অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে লিয়ার বললেন, বলতো, কী হবে?
বিদূষক উত্তর দিল, দিদির মতোই উপযুক্ত হবে তার আচরণ। সোজাপথে না গিয়ে মানুষ যেমন ঘুরপথে গোপনীয় খবর সংগ্রহ করে, তেমনি মানুষের এক চোখ যাতে অন্য চোখকে দেখতে না পায় সেজন্যই ঈশ্বর ব্যবধান তৈরি করেছেন নাসিকা সৃষ্টির মাধ্যমে।
কর্ডেলিয়ার প্রতি আমার আচরণ ঠিক নয় তা আমি জানি, বললেন লিয়ার।
বিদূষক বলল, যাতে শামুকরা আশ্রয়হীন না হয় তাই একটি খোলা তৈরি আছে তাদের মাথা গোঁজার জন্য।
লিয়ার বললেন, ও কথা আর আমাকে মনে করিয়ে দিও না। জোর করে আমি কেড়ে নেব সব।
বিদূষক বলল, মহারাজ, বয়স বাড়ার আগেই আপনার এ বুদ্ধি হওয়া উচিত ছিল।
লিয়ার বললেন, দোহাই তোমাদের, আমাকে তোমরা পাগল করে দিওনা। হে ঈশ্বর! আমার বিবেক-বুদ্ধিকে চঞ্চল করে তুলোনা তুমি। আমি পাগল হতে চাইনা! না, কখনই না।
০২.
সুপ্ৰভাত কিউরান, বলল এডমন্ড।
প্রতি উত্তরে বলল কিউরান, সুপ্ৰভাত এডমন্ড। আমি এইমাত্রই এলাম। আপনার বাবার কাছ থেকে। আমি আগে থেকেই তাকে সতর্ক করে দিয়েছি ডিউক অফ কর্নওয়াল ও রিগানের আসার ব্যাপারে। ভালো কথা, আপনি কি শুনেছেন একটা খবর?
কী খবর কিউরান? জানতে চাইল এডমন্ড।
কিউরান বলল, আলবেনি আর কর্নওয়ালের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। উভয়েই গোপনে যুদ্ধের আয়োজন করছেন।
না, সে কথা শুনিনি তো, বলল এডমন্ড।
কিউরান বলল, এবার তাহলে আমি চলি স্যার।
ঠিক আছে, তুমি এস, এডমন্ড বলল।
কিউরান চলে যাবার পর মনে মনে চিস্তা করতে লাগল এডমন্ড, ডিউক আসছেন, সে তো খুব ভালো কথা। ভাগ্যের উপর নির্ভর এবার আমার পরিকল্পনামাফিক কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি। গলাটা একটু উঁচু করে ভাইকে বললেন তিনি, নেমে এস, একটা কথা আছে তোমার সাথে। এই অন্ধকারের মাঝে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যাও তুমি। বাবা জানতে পেরেছেন তুমি কোথায় লুকিয়ে আছি। ঐ বাবার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। তলোয়ার বের করে আত্মহত্যার ভান করি। ও রে কে আছিস; আলো আন। যাও, শীঘ্ৰ পালিয়ে যাও।
এডমন্ড চলে যাবার পর নিজের চক্রান্তকে আরও যুক্তিপূৰ্ণ করে তুলতে নিজেই আঘাত করল নিজেকে। তারপর সেই রক্তাক্ত হাত নিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, কে আছ, বাঁচাও আমাকে। বাবা, কোথায় তুমি?
ব্যগ্ৰকণ্ঠে বলে উঠলেন গ্লস্টার, কী হয়েছে, এডমন্ড? এত রক্ত কেন তোমার হাতে?
এডমন্ড বলল, এই অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আপনমনে কী সব যেন বলছিল এডগার। আপনার শব্দ শুনেই সে পালিয়ে গেল এই রাস্তা দিয়ে।
কোথায় পালাবে সে শয়তানটা! ভাবেই হোক তা থেকে খুঁজে বের কর তোমরা — বলে অনুচরদের নির্দেশ দিলেন গ্লস্টার। তারপর জানতে চাইলেন এডমন্ডের কাছে, তোমার কাছে কেন সে এসেছিল?
