তার প্রেমিক ওফেলিয়ার বাবা পলোনিয়াস। শুধু এ কারণে তাকে মেরে ফেলার জন্য মনে মনে খুব অনুতপ্ত হ্যামলেট। ওফেলিয়া মনে-প্ৰাণে ভালোবাসে হ্যামলেটকে। সেদিক থেকে কোনও কুটিলতা বা লোকদেখানো ভাব নেই ওফেলিয়ার মনে। শেষ পর্যন্ত সেই হ্যামলেটের হাতেই মারা গেলেন তার বাবা? ওফেলিয়া চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভাবে তার বাবার কথা। তার মনকে সে কিছুতেই মানাতে পারে না। হ্যামলেট বুঝতে পারলেন পাগলামোর ভান করতে গিয়ে পলোনিয়াসকে খুন করে তিনি খুবই ভুল করেছেন। এ ভুল শোধরাবার জন্য ক্লডিয়াসের ইচ্ছে মতো ইংল্যান্ডে যাওয়া ছাড়া তার সামনে অন্য কোনও রাস্তা নেই। ক্লডিয়াসকে তিনি জানালেন ইংল্যান্ডে যেতে কোনও আপত্তি নেই তার। ক্লডিয়াস মনে মনে হাসলেন ভাইপোর কথা শুনে। ভাইপোর ইংল্যান্ডে যাবার সব ব্যবস্থাই করে দিলেন ক্লডিয়াস, সেই সাথে তার কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরকেও সঙ্গে দিলেন। এবার ক্লডিয়াস ব্যবস্থা নিলেন পথের কাঁটা সরাবার। সে সময় ইংল্যান্ড ছিল ডেনমার্কের অনুগত। তিনি একটা চিঠি লিখলেন ইংল্যান্ডের রাজাকে। তাতে লেখা রইল হ্যামলেট ইংল্যান্ডের মাটিতে পা দেবার সাথে সাথেই তিনি যেন তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। ক্লডিয়াসের যে সমস্ত বিশ্বস্ত অনুচরেরা হ্যামলেটের সাথে যাচ্ছিল, তাদেরই একজনের হাতে চিঠিটা তুলে দিলেন তিনি। কিন্তু একাজে সফল হলেন না। ক্লডিয়াস। জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যাবার পথে চিঠিটা হস্তগত হল হ্যামলেটের। চিঠিতে নিজের নামটা কেটে দিয়ে সে জায়গায় পত্ৰবাহক আর তার সঙ্গীর নাম লিখে যথাস্থানে চিঠিটা রেখে দিলেন হ্যামলেট। এদিকে ইংল্যান্ডে পৌঁছাবার আগে মাঝদরিয়ায় একদল জলদসু্য এসে আক্রমণ করল তাদের জাহাজ। জলদসু্যরাও জাহাজে করে এসেছিল। খোলা তলোয়ার হাতে হ্যামলেট বাঁপিয়ে পড়লেন তাদের জাহাজে। যাকে সামনে পেলেন, তাকেই কচুকাটা করলেন। হ্যামলেটের সহগামীক্লডিয়াসের বিশ্বস্ত অনুচরেরা কিন্তু তার বিপদে এগিয়ে এলো না। হ্যামলেটকে একা ফেলে এই ফাকে তারা নিজেদের জাহাজ নিয়ে পালিয়ে গেল। একা একা জলদসু্যদের সাথে লড়াই করে তিনি শেষে বন্দি হলেন তাদের হাতে। তারা আগেই মুগ্ধ হয়েছিল হ্যামলেটের সাহস আর বীরত্ব দেখে। এরপর যখন তারা শুনল যে ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট, তখন তারা নিজেদের জাহাজে চাপিয়ে হ্যামলেটকে নামিয়ে দিল ডেনমার্কের সমুদ্র উপকূলে। তারপর জলদসু্যরা সবাই চলে গেল।
