রাজা ক্লডিয়াস মঞ্চের উপর বসেছেন তার নির্দিষ্ট আসনে, আর রানি গারট্রড বসেছেন তার পাশে। পদমর্যাদা অনুসারে মন্ত্রী, পারিষদ আর সেনাপতিরা বসেছেন তাদের পাশে। রাজ্যের মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। মঞ্চের সামনে আর দিকে।
তলোয়ারবাজি শুরু হবার আগে ওফেলিয়ার জন্য হ্যামলেটের মনে জেগে উঠল গভীর অনুতাপ। তিনি লিয়ার্টিসের দু-হাত ধরে বললেন, বন্ধু লিয়ার্টিস, অতীতে আমি যদি কোনও অন্যায় বা ভুল-ত্রুটি করে থাকি, তাহলে এ মুহূর্তে সেসব ভুলে যাও তুমি। মনে রেখ, সেদিনের হ্যামলেট কিন্তু আজকের মতো স্বাভাবিক মানুষ ছিল না, তখন সে ছিল পুরোপুরি উন্মাদ। পুরনো বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে তোমায় বলছি, তুমি ভুলে যাও সে দিনের উন্মাদ হ্যামলেটকে।
আমার মনে আর কোনও ক্ষোভ নেই তোমার প্রতি, বলল লিয়ার্টিস, আজ থেকে তুমি আর আমি দুজনে আগের মতোই বন্ধু।
সুরাভর্তি পানপত্রে রাজা ক্লডিয়াস চুমুক দেবার সাথে সাথে দামামা আর ভেরি বেজে উঠল। চারদিক থেকে। তার সাথে তাল দিয়ে শুরু হল দুই পুরনো বন্ধুর তলোয়ারবাজি। এ প্রতিযোগিতার চলিত নিয়ম ছিল, এই প্ৰতিযোগীরা কেউ কাকে আঘাত করবে না। হ্যামলেট খেলতে লাগলেন সে নিয়ম মেনে। কিন্তু লিয়ার্টিসের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। হ্যামলেটকে জোরদার আঘাত করার জন্য মঞ্চ থেকে বারবার তাকে ইশারা করছেন রাজা ক্লডিয়াস। লিয়ার্টিস ভেবে পাচ্ছে না যেখানে নিয়ম মেনে খেলছেন হ্যামলেট, সেখানে সে কী করে নিয়ম ভাঙবে। আর সে ভাবে হ্যামলেটকে আঘাত করতে বিবেকে লাগছে তার। খেলার মাঝে এক সময় লিয়ার্টিসকে কোণঠাসা করে ফেললেন হ্যামলেট, ফলে বিবেকের বাধা ভুলে গিয়ে ক্রমশ উত্তেজিত হতে লাগল লিয়ার্টিস।
খেলার প্রথম রাউন্ড শেষ হবার পর মার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ক্লাস্ত হ্যামলেট। ক্লডিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললেন রানি, হ্যামলেট তৃষ্ণাৰ্ত, ওকে শরবত দাও। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন ক্লডিয়াস। সাথে সাথেই তিনি বিষ মেশান শরবতের গ্লাস রানির হাতে তুলে দিলেন। কিন্তু রানি সে গ্লাস হ্যামলেটের হাতে দেবার পূর্বেই বেজে উঠল দ্বিতীয় রাউন্ড শুরুর বাজনা। সাথে সাথেই মার কাছ থেকে ছিটকে এসে হ্যামলেট দাঁড়ালেন খেলার জায়গায়। সেখান থেকে চেঁচিয়ে মাকে বললেন খেলার শেষে তিনি শরবত খাবেন। শুরু থেকে একইভাবে খেলা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়েছেন রানি। তাই শরবতের গ্লাসটা রাজাকে ফিরিয়ে না দিয়ে তিনি নিজেই কয়েক চুমুকে খেয়ে ফেললেন শরবতটুকু। ক্লডিয়াস স্বপ্নেও ভাবেননি যে এরূপ ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু তখন আর কিছু করার নেই। ক্লডিয়াস একমনে খেলা দেখতে লাগলেন বুকে একরাশ উত্তেজনা নিয়ে।
দ্বিতীয় রাউন্ড চলার সময় হ্যামলেটকে তাতিয়ে তুলতে ইশারা করলেন ক্লডিয়াস। সাথে সাথেই তলোয়ার দিয়ে হ্যামলেটকে জোর আঘাত করল লিয়ার্টিয়াস।
বন্ধুকে লক্ষ করে হ্যামলেট বললেন, এ কি করছ? তুমি কি খেলার নিয়ম ভুলে গেছ?
