েছেন তার মেয়ের সাথে, বলল। এডগার।

কান্নায় ভেঙে পড়ে গ্লস্টার বলল, না, আমি আর বঁচিতে চাই না। কিন্তু মৃত্যু তো মানুষের ইচ্ছাধীন নয়।

চিৎকার করে এডমন্ড তাঁর ভৃত্যদের হুকুম দিল বিচার না হওয়া পর্যন্ত তারা যেন লিয়ার আর কর্ডেলিয়াকে রেখে দেয়।

না কর্ডেলিয়া, ওদের ডেক না, বললেন লিয়ার, তার চেয়ে আমরা বরং কারাগারে গিয়ে সেই সব রাজাদের সমব্যাখী হই যারা ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার চোখের জলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে ওদের সাম্রাজ্য আর গর্ব। চল, আমরা কারাগারে যাই।

রক্ষীসহ লিয়ার আর কর্ডেলিয়া চলে যাবার পর একটা কাগজ ক্যাপ্টেনের হাতে দিয়ে তাকে নির্দেশ দিল এডমন্ড, মনে রেখ, এই চিঠির নির্দেশ অনুযায়ী যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ তোমায় দেওয়া হয়েছে, তা পালন করতে পারলে পদোন্নতি হবে তোমার। যাও, কাজটা তাড়াতাড়ি করে এস।

এ সময় নেপথ্যে বাদ্যধ্বনি শোনা গেল। তারই সাথে প্রবেশ করল আলবেনি, গনেরিল, রিগান আর সৈন্যেরা। আলবেনি বলল, সাবাস এডমন্ড! আজকের যুদ্ধে তুমিই জয়ী হয়েছ। এবার আমি আমার ইচ্ছেমত বন্দিদের শাস্তি দেব।

আলবেনির কথা শুনে এডমন্ড খুশি হল। সে বলল, রাজা এবং কর্ডেলিয়ার এই অবস্থা দেখে দেশের মানুষ যাতে বিদ্রোহ করতে না পারে, সে জন্যই কঠোর পাহারায় রেখেছি তাঁদের। এরপর ঠান্ডা মাথায় একদিন তাদের বিচার করা যাবে।

আলবেনি বল, তুমি বোধহয় তোমার পদমর্যাদার কথা ভুলে গেছ এডমন্ড। মনে রেখা তুমি রাজার আত্মীয় নও, একজন প্ৰজা মাত্র।

রিগান বলল আলবেনিকে, মহাশয়, দয়া করে ভুলে যাবেন না যে আমার সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্যই আজ উনি আপনাদের সমপর্যায়ভুক্ত এক সহকর্মী।

তোমার শক্তি, একথা বোলোনা বোন, উনি নিজ বলেই বলীয়ান, বলল গনেরিল।

রিগান বলল, নিজের মতোই আজ আমি ওনাকে সমস্ত সম্মান সম্রাম দান করলাম। হে আ-র প্রিয় সেনানায়ক, সবার সামনে আমি ঘোষণা করছি যে আজ থেকে তুমিই আমার স্বামী এবং প্রভু। আমার সমস্ত জীবন সমর্পণ করলাম তোমার হাতে।

ছিঃ ছিঃ রিগান, ধিক্কার দিয়ে বলে উঠল গনেরিল।

আলবেনি চিৎকার করে বলে উঠল, এডমন্ড, রাজদ্রোহিতার অপরাধে আমি বন্দি করলাম তোমায়— সেই সাথে তোমার প্রতি অনুরক্ত আমার ভণ্ড কুটিল স্ত্রীকে গ্রেফতার করলাম। আর এডমন্ড, তুমিও তো সশস্ত্র। আমি তিনবার ঢাক বাজাবার সাথে সাথে একজন লোক এসে তোমার এই রাজদ্রোহিতা আর বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ দেবে।

খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বলল এডমন্ড, সেই অভিযোগকারী লোকটি একটি শয়তান। সাহসের সাথে আমিও দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আহ্বান জানাচ্ছি তাকে।

আলবেনি বলল, কিন্তু এডমন্ড, তোমার নিজস্ব সৈন্যেরা আমার অনুগত। কাজেই এখন থেকে নিজস্ব শক্তিই তোমার একমাত্র ভরসা।

এ সময় রিগান হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। আলবেনি ভৃত্যদের আদেশ দিল ওরা যেন তাকে তার তাঁবুতে নিয়ে যান।

এদিকে আলবেনির আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে নেপথ্যে ঢাক বাজাতে লাগল। ভূত্যেরা। তৃতীয় বার ঢাক বাজার সাথে সাথে সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করল এডগার।

রক্ষী, এর আগমনের উদ্দেশ্য কী? জানতে চাইল আলবেনি।

শয়তানের ষড়যন্ত্র যদিও আমার নির্দিষ্ট পরিচয় নষ্ট হয়ে গেছে, তবুও জেনে রাখুন, আমিও উঁচুবংশের লোক, বলল ছদ্মবেশী এডগার।

ছদ্মবেশী এডগারকে প্রশ্ন করল আলবেনি, আপনার প্রতিপক্ষ কে?

আর্ল অফ গ্লস্টার এডমন্ডের প্রতিনিধি কে? জানতে চাইল ছদ্মবেশী এডগার।

আমিই স্বয়ং এডমন্ড, আর্ল অফ গ্লস্টার। বল, কী জানতে চাও তুমি? এডগারের সামনে এগিয়ে এল এডমন্ড।

তাহলে যুবক, তলোয়ার নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হও। আপনার অনেক গুণ থাকা সত্ত্বেও আমি জোর গলায় বলছি আপনি বিশ্বাসঘাতক। আপনি একথা অস্বীকার করলে আমার হাতের তলোয়ারই তার যোগ্য জবাব দেবে, বলল, এডগার।

ছদ্মবেশী এডগারকে বলল এডমন্ড, তোমার চেহারা আর কথাবার্তায় ভদ্রবংশের বলে মনে হলেও তোমার ঘৃণ্য ভাষণের জন্য আমার ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তে তলোয়ার দিয়ে তোমায় হত্যা করতে।

তলোয়ার নিয়ে দু-জনের মাঝে লড়াই শুরু হবার কিছুক্ষণ বাদেই প্রচণ্ড আহত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল এডমন্ড। তা দেখে গনেরিল চিৎকার করে বলে উঠল, ওরে কে আছিস, বাঁচা ওকে।

গনেরিলকে জোর ধমক দিয়ে বলল আলবেনি, চুপ কর কুটিল নারী। তুমি আর এডমন্ড, উভয়েই শোন তোমাদের পাপের কথা। আর এডমন্ড, এই চিঠিটাই সাক্ষ্য দিচ্ছে তোমার ঘৃণ্য কাজের।

বেশ করেছি। ওটা আমার চিঠি। আমি যা খুশি তাই করতে পারি, বলল গনেরিল।

আলবেনি ভৃত্যদের ডেকে বললেন, তোমরা ওকে দেখো।

মুমূর্ষু এডমন্ড বলতে লাগল, স্বীকার করছি অনেক পাপ করেছি।আমি। ওহে যুবক, যদি তুমি উচ্চবংশীয় হওতাহলে আমাকে হত্যা করার পাপ থেকে আমি ক্ষমা করে দেব তোমায়।

তার প্রতিদানে আমি তোমায় ক্ষমা করব এডমন্ড। আমি তোমার বড়ো ভাই এডগার। ভগবানের কাছে মানুষকে তার পাপের শাস্তি এ জন্মেই পেতে হয়। হয়তো আমার বাবার সেরূপ কোনও কাজের জন্য নিজের চোখ হারিয়েছেন।

আলবেনি বলল, হে উচ্চবংশের সস্তান, তোমাকে আলিঙ্গন করা থেকে তুমি আমাকে বঞ্চিত কর না। তোমার বাবা এবং তুমি, উভয়েই আমার প্রিয়। এতদিন কোথায় ছিলে তুমি? তোমার বাবার এরূপ অবস্থার কথা কে জানোল তোমায়? উত্তরের আশায় আলবেনি উৎসুক ভাবে চেয়ে রইলেন এডগারের দিকে।

এডগার বলল, দিনের পর দিন আমি যখন মৃত্যুভয়ে মৃত্যুর চেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করছি, ঠিক সে সময় আমার দেখা হল বাবার সাথে। তখন দেখলাম তার দু-চোখ রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পাগলের ভান করে আমি তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাম। পরে আমার পরিচয়ও তাকে দিলাম। কিন্তু এত দুঃখ-কষ্ট-বেদনার ভার সইতে না পেরে তিনি মারা গেলেন।

আলবেনি বলল, আপনার এই দুঃখ আমায়ও বিচলিত করেছে।

এডগার বলল, এত অল্পেই আপনি বিচলিত হবেন না মহামান্য ডিউক। যারা নির্বোধি তারাই শুধু অল্পে কাতর হয়। আমি যখন পলাতক আসামীর মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, তখন একজন লোক সহানুভূতির সাথে আমার সব কথা শুনে জড়িয়ে ধরেন আমার বাবাকে। তিনিই আমায় আশা জুগিয়েছেন। এরপর এক এক করে রাজা লিয়ার আর তার দুঃখের কাহিনি বলে যেতে লাগল এডগার।

উৎসুক হয়ে আলবেনি বললেন, কে তিনি?

উনি হলেন নির্বাসিত কেন্ট, যিনি আজও ছদ্মবেশে রয়েছেন, উত্তর দিল এডগার।

এ সময় হাতে একটা রক্তাক্ত ছুরি নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল একজন ভৃত্য। সে চেঁচিয়ে বলল, কে কোথায় আছ, বাঁচাও আমাকে।

আলবেনি বলল, কী হয়েছে?

ছুরিতে ওই যে রক্ত দেখছেন, তা আপনার স্ত্রীর। ওটা দিয়েই আত্মহত্যা করেছেন তিনি। আর মরার আগে বোনকেও তিনি বিষ খাইয়ে মেরেছেন, বলল সেই ভৃত্য।

এডমন্ড বলল, বাঃ বেশ ভালেই হয়েছে। এবার নিশ্চিন্তে বিয়ে করতে পারব আমরা।

এডগার বললেন আলবেনিকে, মহাশয়, ওই দেখুন, এদিকেই আসছেন কেন্ট।

দূর থেকে কেন্টকে আসতে দেখে শ্ৰদ্ধাভরে বলল আলবেনি, ভেবে পাচ্ছি না। কী দিয়ে আপনার মতো মাননীয় ব্যক্তিকে সম্মান জানাব।

কেন্ট বলল, রাজা কোথায়? আমি এসেছি তার কাছ থেকে বিদায় নিতে।

চমকে উঠলেন আলবেনি, তিনি বললেন, সত্যিই তো রাজালিয়ার আর তার মেয়ে কর্ডেলিয়া কোথায়?

কেন্ট বলল, যদিও আর বেশিক্ষণ বঁচিব না, তবুও তার আগে একটা কাজ করে যেতে চাই আমি। তাড়াতাড়ি একটা লোককে প্রাসাদ দুর্গে পাঠাতে হবে এই পরিচয় চিহ্ন আর তলোয়ারটা দিয়ে। অনেক আগেই ওদের মেরে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আলবেনি বলল, যাও, শীঘ্ৰ যাও।

তলোয়ারটা হাতে নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব দুর্গের দিকে ছুটে গেল এডওয়ার্ড। তার যাবার দিকে তাকিয়ে বলল এডমন্ড, আমার আর গনেরিলের আদেশ অনুযায়ী ওরা তো কর্ডেলিয়াকে মেরে ফেলবে, কিন্তু বাইরে আমরা রটিয়ে দেব দুঃখে আর হতাশায় আত্মহত্যা করেছে কর্ডেলিয়া।

কর্ডেলিয়ার মৃতদেহ কোলে নিয়ে পাগলের বেশে ঘরে এসে ঢুকলেন রাজা লিয়ার। ক্যাপ্টেন, এডগার আর অন্য সবাই ঢুকাল তার পিছু পিছু।

ওগো, তোমরাকি সবাই পাথর হয়ে গেলে? প্ৰাণপণে প্ৰতিবাদ কর তোমরা। সে যে চিরকালের মতো ছেড়ে গেছে আমায়। একটা আয়না দেও আমায়। আমি দেখব ওর মাঝে এখনও প্ৰাণ আছে কিনা— পাগলের মতো বলতে লাগলেন রাজা লিয়ার।

এডগার ও কেন্ট বলল, সত্যিই কী ভয়াবহ পরিণতি রাজা লিয়ারের।

ওগো, তোমরা দেখ ওর আঁচলটা নড়ছে, ও এখনও বেঁচে আছে। কে তুমি, চলে যাও বলছি, বললেন লিয়ার।

মহারাজ, ইনি আপনার বন্ধু কেন্ট, বলল এডগার।

লিয়ার বলল, তোমরা মিথ্যেবাদী। মানুষ খুনের দায়ে অভিযুক্ত তোমরা। হয়তো বাঁচাতে পারতাম তাকে। কিন্তু … কর্ডেলিয়া, তুমি যেও না, দাঁড়াও, তাকিয়ে দেখ তোমার হত্যাকারীকে ফাসি দিয়েছি আমি।

কে তোমরা? ভালো করে দেখতে পাচ্ছি না আমি। তুমিই কি কেন্ট?

হ্যাঁ প্ৰভু, আমিই কেন্ট, যে আপনার দুঃখে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

রাজা লিয়ার স্বাগত জানাচ্ছে তোমায়।

কেন্ট বলল, আপনার দুই মেয়ে আজ মৃত। শ্মশানে পরিণত হয়েছে তাদের রাজ্য।

আমারও মনে হয় তাই, বললেন লিয়ার।

আলবেনি বলল, মাননীয় কেন্ট, মেয়ের শোকে উনি পুরোপুরি উন্মাদ। এসব কথা আজ ওর কাছে অর্থহীন।

কেন্ট বলল আলবেনিকে, মহাশয়, এডমন্ডের মৃত্যু হয়েছে।

সে কথায় কান না দিয়ে আলবেনি বলল, মাননীয় লর্ড এবং আমার বন্ধুরা, এবার আপনারা আমার মনোগত অভিপ্রায় শুনুন। বৃদ্ধ রাজাকে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে দিলাম। আজ থেকে ওর সেবায় নিয়োজিত রাখব নিজেকে। প্রিয় এডগার ও কেন্ট, পূর্বের মতো নিজেদের সাম্রাজ্য নিজের হাতে নিয়ে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হন। আপনারা।

সবাই তাকিয়ে রইল রাজার দিকে। লিয়ার বলতে লাগলেন, হায় হতভাগী কর্ডেলিয়া! তুমি কি কিছু বলতে চাইছ? চিৎকার করে বললেন তিনি, কিছু বল আমায়। আমি তোমার বৃদ্ধ পিতা হতভাগ্য রাজা লিয়ার। আমার মেয়ে কি আজও বেঁচে আছে? ওর ঠোঁট যেন নড়ছে। এডগার, তুমি দেখতো একবার। ওঃ ভগবান! বলেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে সাথে সাথেই মারা গেলেন তিনি। কাতর স্বরে বলল প্ৰভুভক্ত কেন্ট, প্রচণ্ড দুঃখ-শোকেই মৃত্যু হল রাজার।

প্ৰভু, একবার চোখ মেলে তাকান, বলল এডগার।

ওর জীবনকে দীর্ঘায়িত করে আর তাকে কষ্ট দিও না তুমি, বলল কেন্ট, জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গিয়েছিল রাজার। এই প্রচণ্ড কষ্ট এতদিন ধরে তিনি কীভাবে সহ্য করেছেন তা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।

আলবেনি বলল, এবার আপনারা রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করুন।

কেন্ট বলল, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। প্রভুর সঙ্গ ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন। তিনি ডাকছেন আমায়, আমি চললাম তার কাছে।

শেষে বলল এডগার, বয়স বাড়ার সাথে সাথে নানা বাধা-বিয়ের মধ্য দিয়ে মানুষ দুঃখের স্বাদ যেমন পায়, তেমনি অর্জন করে নানারূপ অভিজ্ঞতা। অল্প বয়সিরা এসব জানে না। তাই আমাদের উচিত সর্বদা সত্যের পথ অনুসরণ করা— আর সেই সাথে বর্তমান সময়ের ভার বহন করা।

জুলিয়াস সিজার

প্রচণ্ড ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা দুই যুবক যুবতিকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বললেন ট্রিবিউন ক্লেভিয়াস, ওহে! শোন একটু। আমি তোমাদেরই বলছি, বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রিবিউন মেরুলাসকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। যুবকটিকে দেখিয়ে তিনি জানতে চাইলেন মেয়েটির কাছে, ও তোমার কে হয়?

কথা শুনে লজ্জা পেল মেয়েটি, বলল, আজ্ঞে ও আমার স্বামী।

ক্লেভিয়াস জানতে চাইলেন, কোথা থেকে আসছ তোমরা?

ভয়ে ভয়ে যুবকটি উত্তর দিল, গ্রাম থেকে আসছি আমরা।

তা সেখানে কাজ-কম্মো কিছু করা? জিজ্ঞেস করলেন ক্লেভিয়াস।

উৎসাহিত হয়ে যুবকটি জবাব দিল, আজ্ঞে, গ্রামে আমার কামারশালা আছে, আমি তার দেখাশোনা করি।

চাপা গলায় তাকে ধমকে বললেন ক্লেভিয়াস, সাত-সকালে কাজ-কম্মো ছেড়ে বউকে নিয়ে এতদূর এসেছি কেন? আবার দুজনের হাতেই দেখছি সাজিভরা ফুল। তা কোন দেবতার চরণে দেবে এগুলি?

যুবতি বউটি হেসে জবাব দিল, জুলিয়াস সিজারকে। শুনেছি। অনেক দেশ জয় করে ফিরে আসছেন সিজার। একটু বাদেই নাকি তিনি রথে করে এপথ দিয়ে যাবেন। তাকে দেবার জন্যই গাছের এই সামান্য ফুলগুলি নিয়ে এসেছি আমরা।

চাপা গলায় বললেন ফ্লেভিয়াস, সিজারকে দেবে বলে এনেছ? তোমরা কি খোঁজ রাখি যুদ্ধে সিজার কাকে হারিয়েছেন?

হ্যাঁ জানি— জবাব দিল যুবকটি। যুদ্ধে পরাজিত করে পম্পিকে হত্যা করেছেন সিজার। তাকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে উঠেছেন ফ্লেভিয়াসের সঙ্গী ট্রিবিউন মেরুলাস। দু-জন গ্ৰাম্য যুবক-যুবতির সঙ্গে এত কী কথা থাকতে পারে ফ্লেভিয়াসের—একথা জানার কৌতূহল চাপতে না পেরে পায়ে পায়ে তিনি এগিয়ে এলেন তাদের দিকে। তাকে দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে বললেন ফ্লেভিয়াস —এবার আপনিই দেখুন ব্যাপারটা! যুদ্ধে পম্পিকে হারিয়ে তাকে মেরে ফেলেছেন সিজার–এ খবর শুনে ওদের আর আনন্দের সীমা নেই। সিজার এদিক দিয়ে ফিরবেন শুনে সাত-সকলে গা ছেড়ে ওরা চলে এসেছে এখানে। এপথ দিয়ে যাবার সময় ওরা ফুল দিয়ে সিজারকে অভ্যর্থনা জানাবে।

ট্ৰিবিউন মেরুলাস বললেন, শুধু এরাই নয়, আরও শত শত মানুষ সে উদ্দেশে এখানে এসেছে, সে তো আপনি নিজের চোখেই দেখলেন।

আক্ষেপ করে বললেন ফ্লেভিয়াস, তাই তো দেখছি। যে পম্পিকে যুদ্ধে হারিয়ে তাকে হত্যা করেছেন সিজার, সেই পম্পিকে সম্মান জানাবার জন্য একদিন রোমের রাজপথে ভিড় জমাত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা! আমি নিজে দেখেছি পম্পিকে সম্মান জানানোর জন্য দুধের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ফুলের সাজি হাতে যুবতিরা সকাল-সন্ধে অপেক্ষা করেছে। অদৃষ্টের পরিহাসে সে ছবিটা আজ পুরোপুরি পালটে গেছে। পম্পির হত্যাকারীকে সম্মান জানাতে তারা সব কাজ-কর্ম ফেলে দলে দলে ছুটে আসছে। যে গ্ৰাম্য-দম্পতিকে উদ্দেশ করে এসব কথা বলা, তারা তো অনেক আগেই চলে গেছে। তবুও ভিড়ের মাঝে অনেকেরই কানে এল ফ্লেভিয়াসের আক্ষেপ।

ভিড়ের মাঝে সমবেত লোকদের লক্ষ্য করে আপন মনে বলতে লাগলেন ফ্রেভিয়াস, এই সেদিন পর্যন্ত রোমের নিয়ন্ত্রক ছিলেন সেনাপতি পম্পি! আশ্চর্য! তোমরা কিনা এত সহজে তাকে ভুলে গেলে? সিজারের সাথে যুদ্ধে পম্পি হেরে যাওয়ায় আজ তোমরা সিজারের গুণ-গান করছা! পম্পির উপকারের কথা তোমরা এত সহজেই ভুলে গেলে? তোমরা নিশ্চয়ই জান উপকারীর উপকার যে স্বীকার করে না সে অকৃতজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়। যাও, চলে যাও তোমরা। বাড়ি গিয়ে দেবতার সামনে হাঁটু গেড়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত কর তোমরা। নইলে দেবতার রোষে ধ্বংস হয়ে যাবে রোম।

কানুন, যার বলে তারা অসীম ক্ষমতার অধিকারী। রোমের সাধারণ মানুষেরা মনে করে তারা গরিব জনসাধারণের প্রতিনিধি। তাই ট্রিবিউন ফ্রেভিয়াসের ধমক খেয়ে আস্তে আস্তে ভিড় ফাকা হয়ে গেল। যারা সিজারকে সম্মান জানাতে এসেছিল, ফ্লেভিয়াসের ধমক খেয়ে মুখ কালো করে তারা সবাই ফিরে গেল। সাধারণ মানুষ মোটেও ভাবে না পম্পি বা সিজারকে তাদের জন্য কী করেছে। যে সব উচ্চাভিলাষী তাদের পথের বাধা দূর করে তাঁর তর করে এগিয়ে যেতে পারেতাকে নিয়েই মাতামাতি করে লোকেরা, মাথায় তুলে নাচে, ফুল দিয়ে সংবর্ধনা জানায় তাকে।

প্রায়-দু-হাজার বছর ধরে রোমের বীর সেনাপতিরা দুৰ্দান্ত লড়াই করে একের পর এক নতুন রাজ্যের সৃষ্টি করেছেন। এমনই এক বীর সেনাপতি ছিলেন পম্পি। এই সেদিন পর্যন্ত রোমের প্রতিটি মানুষ তাকে দেশের ভাগ্য-নিয়ন্তা বলে মানত। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হবার পর সিজার নিজ হাতে হত্যা করেন পম্পিকে। আজকে আমরা যাকে ফ্রান্স ও ব্রিটেন বলে জানি, সেখানে তারা পরিচিত ছিল গল ও ব্রিটানি নামে। ওই দুটি রাজ্যে পাকাপাকিভাবে রোমান শাসন প্রবর্তন করে বহুদিন বাদে বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরে আসছেন সিজার।

রোমে এমন বহু লোক এখনও আছে যারা পম্পি মারা যাবার পরও তাকে সমর্থন করে জুলিয়াস সিজারকে ভাবে দেশের শত্রু। অন্য দল মনে করে সিংহাসনে বসলে প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হবেন সিজার। দেশ ও দশের পক্ষে তা মোটেই কল্যাণকর নয়। এই দ্বিতীয় দলের মধ্যে রয়েছে অনেক বুদ্ধিজীবী মানুষ যারা আবার সিজারের বন্ধুও বটে। এদের মধ্যে অনেকেই ভালো যোদ্ধা। — তারা মনে করেন সুযোগ এবং ভাগ্য সুপ্ৰসন্ন হলে তারা অনেকেই সিজারের মতো কৃতিত্ব দেখাতে পারতেন। দিন দিন যে ভাবে জুলিয়াস সিজারের ক্ষমতা বেড়ে চলেছে তা দেখে অনেকের চোখের ঘুম উবে গেছে। সিজারকে ক্ষমতাচুৰ্যত করার সংকল্প নিয়ে তারা একজোট হয়েছেন। তারা আপ্ৰাণ চেষ্টা করছেন দেশের জনমত যাতে সিজারের বিরুদ্ধে যায়–তারা চাইছেন দেশের মানুষকে সিজারের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে। কিন্তু জয়ের আনন্দে ডুবে থাকা সিজার এ ষড়যন্ত্রের বিন্দুমাত্ৰ আভাসও পাননি। শুরুতে আমরা ফ্লেভিয়াস আর মেরুলাস নামে যে দুজন ট্রিবিউনকে দেখতে পেয়েছি তারা উভয়েই সিজারবিরোধী। তাদের কথাবার্তাই এর প্রমাণ।

জনতার ভিড় ফাঁকা হয়ে যেতে সহযোগীর দিকে তাকিয়ে বললেন ট্রিবিউন ফ্লেভিয়াস, তাহলে মেরুলাস, আপনি রাজধানীর দিকেই যান।

মেরুলাস বললেন, সে না হয় যাচ্ছি। আপনি তো ধমক দিয়ে সবাইকে বাড়ি পাঠালেন। এবার কী করবেন। আপনি?

ফ্লেভিয়াস উত্তর দিলেন, আমি শুনেছি কিছু লোক নাকি শহরের মধ্যে সিজারের একটা মূর্তি বসিয়ে তাকে ফুল-মালায় সাজিয়েছে। আমি চাই মূৰ্তিটা খুঁজে বের করে সেটা ভেঙে দিয়ে আসতে।

যাই করুন না কেন, সেটা চিন্তা-ভাবনা করে করবেন, তাকে সাবধান করে বললেন মেরুলাস, আজ আবার লুপারকাল উৎসবের দিন। শহরের সব বাড়িতেই ভালোমত খানাপিনা হবে।

সে যাই হোক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না, বললেন ফ্লেভিয়াস, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি। রোমের রাস্তা-ঘাটে সিজারের মূর্তি দেখতে পেলে আমি তা ভেঙে গুড়িয়ে দেব। আমি চাই আপনিও তা করুন। সিজারের সম্মানের জন্য কোথাও সাজ-সজ্জার ব্যবস্থা হয়েছে দেখলে আপনি তা টেনে ছিড়ে ফেলে দেবেন। সিজারের বড় বড় বেড়েছে। ওর ক্ষমতা বেড়ে যাবার আগেই ধ্বংস করতে হবে তাকে। নইলে ঝামেলায় পড়ে যাব আমরা। এসব কথা বলতে বলতে দু-জন দু-দিকে চলে গেলেন।

 

রাজধানী রোম শহরের মধ্যে সাধারণত যে জায়গায় সভাসমিতি হয়, জুলিয়াস সিজার চলে এলেন সেখানে, সাথে পত্নী কালফুর্নিয়া, মার্ক অ্যান্টনি, ব্রুটাস, ক্যাসিক, সিসেরো ও ডেসিয়াস। সিজারের পেছন পেছন এল জনতার এক বিশাল বাহিনী। তাদের মধ্যে ছিলেন দুই ট্রিবিউন ফ্রেভিয়াস আর মেরুলাস। সেই সাথে ছিল ভবিষ্যৎবক্তা এক জ্যোতিষী।

স্ত্রীকে ডেকে সিজার বললেন, কালফুর্নিয়া! তুমি গিয়ে সোজাসুজি দাঁড়াও অ্যান্টনির যাবার পথে। আর অ্যান্টনি! তুমি কিন্তু ভুলে যেও না যাবার পথে কালফুর্নিয়াকে একবার ছুঁয়ে যেতে। কিন্তু দুজনের কেউ বুঝতে পারল না একথা বলার মানে কী। তারা অবাক হয়ে চেয়ে রইল সিজারের দিকে।

মৃদু হেসে বললেন, বুঝতে পারছি না, তাই না? পুরনো দিনের লোকেরা বলতেন লুপারকাল উৎসবের তারিখে যাবার পথে যদি কোনও বীর যোদ্ধা বন্ধ্যা নারীকে ছুঁয়ে দেয়, তাহলে সে নারী গৰ্ভবতী হয়ে ওঠে।

সিজারের আদেশ শুনে অ্যান্টনি বললেন, আমি অবশ্যই আপনার কথা মনে রাখব। সিজার। সে সময় ভিড়ের মাঝ থেকে চেঁচিয়ে বলে উঠল। সেই ভবিষ্যৎবক্তা জ্যোতিষী, মহামান্য সিজার। আইডস অব মার্চ (১৫ মার্চ) দিনটা আপনার পক্ষে অশুভ! আগে থেকেই আপনি সে ব্যাপারে সাবধান হবেন।

কে বলল কথাটা? জানতে চাইলেন সিজার। আজ্ঞে, ও একজন জ্যোতিষী, জবাব দিলেন ব্রুটাস, ও বলছে আইডস অব মার্চ দিনটি আপনার পক্ষে অশুভ। তাই আগে থেকে ও ব্যাপারে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছে সে।

সিজার আদেশ দিলেন, যাও, লোকটাকে ধরে নিয়ে এস আমার সামনে। আমি দেখতে চাই তাকে  সিজারের কথা শেষ হতে না হতেই ভিড়ের মাঝ থেকে লোকটাকে টানতে টানতে সিজারের সামনে এনে হাজির করল কাসকা।

সিজার বললেন, তুমি জ্যোতিষী? আবার বল তো কিছুক্ষণ আগে তুমি আমায় যা বলছিলে।

জ্যোতিষী বলল, গণনায় দেখতে পাচ্ছি। আইডস অব মার্চ দিনটি আপনার পক্ষে অশুভ। তাই সাবধান হতে বলেছি আপনাকে।

ভালোভাবে লোকটির মুখখানা দেখে সিজার বললেন, বেচারা বোধহয় স্বপ্ন দেখছে। যাই হোক আমি এখন যাচ্ছি। উৎসবের যেন কোনও ত্রুটি না হয়।

কথা শেষ হবার পর পত্নী কালফুর্নিয়া আর মার্ক অ্যান্টনিকে সাথে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন সিজার। শুধু ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগল সিজারকে নিয়ে।

এবার ব্রুটাসের দিকে তাকিয়ে বললেন ক্যাসিয়াস, যাও হে, উৎসবের বাকিটুকু দেখে এস।

নিষ্পৃহ গলায় উত্তর দিল ব্রুটাস, না ভাই, ও সব হইচই খেলাধুলা, অ্যান্টনির ভালো লাগতে পারে, ওতে আমার কোনও উৎসাহ নেই। তুমি যা বলতে চাও, এইবেলা বলে ফেল। আমায় আর উৎকণ্ঠার মাঝে রেখা না। এখন আমায় বাড়ি যেতে হবে।

কাতর স্বরে বলল ক্যাসিয়াস, আজি-কাল দেখছি তুমি আমায় দেখতে পেলেই বেশ গভীর হয়ে যাও। আরও লক্ষ করেছি আমার প্রতি তোমার স্নেহ-ভালোবাসাও সেরূপ নেই। দয়া করে এর কারণটা বলবে কি?

অবাক হয়ে বলল ব্রুটাস, কী বলছি তুমি? তোমায় দেখলে আমি গভীর হয়ে যাই? নিশ্চয়ই তুমি আমায় ভুল বুঝেছ ক্যাসিয়াস।

তোমাকে দেখে গম্ভীর হবার কোনও কারণ এখনও ঘটেনি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে মনের ভেতর যে অন্তৰ্দ্ধন্দ্ব হচ্ছে তাতেই ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছি আমি। এসব নিয়ে এত বিব্রত আমি যে কোনও বন্ধুর সাথে দেখা হলেও বন্ধুসুলভ আচরণ করা হয়ে ওঠে না তার সাথে।

মানসিক অস্তদ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত ব্রুটাস? এতো সোনায় সোহাগা! যে বিষয়ে আলোচনা করতে চায় ক্যাসিয়াস, তার দরজা নিজেই খুলে দিল ব্রুটাস। হঠাৎ বলে উঠলেন ক্যাসিয়াস, আচ্ছা! ব্রুটাস, তুমি কি নিজের মুখ নিজে দেখতে পাও?

পালটা প্রশ্ন করলেন ব্রুটাস, তা কী সম্ভব? আরসি ছাড়া কি নিজের মুখ দেখা যায়?

সায় দিয়ে ক্যাসিয়াস বললেন, এবার একটা খাঁটি কথা বলেছ তুমি। এমন কোনও আরসি। নেই যার মধ্যে তুমি দেখতে পাবে তোমার ভেতরের যোগ্যতা আর গুণাবলি। আমি নিজে দেখেছি এই শহরে সিজার ছাড়া বহু নামি লোক আছেন যাদের মুখে অহরহ শোনা যায় ব্রুটাসের নাম। তারা সবাই মানসিক-দ্বন্দ্বের শিকার। এতে কোনও দ্বিরুক্তি নেই যে ব্রুটাসের মন জয় করার উদ্দেশ্যেই এ সব কথা বলছে ক্যাসিয়াস।

স্পষ্ট করে বল তো ক্যাসিয়াস, কী বলতে চাও তুমি? জানতে চাইল ব্রুটাস, কেন তুমি বলছি আমার গুণাবলির দিকে নজর দিতে?

ক্যাসিয়াস বলল, তাহলে শোন তুমি, এবার থেকে আমি হব সেই আয়না যার মধ্যে ফুটে উঠবে তোমার গুণাবলি–– যার সম্বন্ধে কোনও কিছুই জানা নেই তোমার। তার কথা শেষ হতে হতেই কানে এল বহু মানুষের কোলাহল, আনন্দ আর জয়ধ্বনি।

ক্যাসিয়াস! ও কীসের জয়ধ্বনি? জানতে চাইল ব্রুটাস; তাহলে কি সবাই মিলে রাজা বানিয়ে দিলে সিজারকে?

