পলোনিয়াসের মৃত্যুর জন্য হ্যামলেটের উপর যতই রেগে থাকুক। লিয়ার্টিস, সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না তলোয়ার খেলতে খেলতে এভাবে তাকে মেরে ফেলার জন্য ক্লডিয়াসের পরিকল্পনাকে। এ কাজ করতে বিবেকে বাধ্যছে তার। ঠিক সে সময় এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় মারা গেল তার প্রিয় বোন ওফেলিয়া। এবার ক্লডিয়াস সুযোগ পেলেন লিয়ার্টিসের মন থেকে বিবেকের বাধা মুছে ফেলার।
ঘটনাটা এভাবেই ঘটল। পাগল হবার পরেও কিন্তু ওফেলিয়া ভুলতে পারেনি। হ্যামলেটকে। একদিন কেন জানি তার মনে হল ঐ হ্যামলেটের সাথেই বিয়ে হবে তার। কথাটা মনে হতেই সে নিজেকে ফুল-মালায় সাজিয়ে ঐ সাজেই নদীর ধারে হাজির হল। হঠাৎ কী খেয়াল হল তার, নদীর ধারে একটি গাছে উঠল ওফেলিয়া। বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মতো গাছের একটি পলকা ডাল এগিয়ে এসেছিল নদীর উপর। ওফেলিয়া সেই ডালে চেপে বসল।
ওফেলিয়ার ভার সইতে পারল না সেই পলকা ডাল। মাচু করে ভেঙে গেল আর সেই সাথে ওফেলিয়া পড়ে গেল জলে। খরস্রোতা সেই নদীর জলে পড়তে না পড়তেই ওফেলিয়া তলিয়ে গেল অতলে। পরদিন তার মৃতদেহ ভেসে উঠতেই, সবার আগে লিয়ার্টিসের কানে এল সে খবর। নদীর ধারে গিয়ে তিনি দেখলেন যে তার পাগলি বোনের মৃতদেহের পরনে রয়েছে বিয়ের কনে সাজতে–হয়তো বেচারির সাধ হয়েছিল বিয়ের আগে। বিয়ের সাজ কথাটা ভেবে একটা চাপা। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন লিয়ার্টিস।
রাজধানীতে ফিরে এসে ওফেলিয়ার মৃত্যুর কথা শুনে ভেঙে পড়লেন হ্যামলেট নিজেও।
হ্যামলেট স্থির করলেন প্রেমিককে সমাধি দেবার সময় তিনি উপস্থিত থাকবেন। বন্ধু হোরেশিওর সাথে দেখা করে তারই সাথে সমাধিস্থলে চলে এলেন তিনি।
সে সময় কবর খুঁড়তে খুঁড়তে দুজন মজুর আপনমনে ভালোবাসার গান গাইছিল। তা শুনে হোরেশিওর দিকে তাকিয়ে হ্যামলেট বললেন, দেখেছে হোরেশিও, কী আশ্চর্য ব্যাপার! এমন ভালোবাসার গান মানুষ কি কবর খুঁড়তে খুঁড়তে গাইতে পারে।
হোরেশিও উত্তর দিলেন, বন্ধু! এ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ওদের জীবনের বেশির ভাগ কেটে গেছে কবর খুঁড়তে খুঁড়তে। তাই ওরা ভুলে গেছে মৃত্যুশোক বা কবরের অন্ধকারে থাকা বিভীষিকাকে। সাধারণ মানুষের মতো মৃত্যুর ব্যাপারে যদি তাদের কোনও অনুভূতি থাকত, তাহলে এ কাজ তারা কখনই করতে পারত না।
হ্যামলেট এগিয়ে এসে মাটি-কাটা মজুরদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, যে কবরটা খুঁড়ছ তা কি কোনও পুরুষের জন্য?
এক ঝলক হ্যামলেটের দিকে তাকিয়ে জবাব দিল লোকটি, আজ্ঞে হুজুর, তা নয়।
তা হলে কি কোনও নারীর জন্য?? জানতে চাইলেন হ্যামলেট।
লোকটি উত্তর দিলে, না, তাও নয়!
অবাক হয়ে বললেন হ্যামলেট, তাহলে কার জন্য খুঁড়ছ কবরটা?