এডমন্ড উত্তর দিলে, সে আমার কাছে এসেছিল। আপনাকে হত্যা করার উপদেশ দিতে। কিন্তু আমি মন থেকে কিছুতেই সায় দিইনি। পিতৃহত্যার মতো জঘন্য কাজে। তাই সে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে আমায়। যখন আমি তার অসৎ উদ্দেশ্যের জোর প্রতিবাদ করছি আর প্রতি আক্রমণে উদ্যত হয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছি, ঠিক তখনই সে পালিয়ে গেল ভয় পেয়ে।
স্নেহশীল পিতা কিন্তু বুঝতে পারল না এডমন্ডের চালাকি, উপরন্তু তার প্রতি করুণায় বিগলিত হয়ে তিনি বললেন, রাজার আদেশ নিয়ে আমি সারা রাজ্যে ঘোষণা করে দেব যে তাকে ধরে আনতে পারবে, তাকে প্রচুর পুরস্কার দেওয়া হবে। আর তার আশ্রয়কারীকে দেওয়া হবে প্ৰাণদণ্ড।
এডগারের প্রতি পিতার অবিশ্বাসকে আরও জোরদার করার জন্য বলল এডমন্ড, বাবা, সে আমায় ভয় দেখিয়ে গেছে। যদি আমি এই ষড়যন্ত্রের কথা প্ৰকাশ করি, তাহলে সে বলবে। আমিই নাকি সেই ষড়যন্ত্রের কারণ। সে নাকি আমার প্ররোচনাতেই পিতৃসম্পত্তি গ্ৰাস করার ষড়যন্ত্র করেছে। তার মৃত্যুতে আমার পক্ষে সম্পত্তি লাভ সহজ হবে জেনেই আমি নাকি মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছি।
গ্লস্টার বললেন, কোনও ভয় নেই তোমার। ওর হাতের লেখাই প্রমাণ করবে ওর ষড়যন্ত্রের কথা। ঐ শোন মহামান্য ডিউকের আগমনের বাদ্যধ্বনি। শয়তানটা যাতে আমার রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। সেজন্য সমস্ত শহর ও বন্দরের পথ বন্ধ করে দেব আমি। রাজ্যের সর্বত্র পথে-ঘাটে ওরা ছবি ছাপিয়ে দেব আমি। সন্তানের উপযুক্ত কাজই করেছ তুমি। ওকে আর আমি সস্তান বলে স্বীকার করব না। আমার একমাত্র সন্তান তুমিই আর সমস্ত সম্পত্তি আমি তোমাকেই দিয়ে যাব।
এ সময় কর্নওয়াল প্রবেশ করে বললেন গ্লস্টারকে, কেমন আছ বন্ধু? ভারি একটা আশ্চর্য খবর শুনলাম। এখানে এসে।
এ কথা সত্যি হলে অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া কঠিন হবে–বলল রিগান, আচ্ছা, বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী কি ওর নাম রাখা হয়েছিল?
সে কথা বলতে আমার বুক দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ম্যাডাম–বলল গ্লস্টার।
রিগান বলল, আচ্ছা, ওকি আমার বাবার উচ্ছঙ্খল নাইটদের মধ্যে একজন?
এডমন্ড জানাল, হ্যাঁ ম্যাডাম, ও ছিল তাদেরই একজন।
একথা শুনে রিগান বলল, এবার বেশ বুঝতে পারছি আমি। বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করতে ঐ শয়তান নাইটরাই প্ররোচিত করেছে তাকে। এডগারের সাথে সাথে তাহলে তারাও ভোগ করতে পারবে সম্পত্তি। আজ সন্ধ্যায় আমি দিদির পাঠানো একটা চিঠি পেয়েছি। যাতে এদের সম্পর্কে আমায় সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। সে চিঠিতে দিদি লিখেছে ওরা আসার আগেই আমি যেন বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই।