নাটক লেখা শেষ হলে হ্যামলেট তা পড়ে শোনালেন অভিনেতাদের। নাটকের কাহিনিটা তাদের খুবই পছন্দ হল। তারা চুটিয়ে মহড়া দিতে লাগলেন। মহলা চলতে চলতে নাটকের দিনক্ষণও স্থির হয়ে গেল।
নাটক অভিনয়ের দিন হ্যামলেট শুরুতেই রাজা রানির খুব কাছে এসে বসলেন। সেখান থেকে পাদপ্রদীপের আলোয় তিনি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন তাদের হাব-ভাব। নাটক এগিয়ে যাবার সাথে সাথে হ্যামলেট স্পষ্ট বুঝতে পারলেন নতুন রাজা ক্লডিয়াসের মুখখানা কেমন যেন বিবৰ্ণ হয়ে পড়ছে। এর কিছুক্ষণ বাদে বাগানে ঘুমন্ত রাজার কানে বিষ ঢেলে দেবার দৃশ্যটা যখন সামনে এল, তখন আর সহ্য করতে পারলেন না ক্লডিয়াস। আসন ছেড়ে উঠে তিনি চলে গেলেন প্রাসাদের ভেতরে। হ্যামলেটের এও নজর এড়াল না যে তার মা রানি গারটুডিও ভেতরে ভেতরে যথেষ্ট অস্থির হয়ে উঠেছেন। এবার আর কোনও সন্দেহ রইল না হ্যামলেটের মনে যে তার বাবা তাকে যে সমস্ত কথা বলেছেন তা সবই সত্যি। এবার নিশ্চিত হয়ে নাটক দেখতে দেখতে স্থির করলেন হ্যামলেট, অন্যায়ের প্রতিবিধান করার যে প্রতিজ্ঞা তিনি বাবার কাছে করেছেন তা অবশ্যই তাকে পালন করতে হবে। বাবার হত্যাকারীর সাথে তার যে সম্পর্কই থাকুক না কেন, তিনি নিজ হাতে শাস্তি দেবেন তাকে।
নাটক অভিনয়ের শেষে রাজা ডাকলেন অভিনেতাদের, প্রশংসা করলেন তাদের দলগত অভিনয়ের। সাথে সাথে পারিশ্রমিক ছাড়াও বকশিশ দিলেন তাদের। শেষে রাজা জানতে চাইলেন এই নাটকের রচয়িতা কে। রাজা অবাক হয়ে ভু কুঁচকোলেন যখন তিনি শুনলেন তার ভাইপো হ্যামলেটই লিখেছেন এ নাটক। তিনি খুব ধাক্কা খেলেন। ভেতরে ভেতরে।
এদিকে দিনে দিনে বেড়েই চলল হ্যামলেটের পাগলামি। রানি এবং মন্ত্রী পালোনিয়াসের সাথে পরামর্শ করে রাজা ক্লডিয়াস স্থির করলেন যে হ্যামলেটকে এ রাজ্যে রাখা মোটেই নিরাপদ নয়। যে করেই হোক, তাকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও দেশের বাইরে পাঠাতে হবে। তার মা রানি গারট্রড স্বয়ং দায়িত্ব নিলেন এ কাজের। ক্লডিয়াসের দুর্ভাবনাও কম নয়। হ্যামলেটকে নিয়ে। কারণ যে করেই হোক হ্যামলেট জানতে পেরেছেন যে তিনিই হত্যা করেছেন তার বাবাকে। এ পরিস্থিতিতে যে কোনও সাংঘাতিক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যদি হ্যামলেট দেশে থাকেন।
মন্ত্রী পালোনিয়াসের লোক এসে হ্যামলেটকে জানাল বিশেষ কারণে রানি গারট্রড দেখা করতে চান তার সাথে। পলোনিয়াস ওদিকে আবার গারট্রডকে বললেন রানি মা! হ্যামলেটের সাথে দেখা করার সময় আপনি খুব স্বাভাবিক আচরণ করবেন। তাকে বলবেন, আপনি আর সইতে পারছেন না তার দুঃখ। আপনার কোনও ভয় নেই, আমি লুকিয়ে থাকব আপনার ঘরের পর্দার আড়ালে। আমার লোক গেছে তাকে খবর দিতে। এখনই এসে যাবেন তিনি, বলেই ঘরের পর্দার আড়ালে লুকোলেন পলোনিয়াস; কিছুক্ষণ বাদে মা মা বলতে বলতে হাজির হলেন হ্যামলেট। মার কাছে জানতে চাইলেন কেন তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে।
আমি মনে খুব আঘাত পেয়েছি তোমার আচরণে, বললেন রানি, তুমি দুঃখ দিয়েছ বাবার মনেও।
তা হতে পারে মা বললেন হ্যামলেট, তবে শুধু আমি নই, তুমিও দুঃখ দিয়েছ আমার বাবার মনে। হ্যা, তবে তুমি খুশি করতে পেরেছ দেশের বর্তমান রাজাকে, যিনি আবার তোমার বর্তমান স্বামী।
তুমি কি আমায় ভুলে গেছ হ্যামলেট? বললেন রানি।
না! আমি তোমায় মোটেও ভুলিনি, উত্তর দিলেন হ্যামলেট, মহান যিশুর নামে শপথ করে বলছি তোমায় আমি ভুলিনি। তুমি আমার গৰ্ভধারিণী মা, ডেনমার্কের রানি আর এখন আমার বাবার ভাইয়ের স্ত্রী।
কাঁদো কঁদো গলায় বলে উঠলেন রানি, হ্যামলেট! কেন তুমি এভাবে আমার সাথে কথা বালছ?
তুমি স্থির হয়ে বসো মা, বললেন হ্যামলেট, আমি একটা দৰ্পণ রাখছি তোমার সামনে। দর্পণ অর্থাৎ তোমার যাবতীয় অন্যায় ও দুষ্কর্মের কথা শোনাব তোমায়। সে সব শুনলেই তুমি বুঝতে পারবে আসল চরিত্রটা কী। সেই সাথে এও বুঝতে পারবে কেন আমি তোমার সাথে এরূপ আচরণ করছি।
ছেলের কথা শুনে ভয় পেয়ে বলে উঠলেন রানি, তুই কি আমায় হত্যা করতে চাস হ্যামলেট? ওরে কে কোথায় আছিস, আমায় বঁচা।
রানির আর্তনাদ শুনে পর্দার আড়াল থেকেই বললেন পলোনিয়াস, ভয় নেই রানিমা। পর্দার আড়াল থেকে পুরুষের গলা ভেসে আসছে দেখে হ্যামলেট ধরেই নিলেন যে তার কাকা ক্লডিয়াস লুকিয়ে আছেন সেখানে। একথা মনে হতেই তিনি খাপখোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন পর্দার উপর, যার আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন পলোনিয়াস। সজোরে সেই তলোয়ার বসিয়ে দিলেন পলোনিয়াসের বুকে। পলোনিয়াস আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে, চারিদিক ভেসে যেতে লাগল রক্তে।
হাঃ হাঃ এই ব্যাপার! আমি তো ভেবেছি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে চেচাচ্ছে একটা ইদুর: বলেই পাগলামির ভান করে হাসতে লাগলেন হ্যামলেট। দেখতে দেখতে এ খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল গেল যে মায়ের সাথে দেখা করতে এসে হ্যামলেট নিজ হাতে হত্যা করেছেন মন্ত্রীকে। এ খবর শুনে ভয়ে থর থর করে কেঁপে উঠল প্রাসাদের সবাই। ভয়ের কারণ একটাই, পাগলামিতে পেয়েছে হ্যামলেটকে। কে বলতে পারে পাগলামোর মুখে তিনি কখন কী করে বসবেন?
দেশের মানুষ ভালোবাসে হ্যামলেটকে। তাই ইচ্ছে সত্ত্বেও রাজা ক্লডিয়াস এতদিন পর্যন্ত কোনও চেষ্টা করেননি তাকে মেরে ফেলার। তিনি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন যে কোনও ছুতোয় হ্যামলেটকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে তাকে হত্যা করার। আচমকা সে সুযোগ এসে গেল ক্লডিয়াসের হাতে, যখন হ্যামলেটের হাতে মারা গেলেন মন্ত্রী পালোনিয়াস। ভাইপোর জন্য যেন রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। এরূপ ভাব দেখিয়ে ক্লডিয়াস পরামর্শ দিলেন তার ভাইপোকে –অকারণে পলেনিয়াসকে হত্যা করে যে অন্যায় তিনি করেছেন, দেশবাসীর মন থেকে তা মুছে ফেলতে গেলে বেশ কিছুদিন তার বিদেশে গিয়ে কাটিয়ে আসা উচিত। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ইংল্যান্ডই তার পক্ষে আদর্শ জায়গা।