ব্রুটাসকে একটু খোঁচা দেবার লোভ সামলাতে না পেরে ক্যাসিয়াস বললেন, মনে হচ্ছে সিজার রাজা হোক এতে তোমার আপত্তি আছে।

আপত্তি আছেই তো! বললেন ব্রুটাস, তা সত্ত্বেও সিজারকে আমি ভালোবাসি, সে কথা মনে রেখা তুমি। আমি আবারও বলছি সত্যি করে বল তো আমার কাছে কী চাও তুমি! যদি জনসাধারণের কল্যাণমূলক কিছু বলতে চাও, তাহলে নিৰ্ভয়ে বলতে পার তুমি। যদি তার সাথে সম্মান এবং মৃত্যু–দুটোই জড়িত থাকে, তাহলেও তা নিয়ে মাথা ঘামাব না আমি।

যাক, এতক্ষণে তুমি আঁচ করতে পেরেছ আমার বক্তব্যের কিছুটা, বললেন ক্যাসিয়াস, তুমি ঠিকই বলেছ ব্রুটাস, আমি যা বলতে যাচ্ছি তার সাথে জড়িয়ে আছে দেশের মানুষের মঙ্গল এবং মর্যাদার প্রশ্ন! তুমিই ভেবে দেখ না কেন আমরা উভয়েই ছোটোবেলা থেকে যা খেয়ে বড়ো হয়েছি, সেই খাবার সিজােরও খেয়েছে। সিজারের চেয়ে বেশি ছাড়া কম শক্তিধর নই আমরা। এই সেদিনের কথাই ধরনা কেন, বর্ষায় ফুলে ফেপে ওঠা টাইবার নদীর সামনে গিয়ে সিজার আমাকে বলল, এই নদীতে ঝাপ দিতে পারবে তুমি? তার কথার উত্তর না দিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। সাথে সাথে সিজারও নেমে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে বেশ ভালোভাবে সাঁতার কেটে চলেছি আমরা, এমন সময় কানে এল সিজারের আর্ত কণ্ঠস্বর, আমায় বাঁচাও ক্যাসিয়াস! জলে ডুবে যাচ্ছি আমি। জল থেকে সেদিন তাকে না তুললে নদীর অতলে তলিয়ে যেত সিজার। পম্পিকে হত্যা করে রোমের মানুষের কাছে সেই সিজার। আজ দেবতা। আর তাকে প্ৰাণে বঁচিয়েও এই হতভাগা ক্যাসিয়াস আজও সেই ক্যাসিয়াসই রয়ে গেল। সিজারের কথা রোমের মানুষের কাছে আজ দৈববাণী স্বরূপ। তুমি কি জান সিজার একজন মৃগী রোগী? প্রচণ্ড জুরের ঘোরে মৃগীরোগের তাড়নায় বেঙ্কুশ হয়ে থারথার করে কঁপিছে তার দেহ–সিজারের এরূপ অবস্থা আমি নিজের চোখে দেখেছি! আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবছি কীভাবে সেই লোকটা এত ক্ষমতাবান হয়ে উঠল।

ক্যাসিয়াসের কথা শেষ হতে না হতেই পুনরায় শোনা গেল সিজারের নামে জনতার জয়ধ্বনি।

ব্রুটাসের গলায় আশঙ্কার সুর ফুটে বলল। সে বলল, মনে হয় রোমের লোকেরা নতুন কোনও সম্মানে ভূষিত করছে সিজারকে। তাই বারবার জয়ধ্বনি দিচ্ছে তার নামে।

সম্মানের কথা কী বলছি ব্রুটাস! বললেন ক্যাসিয়াস, এই মুহূর্তে রোমে সিজার ছাড়া অন্য কেউ নেই যে এরুপ নাগরিক সংবর্ধনার যোগ্য। কী আশ্চর্য দেখ, এই লোকটা কীভাবে পুরো দেশটা শাসন করছে। আগে কখনও এমনটি দেখেছ? অথচ ভেবে দেখ সিজারের মধ্যে এমন কী আছে যা তোমার নেই। তুমি কি জান ব্রুটাস নামে তোমার এক পূর্বপুরুষ তার বীরত্ব ও দেশপ্রেমের জন্য লোকের কাছে কত আদরণীয় ছিলেন? দেশের সম্মান রক্ষা করার জন্য তিনি শয়তানের সাথে লড়তেও রাজি ছিলেন। ভাব তো সে সব কথা! আজি কিনা সিজারের মতো লোক দেশের রাজা হতে চলেছে? আর ব্রুটাস তুমি, সেই ব্রুটাসই রয়ে গেলে। এখন আমার প্রশ্ন এসব কি ঠিক হচ্ছে, আর কেনই বা এসব হতে দেব?

ক্যাসিয়াসের দিকে চেয়ে ব্রুটাস বললেন, আমি বেশ বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা। এবার আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি তুমি আমায় দিয়ে কী করাতে চাও। তবে এ ব্যাপারে এখনই আমি কিছু বলব না, যা বলার তা পরে বলব। তুমি আজ বাড়ি চলে যাও। পরে এ ব্যাপারে তোমার সাথে আলোচনায় বসব আমি।

ব্রুটাসের কথা শেষ হতে না হতেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ফিরে এলেন সিজার। ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াসকে দেখতে পেয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তাদের দিকে। তারপর গলা চড়িয়ে বললেন, মার্কাস অ্যান্টনিয়াস!

সিজারের আহ্বানে অনুগত ভূত্যের মতো তার সামনে এসে দাঁড়াল মার্ক অ্যান্টনি।

সিজার বললেন, দেখ অ্যান্টনি, কয়েকজন মোটাসোটা সরল মনের লোকের প্রয়োজন আমার। তুমি সেরূপ কয়েকজন লোককে পাঠিয়ে দেবে। দেখবে লোকগুলো যেন ক্যাসিয়াসের মতো লিকলিকে না হয়। ক্যাসিয়াসের যেমন হাড়-জিরজিরে চেহারা, তেমনি কোটরে বসা ওরা দুচোখের চাহনি কত তীক্ষ আর জোরালো। মনে হয় ও খুব চিন্তা-ভাবনা করে, মাথা ঘামায়। এসব লোক কিন্তু খুবই বিপজ্জনক।

অ্যান্টনি বললেন, না মহামান্য সিজার, ক্যাসিয়াসকে আপনি সেরূপ লোক ভাববেন না। দেখতে রোগ হলেও উনি একজন সৎ এবং মহান রোমান।

সিজার বাধা দিয়ে বললেন, অ্যান্টনি! তোমার কথা সঠিক নয়। আমি আবারও বলছি ক্যাসিয়াস একটু মোটা হলে ভালো হত। ভুলে যেওনা ও প্রচুর পড়াশুনো করে। সবকিছু খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রয়েছে ওরা। তোমার মতো ক্যাসিয়াসও খেলাধুলা, গানবাজনা কিছুই ভালোবাসে না–এমনকি প্ৰাণ খুলে হাসতেও জানে না। যারা প্ৰাণ খুলে হাসে তাদের ও ঘেন্না করে। এসব লোক যখন দেখে তাদের পরিচিত কেউ অনেক উপরে উঠে গিয়েছে, তখন তারা হিংসায় জুলেপুড়ে মরে। এদের থেকে যতটা সম্ভব ব্যবধান রেখে চলা উচিত। তাই বলে ভেব না যেন আমি এদের ভয়ে ভীত। আমি জুলিয়াস সিজার–কাউকে ভয় পাই না আমি।

অ্যান্টনির সাথে কথা বলতে বলতে সিজার অন্যদিকে চলে গেলেন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে।

ক্যাসিয়াসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের একজন ক্যাসকা। তার কাছ থেকে ব্রুটাস শুনতে পেলেন উপস্থিত জনতার সামনে অ্যান্টনি একটা রাজমুকুট পরিয়ে দিতে গিয়েছিল সিজারের মাথায়। কিন্তু পরপর তিনবারই সিজার অ্যান্টনির হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। তা দেখে সবার ধারণা হয় সিজার রাজমুকুট পরতে চান না। অর্থাৎ রাজা হবার কোনও বাসনা নেই তার! এসব দেখে-শুনে ক্যাসকার মনে হয়েছে জনতার কাছে মহৎ সাজার জন্যই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঐ রাজমুকুট ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন সিজার। নইলে রাজমুকুট পরার সাধ তার খুবই ছিল। ক্যাসিয়াসও সায় দিল সে কথায়।

সে রাতে ক্যাসিয়াস তার মতাবলম্বী আরও কয়েকজনকে বাড়িতে ডেকে এনে গোপনে নানারূপ আলোচনা করলেন। এভাবেই শুরু হল সিজারকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র। বহুদিন হল রাজাকে উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের মানুষ— কায়েম হয়েছে জনগণের শাসন। একের পর এক যুদ্ধে জিতে আর দেশ জয় করে উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছে সিজার। রাজমুকুট মাথায় না। পড়লেও সিজার যে রাজা হতে চান সে বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু রোমের শাস্তিকামী জনগণ কিছুতেই রাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজি নয়।

রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে ব্রুটাসের বাড়িতে নিয়ে এলেন ক্যাসিয়াস। রোমের সবাই জানে ক্যাসিয়াস লোকটা মোটেই সুবিধের নয়। তাকে চিনতে ভুল হয়নি সিজারের। কিন্তু ক্রটাস এক বুদ্ধিজীবী লোক, ব্যক্তিগতভাবে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন সিজার। এ ধরনের লোককে দলে ভেড়াতে না পারলে সিজারকে হঠাবার চক্রান্ত মোটেই সফল হবে না। কাজেই সবার সম্মুখে রোমের স্বাধীনতা রক্ষায় ব্রুটাসের সাহায্য চাইলেন। প্রয়োজন হলে দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করতে হবে–বেশ নাটকীয় ঢং-এ সবার সামনে একথাটা বললেন ক্যাসিয়াস।

ব্রুটাস সবাইকে জানালেন রাতের অন্ধকারে কে বা কারা তার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে প্রচুর চিঠি ফেলে রেখে গেছে। সব চিঠিরই বক্তব্য মোটামুটি একই রকম–রোমের মানুষ প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে ব্রুটাসকে। সেই সাথে সিজারের উচ্চাভিলাষের উল্লেখও রয়েছে সে সব চিঠিতে। ব্রুটাস জানালেন দেশের মানুষ যে তাকে এত ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে তা তিনি জানতেন না। ব্রুটাসের কথা শুনে মনে মনে আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন ক্যাসিয়াস, কারণ বুদ্ধিটা তারই। নানা লোককে দিয়ে চিঠিগুলো লিখিয়ে রাতের অন্ধকারে নিজেই সেগুলি ফেলে দিয়েছিলে ব্রুটাসের ঘরে। চিঠিগুলো পড়েই পালটে গেছে ব্রুটাসের মন। সিজারকে উৎখাত করার কথা দানা বাঁধতে শুরু হয়েছে তার মনে।

এবার চালে বাজিমাত করলেন ক্যাসিয়াস–সফল হল তার উদ্দেশ্য। স্পষ্ট ভাষায় ব্রুটাস জানিয়ে দিলেন সিজারকে হাঁটাবার চক্রান্তে তিনিও সামিল আছেন এবং সে ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। তিনি, কারণ সিজারের চেয়ে দেশ তার কাছে অনেক বেশি দামি। নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সিজার যদি রোমের মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে চান, তাহলে তাকে হটিয়ে দিতে পেছপা হবেন না তিনি।

অনেক রাত ধরে সবাই আলোচনা করলেন কীভাবে হটানো যায় সিজারকে। এ বিষয়ে সবাই একমত হলেন যে সিজারকে হটাতে হলে তাকে মেরে ফেলা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। কিন্তু সমস্ত সৈন্যরা সিজারের অনুগত, দেশের প্রধান সেনাপতি তিনি। দেশের মানুষদের অধিকাংশই তার সমর্থক। স্বার্থের সংঘাত বেধে গেলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে, কেউ তা রোধ করতে পারবেনা। একবার যুদ্ধ বেধে গেলে ক্যাসিয়াস ও তার সহযোগীরা সবাই কচুকাটা হবে সিজারের সেনাবাহিনীর হাতে। কাজেই যুদ্ধ বেঁধে যাবার আগেই হত্যা করতে হবে সিজারকে। এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।

 

ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সেই ১৫ মার্চ। রোমের সেনেটের সদস্যরা সে দিন এক বিশেষ অধিবেশন ডেকেছেন আর তাতে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানান হয়েছে সিজারকে। চারদিকে কানায়ুষো শোনা যাচ্ছে সেনেটের সদস্যরা নাকি সিজারের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান দেশে। সাথে সাথে এও শোনা যাচ্ছে জনতার কাছে মহান হবার জন্য তিনবার রাজমুকুট ফিরিয়ে দিয়েছেন সিজার। কিন্তু এবার সেনেটররা তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলে সানন্দে তিনি তা গ্রহণ করবেন। এদিকে ক্যাসিয়াস-ব্রুটাস চক্রও কিন্তু চুপচাপ বসে নেই। তারা সংকল্প করেছে সেনেটের ভেতর মাথায় রাজমুকুট পরার আগেই তারা হত্যা করবে সিজারকে।

ঘটনার আগের দিন রাতে ঘুমের ঘোরে বারবার দুঃস্বপ্ন দেখেছেন সিজার পত্নী কালফুর্নিয়া। ঐ দিন শুধু সেনেটে যাওয়া নয়, রাজপ্রাসাদ থেকে বেরুতেও নিষেধ করেছেন স্বামীকে।

কিন্তু সেই বীর জুলিয়াস সিজার, যার জীবনের প্রায় অর্ধেক কেটে গেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ করতে করতে— সে ভয় পায় না। দুঃস্বপ্নে। তার মতে ভীরুরা বারবার মরে, আর বীর একবারই মরে। কিন্তু স্ত্রীর কথায় কিছুটা বিচলিত হলেন তিনি। তিনি স্থির করলেন আজ সেনেটে যাবেন না, প্রাসাদেই কাটাবেন কালফুর্নিয়ার সাথে, যড়যন্ত্রকারীদের কাছে যথাসময়ে খবর পৌঁছে গেল। আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আজ সেনেটে যাবেন না সিজার। ষড়যন্ত্রকারীরা দেখল সিজার সেনেটে না গেলে তাদের এতদিনের মতলবটো ভেস্তে যাবে। ডেসিয়াস ব্রুটাস ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের একজন। ক্যাসিয়াস তাকেই দায়িত্ব দিলেন ভুলিয়ে-ভালিয়ে সিজারকে সেনেটে নিয়ে আসার।

ক্যাসিয়াসের নির্দেশে সিজারের প্রাসাদে গেল ব্রুটাস ডেসিয়াস সিজার তাকে বললেন গতরাত ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখেছে তার স্ত্রী। তাই তিনি স্থির করেছেন আজ সেনেটে যাবেন না।

ডেসিয়াস ব্রুটাস বললেন, আপনার স্ত্রী কি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তা কি আমায় শোনাবেন?

সিজার বললেন, নিশ্চয়ই শোনাব। কাল রাতে আমার স্ত্রী স্বপ্ন দেখেছে যে আমার প্রতিমূর্তির মুখ থেকে ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরুচ্ছে এবং রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা হাসিমুখে সেই রক্ত দিয়ে তাদের হাত ধুয়ে নিচ্ছেন। স্ত্রীর মতে এই স্বপ্ন আমার জীবন সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই স্থির করেছি আজ আর বের হব না।

ডেসিয়াস ব্রুটাস বলল, মাননীয় সিজার! আপনার স্ত্রীর প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা উনি দিয়েছেন তা ঠিক নয়। বরঞ্চ উনি যে স্বপ্ন দেখেছেন তা সব দিক দিয়েই সৌভাগ্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আপনার প্রতিমূর্তির মুখ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে রক্ত বেরুচ্ছে আর সেই রক্তে বিশিষ্ট রোমান নাগরিকরা হাত ধুচ্ছেন-এর অর্থ নানা দেশের রক্ত সংগ্রহ করে রোমের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন আপনি। আর এ কাজে রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা সাহায্য করবেন। আপনাকে। আপনি কেন এই সুলক্ষণযুক্ত স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বলে ধরে নিচ্ছেন মাননীয় সিজার?

তাহলে তুমি আমার স্ত্রীর স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা করছ? বললেন সিজার, আসলে এভাবে আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি।

ব্রুটাস ডেসিয়াস বললেন, এবার আমার কথা শুনুন মহামান্য সিজার। আজ সেনেটেররা আপনার মাথায় রাজমুকুট পরাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি না গেলে হয়তো তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তনও হতে পারে। ভুলে যাবেন না, আপনার স্ত্রী দুঃস্বপ্ন দেখেছেন বলে আপনি সেনেটে যাবেন না, তাহলে সেনেটরদের কাছে আপনার মান-মর্যাদা থাকবে কি? আপনি তাদের কাছে কাপুরুষের পর্যায়ে পড়ে যাবেন।

মনে মনে স্ত্রীর কথা ভেবে বললেন সিজার, কালফুর্নিয়া! দুঃস্বপ্ন দেখে যে ভয় তুমি পেয়েছ তা নিছক ভিত্তিহীন— এতে কোনও সন্দেহ নেই আমার। ওহে কে আছ! আমার সেনেটে যাবার পোশাকগুলো এনে দাও।

ডেসিয়াস চলে যাবার আগেই একে একে সেখানে এলেন ক্যাসিক, সিন্না, মেটেলাস, লিগারিয়াস, ট্রোবনিয়াস এবং ক্যাবলিয়াস।

তাদের সবাইকে দেখে অবাক হয়ে বললেন সিজার, কী ব্যাপার! তোমরা সবাই এসে হাজির হয়েছ আমার বাড়িতে? তোমাদের সবাইকে জানাই সুপ্ৰভাত। ঠিক সে সময় এসে হাজির মার্ক অ্যান্টনি।

তাকে দেখে হেসে বললেন সিজার, কী ব্যাপার অ্যান্টনি! অনেক রাত অবধি ফুর্তি করেও এই সাত সকালে এসেছ তুমি?

সিজারকে হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়ে অ্যান্টনি বললেন, সুপ্ৰভাত সিজার।

এক এক করে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন সিজার, এসো, ভেতরে গিয়ে আমার সাথে সামান্য মদ্যপান করবে। তারপর আমরা সবাই একসাথে সেনেটে যাব।

এদিকে আর্তেমিদোরাস নামে এক গ্রিক অধ্যাপক কোনওভাবে জানতে পেরেছিলেন সিজারকে হত্যার চক্রাস্তের কথা। তিনি সিজারকে উদ্দেশ্য করে চক্রান্তকারীদের সবার নাম জানিয়ে একটা চিঠি লিখলেন। যেদিক দিয়ে সিজার সেনেটে ঢুকবেন তিনি তার একাধারে চিঠিটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন যে জ্যোতিষী ১৫ মার্চের ব্যাপারে সিজারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনিও এসে দাঁড়ালেন অধ্যাপকের পাশে। জ্যোতিষীকে দেখে সিজার বললেন, আরে, ১৫ মার্চ তো এসে গেছে। আজই তো সেই দিন!

সিজারের প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখে জ্যোতিষী বললেন, হ্যাঃ সিজার! আজই। ১৫ মার্চ। দিনটা সবে শুরু হয়েছে, শেষ হতে এখনও বাকি। জ্যোতিষীকে পাত্তা না দিয়ে সিজার এগিয়ে যাবেন এমন সময় অধ্যাপক আর্তেমিদোরাস তার লেখা চিঠিটা সিজারের হাতে দিয়ে বললেন, মহামান্য সিজার! দয়া করে আমার আবেদনটা পড়ে দেখুন। সিজারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের অন্যতম মেটেলাস ট্রোবনিয়াসও তার আবেদনপত্রটি এগিয়ে দিলেন সিজারের দিকে। সেটি পড়ে দেখার জন্য ডেবিয়াস ব্রুটাস অনুরোধ জানালেন সিজারকে। এইসব দেখে ঘাবড়ে গিয়ে গ্রিক অধ্যাপক বললেন, মাননীয় সিজার! আমার আবেদনের সাথে জড়িয়ে আছে আপনার স্বার্থ। অনুগ্রহ করে ওটা আগে পড়ুন।

সিজার বললেন, না, তা হয় না। আপনার আবেদনের সাথে যদি আমার ব্যক্তিগত বিষয় জড়িয়ে থাকে, তাহলে সেটা সবশেষে পড়া হবে।

ব্যস্ত হয়ে অধ্যাপক বললেন, এ নিয়ে আপনি আর দেরি করবেন না সিজার। দয়া করে এটি এখনই পড়ে ফেলুন।

লোকটার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে, বললেন সিজার। তারপর অধ্যাপককে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, আমি আপনাকেই বলছি, যদি আপনার কোনও আবেদন থাকে, তাহলে সেটা রাস্তায় নয়, সেনেটে এসে আমায় দেবেন।

সবাইকে নিয়ে সেনেটে ঢুকে তার নির্দিষ্ট আসনে বসলেন সিজার। তার বিশ্বস্ত বন্ধু মার্ক অ্যান্টনি কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন। কৌশলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন ক্যাসিয়াসের বন্ধু ট্ৰেবোনিয়াস।

এবার চক্রান্তকারীরা এগিয়ে গেল তাদের পরিকল্পিত পথে। প্রথমে সেনেটর মেটেলাস নতজানু হয়ে হাতজোড় করে বললেন, মাননীয় সিজার! অনুগ্রহ করে আপনি আমার নির্বাসিত ভাইকে দেশে ফেরার অনুমতি দিন।

তা হয় না মেটেলাস, বললেন সিজার, তোমার ভাই অপরাধী। বিচারে তার অপরাধের উপযুক্ত সাজা পেয়েছে সে। সে সাজা মকুব করার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। আর তা তুলে নেবার অধিকারও আমার নেই। আর যাই হোক, দেশের আইন-কানুন ছেলেখেলার বিষয়বস্তু নয়।

ব্রুটাস এগিয়ে এসে সিজারের হাত চুম্বন করে বললেন,  আপনি যদি মেটেলাসের ভাইকে মুক্তি দেন, তাহলে খুবই ভালো হয়। সিজার স্বপ্নেও ভাবেননি ব্রুটাসের মতো একজন ন্যায়পরায়ণ লোক এরূপ অন্যায় অনুরোধ করতে পারে। ব্রুটাসের পরপর একই আবেদন জানালেন ক্যাসিয়াস। কিন্তু তাকে ওই একই জবাব দিলেন সিজার। তিনি জানালেন কাউকে অনুনয়। যেমন তার পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি অন্যের অনুরোধ তিনি গ্রাহ্যের মধ্যেও আনবেন না। তাতে যদি তারা বলেন যে পাইলিয়াসকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া অন্যায় হয়েছে, তাহলেও সে নির্বাসন দণ্ড রদ করবেন না তিনি।

সিজারের কথা শুনে সমস্বরে বলে উঠল। সবাই, হে সিজার! আপনি মহান।

কিন্তু তাতে একটুও নরম হলেন না সিজার। এবার চক্রান্তকারীদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল ক্যাসকা। চিন্তা-ভাবনা না করে কোমর থেকে ধারালো ছোরা বের করে আমূল বসিয়ে দিল সিজারের কঁধে। অবাক হয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সিজার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পরনের সাদা পোশাক। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সকালে যারা তার বাড়িতে গিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে এসেছে, এখন তাদেরই সবার হাতে ছুরি, চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রচণ্ড ঘৃণা, আক্রোশ আর প্রতিশোধ–স্পাহা। এরপর ক্যাসিয়াস, মেটেলাস, সিন্না, ডেসিয়াস, ট্ৰেবোনিয়াস, লাইগোরিয়াস — সবাই পরপর এগিয়ে এসে ছুরি বসিয়ে দিল সিজারের বুকে।

টলতে টলতে সিজার এগিয়ে গেলেন বন্ধু ব্রুটাসের দিকে। আগে থেকে ব্রুটাসের হাতে ছিল ছোরা। কিন্তু সে মুহুর্তে ব্রুটাসের বিবেক কেন যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে চোখ বুজে ছোরা বসিয়ে দিলেন সিজারের বুকে।

আর্তনাদের সুরে সিজার বললেন, ব্রুটাস! শেষে তুমিও?? আর কোনো কথা বেরুল না। সিজারের মুখ থেকে। রক্তাক্ত দেহে তিনি লুটিয়ে পড়লেন। সেনেটের শক্ত মেঝেতে।

এবার সমবেতভাবে বলে উঠল চক্রান্তকারীরা, রক্ষা পেয়েছে রোমের স্বাধীনতা। মৃত্যু হয়েছে অত্যাচারী শাসকের। যাও! বাইরে গিয়ে তোমরা জোরালো গলায় এ কথা বল।

সেনেট থেকে বের হয়ে চক্রান্তকারীরা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এবার তাদের ব্যাখ্যা করার পালা কেন তারা বাধ্য হয়েছে রোমের জনপ্রিয় শাসক জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করতে। রোমের স্বাধীনতাকে বীচাবার জন্যই যে তারা একাজ করেছেন সে কথা বুঝিয়ে বলতে হবে সবাইকে। সিজারকে হত্যা করার আগেই তার বন্ধু মার্ক অ্যান্টনিকে সিজারের পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্ৰেবোনিয়াস। অ্যান্টনি যখন জানতে পারলেন যে সিজারকে খুন করা হয়েছে। তিনি ভয় পেলেন এই ভেবে যে সিজারের বন্ধু হিসাবে হয়তো চক্রান্তকারীরা এবার তাকেও হত্যা করবে। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে সোজা চলে গেলেন নিজের বাড়িতে।

অ্যান্টনি বেশ বুদ্ধিমান লোক। তিনি ভেবে-চিন্তে লোক পাঠালেন ব্রুটাসের কাছে। তার লোক ব্রুটাসকে এটাই বোঝাল যে এখন থেকে ব্রুটাস ও তার সাথীদের নির্দেশমতেই চলবেন অ্যান্টনি।

সিজারের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন অ্যান্টনি। সে বেঁচে থাকলে হয়তো ঝামেলা বাধাতে পারে–এ কথাই ব্রুটাসকে বোঝাতে চাইলেন তার সঙ্গীরা। তাদের অভিমত সিজারের মতো অ্যান্টনিকেও মেরে ফেলা হোক।

তাদের কথায় আপত্তি জানিয়ে ব্রুটাস বললেন, না, তা সম্ভব নয়। সিজারের জীবিতকালে হয়তো অ্যান্টনি তার বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। কিন্তু এখন সে তো একজন সাধারণ লোক। তাকে ভয় করার কী আছে! অহেতুক রক্তপাত ঘটালে খেপে যেতে পারে রোমের জনসাধারণ। এরপর অ্যান্টনি প্রেরিত লোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি অ্যান্টনিকে বলে দিও যে তিনি স্বচ্ছন্দে দেখা করতে পারেন ব্রুটাসের সাথে। ব্রুটাস ও তার সঙ্গীদের তরফ থেকে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই তার।

ব্রুটাস ও তার সঙ্গীদের মনোভাব অবগত হবার পর আর দেরি না করে অ্যান্টনি গিয়ে দেখা করলেন ব্রুটাসের সাথে। তাকে বন্ধুর মতো খাতির করে বসলেন ব্রুটাস। সিজার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি অ্যান্টনিকে বললেন কেন সিজারকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়েছিল সে কথা তিনি সময় মতো বুঝিয়ে দেবেন তাকে।

সব কথা শোনার পর ব্রুটাসকে অনুরোধ জানিয়ে অ্যান্টনি বললেন, সিজারের মৃতদেহটা আমার হাতে দিন। আমি সেটা সমাধিস্থ করতে চাই। কিন্তু তার আগে সিজারের কীর্তির বিষয়ে কিছু বলতে চাই জনসাধারণের কাছে। আমার মনে হয় তাতে সিজারের আত্মার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা প্ৰদৰ্শন করা হবে।

এতক্ষণ ধরে ব্রুটাসের পাশে বসে মন দিয়ে উভয়ের কথা শুনছিলেন। ক্যাসিয়াস। এ্যান্টনির প্ৰস্তাব শুনে তিনি ব্রুটাসকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, অ্যান্টনি যদি বলে যে সিজারের সমাধি দেবার আগে জনতার সামনে সে কিছু বলবে, তুমি কিন্তু তাতে রাজি হয়ে না।

পালটা প্রশ্ন করলেন ব্রুটাস, কেন তাতে ভয় পাবার কি আছে? ক্যাসিয়াস যে অ্যান্টনিকে কেন ভয় পাচ্ছে তা বোধগম্য হল না তার।

অ্যান্টনি যাতে শুনতে না পায় এ ভাবে বললেন ক্যাসিয়াস, ব্রুটাস! তুমি এখনও চিনতে পারনি রোমের জনসাধারণকে। তারা এখনও ভালোবাসে সিজারকে। বলা যায় না, হয়তো অ্যান্টনির কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে।

একই স্বরে জানালেন ব্রুটাস, না ক্যাসিয়াস, সে সুযোগ আমি দেব না। অ্যান্টনিকে। আগে আমি জনসাধারণকে বোঝােব কেন হত্যা করা হয়েছে সিজারকে, তারপর আমার অনুমতি নিয়ে অ্যান্টনির যা বলার তা সে বলবে। তবে আপত্তিজনক বা উত্তেজনাকর কিছু বললে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করব আমি।

ক্যাসিয়াস বললেন, বুঝতে পারছি না। কী হবে। আমার কিন্তু মোটেও ভালো ঠেকছে না। কাজটা বোধহয় ঠিক হল না।

আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে অ্যান্টনিকে বললেন ব্রুটাস, সমাধি দেবার জন্য এবার তুমি নিয়ে যেতে পার সিজারের মৃতদেহ। সিজারের গুণাবলি সম্পর্কে জনতাকে কিছু বলার থাকলে তাও বলতে পার তুমি। তবে আমার বক্তব্য শেষ হবার পরই তোমার যা বলার তা বলবে।

অ্যান্টনি বললেন, বেশ, তাই হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আমি।

বেশ, তাহলে তুমি তৈরি হও আমার পেছন পেছন সিজারের মৃতদেহ নিয়ে যাবার জন্য–বলে ক্যাসিয়াসকে সাথে নিয়ে চলে গেলেন ব্রুটাস।

 

সিজারের মৃতদেহ নিয়ে অ্যান্টনি চলে এলেন রোম শহরের মাঝখানে একটা খোলামেলা প্রশস্ত জায়গায়–যেখানে কারও ভাষণ শুনতে বা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে সমবেত হতেন রোমের নাগরিকেরা। সিজারের মৃতদেহ সেখানে নিয়ে যাবার রোমের সাধারণ মানুষ, যারা ভালোবাসতেন অ্যান্টনিকে, তারা দলে দলে এসে সেখানে ভিড় জমাল। ভিড় জমছে দেখে জনতার সামনে এগিয়ে এসে তার ভাষণ শুরু করলেন ব্রুটাস :

হে রোমের অধিবাসীবৃন্দ! তোমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্ন জেগেছে আজ তারই জবাব দিতে এসেছি আমি। তোমরা সবাই জান আমি ছিলাম সিজারের অন্তরঙ্গ বন্ধু–এ বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। সিজারকে আমি যতটা ভালোবাসতাম, তোমরা কেউ ততটা বাসতে না। সিজার ছিলেন একজন খাঁটি রোমান, মহান বীর–তাই আমি তাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দিনে দিনে তার উচ্চাশা বেড়ে উঠছিল। নিজে রাজা হবার জন্য সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শুরু করছিলেন তিনি। কিন্তু তোমরা জেনে রাখা সিজার আমার যতই প্রিয় হোন না কেন, আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমার জন্মভূমি—রোম। এই রোম থেকে বহুদিন আগে রাজতন্ত্রকে হঠিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি। গণতন্ত্রের। সেই গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন নাগরিক তোমরা। হে আমার বন্ধু রোমানরা! আজ সিজার বেঁচে থাকলে তিনি হতেন রাজা আর স্বাধীনতা হারিয়ে তোমরা হতে তার প্রজা। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আমরা বাধ্য হয়েছি সিজারকে হত্যা করতে। এবার তোমরাই বিচার কর, বল আমরা ঠিক কাজ করেছি কিনা?

সেখানে উপস্থিত রোমের জনতা সমবেতভাবে বলে উঠল, স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তোমরা ঠিক কাজই করেছ ব্রুটাস।

ব্রুটাস বললেন, তোমাদের অভিমত যদি এই হয় তবে তার সাথে আমি একমত। এবার সবাই মন দিয়ে শোন আমার কথা। আমার মতোই মার্ক অ্যান্টনিও ছিলেন সিজারের এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু। সিজারকে সমাধি দেবার আগে তিনি তার সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলতে চান। আমি চাই সিজারের প্রতি সম্মান জানাবার জন্য তোমরা সবাই মন দিয়ে তার কথা শুনবে।

ব্রুটাসের বক্তব্য শেষ হবার পর মঞ্চে এলেন অ্যান্টনি। সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, হে আমার রোমান বন্ধুরা! মাননীয় ব্রুটাস আমায় সুযোগ দিয়েছেন সিজার সম্পর্কে তোমাদের কাছে কিছু বলার। আশা করি তোমরা সবাই মন দিয়ে শুনবে আমার কথা।

সে সময় উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একদল লোক জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, আপনার যা খুশি তা বলতে পারেন। তবে আগেই জানিয়ে রাখছি ব্রুটাসের নিন্দ বা সমালোচনা সহ্য করব না। আমরা। আমরা মনে করি সিজারকে হত্যা করে ব্রুটাস ও তার সঙ্গীরা ঠিক কাজই করেছেন।

সে তো নিশ্চয়ই, সায় দিয়ে বললেন অ্যান্টনি, ক্রটাস একজন মহৎ ব্যক্তি, রোমের সবাই জানে সে কথা। কোনও অন্যায় কাজ করতে পারেন না তিনি। আজ আমি এখানে এসেছি সিজারকে সমাধি দিতে, তার প্রশৃংসা করতে নয়। কিছুক্ষণ আগে ব্রুটাস বলেছেন সিজার খুব উচ্চাভিলাষী ছিলেন। ব্রুটাসের অভিযোগ সত্যি হলে বলতেই হবে খুব অন্যায় করেছেন সিজার। আমরা জানি প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু উচ্চাশাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। সেই সাথে আমরা এও জানি উচ্চাশা জিনিসটাই খারাপ। তবে সিজারের উচ্চাশার কোনও প্রমাণ কিন্তু কেউ পায়নি। এই তো সেদিনের কথা তোমরা সবাইজান, আমি নিজে সিজারের মাথায় মুকুট পরিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি নেননি। পরপর তিনবার আমার হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এবার তোমরাই বল, এর দ্বারা কী প্রমাণ হয় সিজার সত্যিই উচ্চাভিলাষী ছিলেন?

জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হল অ্যান্টনির কথায়। ব্রুটাসের কথা শুনে যেমন মোহগ্ৰস্ত হয়েছিল জনতা, অ্যান্টনির কথায় সে মোহের ঘোর কেটে গেল। তারা ভেবে দেখল, সত্যিই তো, যে সিজার বার বার রাজমুকুট প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি কি উচ্চাভিলাষী হতে পারেন? তাহলে কিছুক্ষণ আগে ব্রুটাস তাদের কী বুঝিয়েছেন? স্বভাবতই এ প্রশ্ন জাগল তাদের। জনতার চোখমুখ আর হাবভাব দেখে অ্যান্টনি বুঝতে পারলেন এবার সফল হতে চলেছে তার উদ্দেশ্য। তিনি এমনভাবে সিজারের গুণাবলির বর্ণনা দিতে লাগলেন যা শুনে কিছুক্ষণ আগে হত্যাকারীদের প্রতি যে সামান্য শ্রদ্ধা-ভক্তি জন্মেছিল জনতার মনে, এবার তা কপূরের মতো উবে গেল। ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস, কাসকা ইত্যাদি যারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল সিজারকে, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল জনতার মনে।

আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে অ্যান্টনি জনতাকে পড়ে শোনালেন সিজারের উইল। সেই উইলে সিজার তার নিজস্ব বাগান ও অন্যান্য সম্পত্তির কথা ছিল। সেই বাগানে মানুষ আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারবে। তাছাড়া রোমের সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে তিনি তাদের প্রত্যেককে নগদ পচাত্তর লিরা করে নগদ অর্থ দান করে গেছেন। উইলটা জনতাকে পড়ে শোনাবার পর অ্যান্টনি বললেন, এমনই মহান মানুষ ছিলেন সিজার। এবার আপনারাই বিচার করে বলুন তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন কিনা।

এবার সীমাহীন ক্ৰোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল জনতা। তারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল, ওরে বিশ্বাসঘাতক শয়তানের দল! তোদের কাউকে রেহাই দেব না। আমরা। পুড়িয়ে দেব ব্রুটাসের বাড়ি। সিজার হত্যার প্রতিশোধ নেব আমরা। হত্যাকারীদের বধ করে, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ছাই করে দেবার সংকল্প নিয়ে দল বেঁধে এগুতে লাগল। জনতা ব্রিটাস আর ক্যাসিয়াস যখন জানতে পারলেন তাদের ধরতে আসছে, তখন তারা যে যার বাড়ি-ঘর ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে বহুদূরে পালিয়ে গেলেন। তাদের যে সব সহযোগী সিজার হত্যার সাথে জড়িত ছিল, জনতা তাদের খুঁজে বের করে বিনাবিচারে মেরে ফেলল, পুড়িয়ে ছাই করে দিল তাদের ঘর-বাড়ি। এবার ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস বুঝতে পারলেন দেশে ফিরে গেলে জনতার হাতে মৃত্যু হবে তাদের। আর যদিও বা জনতার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যায়, তাহলেও মার্ক অ্যান্টনির হাত থেকে রক্ষা নেই তাদের। অ্যান্টনির হাত থেকে বাঁচতে হলে লড়াইয়ের প্রয়োজন। তাই তারা প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করে লড়াইয়ের জন্য অস্ত্ৰ-শস্ত্র এবং সৈন্যর জোগাড় করতে লাগলেন। এরইমধ্যে রোমে এসে পৌঁছালেন সিজারের ভাইপো অক্টেভিয়াস। তিনি বয়সে অ্যান্টনির চেয়ে ছোটো হলেও ভালো যোদ্ধা এবং যথেষ্ট রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন লোক। তাছাড়া রোমের এক শাসক মার্কাস এমিল লেপিডাসকেও বন্ধু হিসেবে পেলেন তিনি। তারা উভয়ে যোগ দিলেন অ্যান্টনির সাথে। অ্যান্টনি অক্টেভিয়াসকে জানালেন যে যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। এবার তারাও তৈরি হতে লাগলেন শত্রুর সাথে মোকাবিলার জন্য।

সিজারকে হত্যার প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে তার সেনাবাহিনীর কয়েকজন অভিজ্ঞ সেনানীও যোগ দিলেন মার্ক অ্যান্টনির সাথে। সামান্য কয়েকদিন বাদেই যুদ্ধ বেধে গেল দু-পক্ষের মধ্যে। যুদ্ধ চলাকালীন ব্রুটাসের পত্নী সোফিয়া আত্মহত্যা করলেন বিষ খেয়ে। পত্নীর শোকে মুহ্যমান হয়ে গেলেন ব্রুটাস। ইতিমধ্যে বিবেকের দংশনে অস্থির হয়ে গেছেন তিনি। ক্যাসিয়াসের বুদ্ধিতে সিজার হত্যার চক্রান্তে যোগ দিয়ে তিনি যে মোটেই ভালো কাজ করেননি, সে কথা এতদিনে উপলব্ধি হল তার। যুদ্ধ চলাকালীন মাঝে মাঝেই তার সাথে ঝগড়া ও কথা-কাটাকাটি হতে লাগল ক্যাসিয়াসের। কিন্তু অন্যায়ের সাহায্য নিতে রাজি নন। ব্রুটাস। অথচ অর্থ এবং সৈন্য সংগ্রহের জন্য যে কোনও নীচ কাজ করতে সবসময় তৈরি ক্যাসিয়াস। একদিন তাদের বিবাদ চরমে উঠে গেল। বুদ্ধিমান ক্যাসিয়াস নিজেকে সামলে নিলেন, নইলে হয়ত সেদিন উভয়ের মাঝে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেত। সেদিন রাতে তাঁবুর ভেতর ব্রুটাসের সামনে আবির্ভূত হলেন জুলিয়াস সিজারের প্ৰেতাত্মা। যাবার আগে সেই প্ৰেতাত্মা বলে গেলেন, আবার দেখা হবে ফিলিগির যুদ্ধক্ষেত্রে।

 

সিজারের প্ৰেতাত্মা দেখা দিলেও ফিলিগির যুদ্ধে শত্রুসৈনের হাতে পরাস্ত হলেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। ধরা পড়লে অ্যান্টনি তাদের প্রাণদণ্ড দেবেন। তাই ধরা পড়ার আগেই প্রাণদণ্ডের বিকল্প হিসাবে সম্মানজনক মৃত্যুর আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলেন তারা। যে ছুরি একদিন সিজারের বুকে বসিয়েছিলেন ক্যাসিয়াস, সেই ছুরি বিশ্বস্ত ভূত্য জিন্ডারাসের হাতে দিয়ে তাকে আদেশ দিলেন সে যেন ছুরিটা তার বুকে বসিয়ে দেয়। চোখের জল ফেলতে ফেলতে প্রভুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল জিন্ডারাস। এবার ব্রুটাসও তার তলোয়ার ভৃত্য স্ট্র্যাটোর হাতে গুজে দিয়ে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন সে তলোয়ারের উপর। গোটা তলোয়ারটাই ঢুকে গোল তার হৃৎপিণ্ডে।

সিজারের আত্মার শান্তি হোক — শুধু এইটুকু বলে রক্তাক্ত দেহে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ব্রুটাস।

ইশারায় ব্রুটাসের মৃতদেহকে দেখিয়ে যুবক অক্টেভিয়াসকে বললেন অ্যান্টনি, সবদিক দিয়েই উনি ছিলেন একজন খাঁটি রোমান। সিজার হত্যার চক্রান্তকারীদের একজন হলেও তিনি একজন মহান লোক —প্ৰয়াত সিজারের বিশিষ্ট বন্ধুদের অন্যতম। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে অন্যান্য সব চক্রান্তকারীরা হত্যা করেছে সিজারকে। একমাত্র উনিই দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা ভেবে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সাথে।

টাইটাস অ্যাড্রোনিকাস

রোম সম্রাটের মৃত্যুর পর সিংহাসনের অধিকারী কে হবে তাই নিয়ে বিবাদ বেধেছে সম্রাটের দুই ছেলের মধ্যে। বড়ো ছেলে স্যাটার্নিনাস বললেন, আমি সম্রাটের বড়ো ছেলে সেহেতু সিংহাসনে বসার অধিকার একমাত্র আমারই!

সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বলে উঠল। ছোটো ছেলে বাসিয়ানাস, হে রোমের জনগণ! আমি যদি কখনও আপনাদের প্রিয় হয়ে থাকি, তাহলে আপনারা আমার সিংহাসনে বসার পথকে সুগম করুন। কিন্তু তাদের কারও দাবি মেনে নিলেন না। রাজপ্রতিনিধি মার্কাস অ্যাভেড়ানিকাস। রোমের পরবতী সম্রাট হিসেবে তিনি ঘোষণা করলেন বীর যোদ্ধা টাইটাস অ্যান্ডোনিকাসের নাম। তার অভিমতকে সমর্থন করলেন সেনেটের সদস্যরা। ঘোষণা শেষ হবার কিছুক্ষণ বাদেই গথ বাহিনীকে যুদ্ধে পরাস্ত করে রোমে ফিরে এলেন টাইটাস অ্যান্ডোনিকাস। তার পেছু পেছু দুজন সৈনিক বহন করে নিয়ে এল একখানা কফিন। এরপর যুদ্ধে পরাজিত গথদের রানি ট্যামোরা ও তার তিন ছেলে অ্যালার্বাস, চিরন এবং ডিমেট্রিয়াসকে বন্দি অবস্থায় নিয়ে এলেন সৈনিকেরা।

ইশারায় কফিনটিকে দেখিয়ে টাইটাস বললেন, এই কদিনের মধ্যে রয়েছে আমার দ্বাবিংশ সন্তানের মৃতদেহ। মৃত আত্মার শান্তি কামনায় এবার টাইটাসের বড়ো ছেলে সুসিয়াস আগুনে আহুতি দিলেন গথদের রানির বড়ো ছেলে অ্যালার্বাসকে।

সেনেটরদের উদ্দেশ করে টাইটাস বললেন, মাননীয় সেনেটরগণ, আমি একজন সামান্য সৈনিক। আমি দেশবাসীর সেবা করে বাকি জীবনটা কাটাতে চাই। সম্রাটের বড়ো ছেলেরই সিংহাসনে বসা উচিত, এটাই আমার অভিমত।

বেশ! আপার অভিমত অনুযায়ীই কাজ হবে, বলে সেনেটরদের উদ্দেশ করে মার্কাস অ্যান্ডোনিকাস বললেন, তাহলে রোমের সিংহাসনে স্যাটার্নিনাসই বসুক।

বেজায় খুশি হয়ে স্যাটার্নিনাস বললেন টাইটাসকে, আপনি সত্যিই একজন খাঁটি দেশসেবক। আমি চাই আপনার মেয়ে ল্যাভিনিয়াকে স্ত্রীরূপে গ্ৰহণ করতে। সে হবে রোম সম্রাজ্ঞী।

প্রতিবাদ করা ছোটো রাজকুমার ব্যাসিয়ানাস বললেন, তা কী করে হবে। ল্যাভিনিয়া আমার বাগদত্তা। আমি ছাড়া ওর ওপর আর কারও অধিকার নেই, বলে ল্যাভিনিয়ার হাত ধরে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।

টাইটাস বললেন, ব্যাসিয়ানাসের এরূপ আচরণ রীতিমতো রাজদ্রোহিতা! আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দেব না, বলে ব্যাসিনিয়াসের পেছু নিতে যাবেন, এমন সময় তার ছোটো ছেলে মিউটিয়াস তাকে বাধা দিয়ে বলল, ল্যাভিনিয়া ব্যাসিনিয়াসের বাগদত্ত। তাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ব্যাসিনিয়াস উচিত কাজই করেছে। ছেলের কাছে বাধা পেয়ে রাগে অগ্নিশৰ্মা হয়ে উঠলেন টাইটাস। তলোয়ারের এক কোপে তিনি মেরে ফেললেন মিউটিয়াসকে।

একী করলেন আপনি? বলে উঠলেন মার্কাস অ্যান্ডোনিকাস, ব্যাসিনিয়াসের জন্য আপনি নিজের ছেলেকে মেরে ফেললেন? আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

এবার সেনেটদের উদ্দেশ করে সম্রাট স্যাটানিনাস বললেন, এত সব কাণ্ডের পর আমার আর দরকার নেই ল্যাভিনিয়াকে। তার চেয়ে আমি বরং গথ রানি ট্যামোরাকে বিয়ে করে রোমের সম্রাজ্ঞীর আসনে বসাব। তারপর ঘাড় ধরে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবী টাইটাস আর তার ছেলেদের। রোমের সাম্রাজ্ঞী হবার আনন্দে রানি ট্যামোরা নিমেষের মধ্যে ভুলে গেলেন তার পুত্ৰশোক। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি স্যাটার্নিনাসকে বললেন, তিনি যেন ব্যাসিয়ানাসকে মার্জনা করেন। এবার ট্যামোরা ও তার নিজ পারিষদদের নিয়ে জঙ্গলে শিকার করতে গেলেন স্যাটানিনাস। সম্রাটের ক্ষমা পেয়ে ল্যাভিনিয়ার সাথে ব্যাসিয়ানাসও গেলেন তাদের সাথে। অ্যারন নামে এক মুর প্রেমিক ছিল ট্যামোরার। সেও তার সাথে বন্দি হয়ে এসেছে রোমে। সে দেখল যে ভাবে ট্যামোরার বড়ো ছেলে অ্যালারব্বাসকে পুড়িয়ে মেরেছে টাইটাস, তার প্রতিশোধ নেবার সুযোগ এটাই। ট্যামোরাকে সে কথা বলে প্ৰতিশোধ নেবার চক্রান্ত করল অ্যারন।

এদিকে গভীর জঙ্গলের মাঝে এক নির্জন জায়গায় অ্যারনের সাথে ট্যামোরাকে আলোচনারত দেখে কৌতূহলী হয়ে ল্যাভিনিয়ার সাথে এগিয়ে গেলেন ব্যাসিয়ানাস। তিনি ট্যামোরাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন একজন সাধারণ পাশ্বচারের সাথে এভাবে গোপনে কথা বলা সম্রাজ্ঞীর পক্ষে অমর্যাদাকর। ল্যাভিনিয়াও সে কথায় সায় দিল। তাদের দেখে অ্যারন ইশারা করলেন ট্যামোরাকে। তাদের দুজনকে দেখিয়ে, ট্যামোরা তার ছেলেদের বললেন, দ্যাখ! এরা আমায় ভুলিয়ে-ভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে, আর আমি গাথ বলে যা-তা গালাগালি করছে। এখন বলছে ওরা আমার হাত-পা বেঁধে রেখে এই জঙ্গলে ফেলে রাখবে যাতে জন্তু-জানোয়ার আমায় খেয়ে নিতে পারে।

ট্যামোরার কথা শুনে খেপে গেল তার ছেলেরা। তারা ব্যাসিনিয়াকে হত্যা করে একটা গর্তের ভেতর ফেলে রেখে দিল। তারপর টানতে টানতে ল্যাভিনিয়াকে নিয়ে গেল সেখান থেকে।

জঙ্গলের মাঝে টাইটাসের দুই ছেলে কুইনটাস আর আর্টিয়াসকে দেখতে পেয়ে বদ মতলব চাপল অ্যারনের মাথায়। চিতাবাঘ শিকারের লোভ দেখিয়ে সে তাদের নিয়ে গেল সেই গর্তের ধারে, যেখানে পড়েছিল ব্যাসানিয়াসের মৃতদেহ। ঝুকে দেখতে গিয়ে পা হড়কে গর্তের ভিতর পড়ে গেল আর্টিয়াস। তখন পা টিপে টিপে সেখান থেকে সরে পড়ল অ্যারন। সে ডেকে নিয়ে সম্রাট স্যাটানিনাসকে। ইতিমধ্যে সম্রাজ্ঞী ট্যামোরাও হাজির হয়েছেন সেখানে। গর্তের ভেতর থেকে আর্টিয়াসকে টেনে তোলার পর সম্রাট জানতে পারলেন তার ভাইয়ের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে। গর্তের ভিতর।

ইশারায় কুইনটাস আর আর্টিয়াসকে দেখিয়ে ট্যামোরা বললেন, এ নিশ্চয়ই ওই দুজনের কাজ। সেই সাথে তিনি একটা চিঠি তুলে দিলেন সম্রাটের হাতে। চিঠিটা খুলে সম্রাট দেখলেন তাতে লেখা রয়েছে ব্যাসিনিয়াসকে মেরে বনের যে কোনও একটা জায়গায় ফেলে দেবে।

চিঠিটা টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাস লিখেছেন তার এই দুই ছেলেকে—বললেন ট্যামোরা, আমি কায়দা করে চিঠিটা ওদের কাছ থেকে হাতিয়েছি। সম্রাটের আদেশে এবার রক্ষীরা বেঁধে রাখল কুইনটাস আর আর্টিয়াসকে। এরপর বনের মাঝে খোঁজাখুঁজি করে তারা ল্যাভিনিয়াকে দেখতে পেল হাত-পা বাধা, জিব কাটা অবস্থায়। আহত ল্যাভিনিয়াকে তার প্রাসাদে পৌঁছে দিলেন রাজ–প্রতিনিধি টাইটাস অ্যান্ডোনিকাস। আহত মেয়েকে এহেন অবস্থায় দেখে শিশুর মতো অঝোরে কান্দতে লাগলেন বীর যোদ্ধা অ্যাড্রোনিকাস।

ব্যাসানিয়াসকে হত্যার অপরাধে সম্রাট প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করলেন কুইনটাস আর আর্টিয়াসকে। নিজের অসহায় অবস্থার কথা বলে ছেলেদের প্রাণভিক্ষা চাইলেন টাইটাস। কিন্তু তার কথায় কান দিলেন না সম্রাট। কিছুক্ষণ বাদে অ্যারন এসে বললেন টাইটাসকে, সম্রাট বলেছেন আপনি যদি আপনার একখানা হাত কেটে সম্রাটকে দিতে পারেন তাহলে তিনি আপনার ছেলেদের প্রাণদণ্ড রুদ করে দেবেন। অ্যারিনের কথায় বিশ্বাস করে টাইটাস তার একটি হাত কেটে অ্যারনের হাতে দিয়ে দিলেন। অ্যারন সেটি নিয়ে রওনা দিলেন রাজপ্রাসাদ অভিমুখে। কিছুক্ষণ বাদে একটি থালায় সাজান কুইনটাস আর আটিয়াসের কাটামুণ্ড নিয়ে একজন জল্লাদ এল টাইটাসের সামনে। তিনি দেখলেন তার কাটা হাতটিও সাজান রয়েছে ছেলেদের কাটামুগুর পাশাপাশি। জল্লাদ বলল টাইটাসকে, এগুলো আপনাকে উপহার স্বরূপ পাঠিয়েছেন সম্রাট।

সম্রাটের কাণ্ড দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। বড়ো ছেলে লুসিয়াসকে ডেকে তিনি বললেন, দ্যাখ! হাতে আর মোটেও সময় নেই। প্ৰাণে বাঁচতে চাও তো এইবেলা রোম ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে গথিদের দেশে আশ্রয় নাও। সেখান থেকে সৈন্য নিয়ে রোম আক্রমণ করে এর প্রতিশোধ নেবে। পিতার নির্দেশে তখনই ঘোড়ায় চড়ে রোম ছেড়ে পালিয়ে গেলেন লুসিয়াস। যাবার আগে তিনি নিজের ছেলেকে বাবার কাছে রেখে গেলেন।

দু-হাত আর জিভ কটা, কথা বলার ক্ষমতাও নেই ল্যাভিনিয়ার। টাইটাসের কথা মতো সে দাঁতে কাঠি কামড়ে ধরে ভেজা মাটির উপর লিখল—সম্রাজ্ঞী ট্যামোরার নির্দেশে তার দুই ছেলে চিরন আর ডিমিট্রিয়াস কেটে নিয়েছে তার দুহাত আর জিভ। এমন কি সম্রাজ্ঞীর প্ররোচনায় বনের মাঝে খুন হয়েছেন তার স্বামী ব্যাসিয়ানাস।

সম্রাট স্যাটানিনাস আর সম্রাজ্ঞী ট্যামোরা উভয়েই বেজায় ভয় পেয়ে গেলেন যখন তারা গুপ্তচরের মুখে শুনলেন বিশাল গথ সেনাবাহিনী নিয়ে রোম আক্রমণ করতে আসছেন টাইটাসের ছেলে লুসিয়াস। এদিকে টাইটাসের পেট থেকে লুসিয়াসের কথা বের করতে ট্যামোরা তার দুই ছেলে চিরন আর ডিমিট্রিয়াসকে মন্ত্রী সাজিয়ে টাইটাসের কাছে নিয়ে এলেন। টাইটাসকে আশ্বাস

ঐ দু-জনকে তার কাছে রেখে যান। সেই সাথে তাকে আমন্ত্রণ জানালেন তিনি যেন সম্রাটকে সাথে নিয়ে নৈশভোজে তার প্রাসাদে আসেন।

দুই ছেলেকে টাইটাসের ভরসায় রেখে দিয়ে রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলেন ট্যামোরা। এরপর টাইটাসের প্রাসাদে এলেন রাজপ্রতিনিধি মার্কাস অ্যান্ডোনিকাস। ছেলে দুটিকে দেখেই তিনি তাদের শনাক্ত করলেন ট্যামোরার ছেলে চিরন আর ডিমিট্রিয়াস বলে। রাজপ্রতিনিধির কথা শুনে খুব খুশি হলেন টাইটাস। তিনি তখনই ল্যাভিনিয়াকে ডেকে এনে তাদের চোখের সামনে নিষ্ঠুরভাবে–ছুরি দিয়ে হত্যা করলেন ট্যামোরার ছেলে দু-টিকে। তারপর নিজেই রান্না করলেন ছেলে দুটির মাংস। নৈশভোজে সম্রাট স্যাটানিনাস আর সম্রাজক্ট ট্যামোরা এসে পৌঁছাবার পর তিনি তাদের সেই মাংস খাওয়ালেন। এবার তাদের সবার সামনে টাইটাস নিজ হাতে হত্যা করলেন মেয়ে ল্যাভিনিয়াকে। ট্যামোরা বাধা দিতে এলে তিনি তাকেও খুন করলেন। পরমুহূর্তে টাইটাস অ্যান্ড্রোনিকাসকে হত্যা করলেন সম্রাট স্যাটার্নিনাস। তখন ভোজসভায় রক্তের ছড়াছড়ি। যে যেদিকে পারে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এ সব কাণ্ডের মাঝেই বিশাল বাহিনী নিয়ে হাজির হলেন টাইটাসের বড়ো ছেলে লুসিয়াস। কোমরে আঁটা খাপ থেকে তলোয়ার খুলে তিনি আমূল বসিয়ে দিলেন সম্রাটের বুকে।

এরপর জনগণের ইচ্ছানুসারে রোমের সিংহাসনে বসলেন লুসিয়াস।

ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা

ট্রয় শহরের রাজপ্রাসাদের বাইরে পথের ধারে দাঁড়িয়ে রাজপুত্র ট্রয়লােস কথা বলছেন ক্রেসিডার কাকা প্যান্ডারাসের সাথে। ক্রেসিডার বাবা কালচাসট্রিয়ের পুরোহিত। তিনি এখন গ্রিকদের পক্ষে। তারই মেয়ে সুন্দরী ক্রেসিডার প্রেমে হাবুডুবু রাজপুত্র ট্রয়লাস।

এখন খুবই দুঃসময় চলছে ট্রয়ের। এখনকার রাজা প্রায়ামের পাঁচটি ছেলে, তাদের নাম হেক্টর, ট্রয়লাস, প্যারিস ডিফোবাস আর হেলেনাস। এছাড়াও রাজার এক অবৈধ পুত্রসস্তান আছে — নাম মারগারেলন। সে প্রায় ছবছর আগের কথা। রাজার সেজ ছেলে প্যারিস সে সময় প্রেমে পড়েছিলেন গ্রিক সেনাপতি আগামেমননের ভাই মিনিলাসের সুন্দরী স্ত্রী হেলেনের সাথে। স্বামীর কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে এনে সোজা তাকে রাজপ্রাসাদে এনে তুলেছিলেন প্যারিস। সেই থেকেই হেলেন রয়েছে প্যারিসের সাথে। এর পরপরই গ্রিসের রাজারা সবাই একজোট হয়ে ট্রয় আক্রমণ করেছেন। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হেলেনাকে উদ্ধার করে তাকে গ্রিসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। জলে, স্থলে চারদিক দিয়ে তারা বারবার আঘাত হানছে ট্রয়ের উপর।

বীর যোদ্ধা হিসেবে রাজপুত্র ট্রয়লাসের যথেষ্ট খ্যাতি সত্ত্বেও যতই দিন যাচ্ছে শত্রুসৈন্যের মোকাবিলা করার উৎসাহ কেন জানি তিনি হারিয়ে ফেলছেন। ট্রয়লাসের মনোভাব অনুমান করে

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রয়লাস বললেন, না, মন থেকে যেন সাড়া পাচ্ছি না।

বল কী! তোমার মতো বীরের মুখে তো এ কথা মানায় না, বললেন প্যান্ডারাস।

ট্রয়লাস বললেন, যুদ্ধ করা তারই পক্ষে সম্ভব হৃদয়-মন যার আয়ত্তে থাকে। আজ আর আমার মন নিজের আয়ত্তে নেই। যতক্ষণ রাজসভায় থাকি, সুন্দরী ক্রেসিডা আমার সারা মন জুড়ে থাকে। তখন আর নিজের মনের উপর অধিকার থাকে না।

প্যান্ডারাস বললেন, ক্রেসিডার কাকা হিসেবেই আমি বলছি, সে যতই সুন্দরী হোক না কেন, হেলেনের সাথে তার কোনও তুলনা হয় না। আমি ভেবে পাচ্ছি না কেন যে ক্রেসিডা তার বাবার সাথে গ্রিক শিবিরে যায়নি। তার উচিত ছিল সেখানে যাওয়া। ভবিষ্যতে তার সাথে দেখা হলে আমি তাকে সে কথা বলব। এই বলে অন্যদিকে চলে গেলেন প্যান্ডারাস। আর ক্রেসিডার কথা ভাবতে ভাবতে ট্রয়লাসও হাঁটা দিলেন রাজপ্রাসাদ অভিমুখে।

প্রাসাদের লাগোয়া পথ ধরে হেঁটে চলেছে ক্রেসিডা। এমন সময় ভৃত্য আলেকজান্দার এসে তাকে বলল, আজ সকালে সূর্য ওঠার আগেই যুবরাজ হেক্টর রওনা দিয়েছেন যুদ্ধ করতে।

অবাক হয়ে ক্রেসিড বললেন, সত্যি?

আলেকজান্দার বলল, আজ্ঞে হ্যা! শুনেছি আজ হেক্টরের মা হেলেনাকে সাথে নিয়ে দুর্গে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখবেন। আজ তুমুল লড়াই হবে গ্রিক বীর অ্যাজাকসের সাথে হেক্টরের। তবে হেক্টর এক লড়াই করবেন না। তার পরের ভাই ট্রয়লাসও থাকবেন তার পাশে। সবাই জানে হেক্টরের চেয়ে যুদ্ধবিদায় কম পারদশী নন ট্রয়লাস।

আমার তো মনে হয় ট্রয়লাস তেমন বীর যোদ্ধা নন, বললেন হেলেন, আমি কিছুতেই রাজি নাইট্রয়লাসকে হেক্টরের চেয়ে বড়ো যোদ্ধা বলে মেনে নিতে।

আপনি মানুন বা না মানুন, এরাই জানে ট্রয়লাসের সমকক্ষ যোদ্ধা ট্রয়ে দ্বিতীয় নেই, বলল আলেকজান্দার, এমনকি যে হেলেনকে রাজপুত্র প্যারিস হরণ করে এনেছেন, সেও বলে হেক্টরের চেয়ে ট্রয়লাস বড়ো যোদ্ধা। আমার তো মনে হয় হেক্টরের চেয়ে ট্রয়লাসকে বেশি পছন্দ করে হেলেন।

অবাক হবার ভান করে ক্রেসিডা বললেন, এমন কথা কেন বলছ তুমি?

গলা নামিয়ে আলেকজান্দার বলল, কারণ কদিন আমি দেখেছি হেলেনকে গোপনে ট্রয়লাসের সাথে দেখা করতে। হেলেন যে ট্রয়লাসকে প্যারিসের চেয়ে বেশি ভালোবাসেন তার আরও প্রমাণ আমার কাছে আছে।

কিছুক্ষণ বাদে ফিরে আসতে লাগলেন ট্রয়ের বীর যোদ্ধারা। প্যান্ডারাসও ছিলেন তাদের মাকে। ক্রেসিডাকে দেখতে পেয়ে তিনি তার কাছে এসে দাঁড়ালেন। একে একে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ট্রয়ের বীর যোদ্ধাদের। তাদের মধ্যে ছিলেন ট্রয়ালাস। ইচ্ছে করেই ক্রেসিডার সামনে ট্রয়লাসের বীরত্বের প্রশংসা করতে লাগলেন প্যান্ডারাস। এমন সময় ট্রয়লাসের তৃত্যু এসে তাকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, আমার প্রভু আপনাকে ডেকেছেন। ক্রেসিডাকে প্রাসাদে যাবার কথা বলে সেই ভূত্যের সাথে চলে গেলেন প্যান্ডারাস।

 

পরপর দু-বছর চলে গেল। তবুট্রয় নগরী ধ্বংস করতে পারলেন না গ্রিকরা। এই না পারার কারণ নিয়ে শিবিরে আলোচনায় বসেছেন গ্রিক সেনাপতিরা। এমন সময় ট্রয়ের সেনাপতি ইনিস এসে হাজির হলেন সেই শিবিরে গ্রিক সেনাপতি আগামেমননকে অভিবাদন জানিয়ে তিনি বললেন,

এত বেশ ভালো কথা, বললেন আগামেমনন, আমাদের শ্রেষ্ঠ বীর অ্যাকিলিস পাশের তাঁবুতে রয়েছেন। চলুন, আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। শিবির থেকে আগামেমননের সাথে ইনিস চলে যাবার পর ইউলিসিস বললেন, অ্যাকিলিস যদি হেক্টরের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে জেতে, তাহলে সে উদ্ধত এবং অহংকারী হয়ে উঠবে। আবার তিনি হেরে গেলে ভেঙে যাবে গ্রিক বাহিনীর মনোেবল। তার চেয়ে হাতের কাছে অ্যাজাক্স রয়েছে, ওকেই পাঠিয়ে দেওয়া যাক হেক্টরের সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে। অ্যাজাক্স জিতলে আমরা তার নামে জয়ধ্বনি দেব। আর পরাজিত হলে বলব ওর চেয়েও বড়ো বীর আছেন গ্রিক বাহিনীতে।

ওই একই সময় ট্রয়ের রাজপ্রাসাদে বসে যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে ছেলেদের সাথে আলোচনারত রাজা প্রায়াম। কথায় কথায় তিনি বললেন, আমি নিশ্চিত পুনরায় হেলেনকে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব আসবে গ্রিক শিবির থেকে। ওকে ছেড়ে দিলেই গ্রিকরা যুদ্ধ থামিয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে ফিরে যাবে তাদের দেশে। রাজা হেক্টরের কাচজে জানতে চাইলেন, হেলেনকে ছেড়ে দিতে তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?

না পিতা, কোনও আপত্তি নেই, বললেন হেক্টর, যার জন্য হাজার হাজার ট্রয়বাসীর প্রাণ গেছে, আজ তার কোনও দাম মেই আমার কাছে। আমি চাই যত শীঘ্র সম্ভব হেলেনকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক গ্রিকদের হাতে।

তুমি ভুলে যাচ্ছ হেক্টর, আমাদের বংশের এক বয়স্ক মহিলাকে গ্রিকরা তাদের দেশে আটলো, রেখেছে, সম্পর্কে যিনি আমার পিসি হন, বললেন রাজা। প্রতিবাদের সুরে ট্রয়লাস বললেন, গ্রিকদের সেই কাজের প্রতিশোধ নিতে প্যারিস যখন গ্রিস থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এল হেলেনকে, তখন সবাই তাকে বাহবা দিয়েছিল। আজাকি তাহলে ধরে নেব হেলেনকে আটকে রাখার যোগ্যতা আমাদের নেই?

রাজা প্রায়ামের মুখের দিকে তাকিয়ে রাজপুত্র প্যারিস বললেন, সেদিন কিন্তু সবাই আমার কাজকে সমর্থন করেছিলেন। আমি তো নিজের ভোগ-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য হেলেনকে নিয়ে আসিনি, তাকে আমাদের দেশে রেখে দেওয়াটা ট্রয় জাতির পক্ষে এক গৌরবের বিষয়। দুনিয়ার সবচেয়ে রূপসি নারী হেলেনকে ট্রয় রেখে দেবার জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাব।

ট্রয়লাস বললেন, হেলেনের সাথে জড়িয়ে আছে ট্রয়ের মান, মর্যাদা, খ্যাতি। পৃথিবীর সব সম্পদের বিনিময়েও আমরা হেলেনকে গ্রিকদের হাতে প্ৰত্যুপণ করতে রাজি নই।

 

এক সন্ধ্যায় প্যান্ডারাস তার বাগানবাড়িতে নিয়ে এলেন ট্রয়লাসকে, উদ্দেশ্য ভাইঝি ক্রেসিডার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাগানবাড়ির এক উইলো গাছের নিচে ক্রেসিডাকে জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এলেন ট্রয়লাস। পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে গাঢ় চুম্বন রেখা একে দিলেন ক্রেসিডার নরম গালে, কপালে। খাওয়া-দাওয়ার পর প্যান্ডারাস তাদের শোবার আয়োজন করলেন এক সুসজ্জিত ঘরের নরম বিছানায়।

এদিকে গ্রিক বাহিনীর হাতে বন্দি হয়েছেন ট্রয়ের বীর যোদ্ধা অ্যান্টিনার। তার মুক্তির বিনিময়ে ট্রয়ের পুরোহিত ক্যালচাস প্রস্তাব দিলেন তার মেয়ে ক্রেসিডাকে যেন তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার এ প্রস্তাব মেনে নিলেন গ্রিক সেনাপতি আগামেমনন। অথচ ট্রয়লাস ও ক্রেসিডা এ ব্যাপারে বিন্দু-বিসর্গও জানতে পারলেন না।

জ্যোৎস্নালোকে উদ্ভাসিত ক্রেসিডার মুখের দিকে তাকিয়ে ট্রয়লাস বললেন, তোমার প্রতি চিরবিশ্বস্ত থেকে প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হব আমি। প্রেমের বিশ্বস্ততার নামই হবে ট্রয়লাস।

এদিকে হেক্টরের ডাকে সাড়া দিয়ে তার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নেমেছেন গ্রিক বীর অ্যাজাক্স। অ্যাজাক্স তার নিকট আত্মীয় জেনে কিছুক্ষণ বাদেই লড়াই থামিয়ে দিলেন হেক্টর।

অন্যদিকে ক্রেসিডাকে গ্রিক শিবিরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রয়ের সেনাপতি ইনিস প্যান্ডারাসের বাগানবাড়িতে এলেন গ্রিক বীর ডায়োমিডিসকে সাথে নিয়ে। কাকার মুখে সব কথা শুনে ক্রেসিডা কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিল ট্রয়লাসের কাছ থেকে। ক্রেসিডাকে হাতে পেয়ে ট্রয়ের বন্দি বীর সেনানায়ক অ্যান্টিনারকে মুক্তি দিল গ্রিক বাহিনী।

পরদিন শেষ বেলায় নিরস্ত হেক্টরকে হত্যা করলেন গ্রিক বীর অ্যাকিলিস। সেনাদের মনোেবল বাড়াতে পরম শত্রু হেক্টরের রক্তাক্ত মৃতদেহ রথের সাথে বেঁধে নিয়ে গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে ঘোরালেন অ্যাকিলিস।

সেদিন রাতে ক্রেসিডার সাথে গোপনে দেখা করতে এলেন ট্রয়লাস। আড়াল থেকে ডায়োমিডিসের সাথে ক্রেসিডার প্রেমালাপ শুনে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল তার মাথায়। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, পরদিন যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করবেন ডায়োমিডিসকে।

ম্যাকবেথ

০১.