দার্শনিকের মতো জবাব দেয় লোকটি, যার জন্য কবর খুঁড়ছি তার এখন শুধু একটাই পরিচয়মৃতদেহ। তবে একদিন সে ছিল অপরূপ সুন্দরী কমবয়সি এক নারী। তার কথা শেষ হতে হতেই ওফেলিয়ার মৃতদেহ নিয়ে সেখানে হাজির হলেন তার বড়ো ভাই লিয়ার্টিস, সাথে রাজা ক্লডিয়াস আর রানি গারট্রড। দূর থেকে তাদের দেখতে পেয়ে হ্যামলেট আর হোরেশিও পড়লেন কিছুটা দূরে এক সমাধিস্তম্ভে লুকিয়ে।
ওফেলিয়াকে কবরে শোয়াবার পর উপস্থিত সবাই নিয়মানুযায়ী তার কবরের উপরে ছড়িয়ে দিল তিন মুঠো মাটি। প্রিয় ছোটো বোনটিকে শেষ বিদায় জানাবার সময় নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না লিয়ার্টিস, কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। তার সেই বুকফাটা কান্না শুনে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারলেন না হ্যামলেট। ছুটে এসে দাঁড়ালেন লিয়ার্টিসের সামনে। হাত-পা নেড়ে পাগলের মতো অঙ্গভঙ্গি করে লিয়ার্টিসকে বললেন হ্যামলেট, বৃথাই তুমি কান্নাকাটি করছ তোমার বোনের জন্য। তার প্রতি আমার যে ভালোবাসা, তোমার ঐ ভালোবাসা তার কাছে কিছুই নয়। ওফেলিয়ার জন্য তুমি কি একটা গোটা কুমির খেতে পোর? না, তুমি পার না, কিন্তু আমি পারি। তুমি কি কবরের ভেতর তার পাশে শুয়ে থাকতে পারবে? না, তুমি পারবে না, কিন্তু আমি পারি।
চরম শোকের সেই চরম মুহূর্তে হ্যামলেটের এরূপ ব্যবহারে প্রচণ্ড উত্তেজিত হল লিয়ার্টিস। খাপ থেকে তলোয়ার বের করে সে ছুটে গেল হ্যামলেটের দিকে। সাথে সাথে তার হাত ধরে টেনে তাকে শাস্ত করলেন রাজা ক্লডিয়াস। তিনি লিয়ার্টিসের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন, আঃ লিয়ার্টিস! কী করছ তুমি। জানি তো ওর মাথার ঠিক নেই; হ্যামলেট আর সুস্থ নয়, পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে। ও। কী লাভ, পাগলের সাথে ঝগড়া করে?? রাজার সম্মান রাখতে লিয়টিস তার তলোয়ার ঢুকিয়ে দিল খাপে, এবার রাজা তাকে বললেন, আমার পরিকল্পনার কথা মনে করে মনকে শাস্ত রাখা লিয়ার্টিস। নিজেকে সংযমী রাখ চরম শোকের মুহূর্তেও।
দেখতে দেখতে তলোয়ার প্রতিযোগিতার দিন এগিয়ে এল। অবশ্য তার আগেই হ্যামলেট সাক্ষাৎ করেছেন লিয়ার্টিসের সাথে। ওফেলিয়ার সমাধিস্থলে তার আচরণের জন্য তিনি ক্ষমা চেয়েছেন লিয়ার্টিসের কাছে। হয়তো হ্যামলেট এ ব্যাপারে খুব বিলম্ব করায় তিনি আর কিছুইবললেন না তাকে।
সারা রাজ্যের মানুষ এসে ভেঙে পড়েছে হ্যামলেট আর লিয়ার্টিসের তলোয়ারবাজি দেখতে। তারই মাঝে সবার নজর এড়িয়ে তলোয়ারবাজির নিয়ম ভঙ্গ করে দুই প্রতিযোগীর জন্য এমন তলোয়ার রেখেছেন যার দুদিক ক্ষুরের মতো ধারালো আর ফলাটাও চুচোলো। রাজা ক্লডিয়াস তার পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে লিয়ার্টিয়াসের তলোয়ারের দুধারে ও ফলায় তীব্র বিষ মাখিয়ে রেখেছেন তিনি। সে বিষ একবার রক্তে মিশলে মৃত্যু নিশ্চিত। এর পাশাপাশি তিনি হ্যামলেটের জন্য তৈরি করে রেখেছেন বিষ মেশান শরবত। লড়াই করতে করতে হ্যামলেট যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বে তখন সেই বিষ মেশান শরবত যাতে তার হাতে তুলে দেওয়া যায় সে ব্যবস্থাও করে রেখেছেন তিনি।