হ্যামলেট দেশে ফিরে গিয়ে দেখলেন বাবার শোকে তার প্রেমিক ওফেলিয়া সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। তিনি শুনতে পেলেন মনের দুঃখে ওফেলিয়া স্নান, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম–সবই বিসর্জন দিয়েছে, সময়মতো সে বাড়িতেও যায় না। দিনরাত হয় সে তার বাবার কবরের ওপর পড়ে থাকে, নতুবা আপন মনে গান গেয়ে গেয়ে কবরের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। তার খুশি মতো আশপাশের গাছ থেকে ফুল পেড়ে কবরের উপর ছড়িয়ে দেয় সে। কেউ কবরখানায় এলে তার হাতে ফুল তুলে দিয়ে বলে, দাও, কবরের উপর ছড়িয়ে দাও। ওফেলিয়ার জন্য খুব অনুতপ্ত হলেও হ্যামলেটের করার কিছু নেই, কারণ তার মতো তিনি নিজেও অসহায়।
হ্যামলেটেরই সমবয়সি পালোনিয়াসের ছেলে লিয়ার্টিস। সেও হ্যামলেটের মতো ওস্তাদ তলোয়ারের লড়াইয়ে। অল্প কিছুদিন আগে লিয়ার্টিস ফ্রান্সে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে সে শুনল পাগলামোর ভান করে তার বাবাকে হত্যা করেছে। হ্যামলেট আর তার বোন ওফেলিয়া পাগল হয়ে গেছে সেই শোকে। সবকিছু শুনে তিনি হ্যামলেটের উপর বেজায় রেগে গেলেন। সুযোগ বুঝে সে রাগকে আরও উসকিয়ে দিলেন ক্লডিয়াস। তিনি লিয়ার্টিসকে বললেন, তোমার বাবা ছিলেন আমার অনুগত, খুবই বিশ্বস্ত এক মন্ত্রী। তার মৃত্যুর প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে। তবেই শান্তি পাবে তাঁর আত্মা। সেই সাথে দেশের মানুষও পরিচয় পাবে তোমার পিতৃভক্তির। মায়ের সামনে পাগলামোর ভান করে অন্যায়ভাবে সে খুন করেছে তোমার বাবাকে। এখন তোমার একমাত্র কর্তব্য হ্যামলেটের অপরাধের জন্য তাকে যথোচিত শাস্তি দেওয়া। তবে মনে রেখ, উত্তেজিত হয়ে কোনও কাজ করতে যেও না, তাতে বিপদের সম্ভাবনা আছে। দেশের মানুষ এখনও ভালোবাসে হ্যামলেটকে। এবার তুমি ভেতরে ভেতরে তৈরি হও প্রতিশোধ নেবার। আর আমার উপর ছেড়ে দাও পুরো ব্যাপারটা, ব্যবস্থা যা করার তা আমিই করব।
এবার রাজা ক্লডিয়াস এক নতুন মতলব আঁটলেন হ্যামলেটকে হত্যা করার। তিনি আয়োজন করলেন তার রাজ্যের ভেতর এক তলোয়ার প্রতিযোগিতার। হ্যামলেট ও লিয়ার্টিস-উভয়েই ভালো তলোয়ারবাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন দেশের অল্পবয়সি যুবকদের কাছে। ক্লডিয়াস স্থির করলেন হ্যামলেটকে মেরে ফেলতে তার এই খ্যাতিকেই তিনি কাজে লাগাবেন। প্রতিযোগিতায় যে তলোয়ার ব্যবহৃত হয় তার ফলা থাকে ভোঁতা, কিন্তু ক্লডিয়াসলিয়ার্টিসকে বোঝালেন যে তার ও হ্যামলেটের–উভয়ের হাতেই থাকবে ধারালো তলোয়ার, যার ফলা হবে খুবই ছুচোলো। আর লিয়ার্টিসের তলোয়ারের দু-ধারে এবং ফলায় মারাত্মক বিষ মিশিয়ে রাখবেন তিনি। সে বিষ এমনই তীব্র যে তার সংস্পর্শে এলেই মৃত্যু অবধারিত। এছাড়া হ্যামলেটের মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য অন্য ব্যবস্থাও তিনি করেছেন বলে জানালেন ক্লডিয়াস। তলোয়ারের আঘাতে যদি হ্যামলেটের মৃত্যু না হয়, তা হলে মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে তার জন্য নির্দিষ্ট শরবতের গ্রাসে মিশনো থাকবে বিষ–এ আশ্বাসও তিনি দিলেন। লিয়ার্টিসকে। খেলার ফাকে যখন হ্যামলেটের তেষ্টা পাবে, তখন যাতে বিষ মেশানো শরবত তার হাতে তুলে দেওয়া হয়, সে ব্যবস্থাও করে রাখবেন তিনি।