প্রচণ্ড যুদ্ধের পর বিদ্রোহীদের পরাস্ত করে ঘোড়ায় চেপে ফরেস -এর শিবিরে ফিরে আসছেন। রাজা ডানকানের দুই সেনাপতি ম্যাকবেথ এবং ব্যাংকো।

খুবই শান্তিপ্রিয় এবং প্রজাবৎসল ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাজা ডানকান। রাজার অধীনস্থ সামন্তরা সে সময় রাজার কাছ থেকে থেন খেতাব পেতেন। এই থেনদের মধ্যে সবচেয়ে পরাক্রমশালী ছিলেন ফন্ডর-এর থেন। কিন্তু একদিন তিনিই বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলেন রাজা ডানকানের বিরুদ্ধে। কডর-এর থেন জানতেন যতই শান্তিপ্রিয় হোন না কেন রাজা ডানকান, বিদ্রোহ দমন করতে তিনি সসৈন্য কাঁপিয়ে পড়বেন তার উপর। আর রাজার সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠবেন না তিনি। কারণ রাজার সামন্তদের অধিকাংশই নামি যোদ্ধা। তিনি স্থির করলেন বিদেশি শক্তির সাহায্য নেবেন। স্কটল্যান্ড আক্রমণ করার জন্য তিনি আহ্বান কুরলেন নরওয়ের রাজা সোয়েনো এবং ভাড়াটে আইরিশ যোদ্ধা ম্যাকডোল্যান্ডকে।

সে আমলে নরওয়ের রাজারা ছিল যুদ্ধবাজ। তারা জাহাজে করে অন্যদেশে গিয়ে লুটপাট করত। এ কারণেই পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকেরা তাদের জলদসু্য বলে বর্ণনা করেছেন। কডৱএর থেনের ডাক পাবার সাথে সাথেই জাহাজ বোঝাই সৈন্য নিয়ে স্কটল্যান্ড হাজির হলেন নরওয়ের রাজা সোয়েনো। অপরদিকে ভাড়াটে যোদ্ধা ম্যাকডোনাল্ড তার সৈন্যবাহিনী সহ আয়ারল্যান্ডের দিক দিয়ে স্কটল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ল।

ঐ বিদেশিদের সাথে হাত মিলিয়ে কডর -এর থেন এগিয়ে চলছেন রাজা ডানকানের ফৌজী ঘাঁটিগুলি দখল করতে। বিদ্রোহের খবর আগেই পেয়েছিলেন রাজা ডানকান। বিদেশিদের মদতে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে কডর-এর থেন স্কটল্যান্ড হানা দিয়েছে শুনে তিনি ডেকে পাঠালেন তার সেনাপতি ও সামন্তদের। তার সেনাপতি এবং সামন্তরা — যেমন ম্যাকবেথ, ব্যাংকো, লেনক্স, ও রস, সেন্টিন, অ্যাঙ্গাস, কেইথনেস প্রমুখ সবাই এসে হাজির হলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ম্যাকবেথ যিনি গ্রামিশ-এর থেন এবং সম্পর্কে রাজার জ্ঞাতি ভাই। তাদের উভয়ের শরীরে বইছে একই বংশের রক্তধারা।

রাজা ডানকান আদেশ দিলেন যে কোনও ভাবেই হোক বিদ্রোহ দমন করে হানাদার বিদেশিদের ধ্বংস করে ফেলতে হবে। রাজাদেশে সেনানী ও সামন্তরা সবাই রওনা দিলেন যুদ্ধে। নিজস্ব বাহিনী নিয়ে তাদের আগে আগে চললেন রাজার বড়ো ছেলে ম্যালকম।

কিন্তু ম্যালকম বেকায়দায় গেলেন ভাড়াটে যোদ্ধা ম্যাকডোনাল্ড ও তার সেনাদের সাথে লড়তে গিয়ে। তাকে বন্দি করার জন্যে ম্যাকডোনাল্ডের নির্দেশে তার সৈন্যরা চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলল তাকে। যুদ্ধ করতে করতেই ম্যালকমের উপর নজর রেখেছিলেন ম্যাকবেথ। তাকে বাঁচাতে তিনি তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুদের উপর। শত্রুদের ধ্বংস করে তিনি ফিরিয়ে নিয়ে এলেন বড়ো রাজপুত্রকে। ম্যালকমকে অন্যদের জিম্মায় রেখে পুনরায় শত্রুনিধনে এগিয়ে গেলেন ম্যাকবেথ। বাঁধভাঙা বন্যার মত বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে। ম্যাকডোনাল্ড, কেউ আটকাতে পারছে না। তাকে। এ অবস্থা দেখে সাহসী সেনানী আর একদল নিভীক সৈনিক নিয়ে ম্যাকবেথ সাহসে ভর করে এগিয়ে গেলেন, কাঁপিয়ে পড়লেন শক্রসেনার উপর। ঘোড়ার পিঠে থাকা অবস্থায় তলোয়ার নিয়ে বহুক্ষণ ম্যাকডোনাল্ডের সাথে লড়লেন ম্যাকবেথ। একসময় তারতলোয়ারের আঘাতে ম্যাকডোনান্ডের হাত থেকে খসে পড়ল তলোয়ার। সাথে সাথে ঘোড়া থেকে নেমে এসে ম্যাকবেথ তার তলোয়ার সরাসরি ঢুকিয়ে দিলেন ম্যাকডোনান্ডের হৎপিণ্ডে। শেষে এক কোপে ম্যাকডোনান্ডের শিরস্ত্ৰাণ সহ মাথাটা কেটে নিয়ে একজন সৈনিককে দিয়ে বললেন, যাও, এটা নিয়ে গিয়ে আমাদের দুর্গের মাথায় টাঙিয়ে দাও। তারপর রাজাকে খবর দিও।

মুখোমুখি লড়াইয়ে ম্যাকডোনাল্ডকে মেরে ফেলার পর ম্যাকবেথ তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে এগিয়ে গেলেন নরওয়েরাজ সোয়োনোর সাথে লড়াই করতে। কিন্তু হানাদারবাহিনী মোটেও দাঁড়াতে পারল না। ম্যাকবেথের নিজস্ব বাহিনীর আক্রমণের সামনে ইচ্ছা করলেই তিনি নরওয়ে রাজকে বন্দি বা হত্যা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। জরিমানা স্বরূপ এক জাহাজ বোঝাই টাকা আদায় করে দলবল সহ স্কটল্যান্ড সীমান্ত থেকে তাদের তাড়িয়ে দিলেন।

অমোত্যদের সাথে ফরেস-এর শিবিরে অপেক্ষা করছিলেন রাজা ডানকান। তিনি খুব খুশি হলেন যখন শুনলেন বিদ্রোহ দমন করে হানাদারদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশের সীমানা থেকে। শিবিরে উপস্থিত সবার সামনেই কডর-এর থেনকে প্রাণদণ্ড দিলেন রাজা ডানকান। সেই সাথে ঘোষণা করলেন আজ থেকে ম্যাকবেথই কডর-এর থেন।

 

০২.

যুদ্ধ শেষ হবার পর ঘোড়ায় চেপে ম্যাকবেথ আর ব্যাংকে রওনা দিলেন ফরেসের শিবিরের দিকে। তারা কেউই লক্ষ করেননি যে ঘন কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে সারা আকাশ। অল্প কিছুদূর যাবার পরই প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হল। মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে চারদিক, বাজপড়ার শব্দে কেঁপে উঠছে পায়ের নিচের মাটি। যুদ্ধ জয়ের আনন্দে মগ্ন থাকলেও প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করতে লাগলেন ম্যাকবেথ; যেতে যেতে এমন একটা জায়গায় এসে পড়লেন তারা যার একদিক খোলা অন্য দিক পাহাড়ঘেরা জলা। সেই জলা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে কুয়াশার মতো ঘন ধোঁয়া। সেদিকে তাকিয়ে মানুষের মতো দেখতে তিনটি অদ্ভুত প্রাণীর দেখা পেয়ে ঘোড়া থেকে নেমে এলেন তারা। তাদের গড়ন মেয়েদের মত হলেও প্রত্যেকের মুখেই দাড়ি। তাদের হাড় বের করা শীর্ণ মুখ আর কোটরে বসা চোখ দেখে মনে হয় না। তারা পৃথিবীর প্রাণী। তারা সত্যিই পৃথিবীর প্রাণী নয়— আসলে তারা জলার ডাইনি। দৈববাণী শোনাবার নামে মানুষকে কুবুদ্ধি দিয়ে তার সর্বনাশ করাই এদের উদ্দেশ্য।

আপন মনে ঘুরে ঘুরে নাচছিল ওই তিন ডাইনি— ছড়ার ধরনে হেঁয়ালির মতো অদ্ভুত কথাবার্তা বলছিল তাদের নিজেদের মধ্যে। কথাগুলো এইরকম–

একজন বলল, মন-জলের এই বিজন রাতে,
আবার কবে মিলব মোরা একসাথে?

দ্বিতীয় জন উত্তর দিল –

তাণ্ডবের পালা শেষ হলে
হারা-জেতা মিটে গেলে

এমন সময় দূর থেকে ভেসে এল বিজয়ী ম্যাকবেথ বাহিনীর ভেরী আর দামামার আওয়াজ। সেই শুনে চেঁচিয়ে উঠে বলল তিন ডাইনি—

বাজে এই সেনাদের দামামা,
তুর্য উঠেছে আজ ম্যাকবেথের সূর্য।

দূর থেকে ওই সব কথা বলেও তা স্পষ্ট শুনতে পেলেন ম্যাকবেথ আর ব্যাংকো।

সাহসে ভর করে দূর থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ব্যাংকো, জিজ্ঞেস করলেন, কে তোমরা? মেয়েদের মতো দেখতে হলেও তোমাদের তিনজনের মুখেই রয়েছে দাড়ি। তাই মেয়েমানুষ বলে মেনে নিতে পারছি না তোমাদের। এবার ব্যাংকের পেছন থেকে ম্যাকবেথও এসে দাঁড়ালেন তাদের সামনে, জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা যদি কথা বলতে পোর, তাহলে নিজেদের পরিচয় দাও।

প্রথম ডাইনি বলল, গ্রামিশ-এর থেন ম্যাকবেথ, তুমি আমাদের অভিনন্দন গ্ৰহণ কর।

দ্বিতীয় ডাইনি বলল, হে কডর-এর থেন ম্যাকবেথ, তুমি আমাদের অভিনন্দন গ্ৰহণ কর।

এবার বলল তৃতীয় ডাইনি, হে স্কটল্যান্ডের ভাবী রাজা ম্যাকবেথ,আমাদের অভিনন্দন গ্রহণ কর তুমি।

ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে ধাঁধার মাঝে পড়ে গেলেন ম্যাকবেথ। তিনি অবশ্যই গ্লামিশ-এর থেন, কিন্তু কডর -এর যেন বেঁচে থাকতে কীভাবে তার খেতাবটা পাবেন তিনি? ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারলেন না। ওদিকে, আবার তৃতীয় ডাইনি তাকে স্কটল্যান্ডের ভাবী রাজা বলে অভিনন্দন জানিয়েছে। তিনি কিছুতেই ভেবে পেলেন রাজা ও তার দুই ছেলে বেঁচে থাকতে কী করে তা সম্ভব।

এগিয়ে এসে ব্যাংকে বললেন, আমার বন্ধুর সম্পর্কে অনেক কিছুই তো বললে তোমরা। এবার আমার ব্যাপারে। যদি কিছু বলার থাকে তো বলে ফেল! তোমরা যেই হও না কেন, মনে রেখা আমি তোমাদের ভয় করি না। আর তোমাদের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর নির্ভরশীলও নই আমি। তোমাদের করুণা বা ঘৃণা, কিছুই চাই না আমি।

প্রথম ডাইনি বলল, স্বাগত ব্যাংকো। বয়সে ম্যাকবেথের চেয়ে ছোটো হলেও অন্যদিক দিয়ে তুমি তার চেয়ে বড়ো।

এবার দ্বিতীয় ডাইনি বলল, ব্যাংকে, তোমায় স্বাগত। ম্যাকবেথের মতো সুখী না হলেও অন্যদিক দিয়ে তুমি তার চেয়ে বেশি সুখী।

শেষে মুখ খুলল তৃতীয় ডাইনি, ব্যাংকো! তুমি সিংহাসনে বসবে না ঠিকই, কিন্তু তোমার বংশের অনেকেই রাজা হবে। আমি তোমাদের দু-জনকেই স্বাগত জানাই।

জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, দাঁড়াও তুমি! কডর-এর থেন বেঁচে থাকতে কীভাবে তার খেতাব পাব আমি? তাছাড়া তোমরা বলেছ। আমি স্কটল্যান্ডের ভাবী রাজা। তা কী করে সম্ভব? কেন শোনালে আমাদের এ সব ভবিষ্যদ্বাণী?

তাদের প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে নিমেষের মধ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলব তিন ডাইনি।

ম্যাকবেথের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল ব্যাংকো, দেখেছ, কেমন অদ্ভুত ভাবে ওরা মিলিয়ে গেল আমাদের সামনে থেকে?

ওরা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে ব্যাংকো, জবাব দিলেন ম্যাকবেথ। তবে আরও খানিকক্ষণ ওরা থাকলে ভালো হত। হয়ত ওদের মুখ থেকে ভালো ভালো কথা শোনা যেত।

সত্যিই কি ওরা এখানে ছিল? ম্যাকবেথকে জিজ্ঞেস করলেন ব্যাংকো, নাকি কোনও মাদকদ্রব্য খেয়ে আমাদের বোধ-বুদ্ধি সব লোপ পেয়ে গিয়েছিল?

ম্যাকবেথ জবাব দিলেন, ওরা তো বলল তোমার বংশেরও কেউ কেউ রাজা হবে।

ওরা এও বলেছে তুমি নিজেই রাজা হবে, বললেন ব্যাংকো।

একই সঙ্গে ওরা বলল আমি নাকি কডর-এর থেন হবে— বললেন ম্যাকবেথ, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। কীভাবে তা সম্ভব হবে।

ম্যাকবেথের কথা শেষ হতে না হতেই ঘোড়ায় চেপে সেখানে এসে হাজির রাজা ডানকানের দুই অমাত্য। ঘোড়া থেকে না নেমেই তারা ম্যাকবেথকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, বিদ্রোহ দমনে আপনার ভূমিকায় মহারাজ খুব খুশি হয়েছেন। আপনার এই অসাধারণ কৃতিত্বের পুরস্কার স্বরূপ মহারাজ। আপনাকে কডর-এর থেন খেতাবে ভূষিত করেছেন। আমরা এসেছি আপনাকে রাজসভায় নিয়ে যাবার জন্য।

আশ্চর্য হয়ে ব্যাংকো বললেন, কন্ডরের থেন? দেখছি ওই অদ্ভুত প্রাণীগুলোর কথাই তাহলে সত্যি হল।

রাজার দুই অমাত্যকে বললেন ম্যাকবেথ, কডর-এর থেন তো এখনও জীবিত। তাহলে তার জীবদ্দশায় সে খেতাব আমি পাব। কী করে?

সে কথা। আপনি ঠিকই বলেছেন সেনাপতি ম্যাকবেথ, উত্তর দিলেন রাজার অমাত্যদ্বয়, তবে মনে রাখবেন যে বিদ্রোহ। আপনি দমন করেছে তা ঘোষণা করেছিলেন কডর-এর থেন নিজেই। যুদ্ধে হেরে গিয়ে তিনি তার দোষ স্বীকার করেছেন। রাজা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে প্রাণদণ্ড দিয়েছেন।

কথা শুনে নিজের মনে বললেন ম্যাকবেথ, তাহলে আমি একই সাথে গ্লমিশ আর কডর -এর থেন! তবে এর চেয়ে বড়ো পুরস্কার পাওয়া এখনও বাকি। এরপর অমাত্যদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন ম্যাকবেথ, এত কষ্ট করে আপনারা যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছেন তার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। এবার ব্যাংকোর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, তাহলে ব্যাংকো, তোমার বংশধররা যে রাজা হবে সে ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস হচ্ছে তো? তুমি তো নিজের চোখেই দেখলে ওদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আমি কডর-এর থেন হয়েছি।

আমাত্যদ্বয়ের কান বাঁচিয়ে ম্যাকবেথের মতো একই স্বরে বললেন ব্যাংকে, দেখ, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কিছু আসে যায় না। আমি যদি সত্যিই দৈববাণীতে বিশ্বাস করি তাহলে তৃতীয় ডাইনির কথা মতো তুমি রাজা হওয়ার প্রেরণা পাবে। আমার যতদূর জানা আছে। এই অদ্ভুত প্রাণীর সবাই অন্ধকারের বাসিন্দা, শয়তানের উপাসক। এদের ভবিষ্যদ্ববাণী কোনও কোনও ক্ষেত্রে মিলে গেলেও আসলে এরা আমাদের ক্ষতিই করে। এরা আমাদের প্রলুব্ধ করে নানারূপ অন্যায় কাজ করতে যার ফল খুব ক্ষতিকারক এবং ভয়ংকর। ওহে বন্ধু! তুমি যে দেখছি বেজায় চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলে?

যদিও নিজের মনে বিড় বিড় করে বললেন ম্যাকবেথ, দৈব আমার সহায় হলে রাজা হওয়া আটকাবে না। আমার, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাংকে কিন্তু কথাগুলি ঠিকই শুনতে পেলেন।

ব্যাংকো বললেন, বন্ধু ম্যাকবেথ! ওরা এসেছেন আমাদের দু-জনকে নিয়ে যেতে। চল, ওদের সাথে আমরা রাজসভায় চলে যাই।

ম্যাকবেথ উত্তর দিলেন, তুমি আমায় ক্ষমা কর ব্যাংকো। অতীতের কিছু ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় ওদের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। চল, আমরা ওদের সাথে যাই। কিছুক্ষণ আগে আমাদের চোখের সামনে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেল, তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তার মেলাই সময় পাওয়া যাবে। দেখাই যাক না কেন আরও অন্য কিছু ঘটে কিনা। পরে না হয় এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করব।

তাতে আমি অরাজি নই, বললেন ব্যাংকো।

অমাত্যদ্বয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন ম্যাকবেথ, আসুন বন্ধুরা, এবার রাজসভায় যাওয়া যাক।

 

০৩.

শিবিরে পৌঁছে ঘোড়া থেকে নেমে ভিতরে ঢুকলেন ম্যাকবেথ আর ব্যাংকো। মাথা থেকে শিরস্ত্ৰাণ খুলে নিয়ে ঘাড় হোঁট করে একসাথে তারা অভিবাদন জানালেন রাজাকে।

সিংহাসন থেকে নেমে এসে সভার মাঝে দাঁড়ালেন রাজা ডানকান। ওদের দেখে রাজা এত আনন্দ পেয়েছেন যে তিনি আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে–সজোরে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ম্যাকবেথ আর ব্যাংকোকে।

গদগদ স্বরে বললেন রাজা ডানকান, হে আমার প্রিয় জ্ঞাতিভাই ম্যাকবেথ! দেশের জন্য তুমি যা করেছ, তার উপযুক্ত প্রতিদান আমি তোমায় দিতে পারিনি। যৎসামান্য যা দিয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশি পাবার যোগ্য তুমি।

ম্যাকবেথ জবাব দিলেন, মহারাজ! কোনও কিছু পাবার আশায় এ কাজ করিনি। রাজার সেবা করে যে গৌরব অর্জন করা যায়, তাই করেছি আমি। দেশ, রাজসিংহাসন ও আপনি –এদের প্রতি আমার যে কর্তব্য আছে শুধু সেটুকুই করেছি আমি।

রাজা বললেন, এই শুভদিনে আমি ঘোষণা করছি আজ থেকে আমার বড়ো ছেলে ম্যালকম কম্বারল্যান্ডের যুবরাজ। এর পর ম্যাকবেথের দিকে তাকিয়ে রাজা ডানকান বললেন, ওখান থেকে ফিরে এসে আমি ইনভার্নেসে তোমার প্রাসাদে যাব—আজকের রাতটা তোমার অতিথি হয়ে কাটাব।

ম্যাকবেথ জবাব দিলেন, সে তো আমার পরম সৌভাগ্য মহারাজ। তবে রাজসেবার প্রস্তুতির জন্য আমায় কিছুটা সময় দিতে হবে। আমি আগে গিয়ে আপনার আগমনবার্তা জানাব স্ত্রীকে। তাই অনুমতি চাইছি ইনভার্নেসে যাবার।

বেশ, তাই হবে, বললেন মহারাজ, ভাই ম্যাকবেথ!

তোমায় অজস্র ধন্যবাদ। রাজার অনুমতি নিয়ে শিবিরের বাইরে এলেন ম্যাকবেথ। সমগ্র পরিস্থিতিটা বিশদভাবে দেখতে গিয়ে চাপা রাগে। লাল হয়ে উঠল তার চোখ-মুখ। এই কিছুক্ষণ আগে বড়ো গলায় রাজা ডানকান তার জ্যেষ্ঠপুত্র ম্যালকমকে কাম্বারল্যান্ডের যুবরাজ হিসেবে ঘোযণা করেছেন। এর অর্থ ডানকানের মৃত্যুর পর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে ম্যালকাম। তার নিজের আর রাজা হবার কোনও সম্ভাবনাই রইল না। তিনি স্থির করলেন রাজাকে হত্যা করবেন। কীভাবে অন্যদের মনে সন্দেহের উদ্রেক না করে কাজটা করা যায় তা নিয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে পড়ল। আজ রাতেই তো ইনভার্নেসে তার প্রাসাদে রাত কাটাবেন রাজা। এই তো সুযোগ্য সময় সবার অগোচরে রাজাকে সরিয়ে দেবার। নিজের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার উদেশে ম্যাকবেথ তার নিজ হাতে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথের কাছে। সেই চিঠিতে রইল রাজার আগমনবার্তা। সেই সাথে তিনি ডাইনীর ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। এবার চিঠিতে সই করে ম্যাকবেথ সেটা দূত মারফত পাঠিয়ে দিলেন লেডি ম্যাকবেথকে। দ্রুতগামী ঘোড়া ছুটিয়ে দূত সে চিঠিটা নিয়ে রওনা হল ইনভার্নেসের প্রাসাদের দিকে।

ম্যাকবেথ তার প্রাসাদে ফিরে আসার বহুক্ষণ আগেই দূত তুতার চিঠিটা এনে দিয়েছে লেডি ম্যাকবেথের হাতে। চিঠিটা খুঁটিয়ে পড়লেন তিনি। তিনি ভেবে দেখলেন ম্যাকবেথ রাজা হলে তিনি হবেন রাজরানি। লেডি ম্যাকবেথও খুব উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনি এও জানেন তার স্বামী খুব সৎ। কোনও অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে চান না তিনি। আবারও চিঠিটা মন দিয়ে পড়লেন লেডি ম্যাকবেথ। তারপর স্বামীর উদ্দেশে মনে মনে বলতে লাগলেন, হে আমার গ্লমিশ ও কডর-এর থেন! তুমি চাইছ সৎপথে সিংহাসনে বসতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। সিংহাসনে বসতে হলে অসৎপথেই তোমাকে তা করতে হবে। তুমি আমার সামনে এলে এমন সব ধারালো বাণী তোমাকে শোনাব, যাতে কার্যসিদ্ধির জন্য অন্য পথের আশ্রয় নিতেও তুমি পেছপা হবে না। আমি সেটা করিয়েই ছাড়ব। যেখানে যত অশুভ, অপ্রাকৃতিক শক্তি আছ, তোমরা সবাই আমাকে সাহায্য কর লক্ষ্য পূরণ করতে। আমার মন থেকে ভয়-ভীতি দূর করে জাগিয়ে তোল দুৰ্জয় সাহস। আমার নারীসুলভ মায়া-মমতা দূর করে আমার মনকে পাথরের মত নিষ্ঠুর কর আমাকে। প্রার্থনার ঢংয়ে যখন তিনি নিজেকে এভাবে উত্তেজিত করছিলেন, সে সময় ম্যাকবেথ এলেন সেখানে।

ঘাড় সামান্য নিচু করে স্বামীকে অভিবাদন জানিয়ে লেডি ম্যাকবেথ ফিসফিস করে বললেন, এই কিছুক্ষণ আগে তোমার চিঠি পেয়েছি। পড়ে মনে হল তোমার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।

স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ম্যাকবেথ বললেন, আর কিছুক্ষণ বাদেই অমাত্যদের সাথে নিয়ে রাজা ডানকান এসে পড়বেন। আজ রাতে তিনি আমাদের অতিথি।

ভালোই তো, বললেন লেডি ম্যাকবেথ, তা এখান থেকে কখন তিনি ফিরে যাবেন?

ম্যাকবেথ বললেন, রাজার কথা শুনে মনে হল আগামী কাল সকালে তিনি চলে যাবেন।

স্বামীর কথা শুনে লেডি ম্যাকবেথ বললেন, আজকের রাতটা যেন শেষ না হয়।

ম্যাকবেথ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, কী বলছ তুমি?

ফিস ফিস করে লেডি ম্যাকবেথ বললেন, আমি বলতে চাইছি আজ রাতটাই যেন রাজার জীবনের শেষ রাত হয়। তোমার চাউনি দেখে মনে হচ্ছে তুমিও এই আশাই করছি। তুমি কি চাও না আজ রাতে রাজাকে হত্যা করে তোমার উচ্চাশা পূরণ করতে? দেখছি তোমার দ্বারা কিছু হবে না। বেশ, যা করার আমিই করব।

স্ত্রীর কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ রইলেন ম্যাকবেথ। লেডি ম্যাকবেথ-আন্দাজ করলেন শুভ-অশুভের দোলাচলে দুলছেন তার স্বামী। তাই স্বামীকে বললেন, দেখ, দুশ্চিন্তার ছায়া পড়েছে তোমার চোখে-মুখে। তোমাকে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবে মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তুমি। এবার মন দিয়ে শোন, কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবসময় হাসিমুখে থাকবে। রাজা এলে তাকে যথাযোগ্য সম্মান জানাবে, লক্ষ রাখবে যেন তার আতিথ্যের কোনও ত্রুটি না হয়। তারপর যা করার তা আমিই করব। রাজা ও তার অমাত্যদের সামনে সবসময় ভালোমানুষ সেজে থাকার চেষ্টা করবে যাতে তোমার প্রকৃত উদ্দেশ্য কেউ টের না পায়। মনে রাখবে আজ রাতে আমরা এমন একটা কাজ করতে যাচ্ছি যা সফল হলে আমাদের বাকি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের ইশারায় চলবে।

ম্যাকবেথের মনে তখনও দ্বন্দ্ব চলছে। স্ত্রীর কথার জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, পরে তোমার সাথে এ বিষয়ে কথা হবে।

ম্যাকবেথের কথা শেষ হতে না হতেই প্রাসাদের বাইরে শোনা গেল তুর্যনাদ, বেজে উঠল। দামামা, ভেরী। রাজা এসেছেন জেনে ম্যাকবেথ তার স্ত্রীকে নিয়ে ছুটে গেলেন ফটকের সামনে। তার নির্দেশে ফটক খুলে দেবার পর স্বামী-স্ত্রী বাইরে গিয়ে রাজা ও সঙ্গীদের যথোচিত অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এলেন প্রাসাদের ভেতরে।

লেডি ম্যাকবেথকে দেখিয়ে হাসিমুখে বললেন রাজা, সেনাপতি ম্যাকবেথের স্ত্রী শুধু রূপসিই নন, তিনি যে একজন আদর্শ গৃহিণী তা তাকে দেখলেই বোঝা যায়। বুঝলেন লেডি ম্যাকবেথ, আজ আমরা সবাই আপনার অতিথি।

সে তো আমাদের পরম সৌভাগ্য মহারাজী, বিনয়ের সাথে বললেন লেডি ম্যাকবেথ, আমরা তো আপনারই আজ্ঞাবহ ভূত্য মাত্র। আমাদের সৌভাগ্যের মূলে রয়েছে আপনার অসীম করুণা। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব অতিথিসেবার–বলে রাজাও অমাত্যদের পথ দেখিয়ে প্রাসাদের ভেতর নিয়ে গেলেন তারা।

এবার খেতে বসলেন রাজা ডানকান ও তার সঙ্গীরা। রীতি অনুযায়ী ম্যাকবেথও বসে গেলেন তাদের সাথে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত মনস্থির করে উঠতে পারেননি। তাই রাজার খাওয়া শেষ হবার আগেই তিনি টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন তার শোবার ঘরে। রাজার খাওয়া শেষ হবার আগেই টেবিল ছেড়ে আসার জন্য লেডি ম্যাকবেথ বাকাবিকি করল তার স্বামীকে। তার বুঝতে বাকি রইল না শুরুতে রাজাকে হত্যা করার সাহস দেখালেও এখন তার স্বামীর বিবেক জেগে উঠেছে। ম্যাকবেথ স্ত্রীকে বললেন, দেখ, রাজা আজ আমাদের অতিথি। তারই দয়ায় আমি একই সাথে গ্লমিশ আর কডর-এর থেন। তাছাড়া আমি তার আত্মীয়। এসব কথা বিবেচনা করে এখন আমি তাকে হত্যা করতে পারব না।

কী বললে, তুমি পারবে না? উপহাসের হাসি হেসে বললেন লেডি ম্যাকবেথ, রাজাকে হত্যা করে সিংহাসনে বসার পরিকল্পনা করে আমাকে চিঠি লেখার সময় তোমার বিবেক-বুদ্ধি কোথায় ছিল? সততার ধ্বজা বয়ে কাপুরুষের মতো জীবন কাটাবে তুমি?

স্ত্রীকে ধমক দিয়ে ম্যাকবেথ বললেন, দোহাই তোমার, একটু থাম। আমি তাই করব যা একজন সত্যিকারের পুরুষ মানুষ করে থাকে। আর এও জেনে রাখ, আমার মতে যে পুরুষের সাহস নেই সে মানুষই নয়।

লেডি ম্যাকবেথ বললেন, এই ভয়ানক পরিকল্পনার কথা যখন তুমি আমায় জানিয়েছিলে, সে সময় তোমার মনে সাহস ও দৃঢ়তা–দুইইছিল। এখন তোমার লক্ষ্য হয়েছে সবার চোখে ভালো মানুষ সেজে থাকা। ভুলে যেও না, আমিও একদিন মা হয়েছিলাম। নিজের বাচ্চাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে দুধ খাওয়াবার মধ্যে যে কী মাধুর্য, তা আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। কিন্তু তোমার মতো শপথ নিলে সেই বাচ্চাকে নিজের হাতে হত্যা করতেও আমি পেছপা হতাম না।

বেশ তো, না হয় তোমার কথাটা মেনে নিলাম, বললেন ম্যাকবেথ, কিন্তু ভেবেছ কি কাজটা ঠিকমতো না করতে পারলে তার পরিণতি কী হবে?

লেডি ম্যাকবেথ বললেন, যদি সাহস থাকে তাহলে ব্যর্থতার কথা উঠছে কেন? একেই রাজার বয়স হয়েছে, তার উপর পথশ্রমে ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বাদেই ঘুমিয়ে পড়বেন তিনি। তখন বাইরে পাহারা দেবে শুধু দু-জন রক্ষী। রাজা ঘুমিয়ে পড়লে ওষুধ মেশান প্রচুর মদ আমি খাইয়ে দেব ওই দুজনকে। সাথে সাথে ঘুমের গভীরে তলিয়ে যাবে তারা। তখন রাজার জীবন আমাদের হাতের মুঠোয়–তা নিয়ে আমরা যা খুশির তাই করতে পারি। শুধু রক্ষী দুটোর ঘাড়ে সব কিছুর দায় চাপিয়ে দিলেই আমরা খালাস। তুমি কি বল, এটা করা সম্ভব নয়?

স্ত্রীর প্রশংসা করে ম্যাকবেথ বললেন, মানতেই হবে তোমার সাহস আছে। নারীসুলভ গুণের চেয়ে পুরুষ প্রবৃত্তিই তোমার মধ্যে প্রবল। তবে তুমি যা বলনি এবার সেটুকু বলছি আমি। রাজাকে হত্যা করার পর ঐ দেহরক্ষী দুটোকেও মেরে ফেলতে হবে। তবে তার আগে ওদের হাতে মাখিয়ে দিতে হবে মৃত রাজার রক্ত। সবাই ভাববে জেগে পাহারা না দিয়ে রাজার রক্ত হাতে মেখে ঘুমোচ্ছে দেখেই আমি হত্যা করেছি তাদের–এ কথাটাই রাজার সঙ্গী-সাথীদের বোঝাতে হবে।

লেডি ম্যাকবেথ বললেন, আর আমরা যখন বুক চাপড়ে মড়া-কান্না শুরু করব, তখন সবাই আমাদের কথাটাই সত্যি বলে ধরে নেবে।

ম্যাকবেথ বললেন, এবার আর কোনও ভয় নেই আমার। আমি ফিরে পেয়েছি। আমার হারিয়ে যাওয়া সাহস এবং আত্মবিশ্বাস। যে ভয়ানক পরিকল্পনা আমি করেছি তা সফল করার জন্য পুরোপুরি তৈরি আমি।

 

০৪.

রাজার সাথে ম্যাকবেথের প্রাসাদে আসার সময়ে সেনাপতি ব্যাংকে তার ছেলে ফ্লিয়ানসকে নিয়ে এসেছেন সাথে। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাজা শুতে যাবার পর ব্যাংকে তার ছেলেকে নিয়ে নিজ প্রাসাদে ফিরে যাবার আয়োজন করছেন। তার প্রাসাদও খুব কাছেই।

ব্যাংকে তার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন এখন কটা বাজে?

ফ্লিয়ানস উত্তর দিল, পেটা ঘড়ির আওয়াজ শুনিনি আমি। তবে চাঁদ ডুবে গেছে।

তাহলে রাত বারোটা বেজেছে, আপন মনে বললেন ব্যাংকো, ঠিক বারোটায় চাঁদ ডুবে যায়। ফ্লিয়ানস, আমার তলোয়ারটা তোমার কাছে রাখি, সাথে একটি বাতিও নিও। প্রচণ্ড ঘুম পেয়েছে আমার—–নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন তিনি–হাতে কাজ না থাকলেই যত সব উদ্ভট চিন্তা মাথায় এসে ঢোকে। ভগবান যেন ও সব থেকে আমায় দূরে রাখেন। ও কি, কে দাড়িয়ে আছে ওখানে? জবাব দাও? ফ্লিয়ানস, তলোয়ারটা আমার হাতে দাও তো?

ব্যাংকের প্রশ্ন শুনে মশাল হাতে এগিয়ে এল। একজন অল্পবয়সি পরিচারক। সেই মশালের আলোয় ব্যাংকো দেখতে পেলেন পরিচারকের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং ম্যাকবেথ।

ম্যাকবেথ বললেন, আমি তোমার বন্ধু ম্যাকবেথ দাঁড়িয়ে আছি এখানে।

ব্যাংকে আশ্চর্য হয়ে বললেন, বারোটা বেজে গেছে কিন্তু তুমি এখনও জেগে আছ? তারপর একটা হিরে বের করে বললেন, অনেকক্ষণ আগেই রাজা ঘুমিয়ে পড়েছেন। তোমার আতিথেয়তায় খুশি হয়ে রাজা এই হিরোটা উপহার দিয়েছেন লেডি ম্যাকবেথকে। আচ্ছা ম্যাকবেথ যুদ্ধ ফেরত আমরা যে তিন ডাইনির দেখা পেয়েছিলাম তাদের কথা মনে আছে তোমার?

ম্যাকবেথ বললেন, দেখ, মন যখন অপ্ৰস্তুত থাকে, তখনই ডাইনিদের অশুভ প্রভাব তার উপর পড়ে, মনের কামনা-বাসনা সব কিছু চাপা পড়ে যায় তার নিচে। তবে মন প্রস্তুত থাকলে সেরূপ ঘটনা ঘটে না।

ব্যাংকে বললেন, জান, কাল রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি। ওই তিন ডাইনিকে। তোমার সম্পর্কে ওরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছে তা তো দেখছি মিলে যাচ্ছে।

প্রশ্নটিশ্ন কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে ম্যাকবেথ বললেন, এই মুহূর্তে ওদের কথা আমার মনে পড়ছে না। তবে তোমার আপত্তি না থাকলে এ বিষয়ে ঘণ্টাখানেক তোমার সাথে কথা বলতে চাই।

ব্যাংকে বললেন, আমার কোনও আপত্তি নেই। তোমার ইচ্ছে আর সময় হলেই আলোচনা হবে।

ম্যাকবেথ বললেন, আমার কথা অনুসারে চললে তুমিও সম্মানিত হবে ব্যাংকো।

ব্যাংকো জবাব দিলেন, আমিও সবার মতো সম্মান চাই, তবে তা রাজার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে।

ম্যাকবেথ বললেন, যাও ব্যাংকো, তুমি বিশ্রাম নাও।

তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যাংকো বললেন, এবার তুমিও বিশ্রাম নাও ম্যাকবেথ–এই বলে ছেলে ফ্লিয়ানসকে সাথে নিয়ে রওনা দিলেন নিজ প্রাসাদের দিকে।

 

গভীর রাত। ইনভার্নেসের দুর্গের ভিতর ভিন্ন ভিন্ন ঘরে গভীর ঘুমে ডুবে রয়েছেন রাজা ও তার সঙ্গী-সাথীরা। ওষুধ মেশান মন্দ প্রচুর পরিমাণে খেয়ে রাজার কামরার বাইরে ঘুমে বেহুশ হয়ে পড়ে রয়েছে রক্ষীদ্বয়। সপুত্র ব্যাংকো চলে যাবার পর মশাল হাতে প্রহরার এক রক্ষীকে ডেকে ম্যাকবেথ বললেন, যাও, তোমার মনিবানিকে গিয়ে বল ওষুধটা তৈরি হলে তিনি যেন ঘণ্টা বাজিয়ে আমায় ডেকে পাঠান। পরিচারক তাকে অভিবাদন জানিয়ে চলে যাবার পর ম্যাকবেথের সামনে ভেসে উঠল এক অদ্ভুত দৃশ্য। তিনি দেখলেন একটা ধারালো ছুরি তার সামনে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে–ছুরির ফলায় লাগানো রয়েছে লাল লাল তাজা রক্ত। যেই সে ছুরির বঁটিটা হাত দিয়ে ধরতে গেলেন ম্যাকবেথ, অমনি সেটা পিছলে গেল। আবার কিছুক্ষণ বাদে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল তার সামনে থেকে।

ওই অলৌকিক ছুরিটা যে রাজাকে হত্যা করার জন্য তাকে প্রেরণা দিচ্ছে, এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে ম্যাকবেথ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। ঘুমন্ত রাজার কক্ষের দিকে। কিছুক্ষণ আগে ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ খাইয়ে রক্ষীদের বেন্থশ করে লেডি ম্যাকবেথ যে নিজেই রাজাকে হত্যা করতে তার কক্ষে ঢুকেছেন, সেকথা তখনও পর্যন্ত জানতেন না। ম্যাকবেথ। উদ্যত ছুরিকা হাতে রাজার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন লেডি ম্যাকবেথ। রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে, হল রাজার মুখখানা ঠিক তার বাবার মুখের মতো। মুহূর্তের মধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ল তার মন। রাজাকে হত্যা করতে অপারগ হয়ে তিনি ছিটকে বেরিয়ে এলেন সেই ঘর থেকে। স্বামীকে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন করতে ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকে পাঠালেন তাকে।

ঘণ্টার আওয়াজকানে যেতেই নিজ মনে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, এবার চরম সময় উপস্থিত। রাজা ডানকান, এই ঘণ্টাধ্বনিই ঘোষণা করছে তোমার জীবনের সমাপ্তির কথা। এবার উপরে যাবার জন্য তৈরি হও। একথা বলতে বলতে ম্যাকবেথ এসে দাঁড়ালেন রাজার কক্ষের সামনে! দেহরক্ষীদ্বয়কে ঘুমে অচেতন দেখে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন তিনি। ধীর পায় এগিয়ে এসে রাজার কাছে দাঁড়ালেন ম্যাকবেথ। নিশ্বাসের সাথে ওঠা-নমা করছে রাজার বুক। রাজার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেই ভয়ে কেঁপে উঠল তার সারা শরীর। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন ম্যাকবেথ। খাপ থেকে ছোরা বের করে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছোরাটা আমূল বসিয়ে দিলেন রাজার বুকে। সাথে সাথেই থেমে গেল রাজার বুকের ধুকপুকুনি। ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। সেই রক্তে ভিজে গেল সারা বিছানা। একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ঘুমন্ত রাজার ঠোঁট থেকে। তারপর বালিশের পাশে এলিয়ে পড়ল। রাজার মাথা।

কানের কাছে একটা অচেনা আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলেন ম্যাকবেথ। ওই আওয়াজটা যেন বলছে, ম্যাকবেথ! তুমি খুনি। রাতের ঘুম পালিয়ে গেছে তোমার চোখ থেকে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি।

পরমুহূর্তেই ম্যাকবেথের কানে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর, ঘুমকে খুন করেছে গ্ল্যামিশ, সে আর ঘুমোবে না। ম্যাকবেথ! কডর আর ঘুমোবে না। রক্তমাখা ছুরি হাতে রাজার ঘর থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর কাছে এলেন ম্যাকবেথ। স্ত্রীকে বললেন, সব শেষ। রাজার ঘুম আর কখনও ভাঙবে না। কীভাবে রাজাকে খুন করেছেন তা সবিস্তারে স্ত্রীকে বললেন ম্যাকবেথ। সব শোনার পর স্ত্রী বললেন, ওই ছুরিটা নিয়ে এসেছি কেন? যাও, রাজার ঘরের বাইরে পাহারাদারদের হাতের কাছে ওটা রেখে এস। ছোরার ফলার রক্ত মাখিয়ে দেবে প্রহরীদের হাতে। তাহলে সবাই ধরে নেবে মদ খেয়ে ওরাই হত্যা করেছে রাজাকে।

ম্যাকবেথ স্ত্রীকে বললেন, আচ্ছা, তুমি কারও চিৎকার শুনতে পেয়েছ?

কই! না তো। জবাব দিলেন লেডি ম্যাকবেথ।

ম্যাকবেথ বললেন স্ত্রীকে, দেখ, আমি যেন কার চিৎকার শুনতে পেলাম। কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই কে যেন আমার কানের কাছে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ম্যাকবেথ! তুমি খুনি। রাতের আর ঘুম বিদায় নিয়েছে তোমার চোখ থেকে। এর মানে কি বুঝতে পারছি? মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাতে ঘুমোতে পারব না আমি। ঘুমে যতই চোখ বুজে আসুক, চোখ বন্ধ করতে পারব না আমি।

লেডি ম্যাকবেথ স্বামীকে বোঝালেন, আমি তো সেরূপ কিছু শুনিনি। আসলে ও সব তোমার মনের ভুল। ভয় পেয়েছ বলেই তোমার এরূপ মনে হচ্ছে। শোন, এবার যা বলছি তাই কর। রাত শেষ হয়ে আসছে। লোক-জন টের পাবার আগেই ছুরিটা রেখে এস ঘুমন্ত রক্ষীদের হাতের কাছে। মনে করে ওদের হাত ও জামায় কিছুটা রক্ত লাগিয়ে দিও।

স্ত্রীর কথা শুনে চমকে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, আবার তুমি আমায় ওখানে যেতে বলছি? না, না, ওখানে যাবার সাহস আমার নেই। এবার বাধ্য হয়েই স্বামীর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলেন লেডি ম্যাকবেথ। নিঃশব্দে ছুরিটা নামিয়ে রাখলেন রাজার ঘরের বাইরে ঘুমন্ত রক্ষীদ্বয়ের পাশে।ছুরির ফলায় লেগে থাকা কিছু কাঁচা রক্ত মাখিয়ে দিলেন রক্ষীদের হাতে ও জামায়। এসব কাজ শেষ করে লেডি ফিরে গেলেন তার শোবার ঘরে।

 

এভাবেই এক সময় শেষ হয়ে এল দুঃস্বপ্নের কালরাত। ম্যাকবেথের অতিথি হয়ে আসার আগের দিন রাজা ডানকান তার বিশ্বস্ত অমাত্য ম্যাকডাফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে যেন সূর্যোদয়ের আগে ডেকে তোলা হয়। রাজার নির্দেশ অনুযায়ী ভোরের আলো ফোটার আগেই ম্যাকডাফ এসে প্রাসাদের দরজায় জোরে ধাক্কা দিতে লাগলেন। দরজার ফাক দিয়ে ম্যাকডাফকে দেখে নৈশ প্রহরী তার পরিচয় এবং এত ভোরে আসার কারণ জানতে চাইলেন। ম্যাকডাফ তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার কারণ জানালেন। প্রহরী দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে ধীর পায়ে রাজার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন ম্যাকডাফ। ঘরে ঢুকেই বিছানার উপর রাজার রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি–জোর গলায় বিলাপ করতে করতে তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। অত ভোরে তার গলায় জোর বিলাপের আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল দুর্গপ্রাসাদের বাসিন্দাদের। তাদের জিজ্ঞাসার জবাবে ম্যাকডাফ সংক্ষেপে যা বললেন তা এই –রক্ষীদের নজর এড়িয়ে প্রাসাদের ভেতর ঢুকে কোনও অজানা আততায়ী ঘুমন্ত রাজার বুকে ছুরি বসিয়ে তাকে খুন করেছে। কডর-এর দুর্গে এরূপ ঘটনার কথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠল। সবাই।

ঘুম আসেনি ম্যাকবেথের। তিনি জেগেই ছিলেন। চিৎকার চেচামেচি শুনে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। রাজার ঘরে ঢুকে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে এমন স্বাভাবিকভাবে বিলাপ করে উঠলেন যা দেখে উপস্থিত কারও মনে তার প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগল না। বারবার নিজের কপাল চাপড়ে বলতে লাগলেন, হায়, হায়, শেষে কিনা আমার কপালে এই ঘটিল! আমারই অতিথি হয়ে এমন নৃশংসভাবে খুন হতে হল রাজাকে? এই দুৰ্ভেদ্য দুর্গ থেকে সবার নজর এড়িয়ে কীভাবে পালিয়ে গেল আততায়ী? নিজ মনে এসব কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ম্যাকবেথ। সে সময় তার চোখে পড়ল রাজার দুই দেহরক্ষী ঘরের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোচ্ছে। এত হই হট্টগােলেওঁ ঘুম ভাঙেনি তাদের। যদিও ম্যাকবেথ জানতেন যে আগে থেকেই তার স্ত্রী রক্ত মাখানো খুনের হাতিয়ারটি রেখে গেছেন রক্ষীদের পাশে। ছুরির ফলায় লেগে থাকা রক্তও লাগিয়ে দিয়েছেন তাদের হাতে ও জামায়, এসব জানা সত্ত্বেও তিনি এমন ভাব দেখাতে লাগলেন যাতে মনে হবে এই প্রথম এগুলি তার চোখে পড়ল।

এই এরাই মাতাল হয়ে খুন করেছে রাজাকে, বলেই তলোয়ারের এক কোপে দুই ঘুমন্ত দেহরক্ষীর মাথা কেটে ফেললেন ম্যাকবেথ।

পাশের ঘরেই শুয়েছিলেন দুই রাজপুত্র ম্যালকম আর ম্যাকডোনাল্ড। তারা উভয়ের বুদ্ধিমান। সহজেই তারা বুঝতে পারলেন সিংহাসনের লোভে কেউ হত্যা করেছে রাজাকে। তারা ভয় পেলেন এই ভেবে যে এবার হয়তো তারা রাজপুত্রদের হত্যা করবে। রাজার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে যখন ম্যাকবেথ ও অন্যান্য সবাই শোক প্রকাশ করছিলেন, সেই সুযোগে ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে গেলেন দুই রাজপুত্র। ম্যালকম পালিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডে আর ডোনালবেন আয়ার্ল্যান্ডে। এবার সুযোগ পেয়ে জোর গলায় বলতে লাগলেন ম্যাকবেথ, এই রাজপুত্ররাই খুন করেছে রাজাকে নইলে সমাধি দেবার আগেই কেন তারা পালিয়ে গেল? সে মুহূর্তে সবার মানসিক অবস্থা এরূপ যে কেউ আর প্রতিবাদ করল না। ম্যাকবেথের কথায়।

রাজা চলে যায়। তবুও সিংহাসন খালি থাকে না। দুই রাজপুত্ৰই পালিয়ে গেছেন। একই বংশের রক্ত বইছে তার শিরায় এমন লোক একজনই আছেন, তিনি হলেন ম্যাকবেথ-গ্রামিশা ও কডর এর থেন। আমোত্যরা নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে শেষমেশ শূন্য সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন ম্যাকবেথকে। এবার সফল হল তিনি তৃতীয় ডাইনির ভবিষ্যদ্বাণী।

 

রাজসিংহাসনে বসে ম্যাকবেথের মনোবাসনা পূৰ্ণ হলেও সংকট দেখা দিল অন্যদিক থেকে। সে সংকটের কারণ আর কেউ নয়, তার একসময়ের সহযোগী সেনাপতি ব্যাংকো। জলার সেই তিন ডাইনি ম্যাকবেথের বংশধরদের রাজা হবার কথা বলেনি, বলেছিল ব্যাংকের বংশধরদের অনেকেই স্কটল্যান্ডের সিংহাসনের বসবে। ব্যাংকের বংশধররা রাজা হবে, এই ভবিষ্যদ্বাণীই ম্যাকবেথের মনকে অহরহ খোঁচা দিতে লাগল। তিনি স্থির করলেন ভাড়াটে খুনির সাহায্যে হত্যা করবেন ব্যাংকে আর তার ছেলে ফ্লিয়ানসকে। রাজা হবার আনন্দে ফরেস-এর প্রাসাদে এক ভোজসভার আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানালেন অমাত্য, সেনাপতি আর থেনদের। ব্যাংকে জানালেন একটা বিশেষ কাজে ছেলেকে নিয়ে তিনি দূরে যাচ্ছেন। ফিরতে হয়তো কিছুটা দেরি হবে। তবে কথা দিলেন দেরি হলেও তিনি অবশ্যই ভোজসভায় যোগ দেবেন। ইতিমধ্যে দু-জন ভাড়াটে খুনির ব্যবস্থা করে রেখেছেন ম্যাকবেথ। সে দুজন এমনই লোক যাদের অপরাধের দরুন এক সময় হত্যা করতে চেয়েছিলেন ব্যাংকো। পরে অবশ্য কোনও কারণে তিনি তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেই থেকে তারা বেজায় রেগে আছে ব্যাংকের উপর, একথা জানতেন ম্যাকবেথ। তাই ম্যাকবেথ ভাবলেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এবার তাদের কাজে লাগাবেন। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন ব্যাংকো তার কাজ সেরে আসার মাঝপথেই তারা যেন ব্যাংকো আর তার ছেলেকে খুন করে, কাজ সেরে ম্যাকবেথের ভোজসভায় যোগ দেবার জন্য ফিরে আসছিলেন ব্যাংকো। পথের মাঝেই ম্যাকবেথের ভাড়াটে খুনিদের হাতে খুন হলেন তিনি। ছুরির ঘা খেয়ে ব্যাং লুটিয়ে পড়ার আগে ব্যাংকে তার ছেলে ফ্লিয়ানসকে পালিয়ে যেতে বললেন–সেই সাথে আরও বললেন ভবিষ্যতে সে যেন তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়। ভাড়াটে খুনিদের কাছ থেকে ব্যাং বেঁচে নেই কথাটা শুনে যতটা খুশি হলেন ম্যাকবেথ, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ হলেন অক্ষত দেহে ফ্লিয়ানস পালিয়ে যাওয়ায়।

ওদিকে ফরেসের প্রাসাদে শুরু হয়েছে। নৈশভোজ। চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে। ভোজন কক্ষের বিশাল লম্বা টেবিলের দুপাশে সারি দিয়ে বসেছেন রাজার অমাত্য, বিশিষ্ট থেন আর সেনারীরা, তাদের বউ আর মেয়েরাও সুন্দর পোশাক আর দামি গয়না-গাটি পরে হাজির হয়েছেন সেখানে। নতুন রাজা হবার আনন্দে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে সৌজন্য বিনিময় করছেন ম্যাকবেথ। কিছুক্ষণ বাদে অবাক হয়ে ম্যাকবেথ দেখলেন তার নির্দিষ্ট আসনে বসে আছেন ব্যাংকো–দরদরি করে রক্ত ঝরিছে তার শরীর থেকে। চারিদিকে তাকিয়ে ম্যাকবেথ লক্ষ করলেন তিনি ছাড়া আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না ব্যাংকোকে–এমন কি তার স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথ পর্যন্ত নয়। ওটি যে ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন তিনি। প্রচণ্ড ভয় আর উত্তেজনায় যেন পাগল হয়ে গেলেন ম্যাকবেথ। ব্যাংকের প্ৰেতাত্মার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় তিনি বলতে লাগলেন, কেন এখানে এসেছ তুমি? যে যাই বলুক, তুমি কখনও বলতে পারবে না। এ কাজ আমি করেছি! কবরের ভেতর থেকে মড়াগুলি যদি এভাবে বেরিয়ে আসে, তাহলে তো সমাধিস্তম্ভগুলিও ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াবে।

ভোজসভায় উপস্থিত কেউ বুঝতে পারল না। আপন মনে কী সব বলছেন ম্যাকবেথ। তারা সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে।

অমাত্য রস আমন্ত্রিত অতিথিদের বললেন, মহারাজ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এবার আপনারা দয়া করে উঠুন।

স্বামীর এ হেন অবস্থা দেখে বেজায় মুশকিলে পড়ে গেলেন লেডি ম্যাকবেথ। তিনি তৎক্ষণাৎ হাতজোড় করে অতিথিদের বললেন, না, না, আপনারা উঠবেন না। এটা মহারাজার পুরনো মানসিক রোগ। মাঝে মাঝে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে সময় তিনি সাময়িক অসুস্থ হয়ে পড়েন। আপনারা যেমন খাচ্ছিলেন সেভাবেই খেয়ে যান। দেখবেন, একটু বাদেই তিনি আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমার অনুরোধ, এখন আপনারা কেউ ওর মুখের দিকে চাইবেন না। তাহলে ওর উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে।

অমাত্য রসের কথায় ইতিমধ্যে অনেক অতিথিই খাওয়া ছেড়ে উঠেছিলেন। এমন তোফা ভোজটা কিনা মাটি হয়ে গেল ভেবে অনেকেরই মুখ বেজার হয়ে গিয়েছিল। এবার রানি নিজে অনুরোধ করায় খুশি মনে খেতে বসলেন সবাই। রানি স্বামীর কাছে গিয়ে তাকে ধমকে চাপা স্বরে বললেন, কী শুরু করেছ তুমি? অতিথিরা সবাই কি ভাবলেন বলতো? ভালো করে চেয়ে দেখ তো কিছুক্ষণ আগে তোমার আসন যেমন খালি ছিল, এখনও তেমনি রয়েছে। তাছাড়া নিজের কানেই তো শুনলে ব্যাংকে মারা গেছে। তাহলে কী করে তিনি তোমার জায়গায় বসবেন? মিছিমিছি ভয় পোচ্ছ তুমি। এ সব তোমার অমূলক ধারণা।

নিজের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে পুনরায় আঁতকে উঠলেন ম্যাকবেথ–দেখলেন আগের মতোই সেখানে বসে আছে ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা।

প্রেতাত্মার দিকে ইশারা করে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ম্যাকবেথ, যা, পালা! দূর হ এখান থেকে। আমি তোকে একটুও ভয় পাই না।

স্বামীকে ধমকে চাপা স্বরে পুনরায় বললেন লেডি ম্যাকবেথ, তোমার কি কোনও হাঁশ নেই? তোমার হাবভাব দেখে সবাই চাপা স্বরে ফিসফাস করছে। তুমি কি বুঝতে পারছি না তোমার আচরণে তাদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে! ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা যে এখানে আসেনি তার প্রমাণসে এলে সবাই তাকে দেখতে পেত। রাজার মৃত্যুর আগে তুমি যেমন মনের ভুলে হাওয়ায় ছুরি ভাসতে দেখতে, এখনও তেমনি ব্যাংকের প্ৰেতাত্মাকে দেখছি। আমি পুনরায় বলছি এ সব তোমার ভ্ৰম। যাও, তুমি নিজের জায়গায় গিয়ে খেতে বস। নইলে সব কিছু পণ্ড হয়ে যাবে।

স্ত্রীর কাছে বকুনি খাবার পর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন ম্যাকবেথ। নিজের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেটা বিলকুল ফাকা— ধারে-কাছেও নেই ব্যাংকের প্রেতাত্মা। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সবার মঙ্গল কামনা করে তিনি যখন পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেবেন। ঠিক সে সময় তার সামনে হাজির ব্যাংকের প্রেতাত্মা। স্ত্রীর ধমক, হাঁশিয়ারি ও পরিস্থিতির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন ম্যাকবেথ, ব্যাংকের প্ৰেতাত্মাকে প্রচণ্ড গালাগাল দিয়ে বললেন, বাঘ, সিংহ, গণ্ডার তুমি যাই হও না কেন, আমি একটুও ভয় পাই না তাতে। কিন্তু তোমার ওই বীভৎস প্রেতিমূর্তি আমার চোখে অসহ্য। যাও, দূর হয়ে যাও..আমার সামনে থেকে। আর কখনও

ম্যাকবেথের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় অতিথিরা বিরক্ত হয়ে খাওয়া শেষ হবার আগেই আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। রাজার সন্দেহজনক আচরণের ব্যাপারে কথা-বার্তা বলতে বলতে ফরেসএর রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গেলেন তারা।

 

নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একমাত্র ম্যাকডাফই আসেনি, তা নজরে পড়েছে ম্যাকবেথের। তিনি গোপনে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলেন মৃত রাজা ডানকানের বড়ো ছেলে ম্যালকম ইংল্যান্ডে পালিয়ে গিয়ে সেখানকার রাজা এডওয়ার্ডের আশ্রয়ে রয়েছেন। ম্যাকডাফও রয়েছেন সেখানে।

সিংহাসনে বসেই প্ৰজাপালনের বদলে ম্যাকবেথ শুরু করলেন নিপীড়ন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। স্কটল্যান্ডের লোক। রাজা ডানকানের হত্যা, দুই ছেলের ইংল্যান্ডে পলায়ন, ব্যাংকের মৃত্যু, এরূপ ঘটনা দেখে ম্যাকবেথের উপর নানারূপ সন্দেহ জাগল প্রজাদের মনে।

ম্যাকবেথের অত্যাচারে তার বিরুদ্ধে প্ৰচণ্ড ক্ষোভ জমা হতে লাগল প্রজাদের মনে। তাদের অনেকেই ঈশ্বরের কাছে এই বলে প্রার্থনা জানাতে লািগল ম্যালকম যেন ইংল্যান্ডের রাজার সাহায্য নিয়ে ম্যাকবেথকে সিংহাসনচ্যুত করেন। তার বিরুদ্ধে জনতার আক্রোশ যেদিন দিন বেড়ে চলেছে তা জানতে পেরে ঘাবড়ে গেলেন ম্যাকবেথ।

রাজা হবার ব্যাপারে যে তিনজন ডাইনির ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, তাদের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠলেন ম্যাকবেথ। তাদের খোঁজে চারদিকে লোক পাঠালেন তিনি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন প্রাসাদ থেকে দূরে বনের ভেতর এক পাহাড়ি গুহায় তাদের ডেরা। কিন্তু স্ত্রীকে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র জানালেন না তিনি। একদিন রাতে যখন তার স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ঘোড়ায় চেপে রওনা হলেন সেই পাহাড়ের উদ্দেশে।

সাধনার উপকরণ হিসেবে ডাইনিরা তাদের আস্তানায় নরকের আগুন জেলে তাতে বসিয়েছে লোহার এক বিরাট কড়াই। তাতে সেদ্ধ হচ্ছে বিষধর সাপের দাঁত, কুকুরের জিভ, ব্যাং-এর ঠ্যাং, নেকড়ের দাঁত, ছাগল, চমরি গাই, নাস্তিক ইহুদির লিভার, তুর্কি সেপাইর কাটা নাক কতোর সৈনিকের কাটা ঠোট— এমনই আরও কত জিনিস। ম্যাকবেথ যে তার ভবিষ্যৎ জানতে আসবে একথা আগেই ডাইনিদের জানিয়ে দিয়েছেন উপদেবী জ্যাকেট— যিনি আবার অশুভ ও অমঙ্গলের নিয়ন্ত্রক।

আমার সব প্রশ্নের জবাব দাও— ম্যাকবেথের মুখে একথা শোনা মাত্ৰই ডাইনিত্ৰয় শুয়োরের রক্ত এবং হত্যাকারীর চর্বি আগুনে ঢেলে জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ করতে লাগল। সাথে সাথেই শোনা গেল বাজ পড়ার প্রচণ্ড আওয়াজ। সেই আওয়াজের রেশমিলিয়ে যেতে না যেতেই আগুনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল লোহার শিরস্ত্ৰাণ পরিহিত এক বিদ্রোহী মুণ্ডু।

গদগদ স্বরে ম্যাকবেথ বললেন, হে প্ৰেতাত্মা! তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

প্রথম ডাইনি বলল, তুমি কী প্রশ্ন করবে তা ও জানে। শুধু মন দিয়ে শুনে যাও ও কী বলে।

সেই ধড়বিহীন মুভূ তার নাম ধরে ডেকে বলল, ম্যাকবেথ! তুমি সাবধান থেকে ফিফির অধিপতি ম্যাকডাফ সম্পর্কে। ওর চেয়ে বড়ো শত্রু আর কেউ নেই তোমার। আমার যা বলার তা বলে দিলাম। এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেল দেহহীন মুণ্ডু।

ম্যাকবেথ বললেন, তুমি যেই হও, আমাকে সাবধান করে দেবার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে আমার যে আরও কিছু জানার ছিল।

দ্বিতীয় ডাইনি বলল, ও আর তোমার প্রশ্নের জবাব দেবে না। চোখ-কান খোলা রাখ। এবার যে আসছে সে প্রথম জনের চেয়েও শক্তিশালী। তার কথা শেষ হতেই আগুনের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এল এক শিশুর প্ৰেতাত্মা। তার সারা দেহ থেকে ঝরিছে তাজা রক্ত।

সেই প্ৰেতাত্মা বলে উঠল, ম্যাকবেথ! স্বাভাবিক ভাবে জন্মেছে এমন কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। মানুষের শক্তিকে ভয় পেও না তুমি। সাহসের সাথে নিজের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়ে যাও। এই বলে অদৃশ্য হয়ে গেল শিশুর প্ৰেতাত্মা।

আপন মনে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, তাহলে ম্যাকডাফ, তুমিই আমার সবচেয়ে বড়ো শত্রু। তাই কিছু করার আগেই এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেব তোমাকে। তুমি বেঁচে থাকতে প্ৰচণ্ড দুৰ্যোগের রাতেও ঘুমোতে পারব না আমি।

তার কথার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আবির্ভূত হল আর এক প্ৰেতাত্মা। এও দেখতে শিশু, তবে এর মাথায় মুকুট আর ডান হাতের মুঠোয় ধরা রয়েছে একটি গাছ।

ম্যাকবেথ ডাইনিদের কাছে জানতে চাইলেন, মাথায় মুকুট, হাতে গাছ, এর মানে কী?

তৃতীয় ডাইনি জবাব দিল, কথা না বলে মনোযোগ দিয়ে শোন ও কী বলতে চায়।

তার নাম ধরে সেই প্ৰেতাত্মা বলল, ম্যাকবেথ। যতক্ষণ পর্যন্ত না বার্নাসের ঘন অরণ্য ডানসিনান পাহাড়ের উপর দিয়ে উঠে ম্যাকবেথের প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও শক্ৰ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।

তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যাকবেথ বললেন, জঙ্গল কখনও পাহাড়ের উপর উঠতে পারে না। এটা প্রকৃতির নিয়ম-বিরুদ্ধ। তবে এতকথা যখন বললে, তখন আর একবার বল ব্যাংকের ছেলেরা কি সত্যিই রাজা হবে?

তিন ডাইনি এক সাথে বলে উঠল, বাধা দিলেও ও শুনবে না। তার চেয়ে ওকে সেই দৃশ্যটা এমন ভাবে দেখিয়ে দাও যাতে প্ৰচণ্ড দুঃখেও ওর মন ভারাক্রাস্ত থাকে।

তাদের কথা শেষ হতে না হতেই রাজার পোশাকপরা আট জন পুরুষের ছায়ামূর্তি আগুন থেকে বেরিয়ে ম্যাকবেথের সামনে দিয়ে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল।সবশেষে বেরিয়ে এল ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা। ব্যাংকের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে রইল সেই প্ৰেতাত্মা। কিছুক্ষণ আগেই রাজার পোশাকপরা যে আটজন ছায়ামূর্তি ম্যাকবেথের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল, তারা যে ব্যাংকেরই বংশের, সেটা তার হাসিমুখ দেখে সহজেই আন্দাজ করলেন ম্যাকবেথ। ডাইনিদের ডেরা থেকে বেরিয়ে নিজ প্রাসাদে ফিরে এলেন ম্যাকবেথ। কিছুক্ষণ বাদে এক গুপ্ত ঘাতককে পাঠিয়ে দিলেন ম্যাকডাফের প্রাসাদে। সে সময় ম্যাকডাফের স্ত্রী আর শিশুপুত্র ছাড়া আর কেউ ছিল না প্রাসাদে। ম্যাকবেথের পাঠানো গুপ্তঘাতক খুন করল তাদের।

ম্যাকবেথের অত্যাচারে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল মানুষের ক্ষোভ। এবার তার সাথে যোগ হল কিছু অমাত্য এবং সামন্ত রাজাদের ক্ষেভ। রস ছিলেন এদের নেতা-যিনি একদা রাজা ডানকানের অমাত্য ছিলেন। ম্যাকবেথকে না জানিয়ে তিনি ইংল্যান্ডে এসে দেখা করলেন ম্যালকমের সাথে। দেশে ফিরে এসে ম্যাকবেথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পরামর্শ দিলেন ম্যালকমকে। তিনি বললেন, যুবরাজ! আপনি যদি দেশে ফিরে ম্যাকবেথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, তাহলে আমাদের মেয়ে-বউরাও ঘর ছেড়ে যোগ দেবে আপনার সাথে।

ম্যালকম বললেন, দেশের পরিস্থিতি যদি সত্যিই এরূপ তাহলে আমি নিশ্চয়ই যাব। রস। আপনি জেনে রাখুন সৈন্য ও অস্ত্ৰ দিয়ে আমায় সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাজা এডওয়ার্ড। ম্যাকবেথের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওর প্রধান সেনাপতি সিওয়ার্ডও আমার সাথে যাবেন বলে জানিয়েছেন।

রস খুব খুশি হলেন এই দেখে যে বিদেশে এসেও চুপচাপ বসে না থেকে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ম্যালকম। এরপর তিনি ম্যাকডাফকে জানালেন কীভাবে গুপ্তঘাতক এসে তার খোজ না পেয়ে হত্যা করে গেছে তার স্ত্রী-পুত্রকে। রসের মুখে এই দুঃসংবাদ শুনে ম্যাকডাফের চোখের জল আর বাধা মানল না। কিছুক্ষণবাদে চোখের জল মুছে তিনি ম্যালকম আর রসের সামনে প্ৰতিজ্ঞা করলেন, ম্যাকবেথকে নিজ হাতে হত্যা করে এ অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেন।

এদিকে পাগলের দশা হয়েছে লেডি ম্যাকবেথের (যতক্ষণ জেগে থাকেন, মাঝে মাঝেই জল দিয়ে দু-হাত ধুয়ে নেন। হাত ধোবার সময় বিড়বিড় করে বলেন, এত রক্ত কেন আমার হাতে? বারবার জল ঢালছি অথচ রক্তের দাগ মুছে যাচ্ছে না! দিন-রাত সব সময় একটা উত্তেজনার মধ্যে রয়েছেন তিনি। ঘুম তার চোখ থেকে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। রাত্রে যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, গোটা প্রাসাদ জুড়ে তিনি পায়চারি করেন। রাজবৈদ্য এসে তাকে পরীক্ষা করে কিছু ওষুধ দিয়ে গেলেন। কিন্তু তাতে তার রোগ সারল না। হতাশ হয়ে রাজবৈদ্য বললেন, এ দেহের রোগ নয়, মনের। যতদূর জানি, সাবধানে থাকাই এর একমাত্র ওষুধ। এ রোগের ক্ষেত্রে কখনও কখনও আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। তাই সাবধান করে দিচ্ছি। রোগিণীর হাতের কাছে ধারালো অস্ত্ৰ, আগুন, বিষ, দড়ি, এসব জিনিস যেন না থাকে।

মানসিক রোগে লেডি ম্যাকবেথ আক্রান্ত হবার কিছুদিন বাদেই ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ডের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্কটল্যান্ড আক্রমণ করলেন তার প্রধান সেনাপতি সিওয়ার্ড। তার সাথে যোগ দিলেন যুবরাজ ম্যালকম, ম্যাকডাফ, রস এবং অন্যান্য বিদ্রোহী স্কটিশ থেন ও সৈন্যরা।

এখবর পেয়েও নিশ্চিন্তে বসে রইলেন ম্যাকবেথ, কারণ ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি জানেন শক্রি তার বাড়ির দোরগড়ায় এসে পড়লেও তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তারা।

শত্রুসৈন্যের দ্বারা দেশ আক্রান্ত হয়েছে আর তাদের আগে রয়েছেন যুবরাজ ম্যালকম, শুধু এটুকু শুনেই মারা গেলেন লেডি ম্যাকবেথ। একটু বাদেই দূত এসে জানাল বার্নাসের জঙ্গল ধীরে ধীরে উঠে আসছে ডানসিনান পাহাড়ে।

খবরটা শুনে দূতকে ধমকিয়ে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, কী বলছিস যা তা? হতভাগা কি দিনদুপুরে নেশা করেছিস? ও বলে কিনা জঙ্গল পাহাড়ে উঠে আসছে। আরে, জঙ্গলের কি আমাদের মতো হাত-পা আছে যে তারা উপরে উঠে আসবে?