আমি খুব দুঃখিত–বলল লিয়ার্টিস, উত্তেজিত ছিলাম বলে আমার খেয়াল ছিল না। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই বিষ মাখানো তলোয়ার দিয়ে হ্যামলেটের গায়ে আবার আঘাত করল লিয়ার্টিস। এবার আর ধৈর্য রইল না হ্যামলেটের। তিনিও তার তলোয়ার দিয়ে জোর আঘাত করলেন লিয়ার্টিসকে।
হ্যামলেটের শরীর থেকে রক্ত করেছিল। লিয়ার্টিসের আঘাতের পর থেকেই। তার মতলব হাসিল হয়েছে দেখে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, লড়াই থামাও এখনি। কিন্তু লড়াই বন্ধ করার বাজনা বেজে ওঠার আগেই হ্যামলেট তার তলোয়ারের আঘাতে ফেলে দিলেন। লিয়ার্টিসের হাতের তলোয়ার। লিয়ার্টিসের তলোয়ারটা মাটিতে পড়ে যেতেই সেই বিষমাখানো তলোয়ার তুলে নিয়ে হ্যামলেট বসিয়ে দিলেন লিয়ার্টিসের বুকে।
রানিকে এলিয়ে পড়তে দেখে মঞ্চে উপস্থিত সবাই চেঁচিয়ে ওঠে বললেন, কেঁহুশ হয়ে পড়েছেন রানি। জ্ঞানলোপের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রানি টের পেলেন যে শরবত তিনি খেয়েছেন, তাতে মেশানো ছিল বিষ। তিনি চেঁচিয়ে বললেন, আমি মারা যাচ্ছি… তোমার শরবতে বিষ মেশানো ছিল হ্যামলেট…আমি চললাম।
হ্যামলেট অবাক হয়ে তাকালেন তার মার দিকে। ঠিক সে সময় বলে উঠল লিয়ার্টিস, শোন বন্ধু হ্যামলেট, আর কিছুক্ষণ বাদে তুমি আর আমি, দুজনেই চিরকালের মতো ছেড়ে যাব এ পৃথিবী। তোমাকে মেরে ফেলার জন্য রাজা নিজেই বিষ মাখিয়ে ছিলেন আমার তলোয়ারে। আমাদের দুজনের রক্তেই মিশে গেছে সে বিষ। বন্ধু, বিদায়–বলতে বলতে এলিয়ে পড়ল লিয়াটস। সীমাহীন ক্ৰোধে তখন সত্যিই উন্মাদ হয়ে উঠেছেন হ্যামলেট। বিযমাখানো তলোয়ারটা তুলে নিয়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন মঞ্চে। কেউ কিছু বোঝার আগেই সে তলোয়ারটা তিনি জোরে বসিয়ে দিলেন ক্লডিয়াসের বুকের ভেতরে।
তুমিই ছড়িয়েছ এ বিষ! তাই তোমাকে সেটা ফিরিয়ে দিলাম, চেঁচিয়ে বলে উঠলেন হ্যামলেট।
রাজা, রানি, ক্লডিয়াস-সবাই এখন মৃত্য। যে অন্যায়ের প্রতিবিধান চেয়েছিলেন বাবার প্রেতিমূর্তি, সেটাই করেছেন হ্যামলেট। কিন্তু এবার তার মাথা ঘুরতে শুরু করেছে, টলছে তার পা। হ্যামলেট বুঝতে পারলেন তার মৃত্যু নিকটেই। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি মাটিতে ঢলে পড়লেন। সাথে সাথেই ছুটে এলেন তার পুরোনো বন্ধু হোরেশিও। হ্যামলেটের মাথাটা তুলে নিলেন নিজের কোলে।