দূত বলল, আজ্ঞে মহারাজ, আমি নেশাও করিনি। আর মিথ্যেও বলছি না। আমার কথায় বিশ্বাস না হলে অনুগ্রহ করে আপনি বরং একবার নিজে গিয়ে দেখে আসুন।

দূতের কথা সত্যি কিনা যাচাই করতে ম্যাকবেথ ছুটে এলেন প্রাসাদের বারান্দায়, দেখলেন সত্যি সত্যিই বার্নাসের জঙ্গল উঠে আসছে ডানসিনান পাহাড়ের চূড়ায়। কিছুক্ষণ ভালোভাবে লক্ষ করে দেখার পর ম্যাকবেথ বুঝতে পারলেন। ওগুলো আসল জঙ্গল নয়। ইংরাজ সৈন্যরা বনের গাছ-পালা দিয়ে এমন ভাবে তাদের শরীরকে আড়াল করে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে পাহাড়চূড়ায় উঠে আসছে, যাতে দূর থেকে তাদের দেখলে মনে হবে সত্যিই যেন একটা গোটা জঙ্গল উঠে আসছে পাহাড়ের উপর।

ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হতে দেখে বেজায় ভয় পেয়ে গেলেন ম্যাকবেথ।

এমন সময় আরেকজন দূত এসে বলল, মহারাজ, ইংরেজ সেনাপতি সিওয়ার্ড তার বিশাল বাহিনী সহ পৌঁছে গেছেন আমাদের প্রধান ফটকের প্রায় কাছাকাছি —তার সাথে রয়েছেন যুবরাজ ম্যালকম, ম্যাকডাফ এবং অমাত্য রস। এছাড়াও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন দেশের অনেক বিশিষ্ট থেন, অমাত্য এবং সৈনিকেরা।

দূতের কথা শেষ হতে না হতেই বেজে উঠল ইংরেজ সৈন্যদের রণ-দামামা। প্রাসাদে যে কয়জন সৈনিক অবশিষ্ট ছিল, তারাও বাঁপিয়ে পড়ল ইংরেজ সৈন্যদের উপর। প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হল দুন্দলে। কিছুক্ষণ বাদে রক্ষীদের হতাহত করে সসৈন্যে প্রাসাদে এসে ঢুকলেন ম্যাকডাফ তলোয়ার উচিয়ে ম্যাকবেথের সামনে গিয়ে বললেন, শয়তান, তুই এখানে? তোকে নিজ হাতে খুন না করা পর্যন্ত শান্তি পাবে না। আমার মৃত স্ত্রীর-পুত্রের আত্মা।

ম্যাকবেথ বললেন, আমাকে অযথা ভয় দেখিও না ম্যাকডাফ। মাতৃগৰ্ভ থেকে স্বাভাবিক ভাবে জন্ম নিয়েছে এমন কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ আমার দেহ মায়াবলে সুরক্ষিত। ম্যাকডাফ বললেন, তাহলে তুমিও শুনে রাখা ম্যাকবেথ, আমি অযোনিসস্তুত। অকালে সময়ের আগেই মাতৃগৰ্ভ ভেদ করে জন্ম হয়েছে আমার।

ম্যাকবেথ বললেন, তাহলে ম্যাকডাফ, তুমিই আমার একমাত্র শত্রু। তোমার কথা শুনে আমার সংশয় মিটে গেছে। আমি চাই না তোমার সাথে যুদ্ধ করতে।

তাহলে তুমি আত্মসমর্পণ করা, বললেন ম্যাকডাফ। তোমার হাত-পা শেকল দিয়ে বেঁধে খাচায় বন্দি করে রাখব তোমাকে। তিলতিল করে মৃত্যু-যন্ত্রণা সহ্য করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে তুমি।

দোহাই তোমার, মিনতি জানিয়ে বললেন ম্যাকবেথ, অমন শাস্তি তুমি আমায় দিও না। মানছি, অনেক অপরাধ করেছি আমি। তবুও খাঁচার মধ্যে বন্দি জানোয়ারের মতো ঘৃণ্য জীবনযাপন করতে পারব না আমি। তার চেয়ে আমায় মেরে ফেল, তবু ওরূপ সাজা দিও না।

মনোবল বলতে তখন আর কিছুই নেই ম্যাকবেথের। ভয়ে ভয়ে তলোয়ার হাতে নিয়ে থারথার করে কাঁপিতে লাগলেন তিনি। তৎক্ষণাৎ ম্যাকডাফ কাঁপিয়ে পড়লেন তার উপর। ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ম্যাকবেথ। শত্রুকে বাগে পেয়ে ম্যাকডাফ এসে দাঁড়ালেন তার পাশে, এক কোপে কেটে ফেললেন ম্যাকবেথের মাথা। সেই কাটা মাথা হাতে নিয়ে ম্যাকডাফ গেলেন ম্যালকমের কাছে। ম্যালকমকে মাথাটা উপহার দিয়ে বললেন, এই সেই শয়তানের কাটা মুণ্ডু যে আমার বাবাকে হত্যা করেছিল, গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে আমায় না পেয়ে মেরে ফেলেছিল আমার স্ত্রী-পুত্রকে। যুবরাজ, আজ থেকে স্কটল্যান্ডের সিংহাসনের অধিকারী আপনি।

সমস্বরে সবাই জয়ধ্বনি করে উঠল, জয়! স্কটল্যান্ডের রাজা ম্যালকমের জয়।

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০১

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট 
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
ভাষান্তর: অজয় দাশগুপ্ত ও অরবিন্দ চক্রবর্তী

ইতালি দেশের এক সুন্দর শহর ভেরোনা—প্রাচীনত্ব আর ঐতিহ্যপূর্ণ। রাজা ছাড়াও এদেশে রয়েছে আরও দুটি অভিজাত পরিবার, ধন-সম্পত্তি আর ক্ষমতার দিক দিয়ে রাজার চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নয়। এ দুটি বংশের একটি ক্যাপুলেট, অন্যটি মন্টেগু।

বংশ দুটি ধনী ও অভিজাত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে চিরকালীন শত্রুতা। এ শত্রুতা যে কবে শুরু হয়েছিল তা সবার অজানা। উভয়ের সম্পর্কটা ঠিক সাপে-নেউলের মতো। উভয় পরিবারের শত্রুতার প্রভাব তাদের চাকর-বাকরদের মধ্যেও পড়েছে। রাস্তা-ঘাটে যখনই যেখানে দেখা হয়, কোনও না কোনও অজুহাতে একে অপরের সাথে ঝগড়া বাধায়, মারামারি করে—যার পরিসমাপ্তি হয় রক্তপাতে।

একদিন সাতসকালে ক্যাপুলেট পরিবারের দুই চাকর স্যামসন আর গ্রেগরি এসে হাজির হল শহরের এক জনবহুল ব্যস্ত এলাকায়—তাদের উদ্দেশ্যে মন্টেগু পরিবারের চাকরদের সাথে ঝগড়া বাধানো।

বিরক্তি মেশান স্বরে গ্রেগরিকে বলল স্যামসন, ‘আমি তোকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি গ্রেগরি, এভাবে প্রতিদিন কয়লার বোঝা বইতে পারব না আমি।’

‘ঠিকই বলেছি,’ বলল গ্রেগরি, ‘ও কাজ করলে আমরা সবাই আমাদের কয়লাখনির কুলি-কামিন বলবে।’

গলাটা সামান্য চড়িয়ে বলল স্যামসন, ‘দেখ গ্রেগরি! তুই কিন্তু ভুলে যাস না আমি বেজায় রাগী। রাগ হলেই আমি তলোয়ার বের করি।’

‘যা! যা! তোর আবার রাগ আছে নাকি’—স্যামসনকে ইচ্ছে করে তাতিয়ে বলল গ্রেগরি।

‘দ্যাখ গ্রেগরি! ভালো হচ্ছে না কিন্তু’—খেঁকিয়ে বলল স্যামসন। ‘জানিস! মন্টেগুদের বাড়ির একটা কুকুর আজ আমার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে।’

জবাবে কী যেন বলতে চাচ্ছিল গ্রেগরি, এমন সময় তার চোখে পড়ল মন্টেগু বাড়ির দুজন বয়স্ক চাকর, আব্রাহাম আর বালথাজার তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।

‘ওরে স্যামসন! মন্টেগু বাড়ির ধেড়ে চাকর দুটি যে এদিকেই আসছে। নে! এবার তো তলোয়ার বের কর’—বলল গ্রেগরি।

একটি ভেবে নিয়ে স্যামসন বলল, ‘নারে! আগে ওদেরই শুরু করতে দে। তাহলে আইন আমাদের পক্ষে থাকবে।’

‘বেশ তাই হলে’—বলল গ্রেগরি। ‘চল, আমরা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে আমি কিন্তু বারবার ভ্রু কুঁচকিয়া এক চোখ বুজে ওদের ভ্যাভাব।’

‘উঁহু, ওতে কোনও কাজ হবে না,’ বলল স্যামসন। ‘বরঞ্চ ওদের দিকে আমি বুড়ো আঙুল নাচাব। দেখবি, ঠিক কাজ হবে তাতে।’

তাদের উদ্দেশ্য করে বুড়ো আঙুল নাচানো দেখে মন্টেগুদের একজন বয়স্ক চাকর আব্রাহাম এগিয়ে এসে বলল, ‘ওহে ছোকরা! তুমি আমাদের বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছ?’

‘বেশ করেছি, দেখাবই তো’, গলা চড়িয়ে বলল স্যামসন। ঠিক তখনই তাকে পেছন থেকে চিমটি কাটল গ্রেগরি। চিমটি খেয়েই সুর পালটে বলল স্যামসন, ‘না, ঠিক তোমাদের নয়, আমি এমনই বুড়ো আঙুল নাচাচ্ছি।’

গ্রেগরি জানতে চাইল, তোমরা কি আমাদের সাথে ঝগড়া বাধাতে চাও?’

‘ঝগড়া। তোমাদের সাথে?’ অবাক হয়ে বলল আব্রাহাম, ‘বলা নেই, কওয়া নেই, অহেতুক ঝগড়া করতে কেন যাব?’

একগুঁয়ের মতো বলল স্যামসন, ‘ধরো, ভুলবশতই তোমরা ঝগড়া করতে চাইছ আমাদের সাথে। তাহলে কিন্তু ছেড়ে দেব না তোমাদের। আমরাও জানি কীভাবে বিবাদ বাধাতে হয়।’

পরিহাসের সুরে বলল আব্রাহাম, ‘আমার মতো বলছে কেন, আমার চেয়ে বেশি জান না বোধ হয়?’

কানে কানে স্যামসনকে বলল গ্রেগরি, ‘অকে বলে দে তোমার চেয়ে ভালো জানি।’

‘ঠিক বলেছিস’ বলেই নির্বোধের মতো আঙুল নাচাতে নাচাতে বলল স্যামসন, ‘তোমার চেয়ে ভালো জানি কী করে ঝগড়া বাধাতে হয়।’

এতক্ষণে রেগে গিয়ে বলল আব্রাহাম, ‘ওহে মিথ্যেবাদী ছোকরা! আমার সাথে ঝগড়া করার মুরোদ নেই তোমার।’

কথা শুনে ফুঁসে উঠে বলল স্যামসন, ‘দাঁড়াও, আমাকে মিথ্যেবাদী বলার মজা দেখাচ্ছি তোমায়’, বলেই খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আব্রাহামের উপর। আত্মরক্ষার জন্য আব্রাহামও বাধ্য হল তলোয়া বের করতে। ওদিকে স্যামসনের দেখাদেখি গ্রেগরিও তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল বালথাজারের উপর।

ওদের এভাবে লড়াই করতে দেখে ছুটে এলেন সেনর বেলভোলিও। নিজের তলোয়ার বের করে ওদের থামাতে থামাতে বললেন, ‘ওরে গাধার দল! কী করছিস তা জানিস তোরা। ফেলে দে তলোয়ার। থামা তোদের লড়াই।’

ঠিক সেসময় ক্যাপুলেট গিন্নির ভাইপো টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। বেনভোলিওকে দেখে সে বলল, কী হে বেনভোলিও। এসব ছোটোলোক চাকর-বাকরদের ব্যাপারে তুমি আবার নাক গলিয়েছ কেন? লড়ার ইচ্ছে হলে আমার সাথে লড়। বের কর তোমার তলোয়ার। চিরদিনের মতো তোমার সাধ মিটিয়ে দেব।’ বলেই তলোয়ার হাতে টিবল্ট ছুটে এল বেনভোলিওর দিকে।

বেনভোলিও জবাব দিলেন, ‘তুমি ভুল করছ টিবল্ট। আমি ওদের মিটমাটের চেষ্টা করছি।’

‘কী বললে, খোলা তলোয়ার হাতে শান্তিরক্ষা?’ হেসে উঠে বললেন টিবল্ট, ‘শুনে রাখ, মন্টেগু পরিবারের সবাইকে আমি চরম ঘৃণা করি। তোমরা শেয়াল-কুকুরের চেয়েও হীন। নাও, এবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও’—বলেই খোলা তলোয়ার হাতে বেনভোলিওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টিবল্ট। এবার শুরু হয়ে গেল লড়াই। খোলা রাস্তার উপর ক্যাপুলেট আর মন্টেগু পরিবারের দুই সদস্য ও দু-জোড়া চাকর নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মেতে উঠল। নিমেষের মধ্যে রটে গেল ক্যাপুলেট আর মন্টেগুরা ফের শুরু করেছে নিজেদের মধ্যে লড়াই। খবর পেয়ে শান্তিরক্ষক তার কয়েকজন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে সেখানে এলেন। দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত করতে কয়েকজন স্থানীয় নাগরিকও সেখানে গেলে অস্ত্র হাতে।

নাগরিকদের উদ্দেশ্য করে শান্তিরক্ষক বললেন, ‘ধর ব্যাটাদের। মেরে শেষ করে দে সব কটাকে। এমন শিক্ষা দিবি যাতে চিরকালের জন্য ওদের মারামারির শখ মিটে যায়।’

‘মন্টেগু আর ক্যাপুলেট, দুপক্ষই নিপাত যাক’—বলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল নাগরিকরা। দাঙ্গাবাজ দু-পক্ষকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে জমে উঠল লোকের ভিড়, হই-হট্টগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি। মারামারির খবর পেয়ে ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তা স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। গোলমাল দেখে স্ত্রীকে বললেন, ‘শয়তানগুলো বুঝি আবার মারামারি শুরু করেছে?’ যাও তো, কাউকে বাড়ি পাঠিয়ে আমার তলোয়ারগুলি নিয়ে আসতে বল। তারপর দেখাচ্ছি ওদের মজা।

বুড়োকর্তার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি বুড়ো মানুষ। তলোয়ার দিয়ে কী করবে? তার চেয়ে বরং সেই ঠেঙ্গোটা পাঠিয়ে দেই যাতে ভরে দিয়ে তুমি চলা-ফেরা কর।’

‘নাঃ নাঃ ঠেঙ্গোতে হবে না, তলোয়ারই চাই আমার। দেখছ না, বুড়ো মন্টেগু তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে ওরও হাতে রয়েছে তলোয়ার।’

ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাকে দেখামাত্রই হেঁকে উঠলেন মন্টেগুদের বুড়ো কর্তা, ‘অ্যাই বদমাস ক্যাপুলেট! যদি বাঁচতে চাস তো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক। মোটেই বাধা দিবি না আমার কাজে।’

স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে মন্টেগু গিন্নিও বলে উঠলেন, ‘সাবধান করে দিচ্ছি তোদের। আর একপাও এগুবি না।’

এবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের বুড়ো-বুড়িদের মাঝে।

সে সময় ভেরোনার রাজা এসকেলাস তার সভাসদদের নিয়ে সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। গণ্ডোগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ঘোড়া থামিয়ে তিনি সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর দাঙ্গাবাজদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আবার তোমরা রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়েছ? ভালো চাও তো সবার হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দাও।’ রাজার আদেশে সবাই তলোয়ার ফেলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

এরপর মন্টেগু আর ক্যাপুলেট—দুই বুড়োর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রাজা বললেন, ‘আপনারা দুজনেই বয়স্ক লোক, কোথায় আপনারা থামাবেন, তা নয়, তলোয়ার হাতে দুজনেই ছুটে এসেছেন। এই নিয়ে পরপর তিনবার এরূপ কাণ্ড ঘটল শহরে। আমি আপনাদের সাবধান করে দিচ্ছি ভবিষ্যতে এরূপ কাণ্ড ঘটলে আমি বাধ্য হব আপনাদের সবার প্রাণদণ্ড দিতে। যান! হাতের তলোয়ার ফেলে নিজ নিজে কাজে চলে যান।’ এরপর ক্যাপুলেটদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি চলুন আমার সাথে। আর হ্যাঁ মন্টেগু, আপনি আজ দুপুরের বিচারসভায় যাবেন। আমার যা বলার সেখানেই বলব’—বলেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন রাজা।

সবাই চলে যাবার পর মন্টেগু পরিবারের বুড়ো কর্তা জিজ্ঞেস করলেন তার ভাইপোকে, ‘আচ্ছা, বলতো কী হয়েছিল? কে আবার নতুন করে ঝগড়াটা বাধাল?’

কাকার প্রশ্নের জবাবে সেনর বেনভোলিও বললেন, ‘সে সময় আমি এপথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দু বাড়ির কয়েকজন চাকর তলোয়ার নিয়ে লড়াই করছে। আমি ওদের ছাড়াতে গেছি এমন সময় কোথা থেকে খবর পেয়ে টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। টিবল্টের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকেও তলোয়ার বের করতে হয়। এরপরই শুরু হল বেজায় লড়াই। ভাগ্যিস সে সময় এপথ দিয়ে আসছিলেন রাজামশাই। তিনি সাবধান করে দিলেন সবাইকে। নইলে দেখতে পেতেন দু-চারটে লাশ রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।’

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, রোমিও ছিল না সেখানে—’ বললেন মন্টেগু গিন্নি, ‘তুমি জান এখন সে কোথায়?’

বেনভোলিও বললেন, ‘আমার মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। খুব সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি বেরিয়েছিলাম পথে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম শহরের পশ্চিম অঞ্চলে। তখন দেখলাম একটা গাছের নিচে পায়চারি করছে রোমিও। আমাকে দেখেই পা চালিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। সেসময় নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিব্রত ছিলাম আমি। আতি ওকে আর ডাকিনি। শুনতে পেলাম রোমিওকে নাকি প্রায়ই এই বনে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।’

 রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০২

বৃদ্ধ মন্টেগুর একমাত্র ছেলে রোমিও। সে একজন সুন্দর-সুপুরুষ-স্বাস্থ্যবান যুবক। সে শুধু সুন্দরই নয়, আচার-আচরণেও খুব ভদ্র। তার মতো সাহসী, বীর সে অঞ্চলে খুব কমই আছে। এক কথায় সে একজন আদর্শ তরুণ।

বেশ ক’দিন ধরেই মন খারাপ রোমিওর। এর কারণ এক রূপসি যুবতি—নাম রোজালিন। রোমিও চায় তাকে বিয়ে করতে কিন্তু রোজালিন মোটেও খুশি নয় তার উপর। বেশ কিছুদিন ধরে রোজালিন না আসায় রোমিওর মন এতই খারাপ যে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পর্যন্ত দেখা করছে না সে। পাগলের মতো শুধু বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মধ্যে একজন মন্টেগু কর্তার ভাইপো সেনর বেনভোলিও, অপরজন রাজার আত্মীয় মার্কুলিসও। দাঙ্গা বন্ধ হবার পর রোমিওকে খুঁজতে খুঁজতে তারা এসে হাজির হল সেই গভীর জঙ্গলে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখা পেল রোমিওর। যার জন্য রোমিওর এ অবস্থা, সেই রোজালিনকে নিয়েও হাসি-ঠাট্টা করল তারা। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে বন্ধুদের অনুনয় করে বলল রোমিও, ‘ভাই, যে ভাবেই হোক তোরা ব্যবস্থা করে দে যাতে অন্তত একবার তার দেখা পাই।’

অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে যখন তারা রাস্তায় কথাবার্তা বলছিল, সে সময় একজন লোক এসে একটা কাগজ মেলে ধরল তাদের সামনে। কাগজটা আর কিছু নয় একটা তালিকা। তারা পড়ে দেখলে ওতে রয়েছে ভেরোনার সব সম্ভ্রান্ত বংশের নারী-পুরুষদের নাম, বাদ গেছে শুধু মন্টেগু পরিবার। যে লোকটা কাগজ নিয়ে এসেছিল সে ক্যাপুলেটদের বাড়ির চাকর—সম্পূর্ণ নিরক্ষর। কাগজে কী লেখা তা সে জানেনা—ক্যাপুলেট বাড়ি কর্তা-গিন্নিরও জানা নেই সেটা। তারা ওর হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়েই বলেছেন—’এতে যাদের যাদের নাম লেখা আছে তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আসবি। তাদের বিনীতভাবে বলবি তারা যেন আজ রাতে আমাদের বাড়িতে নৈশভোজনের আসরে যোগ দেন। সেই সাথে নাচ-গানের ব্যবস্থার কথাটাও বলে আসবি।’

‘তাই হবে কর্তা’—বলে কাগজখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সে। সে যে সম্পূর্ণ নিরক্ষর একথাটা লজ্জায় জানাতে পারেনি মনিবকে। কাজেই রাস্তা-ঘাটে যাকে পাচ্ছে, তাকে দিয়েই কাগজটা পড়িয়ে নিচ্ছে। ক্যাপুলেটদের সাথে মন্টেগুদের চিরকালীন রেষারেষির ব্যাপারটা জানত চাকরটি। কিন্তু রোমিও ও তার দু-বন্ধুকে জানতে না সে। জানলে কখনই সে কাগজটি তাদের পড়তে দিত না।

তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠল রোমিও, ‘আরে! এযে দেখছি চাঁদের হাট বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে। শহরের সম্ভ্রান্ত বংশীয় স্ত্রী-পুরুষ কেউ বাদ নেই এতে।’ লোকটিকে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে রোমিও বলল, তা ভাই এদের কোথায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে?’

লোকটি উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হুজুর, উপরে।’

‘কী বললে, উপরে! তা সে জায়গাটা কোথায়?’ জানতে চাইল রোমিও।

‘আজ্ঞে, রাতের বেলা আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়েছে এদের সবাইকে। কর্তা বলেছেন নাচ-গানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে’—উত্তর দিল লোকটি।

‘তা তোমার মনিবটি কে বাপু?’ জানতে চাইল রোমিও।

‘ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাই আমার মনিব’—বলল লোকটি, তবে আপনি যদি মন্টেগুদের কেউ না হন, তাহলে অনায়াসে সেখানে যেতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে। সেখানে গিয়ে রাতে খাওয়া-দাওয়া করবেন। আচ্ছা হুজুর! তাহলে আসি’—বলে চলে গেল লোকটি।

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৩

রোজালিন নামটাই বারবার ঘুরতে লাগল রোমিওর মাথায়। ঐ তালিকায় রোজালিনের নামও রয়েছে। সে স্থির করল যা হয় হোক, শুধু রোজালিনকে দেখতেই ক্যাপুলেটদের নৈশ ভোজের আসরে যাবে। রোমিওর ভাবনা আন্দাজ করে তাকে ঠাট্টা করে বলল বেনভোলিও, ‘আরে এরে ভাববার কী আছে। রোজালিনের জন্য মন যখন এতই খারাপ, তখন ঝুঁকি নিয়েই ক্যাপুলেটদের বাড়ি গিয়ে দেখে এস তাকে।’

বন্ধু যে ঠাট্টা করছে তা বুঝতে না পেরে রোমিও বলল, ‘যাবই তো, গিয়ে প্রাণ ভরে দেখে আসব তাকে।’

বেনভোলিও বলল, ‘বেশ তো, যাও। হয়তো আজই তোমার শেষ দিন। রোজালিনকে দেখার পর এককোপে তোমার গর্দান নামিয়ে দেবে ক্যাপুলেটরা।

কার্কুসিও বলল, ‘যত ঝুঁকি আর বিপদের ভয় থাকুক না কেন, তোমার কিন্তু সেখানে যাওয়া উচিত। ভেরোনার সুন্দরীরা সেজেগুজে জড় হবে সেখানে। তাদের মধ্যে কাউকে মনে ধরে গেলে রোজালিনকে ভুলে যাবে তুমি—কেটে যাবে তোমার মোহ।’

রোমিও স্থির করল মোহ কাটাতে নয়, প্রাণভরে রোজালিনকে দেখার জন্যই ঝুঁকি সত্ত্বেও ক্যাপুলেটদের বাড়ির নৈশভোজের আসরে যাবে সে। তবে সে একা যাবে না, সাথে থাকবে দু-বন্ধু মার্কুসিও আর বেনভোলিও। তিন বন্ধু স্থির করল শত্রুর চোখে-ধুলো দেবার জন্য তারা ছদ্মবেশ ধরে যাবে।

ফুল আর আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে ক্যাপুলেটদের প্রাসাদসম বাড়িটা। ভেরোনার অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা নাচ-গানে মেতে উঠেছে ভিতরের বিশাল হলঘরে। তাদের দেখলে মনে হবে রূপ-যৌবন যেন উপচে পড়েছে তাদের দেহে—তারা যেন মর্তের মানুষ নয়, রূপকথার কাল্পনিক স্বর্গ থেকে যেন তারা নেমে এসেছে। দামি পোশাক পরিধান করে ক্যাপুলেটদের বুড়োকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছেন হলঘরের দরজায়। তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির একজন সুন্দরী পরিচারিকা—তার হাতের সাজিতে সাজানো রয়েছে একগুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপ কুঁড়ি।

কিছুক্ষণ বাদে সেখানে এসে পৌঁছালেন কাউন্ট প্যারিস। তাকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্থ হয়ে পড়লেন বুড়োকর্তা। কাউন্ট শুধু দেখতে সুন্দর নন, প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক তিনি। তার সাধ হয়েছে বুড়োকর্তার একমাত্র মেয়ে জুলিয়েটকে বিয়ে করার।

বহুদিন হল মারা গেছে বুড়োকর্তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা। বেঁচে আছে শুধু চোদ্দ বছর বয়সি জুলিয়েট। কাউন্ট প্যারিসের সাথে জুলিয়েটের বিয়েতে আপত্তি নেই বুড়োকর্তার, কিন্তু তিনি চান না এখনই বিয়ে হয়ে যাক এই ছোট্ট মেয়েটার। তিনি কাউন্টকে বলেছেন মেয়েটার ষোলো বছর বয়েস হলে তিনি তার বিয়ে দেবেন। দু-বছর যথেষ্ট সময়। কাউন্ট ইচ্ছে করলে এ সময় জুলিয়েটের সাথে মেলামেশা করতে পারেন। বুড়োকর্তার তরফে এ নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। আর এ মেলামেশার ফলে কাউন্টকে ভাবী স্বামী বলে মেনে নেবার জন্য মানসিক দিক দিয়ে তৈরি হতে পারবে। এ কথা অবশ্য ঠিক যে জুলিয়েটের মতো বয়েসে তার গিন্নি অনেকগুলি সন্তানের মা হয়েছিলেন।

গায়ক-বাদকদের ছদ্মবেশে অতিথিদের মধ্যে মিশে গিয়ে রোমিও ও তার দু-বন্ধু এক সময় ঢুকে পড়ল ক্যাপুলেটদের প্রাসাদের ভিতরে। এরা কেউ ক্যাপুলেট পরিবারের সদস্যদের ধারেকাছেও ভেড়েনি। বাড়ির মেয়েরা যেখানে সমবেত হয়েছে, তাদের তিনজোড়া চোখ সেখানেই খুঁজে বেড়াচ্ছে রোজালিনকে। কিন্তু রোজালিনকে খুঁজতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি রোমিও আর তার দুই বন্ধু।

তার দু-বন্ধু বারবার তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ‘ওভাবে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থক না, সামনে এগিয়ে চল।’ কিন্তু সেদিকে কোনও হুঁশ নেই রোমিওর। পলকহীন দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে সে চেয়ে আছে আর মাঝে মাঝে বন্ধুদের বলছে, ‘কে-রে ভাই ওই মেয়েটা? দোহাই তোদের, ওর নামটা একবার জেনে আয় না।’

কিন্তু মন্দ ভাগ্য রোমিওর। তাই মেয়েটির পরিচয় জানার আগেই ক্যাপুলেটরা জেনে গেল রোমিওর আসল পরিচয়। তার পরিচয়টা যে জানল সে হল ক্যাপুলেট পরিবারের সবচেয়ে শয়তান লোক টিবল্ট—মন্টেগুদের নাম শুনলে যে তেলে-বেগুলে জ্বলে ওঠে। সে একটা চাকরকে ডেকে বলল, ‘যা দৌড়ে গিয়ে, আমার তলোয়ারটা নিয়ে আয়।’

চাকরটা তলোয়ার আনতে যাবে এমন সময় সেখানে এসে পৌঁছলেন ক্যাপুলেট বাড়ির বুড়োকর্তা। টিবল্ট যে চাকরকে ডেকে তলোয়ার আনতে বলেছে সে কথাটা শুনেছেন তিনি আর তাতেই বুঝে গেছেন কোনও একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে।

বুড়ো কর্তা টিবল্টকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে রে তোর? অযথা কেন মাথা গরম করছিস আজকের দিনে?’

দূর থেকে রোমিওকে দেখিয়ে বলল টিবল্ট, ‘আমি অযথা মাথা গরম করছি না। ওই যে বাজনাদারের পোশাক পরা ছেলেটিকে দেখছ, ও হল মন্টেগু বাড়ির রোমিও। নিশ্চয়ই ওর কুমতলব আছে, নইলে ছদ্মবেশে আসবে কেন। আমি ওর কান দুটো কেটে নেব তলোয়ার দিয়ে।’

টিবল্টের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন বুড়োকর্তা, তারপর বললেন, ‘তোমার সাবধান করে দিচ্ছি আমি। রাজার ধমক খাবার পরও তোর শখ মেটেনি লড়াই করার? আমি তো নিজে দেখেছি রোমিওকে। কী সুন্দর ওকে দেখতে। তাছাড়া শত্রু হওয়া সত্ত্বেও সে নিজে যখন আমাদের বাড়িতে এসেছে তখন সে আমাদের অতিথি। তাকে সম্মান না হয় না জানালি, তাই বলে তার কান কেটে নিবি? এ কেমন কথা? ক্যাপুলেট বাড়ির ছেলের মুখে এ কথা সাজেনা। আমার সাবধানবাণী সত্ত্বেও যদি তুমি ওর গায়ে হাত তোল, তাহলে তার ফল তুমি একাই ভোগ করবে। বিচারের সময় আমি কিন্তু তোমাকে বাঁচাতে যাব না। সে কথা মনে রেখ।’ বুড়োকর্তার ধমকানিতে শেষমেষ ঠাণ্ডা হল টিবল্ট।

ক্যাপুলেটরা যে রোমিওকে চিনতে পেরেছে সে কথা কিন্তু তখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি সে। তার মন পড়ে রয়েছে সেই অল্পবয়সি সুন্দরী মেয়েটির দিকে। সে জানে সুন্দরী মেয়েদের মন জয় করার উপায় হল সাহসে ভরে করে তাদের সাথে যেতে আলাপ করা। কিছুদূর গিয়ে বন্ধুদের চোখের আড়ালে পাঁচিল টপকে সে লাফিয়ে পড়ল ক্যাপুলেটদের বাগানে। এতসব হই-হট্টগোলের মাঝেও সে যেচে গিয়ে আলাপ করছে মেয়েটির সাথে। মেয়েটি বেশ ভালোভাবেই কথাবার্তা বলেছে তার সাথে। তাই দেখে রোমিও ধরে নিল মেয়েটিরও নিশ্চয় পছন্দ হয়েছে। কিন্তু অসুবিধা এই মেয়েটির নাম পর্যন্ত জানে না সে। সেটাই সবসময় খোঁচাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটির ধাই-মা এসে ‘জুলিয়েট’ বলে ডাকল তাকে। আর তখনই রোমিও জানতে পারল মেয়েটির নাম ‘জুলিয়েট’। ধাই-মাকে জিজ্ঞেস করে রোমিও জানতে পারল জুলিয়েট সবে তেরো ছেড়ে চোদ্দে পা দিয়েছে—আর ক্যাপুলেট কর্তার একমাত্র কন্যা সে।

মনে মনে আক্ষেপ করে রোমিও বলল, ‘হায় ভগবান। একি হল? এই পরমাসুন্দরী মেয়েটি কিনা আমাদের চিরশত্রু ক্যাপুলেট কর্তার একমাত্র মেয়ে?’ কিন্তু শত্রুর মেয়ে হলে কী হবে? প্রথম দেখা থেকেই রোমিও এত ভালোবেসে ফেলেছে জুলিয়েটকে, যে তার পক্ষে কোনও মতেই সম্ভব নয় জুলিয়েটকে ছেড়ে থাকা।

আবার একই সমস্যার মাঝে পড়েছে জুলিয়েট। রোমিওকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে খুবই ভালো লেগে গেছে জুলিয়েটের। এখন নিজের উপরই রাগ হচ্ছে কেন সে সময় ছেলেটির নাম জেনে নেয়নি। তবে সে লক্ষ করেছে ছেলেটি ধাইমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার সাথে কথা বলছিল। তাই সে ধাইমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা ছেলেটির নাম কী?’

কোন ছেলেটির কথা জুলিয়েট জানতে চাইছে সেটা বুঝতে প্রেও মুখে বলল ধাইমা, ‘কার কথা বলছ মেয়ে? অনেক ছেলেই তো এসেছিল। নেচে-গেয়ে, খেয়ে-দেয়ে তারা সবাই বিদায় নিল।’

আদুরে মেয়ের মতো ধাইমার গলা জড়িয়ে বলল জুলিয়েট, ‘ওই যে গো ধাইমা, রাজপুত্তুরের মতো দেখতে সেই সুন্দর ছেলেটা—যার পরনে ছিল বাজনাদারের পোশাক, আবার নাচিয়েদের মতো রংও মেখেছিল মুখে। আমি সেই ছেলেটার কথা বলছি যখন আমায় ডাকতে এসে তুমি তার সাথে কথা বলছিলে।’

ধাইমা বলল, ‘এত ছেলে এল গেল, সে সব বাদ দিয়ে ওকেই কিনা তোর পছন্দ হল’ বলেই নিজেকে সামলিয়ে নিলে সে। তারও একদিন রূপ-যৌব ছিল। সে জানে অপরিচিত ছেলের নাম জানার জন্য কমবয়সি মেয়েরা কত না আগ্রহী হয়। ধাইমার মনে হল আগে রোমিওর পরিচয় জানিয়ে দিলে তার উপর থেকে জুলিয়েটের আকর্ষণ আপনা থেকেই উবে যাবে।

জুলিয়েটের কানের কাছে মুখটা নিয়ে ধাইমা বলল, ‘তুমি ওই ছেলেটার নাম জানতে চাইছ? ও হল আমাদের চিরশত্রু মন্টেগুদের একমাত্র বংশধর—নাম রোমিও। তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি এ বাড়িতে ওর নাম উচ্চারণ করবে না তুমি। তাহলে কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। রোমিও এ বাড়িতে আসায় ওর কান কেটে নিতে চেয়েছিল টিবল্ট। অনেক বকাঝকা করে তাকে ঠাণ্ডা করেছেন বুড়োকর্তা।

ভেরোনার অল্পবয়সি ছেলেদের মাঝে রোমিওর মতো সুপুরুষ, স্বাস্থ্যবান, সুন্দর যুবক আর কেউ নেই সে কথা জানে জুলিয়েট। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল যখন সে জানতে পারল রোমিও তাদের পরম শত্রু মন্টেগু বাড়ির ছেলে।

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৪

গভীর রাত। শত চেষ্টা করেও ঘুমোতে পারছে না জুলিয়েট। বারবারই তার মনে পড়ছে রোমিওর কথা, সেই সাথে কেটে যাচ্ছে ঘুমের রেশ। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়ল সে। চেয়ে দেখল একপাশে কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে ধাইমা। সে যাতে টের না পায় এমনভাবে খাট থেকে নেমে এল জুলিয়েট। মোববাতির ক্ষীণ আলোতে মোটেও দেখা যাচ্ছে না খোলা জানালার নিচে বিশাল বাগান, গাছপালা, ফুল, আর লতাপাতা। এতক্ষণে রোমিও আর মন্টেগুদের কথা ভেবে মাথা গরম হয়ে উঠেছিল তার। বাগানের এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ার স্পর্শে জুড়িয়ে গেল তার মন।

কখন যে তার অজান্তে আক্ষেপের সুরে কথাগুলি বেরিয়ে এল জুলিয়েটের মুখ থেকে, ‘রোমিও! কেন তুমি জন্মেছিলে মন্টেগু বংশে? তুমি কি জান না সেতাই আমাদের মিলনের পথে প্রধান অন্তরায়? তুমি যদি নামটা পালটে নাও তাহলে এমন কী ক্ষতি হবে তোমার? তুমি কি জান না যে নামে কিছু আসে যায় না—গোলাপকে যে নামেই ডাক, তার সুগন্ধ নষ্ট হয় না?’

অনেক আগেই রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্যাপুলেটদের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছে রোমিও ও তার দু-বন্ধু। কিছুদূর যাবার পর বন্ধুদের অজান্তে ক্যাপুলেটদের প্রাচীর টপকে বাগানের ভেতর লাফিয়ে পড়ল রোমিও। রোমিওকে না দেখে তার দু-বন্ধু বেনভোলিও আর মার্কুসিও বহুক্ষণ ডাকাডাকি করল তাকে। কিন্তু কোন সাড়া পেল না। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও রোমিও ফিরে না আসায় তারা যে যার বাড়িতে চলে গেল।

বাগানে নেমে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় সে এসে পৌঁছাল জুলিয়েটের ঘরের জানালার নিচে। এমন সময় উপর থেকে জুলিয়েটের আক্ষেপ তার কানে এল। সে মুখ তুলে উপর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। এখন থেকে রোমিও না বলে ‘প্রিয়তম’ বলে ডেক আমাকে।’

রোমিওর গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে জুলিয়েট বলল, ‘কে তুমি নিচে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে আমার কথা শুনছ?’

রোমিও বলল, ‘নিজের পরিচয়টা না হয় গোপনই থাক। কারণ নিজের নামটাকে ঘেন্না করি—ওটাই আমার পরম শত্রু।’

খুশিভরা গলায় বলল জুলিয়েট, ‘তুমি না বললেও আমি চিনতে পেরেছি তোমায়। তুমি নিশ্চয়ই রোমিও, তাই না?’

রোমিও উত্তর দিল, ‘যদি ও নামটা তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে ধরে নাও ওটা আমার নাম নয়।’

জুলিয়েট জানতে চাইল, ‘আমাদের বাগানের এত উঁচু পাঁচিল টপকে কীভাবে ভেতরে এলে তুমি?’

রোমিও বলল, ‘কোনও বাধাই প্রেমিককে ঠেকাতে পারে না। সাহস থাকলে প্রেমিক যে কোনও কাজ করতে পারে।’

জুলিয়েট বলল, ‘তুমি তো জান আমার পরিবারের লোকদের, তোমায় পেলে তারা খুন করে ফেলবে।’

আবেগ মেশানো গলায় বলল, ‘সে ভয় নেই আমার। তোমাকে দেখার জন্য তলোয়ারের আঘাত সইতেও রাজি আমি।’

এমন সময় ঘুম ভেঙে গেল ধাইমার। জুলিয়েটকে বিছানায় দেখতে না পেয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল সে।

জুলিয়েটের নাম করে বেশ কয়েকবার ডাকল ধাইমা। সে আওয়াজ কানে যেতে রোমিওকে সাবধান করে দিয়ে দ্রুত এসে বিছানায় শুয়ে পড়ল জুলিয়েট। কিন্তু শুয়েও ছটফট করতে লাগল সে। বারবার ছুটে এল জানালার সামনে। নিচে তখনও রোমিও দাঁড়িয়ে। সারারাত জেগে তার সাথে ভালোবাসার অনেক কথা বলল জুলিয়েট। ভোর হবার সাথে সাথে বাগান থেকে বেরিয়ে গেল রোমিও। যাবার আগে জুলিয়েটের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিল রোমিও যে সে তাকে ভালোবাসে, বিয়ে করতেও রাজি আছে তাকে। জুলিয়েট প্রতিশ্রুতি দিল বেলা হবার আগে সে ধাইমাকে পাঠিয়ে দেবে তার কাছে—রোমিও তার মারফত জানিয়ে দেবে কখন কোথায় তাদের বিয়ে হবে।

সময় পেলেই শহরের বাইরে বেরিয়ে আসে রোমিও—চলে যায় লরেন্স নামে সংসার ত্যাগী এক সন্ন্যাসীর কাছে—নানা বিষয়ে আলোচনা হয় তাদের মধ্যে। সন্ন্যাসীও খুব ভালোবাসেন রোমিওকে। সেদিন শেষরাতে ক্যাপুলেটদের বাগান থেকে বেরিয়ে বাড়িতে না ফিরে রোমিও গিয়েছিল সন্ন্যাসীর কাছে। জুলিয়েটকে সে ভালোবাসে এবং বিয়ে করতে চায়—সে কথা সন্ন্যাসীকে বলেছিল রোমিও। আর এও বলেছিল এ ব্যাপারে তারা পরস্পরকে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কিন্তু ব্যাপারটা সারতে হবে গোপনে। জানাজানি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে—কারণ ক্যাপুলেট আর মন্টেগু, উভয় পরিবারের লোকেরাই চেষ্টা করবে সর্বশক্তি দিয়ে এ বিয়ে বন্ধ করার। হয়তো দু-চারটে লাশও পড়ে যেতে পারে।

রোমিও সন্ন্যাসীকে অনুরোধ করে বলল, ‘প্রভু! সব কথাই তো আপনাকে খুলে বললাম। এবার আপনি বিয়ে দেবার দায়িত্ব নিয়ে আমাদের বাঁচান। সন্ন্যাসী ভেবে দেখলেন ক্যাপুলেট আর মন্টেগু, দুই পরিবারের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠলে হয়তো অবসান হবে তাদের চিরশত্রুতার। সে সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে তিনি রাজি হলেন রোমিওর অনুরোধে। সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে রোমিও ফিরে গেল বাড়িতে। সারারাত খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকার দরুন প্রচণ্ড ক্লান্ত তার শরীর, ঘুমে জড়িয়ে আসছে চোখ, ব্যথায় ছিঁড়ে যেতে বসেছে তার শরীর। কিন্তু এত বাধা-বিপত্তির মাঝেও সন্ন্যাসীর কাছ থেকে তার ও জুলিয়েটের বিয়ের আশ্বাস পেয়ে সব কিছুকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছে রোমিও।

বেলার দিকে জুলিয়েট তাই ধাইকে পাঠিয়ে দিল রোমিওর কাছে। ধাই মারফত রোমিও জানাল জুলিয়েটের সাথে তার বিয়ের সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে আছে। বিকেলের দিকে যদি সন্ন্যাসী লরেন্সের ওখানে যায়, তাহলে সেদিনই তাদের বিয়ে হয়ে যাবে—সন্ন্যাসী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের বিয়ে দেবেন। ফিরে গিয়ে ধাই সবকথা জানান জুলিয়েটক। গির্জায় যাবে বলে মার অনুমতি নিয়ে সে দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল জুলিয়েট। সবার অলক্ষে গিয়ে হাজির হল সন্ন্যাসী লরেন্সের ডেরায়। বিয়ের জোগাড় যন্তরের সব ব্যবস্থা আগে থেকেই করা হয়েছিল। এবার সন্ন্যাসী লরেন্স বিয়ে দিয়ে দিলেন রোমিও-জুলিয়েটের।

বিয়ের ক’দিন বাদেই দুর্ভাগতের ছায়া নেমে এল রোমিওর জীবনে। বেনভোলিও আর মার্কুসিওর সাথে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে গেল টিবল্টের। সেদিন উৎসবের রাতে রোমিওকে হাতের কাছে পেয়েও শায়েস্তা করতে না পারায় মনে মনে খুব ক্ষোভ ছিল টিবল্টের। আজ রাস্তায় রোমিওর দু-বন্ধু বেনভোলিও আর মার্কুসিওকে দেখতে পেয়ে বেজায় গালাগালি দিতে লাগল টিবল্ট। সে যে সহজে তাদের নিষ্কৃতি দেবে না একথা বুঝতে পেয়ে তারা চেষ্টা করলেন টিবল্টকে নিরস্ত করতে, ঠিক সে সময় সেখানে এসে হাজির হল রোমিও। তাকে দেখতে পেয়ে খাপ থেকে তলোয়ার বের করল টিবল্ট।

সব সময় বিবাহিত রোমিওর চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে স্ত্রী জুলিয়েটের কচি লাবণ্যভরা মুখখানি। টিবল্ট আবার সম্পর্কে জুলিয়েটের ভাই। তাই তাকে তো আর চট করে আঘাত করা যায় না। টিবল্টের কথায় রেগে না গিয়ে সে চেষ্টা করল তাকে শান্ত করতে, কিন্তু উলটো ফল হল তাতে। টিবল্ট ধরে নিল রোমিও একজন কাপুরুষ। তাই সে ইচ্ছে করেই মন্টেগু বংশের সবার নামে গালাগালি দিতে লাগল।

টিবল্টকে শায়েস্তা করা মোটেই শক্ত কাজ নয় রোমিওর পক্ষে। কিন্তু টিবল্ট যে জুলিয়েটের ভাই, সে কথা মনে ভেবে চুপ করে রইল সে। কিন্তু মার্কুসিওর কাছে অসহ্য মনে হল টিবল্টের ব্যবহার। সে তলোয়ার হাতে তেড়ে গেল টিবল্টের দিকে।

এবার সমস্যায় পড়ে গেলেন রোমিও—একদিকে জুলিয়েটের ভাই টিবল্ট, অন্যদিকে তার প্রধান বন্ধু মার্কুসিও, এদের যে কেউ আহত বা মারা গেলে চরম ক্ষতি হবে তার। তাদের বাঁচাতে রোমিও ঝাঁপিয়ে পড়লেন উভয়ের উদ্যত তলোয়ারের মাঝে। সাথে সাথে তার তলোয়ার সরিয়ে নিল মার্কুসিও, কিন্তু টিবল্ট তা করল না। রোমিওকে ঢালের মত ব্যবহার করে সে সজোরে আঘাত হানল মার্কুসিওর বুকে। মার্কুসিও আহত হয়ে মাটিতে পড়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদেই মৃত্যু হল তার।

এভাবে মার্কুসিওকে মরতে দেখে খুন চেপে গেল রোমিওর মাথায়। তখন জুলিয়েটের কথা আর মনে রইল না রোমিওর। সে তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল টিবল্টের উপর। তার তলোয়ার সোজা গিয়ে বিঁধল টিবল্টের হৃৎপিণ্ডে। সে আঘাতে রাস্তায় পড়ে গিয়ে ছটফট করতে করতে মারা গেল রক্তাক্ত টিবল্ট।

টিবল্টের মৃত্যু দেখে হুঁশ ফিরে এল রোমিওর। সে নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল উত্তেজনার বশে এরূপ কাজ করার জন্য। কিন্তু এবার কী হবে? কোন মুখে সে দাঁড়াবে জুলিয়েটের সামনে?

রাস্তার উপর পাশাপাশি পড়ে রয়েছে মার্কুসিও আর টিবল্টের মৃতদেহ দুটি। এদিকে কৌতূহলী জনতার ভিড়ও ক্রমশ বেড়ে উঠছে। অনেক দিনই ভেরোনার রাজা আদেশ দিয়েছিলেন রাজপথে যে দাঙ্গা বাধাবে তার প্রাণদণ্ড হবে। কার এত দুঃসাহস রাজাদেশ লঙ্খন করে ভর দুপুরে এমন কাণ্ড বাধাল! খবর পেয়ে রাজা নিজেই ছুটে এলেন ঘটনাস্থলে। রাজাকে সব কথা খুলে বললে বেনভোলিও। সে আরও জানান ক্যাপুলেট বাড়ির টিবল্টই প্রথম আক্রমণ শুরু করেছিল। মার্কুসিওর হত্যাকারী সে। আত্মরক্ষার খাতিরেই প্রতি-আক্রমণ করতে হয়েছিল রোমিওকে, তারই ফলে মারা যায় টিবল্ট। সে কথা শুনে প্রাণদণ্ডের পরিবর্তে রোমিওকে নির্বাসন দণ্ড দিলেন রাজা। রাজাদেশ তৎক্ষণাৎ ভেরোনা ছেড়ে মান্টুয়ায় আশ্রয় নিতে হল রোমিওকে। এমনকি জুলিয়েটের সাথে দেখার করার সময়টুকু পর্যন্ত তাকে দিলেন না রাজা।

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৫ (শেষ)

এই তো সবে বিয়ে হয়েছে রোমিও-জুলিয়েটের। এরই মধ্যে রোমিওর হাতে টিবল্টের মৃত্যু ও তার পরিণতিতে রোমিওর নির্বাসন দণ্ডের খবর শুনে যার-পর-নাই ভেঙে পড়ল জুলিয়েট। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়ে সর্বদাই সে কাঁদতে লাগল। বাবা, মা, বাড়ির সবাই নানাভাবে বোঝালেন তাকে—তা সত্ত্বেও জুলিয়েটের চোখের জল বাঁধা মানল না।

একমাত্র মেয়ের এরূপ অবস্থা দেখে বুড়ো ক্যাপুলেট বড়োই উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠলেন। তার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেল, রাতের ঘুম যে কোথায় পালিয়ে গেল তা কে জানে। শেষ অনেক ভেবেচিন্তে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে একটা উপায় খুঁজে পেলেন তিনি। তিনি তো কাউন্ট প্যারিসকে আগেই কথা দিয়েছেন যে জুলিয়েটের বিয়ে দেবেন। তিনি স্থির করলেন অযথা কাল-বিলম্ব না করে কাউন্টের সাথে জুলিয়েটের বিয়েটা চুকিয়ে দেবেন। স্বামী-স্ত্রী ধরে নিলেন বিয়ের আনন্দে টিবল্টের কথা ভুলে যাবে জুলিয়েট।

এবার জুলিয়েটের বিয়ের জোরদার আয়োজন শুরু হল। পরিবারের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘর-দোর সাজানো, রাতারাতি জুলিয়েটের জন্য গহনা গড়ানো, এ সবই হয়ে গেল। ব্যাপার-স্যাপার দেখে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ল জুলিয়েট। এর তো সবে মাত্র বিয়ে হয়েছে তার, আর তাও কিনা চিরশত্রু মন্টেগু পরিবারের রোমিওর সাথে—মরে গেলেও এ খবর তিনি জানাতে পারবেন না কাউকে। সে মিনতি জানিয়ে বাবা-মাকে বলল তার মনটা বড়োই চঞ্চল হয়ে আছে। এসময় তার বিয়ে দিলে বিয়ের কোনও আনন্দই উপভোগ করতে পারবে না সে।

কিন্তু জুলিয়েটের কাতর মিনতি ও চোখের জল সত্ত্বেও তার বাবার মন গলল না। তার অনুরোধের কোনও মূল্য দিলেন না তার বাবা। তিনি জুলিয়েটকে ডেকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন যে কাউন্ট প্যারিসের সাথেই তার বিয়ে হবে। এতে জুলিয়েট রাজি না হলে একবস্ত্রে তাকে বের করে দেবেন বাড়ি থেকে। আর যতদিন বেঁচে থাকবেন তার মুখদর্শন করবেন না।

একগুঁয়ে বাপের সিদ্ধান্ত শুনে খুবই মুশকিলে পড়ে গেল জুলিয়েট। সে ভেবে পেল না কীভাবে এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে। শেষমেশ তার মনে পড়ল সন্ন্যাসী লরেন্সের কথা—যিনি তাদের বিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে চলে গেল সন্ন্যাসীর আস্তানায়। সন্ন্যাসীকে সব কথা বলে তার পরামর্শ চাউল সে।

সবকথা শোনার পর সন্ন্যাসী তাকে বললেন, ‘দেখ, বাবার অবাধ্য হয়ো না। কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও তুমি। ও নিয়ে কান্না-কাটি করোনা। ফুলের তৈরি একটা ওষুধ আমি তোমায় দিচ্ছি। তুমি সেটা সাবধানে রেখে দিও। এটা যেন অন্য কারও হাতে না পড়ে। যে দিন তোমার বিয়ে হবে, তার আগের দিন রাতে এই ওষুধটা খেয়ে তুমি শুয়ো। এই ওষুধের প্রভাবে খুব শীঘ্র ঘুমিয়ে পড়বে তুমি—তখন মৃতের সমস্ত লক্ষণ দেখা দেবে তোমার দেহে। পরদিন সকালে তোমাকে দেখে সবাই ধরে নেবে তুমি মারা গেছ। তখন বাধ্য হয়ে তোমার বাবা বিয়ে বন্ধ করে তোমার মৃতদেহ গির্জায় পাঠিয়ে দেবেন কবর দেয়ার জন্য। গির্জার ভেতর ক্যাপুলেটদের একটা নিজস্ব ঘর আছে। পারিবারিক নিয়ম অনুযায়ী তোমার মৃতদেহ কমপক্ষে একদিন রাখা হবে সেখানে। আমি যে ওষুধটা তোমায় দিচ্ছি তার মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা। এর অর্থ রাত ফুরোবার আগেই ক্যাপুলেটদের সেই কক্ষে ঘুম ভেঙে যাবে তোমার। ঘুম ভেঙে গেলেই দেখবে তোমার কাশে বসে আছে রোমিও। তোমার জ্ঞান ফিরে এলেই রাতারাতি তোমায় মান্টুয়ায় নিয়ে যাবে রোমিও। নিশ্চিন্তে সেখানে ঘর বাঁধতে পারবে তোমরা। আমি এখনই একজন বিশ্বস্ত লোককে মন্টুয়ায় রোমিওর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি। রোমিওর যা যা করণীয় তাকে আগে থেকেই বলে আসবে সে। আশা করি এবার তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে।’

সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এল জুলিয়েট। বাবাকে ডেকে সে বলল, ‘বাবা! কাউন্টকে বিয়ে করতে রাজি আমি। তুমি যেদিন বলবে সে দিনই বিয়ে হবে।’

বাবা ভাবলেন সম্ভবত বাড়ি ছাড়ার ভয়েই জুলিয়েট রাজি হয়েছে কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে। যাই হোক, এবার তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়ের বিয়ের দিন-ক্ষণ স্থির করলেন।

সে দিন তার বিয়ে হবে তার আগের রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল জুলিয়েট। রোমিওর সাথে প্রথম পরিচয়ের রাতে যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রোমিও সারারাত তার সাথে কথা বলেছিল, সে দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে সন্ন্যাসী প্রদত্ত ওষুধটা খেয়ে ফেলল সে। একটু বাদেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।

পরদিন সকালে জুলিয়েটকে ডাকতে এসে ধাই দেখতে পেল মড়ার মতো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে জুলিয়েট। কাছে গিয়ে সে দেখল তা নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না, বুকের ধুকপুকুনি নেই, চোখের মণি ওপরে উঠে গেছে। ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ খবর দিল জুলিয়েটের বাবা-মাকে। তারা এসে মেয়ের অবস্থা দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথেই জুলিয়েটের বাবা চাকরকে পাঠিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। জুলিয়েটকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন বহু আগেই মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে বাড়িময় কান্নার রোল উঠল। বাড়ির সবাই বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।

মেয়ের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃতদেহটিক ফুলে সাজিয়ে কবর দেবার জন্য গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন জুলিয়েটের বাবা-মা। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী জুলিয়েটের মৃতদেহটি একদিন সমাধি ক্ষেত্রে রাখার ব্যবস্থা করা হল।

সন্ন্যাসী লরেন্সও চুপচাপ বসে ছিলেন না। একজন বিশ্বস্ত লোককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মান্টুয়ায় রোমিওর কাছে। কথা ছিল সেই লোক রোমিওকে সব কিছু খুলে বলবে এবং জুলিয়েটের মৃতদেহ সমাধিকক্ষে রাখা হলে সে রোমিওকে সেখানে নিয়ে আসবে। সন্ন্যাসী লরেন্স জানতেন জুলিয়েট যে ওষুধ খেয়েছে তার মেয়াদ কখন শেষ হবে। তিনিও রাতের বেলা সেখানে চলে আসবে যাতে ঘুম ভেঙে জুলিয়েট দেখে তাকে আর রোমিওকে। এরপর জুলিয়েটকে ভেরোনার সীমান্ত পার করিয়ে মান্টুয়ায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তারই।

অথচ রোমিওর দুর্ভাগ্য এমনই যে সন্নাসীর লোক পৌঁছাবার আগেই ভেরোনা ফেরত অন্য এক লোকের মুখে জানতে পারল জুলিয়েট মারা গেছে। জুলিয়েটের বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছিল কাউন্ট প্যারিসের সাথে। কিন্তু বিয়র নির্দিষ্ট দিনে ভোরের আলো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলিয়েটের। আগের রাতেই মারা গেছে সে। জুলিয়েটের মৃত্যুর কথা শুনে মন ভেঙে গেল তার। সে স্থির করল আত্মহত্যা করবে। এক ওঝার কাছ থেকে মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করে ভেরোনায় এসে পৌঁছাল সে। অনেক খোঁজ করেও সন্ন্যাসী লরেন্সের লোক খোঁজ পেন না রোমিওর।

আবার রোমিওর মত ঠিক একই অবস্থা হয়েছে কাউন্ট প্যারিসের। জুলিয়েটের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল প্যারিস। এবার জুলিয়েটের মৃত্যু-সংবাদ শুনে সে যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেল। পরদিন সকালেই জুলিয়েটকে সমাধি দেওয়া হবে শুনে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য সে রাতেই কাউন্ট এসে হাজির সেই সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু নিয়তি কী নিষ্ঠুর! তিনি আসার কিছু আগেই রোমিও এসেছে সেখানে। সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার আগে সে চারপাশে খুঁজে দেখছিল সেখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে কিনা।

কাউন্ট প্যারিস সমাধিকক্ষে ঢোকার সময় রোমিওকে হঠাৎ সেখানে দেখে বেজায় চমকে উঠলেন। তিনি জানেন তোমিও ক্যাপুলেটদের চিরশত্রু। কিছুদিন আগে ক্যাপুলেট বংশের টিবল্টকে হত্যার দরুন ভেরোনার রাজার যে রোমিওকে মান্টুয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছেন সে কথাও অজানা নেই তার। স্বভাবতই কাউন্টের মনে হল সীমান্ত পেরিয়ে এত রাতে এখানে কেন এসেছে রোমিও? নিশ্চয়ই তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে নইলে সে এখানে ঘোরাঘুরি করছে কেন। জুলিয়েটকে বিয়ে করতে না পারলেও কাউন্ট নিজেকে ক্যাপুলেটদের আত্মীয় বলেই মনে করেন। সে কথা মনে রেখে কাউন্ট তখনই তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রোমিওর উপর। সাথে সাথে রোমিও পালটা আক্রমণ করল কাউন্টকে। এ ধরনের চোরা-গোপ্তা আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিল রোমিও। কিন্তু তলোয়ারবাজিতে তার সাথে মোটেই পাল্লা দিতে পারলেন না কাউন্ট প্যারিস। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়লেন সমাধিকক্ষের দোরগোড়ায়। জুলিয়েটের নামটা কোনওমতে আউড়ে চিরকালের মতো নীরব হয়ে গেলেন তিনি।

শত্রু নিধনের পর রোমিও প্রবেশ করলেন জুলিয়েটের সমাধিকক্ষে। সেখানে ঢুকে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখতে পেলেন সামনেই একটা কফিনে শুয়ে আছে জুলিয়েট—প্রাণের স্পন্দন নেই শরীরে। সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের প্রভাব তখনও কাটেনি। জ্ঞান ফিরে আসতে দেরি আছে। কিন্তু রোমিও তো জানে না সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের কথা। তাই সে ধরে নিল জুলিয়েটের মৃত্যু হয়েছে। ওঝার দেওয়া বিষের শিশিটা বের করে শেষবারের মতো জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেল রোমিও। তারপর শিশির পুরো বিষটা ঢেলে দিল নিজের গলায়। বিষের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কিছুক্ষণ বাদেই জুলিয়েটের কফিনের পাশে শেষ নিশ্বাস ফেলল রোমিও।

ওষুধের প্রভাব কেটে যাবার পরই চোখ মেলে তাকাল জুলিয়েট। কফিনের বাইরে বেরিয়ে সে দেখল বরফ-ঠাণ্ডা মেঝের উপর শুয়ে আছে রোমিও। বহুবার ডেকেও তার কোনও সারা পেলনা জুলিয়েট। সন্দেহ হতে রোমিওর নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। ঠিক সে সময় তার নজরে এলো মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে একটা শিশি। শিশিটা কুড়িয়ে নিয়ে শুঁকতেই তীব্র গন্ধে তার নাক জ্বলে যেতে লাগল। শিশিতে যে তীব্র বিষ ছিল এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল জুলিয়েট। রোমিওর কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করে সজোরে নিজের বুকে বসিয়ে দিল জুলিয়েট। দু-একবার ছটফট করে চিরকালের মতো নিশ্চল হয়ে গেল তার দেহ।

সঠিক সময়ে সন্ন্যাসী লরেন্স এলেন সেখানে। রোমিও-জুলিয়েটের মৃতদেহ দেখে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।

খবর পেয়ে ক্যাপুলেট আর মন্টেগু—উভয় পরিবারের লোকেরা সেখানে ছুটে এল তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে। ভেরোনার রাজাও খবর পেয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। সন্ন্যাসী লরেন্স সবাইকে বলতে লাগলেন কীভাবে রোমিও-জুলিয়েট ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করেছিল আর নিষ্ঠুর নিয়তির প্রভাবে কীভাবে তা ধ্বংস হয়ে গেল। কীভাবে অতীতের সামান্য শত্রুতার জেরে তাদের উভয় পরিবারের জীবনে এমন সর্বনাশ নেমে এল সে কথা উপলব্দি করে সবার সামনে কেঁদে ফেললেন রোমিও ও জুলিয়েটের বাবা। হাতে হাত মিলিয়ে তারা ঘোষণা করলেন আজ থেকে সমস্ত বৈরিতার অবসান হল—সেই সাথে শপথ নিলেন ভেরোনা শহরের মাঝখানে তাঁরা রোমিও-জুলিয়েটের মর্মর মূর্তি স্থাপন করবেন।

হ্যামলেট, প্রিন্স অব ডেনমার্ক

এলসিনোর দুর্গ ডেনমার্কের রাজপ্রাসাদের ঠিক লাগোয়। রক্ষী ফ্রান্সিস রাত্ৰিবেলায় পাহারা দিচ্ছিল সেখানে। শীতরাত্রির প্রচণ্ড ঠান্ড পুরু চামড়ার পোশাক ভেদ করে গায়ের চামড়া, মাংস, হাড় সব যেন দীত বসাতে চাইছে, গায়ের রক্ত হিম হবার জোগাড়। রাত্রে পাহারা দেবার ব্যাপারটা খুবই আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে রুক্ষীদের কাছে। ভীতির কারণ অবশ্য একটাই। কয়েক রাত ধরেই দেখা যাচ্ছে একটা রহস্যময় প্রেতিমূর্তি দুর্গপ্রাচীরে এসে দাঁড়াচ্ছে। সেই মূর্তিটা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে রক্ষীদের দিকে। পাহারাদারদের মধ্যে যারা তাকে দেখেছে, তারা সবাই বলছে কী যেন বলতে চায় সেই রহস্যময় প্ৰেত মূর্তিটা, অথচ পারে না। রক্ষীদের কথা অনুযায়ী সেই মূর্তি দেখতে অবিকল প্রাক্তন রাজার মতো—যিনি মারা গেছেন। অল্প কিছুদিন আগে। প্রতি রাতে ঐ প্রেত মূর্তির দেখা পেয়ে, রক্ষীরা ভয় পেয়ে ব্যাপারটা কানে তুলেছে হোরেশিওর। হোরেশিও ছিল মৃত রাজার পুত্র হ্যামলেটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই আশ্চর্যজনক খবর শুনে খুবই বিস্মিত হয়েছেন হোরেশিও। রক্ষীদের কথার সত্য-মিথ্যে যাচাই করতে তিনি নিজেই আজ দুর্গে এসেছেন রাতের বেলায় পাহারা দিতে।

রাতের প্রহর নীরবে গড়িয়ে চলেছে দুর্গের পেটা ঘড়িতে বেজে ওঠা ঘণ্টার আওয়াজের সাথে সাথে। হোরেশিওর উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। শেষ রাতে সেই প্রেতিমূর্তি আবার এসে দাঁড়াল দুর্গপ্রাচীরে। হোরেশিও নিজেও অবাক হলেন হ্যামলেটের পিতা মৃত রাজার আদলের সাথে প্রেতিমূর্তির অবিকল মিল দেখে।

ঠিক তার পরদিনই তার বন্ধু হ্যামলেটকে সেই রহস্যময় প্রেতিমূর্তির আগমনের কথা জানালেন হোরেশিও। পিতার মৃত্যুকালে হ্যামলেট ছিলেন রাজধানীর বাইরে। বাইরে থেকে ফিরে আসার পর তিনি মায়ের মুখে শুনেছেন যে একদিন দুপুরে তার বাবা যখন বাগানে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন, এক বিষাক্ত সাপ সে সময় দংশন করে তাকে, আর তার ফলেই মারা যান তিনি। বাবার এই অপঘাত মৃত্যুতে হ্যামলেট খুব দুঃখ পেলেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মানসিক আঘাত পেলেন যখন তার বাবার মৃত্যুর পর কিছুদিন যেতে না যেতেই কাকা ক্লডিয়াস তার বিধবা মা রানি গারট্রডকে বিয়ে করে রাজা হয়ে বসলেন ডেনমার্কের সিংহাসনে। এ ব্যাপারটাকে দেশের লোকেরা খুশি মনে মেনে নিতে না পারলেও ভয়ে তারা মুখ বন্ধ করে রইল। বাবার মৃত্যুর ঠিক পরেই এই বিয়ে আর সিংহাসন অধিকারের ঘটনাকে কিছুতেই মনে-প্ৰাণে বিশ্বাস করতে পারছেন না হ্যামলেট। আবার হদিসও করতে পারছেন না। সত্যিই কী ঘটেছিল। একটা সন্দেহের দোলা! তার বন্ধু হোরেশিও ঠিক এ সময় তাকে শোনালেন সেই প্রেতিমূর্তির নিয়মিত আগমনের কথা। সেই মূর্তিটা নাকি দেখতে ঠিক তার বাবার মতো–কথাটা শুনে হ্যামলেট স্থির করলেন তিনি নিজে দাঁড়াবেন সেই মূর্তির সামনে।

সেদিন রাত প্রায় শেষের পথে, বন্ধু হোরেশিওর সাথে হ্যামলেট এলেন এলসিনোর দূগে পাহারা দিতে। সেই একই জায়গায় অন্যান্য দিনের মতো দেখা দিল প্রেতিমূর্তিটা। সেটা চোখ পড়ামাত্রই হ্যামলেট চেঁচিয়ে উঠে বললেন, বাবা! ডেনমার্কের রাজা! তিনি চেঁচিয়ে ওঠার সাথে সাথে সেই প্রেতিমূর্তিটা হাত নেড়ে ডাকল তাকে। কিছু বুঝতে না পেরে তিনি তাকালেন হোরেশিওর দিকে। তুমি নিৰ্ভয়ে এগিয়ে যাও, হ্যামলেট, তাকে আশ্বস্ত করে বললেন হোরেশিও, উনি হাত নেড়ে তোমাকে ডাকছেন। মনে হয়। উনি তোমাকে কিছু বলতে চান।

মোহাচ্ছন্নের মতো পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন হ্যামলেট। তাকে অনুসরণ করে কিছুদূর যাবার পর তিনি নিশ্চিত হলেন যে এই প্রেতিমূর্তিটা তার বাবারই। তিনি লক্ষ করলেন যে এই মূর্তিটার পরনে সেই একই পোশাক যা জীবিত অবস্থায় রাজা পরতেন।

শুভ বা অশুভ, যেরূপ প্ৰেতাত্মাই আপনি হন না কেন, চিৎকার করে বলল হ্যামলেট,  যে রূপেই আপনি আমার কাছে এসে থাকুন, আমি কথা বলতে চাই আপনার সাথে। আমাকে কিছু বলার থাকলে আপনি স্বচ্ছন্দে তা বলুন, রোজ রাত্রে আপনি কেন এভাবে এখানে আসেন?

চাপা স্বরে জবাব দিল সেই প্রেতিমূর্তি, হ্যামলেট! আমি তোমার নিহত বাবার প্ৰেতাত্মা।

চিৎকার করে বলে উঠল। হ্যামলেট, নিহত? কী বলছেন আপনি?

উত্তর দিল প্রেতিমূর্তি, আমার সব কথা আগে শোন। তোমার কাকা ক্লডিয়াসই হত্যা করেছে আমায়। একদিন আমি যখন বাগানে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলাম, সে সময় সবার নজর এড়িয়ে হেবোনা গাছের বিষাক্ত রস আমার কানে ঢেলে দেয় ক্লডিয়াস। আর ক্লডিয়াসের ঐ চক্রাস্তে তাকে সাহায্য করেছে আমার স্ত্রী, তোমারই গর্ভধারিণী গারট্রড। এ সব কারণে আমি খুব অশাস্তিতে আছি। হ্যামলেট, তুমি আমার একমাত্র সস্তান। সবকিছু বললাম তোমাকে। এ অন্যায়ের প্রতিবিধান তুমি করো, বিদায়! বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল সেই প্রেতিমূর্তি, আর বিস্ময়ে হতবাক হ্যামলেট তখন অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল দুর্গের ছাদের ওপরে। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বিশ্বাস করে প্ৰেতাত্মার মুখে শোনা সব কথা জানালেন বন্ধু হোরেশিও আর মার্সোল্লাস নামে এক রক্ষীকে। সেইসাথে এই প্রতিশ্রুতিও তিনি তাদের কাছ থেকে আদায় করলেন যে তারা কাউকে কিছু বলবে না।

যা দেখলাম আর তোমার কাছে শুনলাম, তা সবই অদ্ভূত, মন্তব্য করলেন হোরেশিও মৃত আত্মা কি কথা বলতে পারে?

আমাদের অজান্তে এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু ঘটছে যার কোনও উল্লেখ বা ব্যাখ্যা বইয়ে নেই। হোরেশিওকে জানালেন হ্যামলেট।

হ্যামলেটের মনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছে সে রাতের ঘটনা। একএক বার সে নিজমনে বলছে বাবার প্ৰেতাত্মার মুখে যা শুনলাম তা কি সত্য? সত্যি হলে অবশ্যই এর প্রতিবিধান আমায় করতে হবে, আবার পরীক্ষণেই তার মনে হল, শুধু প্ৰেতাত্মার মুখের কথায় বিশ্বাস করে প্রতিবিধান নেবার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা কি ঠিক? এর চেয়ে হাতে নাতে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও প্রমাণ কি সংগ্রহ করা যায় না যাতে আমি নিশ্চিত হতে পারি। কাকার পাপ সম্পর্কে?

হ্যামলেট পাগলের মতো হয়ে উঠলেন রাতদিন এ সব কথা ভেবে ভেবে। রাজ্যের বৃদ্ধ মন্ত্রী পলোনিয়াসের একটি ছেলে ছিল, নাম লিয়ার্টিস আর মেয়ের নাম ওফেলিয়া। দেখতে অপরূপ সুন্দরী ছিল ওফেলিয়া; ওফেলিয়া যেমন মনে-প্ৰাণে ভালোবাসত তরুণ হ্যামলেটকে তেমনি হ্যামলেটও ভালোবাসতেন তাকে। রাজ্যের সবাই মেনেইনিয়েছিল যে হ্যামলেটের সাথে ওফেলিয়ার বিয়ে হবে। হ্যামলেটের হাব-ভাব, কথাবার্তায় অস্বাভাবিকতার লক্ষণ দেখা গেছে —সবার মুখে একথা শুনে খুবই চিস্তার মাঝে পড়ে গেলেন পলোনিয়াস। হোক না হ্যামলেট রাজার ছেলে, কিন্তু বাবার মৃত্যুতে যিনি পাগল হতে বসেছেন, সে কথা জেনে কি তার সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়? আর বিয়ে দিলেও কি তার পরিণতি সুখের হবে? স্বাভাবিক কারণেই এ সব চিস্তা এসে দেখা দিচ্ছে পালোনিয়াসের মনে।

হ্যামলেট পড়েছেন সমস্যায়। বাবার মৃত্যুর পরও মাকড়সার জালের মতো এক চক্রান্ত যে তাকে ঘিরে ধরছে, সে কথা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কাউকে অপরাধী বা ষড়যন্ত্রের সাথে সরাসরি জড়িত বলে ধরতে পারছেন না। শেষে অনেক ভেবে-চিন্তে এ সমস্যা সমাধানের হদিস পেলেন তিনি–রাজা, রানি, পালোনিয়াস, ওফেলিয়া, সবার উপর আড়াল থেকে কড়া নজর রাখা দরকার। খুঁটিয়ে বিচার করা দরকার এদের সবার আচার-আচরণ, কথাবার্তা। আর সেকােজ সেই করতে পারে যাকে কেউ গ্রাহ্যের মধ্যে আনবেন না। অথচ সে সবার উপর নজর রাখতে পারবে। এই ভেবে হ্যামলেট এমন আচরণ করতে লাগলেন যেন তিনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। হ্যামলেটের অদ্ভুত আচরণ আর পাগলাটে কথাবার্তা শুনে রাজপ্ৰসাদের অধিবাসীরা সবাই খুব বিপন্ন হলেন। হ্যামলেটের পাগলামো কিন্তু নিছক পাগলামো নয়, অসংলগ্ন কথার ফাঁকে ফাকে তিনি এমন সব সরস অথচ তীক্ষা মন্তব্য ছেড়ে দেন যার খোঁচায় রাজা, রানি, পলোনিয়াস–সবাই তীব্র বেদনা পান মনে। আর ঠিক তখনই তাদের মনে প্রশ্ন জাগে হ্যামলেট কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন না। এসব নিছক পাগলামির ভান। এটা যদি পাগলামির ভান হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনও বদ। উদ্দেশ্য আছে! তাহলে সে উদ্দেশ্যটা কী ধরনের, সে চিন্তাও জেগে ওঠে তাদের মনে।

হ্যামলেটের এই ধরনের আচরণে সবচেয়ে বেশি ব্যথা পেল তার প্রেমিক ওফেলিয়া। যেমন দেখতে সুন্দর ওফেলিয়া তেমনি সরল তার খোলামেলা মন। কোনও কুটিলতার ছায়া এখনও পর্যন্ত পড়েনি সেখানে। তাই হ্যামলেটের এই অস্বাভাবিক আচরণে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেল ওফেলিয়া তার মনে।

এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলি। রাজার প্ৰেতাত্মার আর আবির্ভাব হয়নি এলসিনোর দুর্গ প্রাকারে। হ্যামলেট কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বাবার মুখ থেকে শোনা সে রাতের হতাশাজনক কথাবার্তাগুলি। তাকে অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে বলেছেন বাবার সেই প্রেতিমূর্তি। হ্যামলেট ঠিকই বুঝতে পেরেছেন কাদের অন্যায়ের কথা বলেছেন তার বাবা। কিন্তু তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, এক তিনি কী ভাবে সে অন্যায়ের প্রতিবিধান করবেন। অনেক ভেবে শেষমেশ তিনি এক বুদ্ধি বের করলেন। রাজপ্ৰসাদে নাটকের অভিনয় করতে সেসময় শহরে এসে জুটেছে একদল অভিনেতাঅভিনেত্রী। তিনি স্থির করলেন তাদেরই কাজে লাগাবেন রাজা-রানির মনোভাব যাচাই করতে। তাদের সাথে দেখা করে হ্যামলেট বললেন, তিনি একটা নাটক লিখেছেন যা তাদের দিয়ে তিনি অভিনয় করাতে চান রাজপ্রাসাদে। অভিনেতারা সবাই খুশি হল তার কথা শুনে। এতো তাদের কাছে আনন্দের কথা যে যুবরাজের লেখা নাটকে তারা অভিনয় করবেন। অভিনেতারা যে তার লেখা নাটকে অভিনয় করতে রাজি, সে কথা জেনে প্রাসাদে ফিরে এসে হ্যামলেট শুরু করলেন নাটক লিখতে। বিষয়বস্তু যদি জানা থাকে তাহলে কুশীলবদের মুখে সংলাপ বসাতে দেরি লাগে না। আর এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু তো আগে থেকেই স্থির হয়ে আছে। বাবার প্ৰেতাত্মার মুখে যে কাহিনি শুনেছিলেন হ্যামলেট, হুবহু তারই আদলে লিখতে হবে নাটক— কীভাবে রাজাকে সরিয়ে সিংহাসন দখল করতে রাজার ছোটো ভাইয়ের সাথে রানির চক্রান্ত, ঘুমন্ত রাজার কানে বিষ ঢেলে তাকে হত্যা করে শূন্য সিংহাসন দখল করা-এ সবই থাকবে নাটকে।

নাটক লেখা শেষ হলে হ্যামলেট তা পড়ে শোনালেন অভিনেতাদের। নাটকের কাহিনিটা তাদের খুবই পছন্দ হল। তারা চুটিয়ে মহড়া দিতে লাগলেন। মহলা চলতে চলতে নাটকের দিনক্ষণও স্থির হয়ে গেল।

নাটক অভিনয়ের দিন হ্যামলেট শুরুতেই রাজা রানির খুব কাছে এসে বসলেন। সেখান থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় তিনি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন তাদের হাব-ভাব। নাটক এগিয়ে যাবার সাথে সাথে হ্যামলেট স্পষ্ট বুঝতে পারলেন নতুন রাজা ক্লডিয়াসের মুখখানা কেমন যেন বিবৰ্ণ হয়ে পড়ছে। এর কিছুক্ষণ বাদে বাগানে ঘুমন্ত রাজার কানে বিষ ঢেলে দেবার দৃশ্যটা যখন সামনে এল, তখন আর সহ্য করতে পারলেন না ক্লডিয়াস। আসন ছেড়ে উঠে তিনি চলে গেলেন প্রাসাদের ভেতরে। হ্যামলেটের এও নজর এড়াল না যে তার মা রানি গারটুডিও ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট অস্থির হয়ে উঠেছেন। এবার আর কোনও সন্দেহ রইল না হ্যামলেটের মনে যে তার বাবা তাকে যে সমস্ত কথা বলেছেন তা সবই সত্যি। এবার নিশ্চিত হয়ে নাটক দেখতে দেখতে স্থির করলেন হ্যামলেট, অন্যায়ের প্রতিবিধান করার যে প্রতিজ্ঞা তিনি বাবার কাছে করেছেন তা অবশ্যই তাকে পালন করতে হবে। বাবার হত্যাকারীর সাথে তার যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, তিনি নিজ হাতে শাস্তি দেবেন তাকে।

নাটক অভিনয়ের শেষে রাজা ডাকলেন অভিনেতাদের, প্রশংসা করলেন তাদের দলগত অভিনয়ের। সাথে সাথে পারিশ্রমিক ছাড়াও বকশিশ দিলেন তাদের। শেষে রাজা জানতে চাইলেন এই নাটকের রচয়িতা কে। রাজা অবাক হয়ে ভু কুঁচকোলেন যখন তিনি শুনলেন তার ভাইপো হ্যামলেটই লিখেছেন এ নাটক। তিনি খুব ধাক্কা খেলেন। ভেতরে ভেতরে।

এদিকে দিনে দিনে বেড়েই চলল হ্যামলেটের পাগলামি। রানি এবং মন্ত্রী পালোনিয়াসের সাথে পরামর্শ করে রাজা ক্লডিয়াস স্থির করলেন যে হ্যামলেটকে এ রাজ্যে রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। যে করেই হোক, তাকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। তার মা রানি গারট্রড স্বয়ং দায়িত্ব নিলেন এ কাজের। ক্লডিয়াসের দুর্ভাবনাও কম নয়। হ্যামলেটকে নিয়ে। কারণ যে করেই হোক হ্যামলেট জানতে পেরেছেন যে তিনিই হত্যা করেছেন তার বাবাকে। এ পরিস্থিতিতে যে কোনও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যদি হ্যামলেট দেশে থাকেন।

মন্ত্রী পালোনিয়াসের লোক এসে হ্যামলেটকে জানাল বিশেষ কারণে রানি গারট্রড দেখা করতে চান তার সাথে। পলোনিয়াস ওদিকে আবার গারট্রডকে বললেন রানি মা! হ্যামলেটের সাথে দেখা করার সময় আপনি খুব স্বাভাবিক আচরণ করবেন। তাকে বলবেন, আপনি আর সইতে পারছেন না তার দুঃখ। আপনার কোনও ভয় নেই, আমি লুকিয়ে থাকব আপনার ঘরের পর্দার আড়ালে। আমার লোক গেছে তাকে খবর দিতে। এখনই এসে যাবেন তিনি, বলেই ঘরের পর্দার আড়ালে লুকোলেন পলোনিয়াস; কিছুক্ষণ বাদে মা মা বলতে বলতে হাজির হলেন হ্যামলেট। মার কাছে জানতে চাইলেন কেন তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে।

আমি মনে খুব আঘাত পেয়েছি তোমার আচরণে, বললেন রানি, তুমি দুঃখ দিয়েছ বাবার মনেও।

তা হতে পারে মা বললেন হ্যামলেট, তবে শুধু আমি নই, তুমিও দুঃখ দিয়েছ আমার বাবার মনে। হ্যা, তবে তুমি খুশি করতে পেরেছ দেশের বর্তমান রাজাকে, যিনি আবার তোমার বর্তমান স্বামী।

তুমি কি আমায় ভুলে গেছ হ্যামলেট? বললেন রানি।

না! আমি তোমায় মোটেও ভুলিনি, উত্তর দিলেন হ্যামলেট, মহান যিশুর নামে শপথ করে বলছি তোমায় আমি ভুলিনি। তুমি আমার গৰ্ভধারিণী মা, ডেনমার্কের রানি আর এখন আমার বাবার ভাইয়ের স্ত্রী।

কাঁদো কঁদো গলায় বলে উঠলেন রানি, হ্যামলেট! কেন তুমি এভাবে আমার সাথে কথা বালছ?

তুমি স্থির হয়ে বসো মা, বললেন হ্যামলেট, আমি একটা দৰ্পণ রাখছি তোমার সামনে। দর্পণ অর্থাৎ তোমার যাবতীয় অন্যায় ও দুষ্কর্মের কথা শোনাব তোমায়। সে সব শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে আসল চরিত্রটা কী। সেই সাথে এও বুঝতে পারবে কেন আমি তোমার সাথে এরূপ আচরণ করছি।

ছেলের কথা শুনে ভয় পেয়ে বলে উঠলেন রানি, তুই কি আমায় হত্যা করতে চাস হ্যামলেট? ওরে কে কোথায় আছিস, আমায় বঁচা।

রানির আর্তনাদ শুনে পর্দার আড়াল থেকেই বললেন পলোনিয়াস, ভয় নেই রানিমা। পর্দার আড়াল থেকে পুরুষের গলা ভেসে আসছে দেখে হ্যামলেট ধরেই নিলেন যে তার কাকা ক্লডিয়াস লুকিয়ে আছেন সেখানে। একথা মনে হতেই তিনি খাপখোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পর্দার উপর, যার আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন পলোনিয়াস। সজোরে সেই তলোয়ার বসিয়ে দিলেন পলোনিয়াসের বুকে। পলোনিয়াস আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে, চারিদিক ভেসে যেতে লাগল রক্তে।

হাঃ হাঃ এই ব্যাপার! আমি তো ভেবেছি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে চেচাচ্ছে একটা ইদুর: বলেই পাগলামির ভান করে হাসতে লাগলেন হ্যামলেট। দেখতে দেখতে এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল গেল যে মায়ের সাথে দেখা করতে এসে হ্যামলেট নিজ হাতে হত্যা করেছেন মন্ত্রীকে। এ খবর শুনে ভয়ে থর থর করে কেঁপে উঠল প্রাসাদের সবাই। ভয়ের কারণ একটাই, পাগলামিতে পেয়েছে হ্যামলেটকে। কে বলতে পারে পাগলামোর মুখে তিনি কখন কী করে বসবেন?

দেশের মানুষ ভালোবাসে হ্যামলেটকে। তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও রাজা ক্লডিয়াস এতদিন পর্যন্ত কোনও চেষ্টা করেননি তাকে মেরে ফেলার। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন যে কোনও ছুতোয় হ্যামলেটকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে তাকে হত্যা করার। আচমকা সে সুযোগ এসে গেল ক্লডিয়াসের হাতে, যখন হ্যামলেটের হাতে মারা গেলেন মন্ত্রী পালোনিয়াস। ভাইপোর জন্য যেন রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। এরূপ ভাব দেখিয়ে ক্লডিয়াস পরামর্শ দিলেন তার ভাইপোকে –অকারণে পলেনিয়াসকে হত্যা করে যে অন্যায় তিনি করেছেন, দেশবাসীর মন থেকে তা মুছে ফেলতে গেলে বেশ কিছুদিন তার বিদেশে গিয়ে কাটিয়ে আসা উচিত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ইংল্যান্ডই তার পক্ষে আদর্শ জায়গা।

তার প্রেমিক ওফেলিয়ার বাবা পলোনিয়াস। শুধু এ কারণে তাকে মেরে ফেলার জন্য মনে মনে খুব অনুতপ্ত হ্যামলেট। ওফেলিয়া মনে-প্ৰাণে ভালোবাসে হ্যামলেটকে। সেদিক থেকে কোনও কুটিলতা বা লোকদেখানো ভাব নেই ওফেলিয়ার মনে। শেষ পর্যন্ত সেই হ্যামলেটের হাতেই মারা গেলেন তার বাবা? ওফেলিয়া চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভাবে তার বাবার কথা। তার মনকে সে কিছুতেই মানাতে পারে না। হ্যামলেট বুঝতে পারলেন পাগলামোর ভান করতে গিয়ে পলোনিয়াসকে খুন করে তিনি খুবই ভুল করেছেন। এ ভুল শোধরাবার জন্য ক্লডিয়াসের ইচ্ছে মতো ইংল্যান্ডে যাওয়া ছাড়া তার সামনে অন্য কোনও রাস্তা নেই। ক্লডিয়াসকে তিনি জানালেন ইংল্যান্ডে যেতে কোনও আপত্তি নেই তার। ক্লডিয়াস মনে মনে হাসলেন ভাইপোর কথা শুনে। ভাইপোর ইংল্যান্ডে যাবার সব ব্যবস্থাই করে দিলেন ক্লডিয়াস, সেই সাথে তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকেও সঙ্গে দিলেন। এবার ক্লডিয়াস ব্যবস্থা নিলেন পথের কাঁটা সরাবার। সে সময় ইংল্যান্ড ছিল ডেনমার্কের অনুগত। তিনি একটা চিঠি লিখলেন ইংল্যান্ডের রাজাকে। তাতে লেখা রইল হ্যামলেট ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দেবার সাথে সাথেই তিনি যেন তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ক্লডিয়াসের যে সমস্ত বিশ্বস্ত অনুচরেরা হ্যামলেটের সাথে যাচ্ছিল, তাদেরই একজনের হাতে চিঠিটা তুলে দিলেন তিনি। কিন্তু একাজে সফল হলেন না। ক্লডিয়াস। জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যাবার পথে চিঠিটা হস্তগত হল হ্যামলেটের। চিঠিতে নিজের নামটা কেটে দিয়ে সে জায়গায় পত্ৰবাহক আর তার সঙ্গীর নাম লিখে যথাস্থানে চিঠিটা রেখে দিলেন হ্যামলেট। এদিকে ইংল্যান্ডে পৌঁছাবার আগে মাঝদরিয়ায় একদল জলদসু্য এসে আক্রমণ করল তাদের জাহাজ। জলদসু্যরাও জাহাজে করে এসেছিল। খোলা তলোয়ার হাতে হ্যামলেট বাঁপিয়ে পড়লেন তাদের জাহাজে। যাকে সামনে পেলেন, তাকেই কচুকাটা করলেন। হ্যামলেটের সহগামীক্লডিয়াসের বিশ্বস্ত অনুচরেরা কিন্তু তার বিপদে এগিয়ে এলো না। হ্যামলেটকে একা ফেলে এই ফাকে তারা নিজেদের জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গেল। একা একা জলদসু্যদের সাথে লড়াই করে তিনি শেষে বন্দি হলেন তাদের হাতে। তারা আগেই মুগ্ধ হয়েছিল হ্যামলেটের সাহস আর বীরত্ব দেখে। এরপর যখন তারা শুনল যে ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট, তখন তারা নিজেদের জাহাজে চাপিয়ে হ্যামলেটকে নামিয়ে দিল ডেনমার্কের সমুদ্র উপকূলে। তারপর জলদসু্যরা সবাই চলে গেল।

হ্যামলেট দেশে ফিরে গিয়ে দেখলেন বাবার শোকে তার প্রেমিক ওফেলিয়া সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। তিনি শুনতে পেলেন মনের দুঃখে ওফেলিয়া স্নান, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম–সবই বিসর্জন দিয়েছে, সময়মতো সে বাড়িতেও যায় না। দিনরাত হয় সে তার বাবার কবরের ওপর পড়ে থাকে, নতুবা আপন মনে গান গেয়ে গেয়ে কবরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তার খুশি মতো আশপাশের গাছ থেকে ফুল পেড়ে কবরের উপর ছড়িয়ে দেয় সে। কেউ কবরখানায় এলে তার হাতে ফুল তুলে দিয়ে বলে, দাও, কবরের উপর ছড়িয়ে দাও। ওফেলিয়ার জন্য খুব অনুতপ্ত হলেও হ্যামলেটের করার কিছু নেই, কারণ তার মতো তিনি নিজেও অসহায়।

হ্যামলেটেরই সমবয়সি পালোনিয়াসের ছেলে লিয়ার্টিস। সেও হ্যামলেটের মতো ওস্তাদ তলোয়ারের লড়াইয়ে। অল্প কিছুদিন আগে লিয়ার্টিস ফ্রান্সে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে সে শুনল পাগলামোর ভান করে তার বাবাকে হত্যা করেছে। হ্যামলেট আর তার বোন ওফেলিয়া পাগল হয়ে গেছে সেই শোকে। সবকিছু শুনে তিনি হ্যামলেটের উপর বেজায় রেগে গেলেন। সুযোগ বুঝে সে রাগকে আরও উসকিয়ে দিলেন ক্লডিয়াস। তিনি লিয়ার্টিসকে বললেন, তোমার বাবা ছিলেন আমার অনুগত, খুবই বিশ্বস্ত এক মন্ত্রী। তার মৃত্যুর প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে। তবেই শান্তি পাবে তাঁর আত্মা। সেই সাথে দেশের মানুষও পরিচয় পাবে তোমার পিতৃভক্তির। মায়ের সামনে পাগলামোর ভান করে অন্যায়ভাবে সে খুন করেছে তোমার বাবাকে। এখন তোমার একমাত্র কর্তব্য হ্যামলেটের অপরাধের জন্য তাকে যথোচিত শাস্তি দেওয়া। তবে মনে রেখ, উত্তেজিত হয়ে কোনও কাজ করতে যেও না, তাতে বিপদের সম্ভাবনা আছে। দেশের মানুষ এখনও ভালোবাসে হ্যামলেটকে। এবার তুমি ভেতরে ভেতরে তৈরি হও প্রতিশোধ নেবার। আর আমার উপর ছেড়ে দাও পুরো ব্যাপারটা, ব্যবস্থা যা করার তা আমিই করব।

এবার রাজা ক্লডিয়াস এক নতুন মতলব আঁটলেন হ্যামলেটকে হত্যা করার। তিনি আয়োজন করলেন তার রাজ্যের ভেতর এক তলোয়ার প্রতিযোগিতার। হ্যামলেট ও লিয়ার্টিস-উভয়েই ভালো তলোয়ারবাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন দেশের অল্পবয়সি যুবকদের কাছে। ক্লডিয়াস স্থির করলেন হ্যামলেটকে মেরে ফেলতে তার এই খ্যাতিকেই তিনি কাজে লাগাবেন। প্রতিযোগিতায় যে তলোয়ার ব্যবহৃত হয় তার ফলা থাকে ভোঁতা, কিন্তু ক্লডিয়াসলিয়ার্টিসকে বোঝালেন যে তার ও হ্যামলেটের–উভয়ের হাতেই থাকবে ধারালো তলোয়ার, যার ফলা হবে খুবই ছুচোলো। আর লিয়ার্টিসের তলোয়ারের দু-ধারে এবং ফলায় মারাত্মক বিষ মিশিয়ে রাখবেন তিনি। সে বিষ এমনই তীব্র যে তার সংস্পর্শে এলেই মৃত্যু অবধারিত। এছাড়া হ্যামলেটের মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য অন্য ব্যবস্থাও তিনি করেছেন বলে জানালেন ক্লডিয়াস। তলোয়ারের আঘাতে যদি হ্যামলেটের মৃত্যু না হয়, তা হলে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে তার জন্য নির্দিষ্ট শরবতের গ্রাসে মিশনো থাকবে বিষ–এ আশ্বাসও তিনি দিলেন। লিয়ার্টিসকে। খেলার ফাকে যখন হ্যামলেটের তেষ্টা পাবে, তখন যাতে বিষ মেশানো শরবত তার হাতে তুলে দেওয়া হয়, সে ব্যবস্থাও করে রাখবেন তিনি।

পলোনিয়াসের মৃত্যুর জন্য হ্যামলেটের উপর যতই রেগে থাকুক। লিয়ার্টিস, সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না তলোয়ার খেলতে খেলতে এভাবে তাকে মেরে ফেলার জন্য ক্লডিয়াসের পরিকল্পনাকে। এ কাজ করতে বিবেকে বাধ্যছে তার। ঠিক সে সময় এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেল তার প্রিয় বোন ওফেলিয়া। এবার ক্লডিয়াস সুযোগ পেলেন লিয়ার্টিসের মন থেকে বিবেকের বাধা মুছে ফেলার।

ঘটনাটা এভাবেই ঘটল। পাগল হবার পরেও কিন্তু ওফেলিয়া ভুলতে পারেনি। হ্যামলেটকে। একদিন কেন জানি তার মনে হল ঐ হ্যামলেটের সাথেই বিয়ে হবে তার। কথাটা মনে হতেই সে নিজেকে ফুল-মালায় সাজিয়ে ঐ সাজেই নদীর ধারে হাজির হল। হঠাৎ কী খেয়াল হল তার, নদীর ধারে একটি গাছে উঠল ওফেলিয়া। বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মতো গাছের একটি পলকা ডাল এগিয়ে এসেছিল নদীর উপর। ওফেলিয়া সেই ডালে চেপে বসল।

ওফেলিয়ার ভার সইতে পারল না সেই পলকা ডাল। মাচু করে ভেঙে গেল আর সেই সাথে ওফেলিয়া পড়ে গেল জলে। খরস্রোতা সেই নদীর জলে পড়তে না পড়তেই ওফেলিয়া তলিয়ে গেল অতলে। পরদিন তার মৃতদেহ ভেসে উঠতেই, সবার আগে লিয়ার্টিসের কানে এল সে খবর। নদীর ধারে গিয়ে তিনি দেখলেন যে তার পাগলি বোনের মৃতদেহের পরনে রয়েছে বিয়ের কনে সাজতে–হয়তো বেচারির সাধ হয়েছিল বিয়ের আগে। বিয়ের সাজ কথাটা ভেবে একটা চাপা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লিয়ার্টিস।

রাজধানীতে ফিরে এসে ওফেলিয়ার মৃত্যুর কথা শুনে ভেঙে পড়লেন হ্যামলেট নিজেও।

হ্যামলেট স্থির করলেন প্রেমিককে সমাধি দেবার সময় তিনি উপস্থিত থাকবেন। বন্ধু হোরেশিওর সাথে দেখা করে তারই সাথে সমাধিস্থলে চলে এলেন তিনি।

সে সময় কবর খুঁড়তে খুঁড়তে দুজন মজুর আপনমনে ভালোবাসার গান গাইছিল। তা শুনে হোরেশিওর দিকে তাকিয়ে হ্যামলেট বললেন, দেখেছে হোরেশিও, কী আশ্চর্য ব্যাপার! এমন ভালোবাসার গান মানুষ কি কবর খুঁড়তে খুঁড়তে গাইতে পারে।

হোরেশিও উত্তর দিলেন, বন্ধু! এ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ওদের জীবনের বেশির ভাগ কেটে গেছে কবর খুঁড়তে খুঁড়তে। তাই ওরা ভুলে গেছে মৃত্যুশোক বা কবরের অন্ধকারে থাকা বিভীষিকাকে। সাধারণ মানুষের মতো মৃত্যুর ব্যাপারে যদি তাদের কোনও অনুভূতি থাকত, তাহলে এ কাজ তারা কখনই করতে পারত না।

হ্যামলেট এগিয়ে এসে মাটি-কাটা মজুরদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, যে কবরটা খুঁড়ছ তা কি কোনও পুরুষের জন্য?

এক ঝলক হ্যামলেটের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল লোকটি, আজ্ঞে হুজুর, তা নয়।

তা হলে কি কোনও নারীর জন্য?? জানতে চাইলেন হ্যামলেট।

লোকটি উত্তর দিলে, না, তাও নয়!

অবাক হয়ে বললেন হ্যামলেট, তাহলে কার জন্য খুঁড়ছ কবরটা?

দার্শনিকের মতো জবাব দেয় লোকটি, যার জন্য কবর খুঁড়ছি তার এখন শুধু একটাই পরিচয়মৃতদেহ। তবে একদিন সে ছিল অপরূপ সুন্দরী কমবয়সি এক নারী। তার কথা শেষ হতে হতেই ওফেলিয়ার মৃতদেহ নিয়ে সেখানে হাজির হলেন তার বড়ো ভাই লিয়ার্টিস, সাথে রাজা ক্লডিয়াস আর রানি গারট্রড। দূর থেকে তাদের দেখতে পেয়ে হ্যামলেট আর হোরেশিও পড়লেন কিছুটা দূরে এক সমাধিস্তম্ভে লুকিয়ে।

ওফেলিয়াকে কবরে শোয়াবার পর উপস্থিত সবাই নিয়মানুযায়ী তার কবরের উপরে ছড়িয়ে দিল তিন মুঠো মাটি। প্রিয় ছোটো বোনটিকে শেষ বিদায় জানাবার সময় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না লিয়ার্টিস, কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। তার সেই বুকফাটা কান্না শুনে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেন না হ্যামলেট। ছুটে এসে দাঁড়ালেন লিয়ার্টিসের সামনে। হাত-পা নেড়ে পাগলের মতো অঙ্গভঙ্গি করে লিয়ার্টিসকে বললেন হ্যামলেট, বৃথাই তুমি কান্নাকাটি করছ তোমার বোনের জন্য। তার প্রতি আমার যে ভালোবাসা, তোমার ঐ ভালোবাসা তার কাছে কিছুই নয়। ওফেলিয়ার জন্য তুমি কি একটা গোটা কুমির খেতে পোর? না, তুমি পার না, কিন্তু আমি পারি। তুমি কি কবরের ভেতর তার পাশে শুয়ে থাকতে পারবে? না, তুমি পারবে না, কিন্তু আমি পারি।

চরম শোকের সেই চরম মুহূর্তে হ্যামলেটের এরূপ ব্যবহারে প্রচণ্ড উত্তেজিত হল লিয়ার্টিস। খাপ থেকে তলোয়ার বের করে সে ছুটে গেল হ্যামলেটের দিকে। সাথে সাথে তার হাত ধরে টেনে তাকে শাস্ত করলেন রাজা ক্লডিয়াস। তিনি লিয়ার্টিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, আঃ লিয়ার্টিস! কী করছ তুমি। জানি তো ওর মাথার ঠিক নেই; হ্যামলেট আর সুস্থ নয়, পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। ও। কী লাভ, পাগলের সাথে ঝগড়া করে?? রাজার সম্মান রাখতে লিয়টিস তার তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল খাপে, এবার রাজা তাকে বললেন, আমার পরিকল্পনার কথা মনে করে মনকে শাস্ত রাখা লিয়ার্টিস। নিজেকে সংযমী রাখ চরম শোকের মুহূর্তেও।

দেখতে দেখতে তলোয়ার প্রতিযোগিতার দিন এগিয়ে এল। অবশ্য তার আগেই হ্যামলেট সাক্ষাৎ করেছেন লিয়ার্টিসের সাথে। ওফেলিয়ার সমাধিস্থলে তার আচরণের জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন লিয়ার্টিসের কাছে। হয়তো হ্যামলেট এ ব্যাপারে খুব বিলম্ব করায় তিনি আর কিছুইবললেন না তাকে।

 

সারা রাজ্যের মানুষ এসে ভেঙে পড়েছে হ্যামলেট আর লিয়ার্টিসের তলোয়ারবাজি দেখতে। তারই মাঝে সবার নজর এড়িয়ে তলোয়ারবাজির নিয়ম ভঙ্গ করে দুই প্রতিযোগীর জন্য এমন তলোয়ার রেখেছেন যার দুদিক ক্ষুরের মতো ধারালো আর ফলাটাও চুচোলো। রাজা ক্লডিয়াস তার পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে লিয়ার্টিয়াসের তলোয়ারের দুধারে ও ফলায় তীব্র বিষ মাখিয়ে রেখেছেন তিনি। সে বিষ একবার রক্তে মিশলে মৃত্যু নিশ্চিত। এর পাশাপাশি তিনি হ্যামলেটের জন্য তৈরি করে রেখেছেন বিষ মেশান শরবত। লড়াই করতে করতে হ্যামলেট যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন সেই বিষ মেশান শরবত যাতে তার হাতে তুলে দেওয়া যায় সে ব্যবস্থাও করে রেখেছেন তিনি।

রাজা ক্লডিয়াস মঞ্চের উপর বসেছেন তার নির্দিষ্ট আসনে, আর রানি গারট্রড বসেছেন তার পাশে। পদমর্যাদা অনুসারে মন্ত্রী, পারিষদ আর সেনাপতিরা বসেছেন তাদের পাশে। রাজ্যের মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। মঞ্চের সামনে আর দিকে।

তলোয়ারবাজি শুরু হবার আগে ওফেলিয়ার জন্য হ্যামলেটের মনে জেগে উঠল গভীর অনুতাপ। তিনি লিয়ার্টিসের দু-হাত ধরে বললেন, বন্ধু লিয়ার্টিস, অতীতে আমি যদি কোনও অন্যায় বা ভুল-ত্রুটি করে থাকি, তাহলে এ মুহূর্তে সেসব ভুলে যাও তুমি। মনে রেখ, সেদিনের হ্যামলেট কিন্তু আজকের মতো স্বাভাবিক মানুষ ছিল না, তখন সে ছিল পুরোপুরি উন্মাদ। পুরনো বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তোমায় বলছি, তুমি ভুলে যাও সে দিনের উন্মাদ হ্যামলেটকে।

আমার মনে আর কোনও ক্ষোভ নেই তোমার প্রতি, বলল লিয়ার্টিস, আজ থেকে তুমি আর আমি দুজনে আগের মতোই বন্ধু।

সুরাভর্তি পানপত্রে রাজা ক্লডিয়াস চুমুক দেবার সাথে সাথে দামামা আর ভেরি বেজে উঠল। চারদিক থেকে। তার সাথে তাল দিয়ে শুরু হল দুই পুরনো বন্ধুর তলোয়ারবাজি। এ প্রতিযোগিতার চলিত নিয়ম ছিল, এই প্ৰতিযোগীরা কেউ কাকে আঘাত করবে না। হ্যামলেট খেলতে লাগলেন সে নিয়ম মেনে। কিন্তু লিয়ার্টিসের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। হ্যামলেটকে জোরদার আঘাত করার জন্য মঞ্চ থেকে বারবার তাকে ইশারা করছেন রাজা ক্লডিয়াস। লিয়ার্টিস ভেবে পাচ্ছে না যেখানে নিয়ম মেনে খেলছেন হ্যামলেট, সেখানে সে কী করে নিয়ম ভাঙবে। আর সে ভাবে হ্যামলেটকে আঘাত করতে বিবেকে লাগছে তার। খেলার মাঝে এক সময় লিয়ার্টিসকে কোণঠাসা করে ফেললেন হ্যামলেট, ফলে বিবেকের বাধা ভুলে গিয়ে ক্রমশ উত্তেজিত হতে লাগল লিয়ার্টিস।

খেলার প্রথম রাউন্ড শেষ হবার পর মার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ক্লাস্ত হ্যামলেট। ক্লডিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললেন রানি, হ্যামলেট তৃষ্ণাৰ্ত, ওকে শরবত দাও। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন ক্লডিয়াস। সাথে সাথেই তিনি বিষ মেশান শরবতের গ্লাস রানির হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু রানি সে গ্লাস হ্যামলেটের হাতে দেবার পূর্বেই বেজে উঠল দ্বিতীয় রাউন্ড শুরুর বাজনা। সাথে সাথেই মার কাছ থেকে ছিটকে এসে হ্যামলেট দাঁড়ালেন খেলার জায়গায়। সেখান থেকে চেঁচিয়ে মাকে বললেন খেলার শেষে তিনি শরবত খাবেন। শুরু থেকে একইভাবে খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়েছেন রানি। তাই শরবতের গ্লাসটা রাজাকে ফিরিয়ে না দিয়ে তিনি নিজেই কয়েক চুমুকে খেয়ে ফেললেন শরবতটুকু। ক্লডিয়াস স্বপ্নেও ভাবেননি যে এরূপ ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ক্লডিয়াস একমনে খেলা দেখতে লাগলেন বুকে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে।

দ্বিতীয় রাউন্ড চলার সময় হ্যামলেটকে তাতিয়ে তুলতে ইশারা করলেন ক্লডিয়াস। সাথে সাথেই তলোয়ার দিয়ে হ্যামলেটকে জোর আঘাত করল লিয়ার্টিয়াস।

বন্ধুকে লক্ষ করে হ্যামলেট বললেন, এ কি করছ? তুমি কি খেলার নিয়ম ভুলে গেছ?

আমি খুব দুঃখিত–বলল লিয়ার্টিস, উত্তেজিত ছিলাম বলে আমার খেয়াল ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই বিষ মাখানো তলোয়ার দিয়ে হ্যামলেটের গায়ে আবার আঘাত করল লিয়ার্টিস। এবার আর ধৈর্য রইল না হ্যামলেটের। তিনিও তার তলোয়ার দিয়ে জোর আঘাত করলেন লিয়ার্টিসকে।

হ্যামলেটের শরীর থেকে রক্ত করেছিল। লিয়ার্টিসের আঘাতের পর থেকেই। তার মতলব হাসিল হয়েছে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, লড়াই থামাও এখনি। কিন্তু লড়াই বন্ধ করার বাজনা বেজে ওঠার আগেই হ্যামলেট তার তলোয়ারের আঘাতে ফেলে দিলেন। লিয়ার্টিসের হাতের তলোয়ার। লিয়ার্টিসের তলোয়ারটা মাটিতে পড়ে যেতেই সেই বিষমাখানো তলোয়ার তুলে নিয়ে হ্যামলেট বসিয়ে দিলেন লিয়ার্টিসের বুকে।

রানিকে এলিয়ে পড়তে দেখে মঞ্চে উপস্থিত সবাই চেঁচিয়ে ওঠে বললেন, কেঁহুশ হয়ে পড়েছেন রানি। জ্ঞানলোপের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রানি টের পেলেন যে শরবত তিনি খেয়েছেন, তাতে মেশানো ছিল বিষ। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, আমি মারা যাচ্ছি… তোমার শরবতে বিষ মেশানো ছিল হ্যামলেট…আমি চললাম।

হ্যামলেট অবাক হয়ে তাকালেন তার মার দিকে। ঠিক সে সময় বলে উঠল লিয়ার্টিস, শোন বন্ধু হ্যামলেট, আর কিছুক্ষণ বাদে তুমি আর আমি, দুজনেই চিরকালের মতো ছেড়ে যাব এ পৃথিবী। তোমাকে মেরে ফেলার জন্য রাজা নিজেই বিষ মাখিয়ে ছিলেন আমার তলোয়ারে। আমাদের দুজনের রক্তেই মিশে গেছে সে বিষ। বন্ধু, বিদায়–বলতে বলতে এলিয়ে পড়ল লিয়াটস। সীমাহীন ক্ৰোধে তখন সত্যিই উন্মাদ হয়ে উঠেছেন হ্যামলেট। বিযমাখানো তলোয়ারটা তুলে নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন মঞ্চে। কেউ কিছু বোঝার আগেই সে তলোয়ারটা তিনি জোরে বসিয়ে দিলেন ক্লডিয়াসের বুকের ভেতরে।

তুমিই ছড়িয়েছ এ বিষ! তাই তোমাকে সেটা ফিরিয়ে দিলাম, চেঁচিয়ে বলে উঠলেন হ্যামলেট।

রাজা, রানি, ক্লডিয়াস-সবাই এখন মৃত্য। যে অন্যায়ের প্রতিবিধান চেয়েছিলেন বাবার প্রেতিমূর্তি, সেটাই করেছেন হ্যামলেট। কিন্তু এবার তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে, টলছে তার পা। হ্যামলেট বুঝতে পারলেন তার মৃত্যু নিকটেই। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি মাটিতে ঢলে পড়লেন। সাথে সাথেই ছুটে এলেন তার পুরোনো বন্ধু হোরেশিও। হ্যামলেটের মাথাটা তুলে নিলেন নিজের কোলে।

শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগে কোনও মতে মুখ তুলে বললেন হ্যামলেট, সবাইকে ডেনমার্কের হতভাগ্য যুবরাজের কাহিনি শোনাবার জন্য একমাত্ৰ তুমিই বেঁচে রইলে হোরেশিও।

 

Exit mobile version