বিদূষক উত্তর দিল, আপনি লিয়ারের ছায়া।
রাজা বললেন, তবে যে লোকে বলছে আমি সেই তিন মেয়ের বাবা রাজা লিয়ার আর তুমি গনেরিল?
গনেরিল বলল, বয়সের কারণেই আপনার এই ভ্ৰাস্তিজনিত মানসিক দুর্বলতা। আপনি বৃদ্ধ ও সম্মানিত। সে কারণে আপনার বোঝা উচিত যে আপনার অনুগত একশো নাইটের আচরণ খুবই অশোভন। সব সময় তারা মদ খেয়ে বাজে কাজে লিপ্ত থাকে। গোটা রাজসভাটা এজন্য পরিণত হয়েছে এক বিলাস কেন্দ্রে। সে কারণে এখনই আমাদের উচিত ওই বিশৃঙ্খলাকারীদের অপমান করা। আমার কথা শুনুন বাবা। বয়স অনুযায়ী আপনার উপযুক্ত সঙ্গী আর অনুচরদের রেখে তাড়িয়ে দিন বাকিদের। আপনি না করলে বাধ্য হয়েই এ কাজ করতে হবে আমায়।
খুবই অপমানিত বোধ করলেন রাজা লিয়ার। তিনি বেজায় রেগে গেলেন এত বড়ো একটা অপমানের আঘাতে। চিৎকার করে তিনি বললেন, অকৃতজ্ঞ মেয়ে, আমি এ প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভুলে যেও না, আমার আরও সস্তান আছে।
গনেরিল, আমার লোকজনের উপর নিন্দনীয় আচরণ করছে আপনার অনুচরেরা।
এমন সময় প্রবেশ করল আলবেনি। কিন্তু তাকে দেখেও থামলেন না। রাজা। সজোরে প্রতিবাদ করে তিনি বললেন, গনেরিল, তুমি শুধু লোভী নও, মিথ্যেবাদীও বটে আমার অনুচরেরা সবাই জ্ঞানী ও গুণী। কোনওরূপ অশোভনীয় আচরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর অনুতপ্ত রাজা নিজের মাথায় হাত চাপড়িয়ে বলতে লাগলেন, হায়! হায় কর্ডেলিয়ার চরিত্রের যে সমস্ত দোষ আমার চেতনাকে নষ্ট করে দেয়, তার প্রতি ঘৃণা আর তিরস্কারের মধ্য দিয়ে মুখামি প্রবেশ করে বিষাক্ত করে তোলে আমায়, সেই বোধকে আজ ধিক্কার জানাচ্ছে রাজা লিয়ার।
আলবেনি বলল, আপনি অযথা উত্তেজিত হবেন না মহারাজ। অনুগ্রহ করে শাস্ত হোন। আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ।
লিয়ার বললেন, হয়তো তাই। তবুও তোমায় অভিশাপ দিচ্ছি গনেরিল তোমার এই কদৰ্য নোংরা দেহ বঞ্চিত হবে সন্তান ধারণের গৌরব আর আনন্দ থেকে। আর সন্তান জন্মালেও তা হবে অদ্ভুত ধরনের। তার জন্য দুশ্চিন্তায় বিশ্ৰী হয়ে যাবে তোমার এই সুন্দর মুখ, শুকোবে না। চোখের জলও। তোমার পক্ষে তীক্ষ্ণ আর যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠবে বিষাক্ত সাপের দাঁতের মতো সেই সন্তান। আমি চলে যাচ্ছি। কারণ আমায় যেতেই হবে।
রাজা লিয়ার চলে যাবার পর আলবেনি বলল, এর অর্থ কী গনেরিল? গনেরিল বলল, জেনে রেখ, এটা ওর বুড়ো বয়সের হঠকারিত।
লিয়ার আবার ফিরে এসে গনেরিলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, তোমার এত দুঃসাহস যে আমার অনুমতি ছাড়াই পঞ্চাশ জন অনুচরকে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রাসাদ ছেড়ে যাবার আদেশ দিয়েছ তুমি? ছিঃ গনেরিল, বৃদ্ধ বাবাকে অপমান করে তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরানোর প্রবৃত্তি দেখে আমি যত না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে বেশি পেয়েছি লজ্জা। মনে রেখ, দয়া-মমতাময়ী আমার আর এক কন্যা আছে! এর শাস্তি সে তোমাকে দেবে! আমি অভিশাপ দিচ্ছি, অনুশোচনায় দগ্ধ হবে তোমার সমস্ত মন।
রাজা লিয়ারের পেছু পেছু চলে গেল কেন্ট ও অন্যান্য অনুচরেরা।
গনেরিল বলল তার স্বামীকে, দেখলে ওর ব্যবহারটা?
আলবেনি বলল, তোমার প্রতি আমার আকৃত্রিম ভালোবাসাই আমায় বলতে বাধ্য করছে যে কাজটা তুমি ঠিক করনি।
তুমি চুপ কর— বলে স্বামীকে থামিয়ে দিলেন গনেরিল। তারপর বিদূষককে বললেন, শয়তান, মুখ! তুমিও দূর হয়ে যাও বাবার সাথে। ওর বার্ধক্যজনিত এই ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার আরও বেশি প্রশ্রয় পেয়েছে অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সুসজ্জিত একশো নাইটের শক্তিবলে, আর দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের অত্যাচার সহ্য করা নিশ্চয়ই আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তোমার ভয় নিতান্তই অমূলক–বলল আলবেনি।
তা হয় হোক, বলল গনেরিল, আসলে ভয় থেকে মুক্ত হতে গেলে আগে থেকেই জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া প্রয়োজন, নইলে ভবিষ্যতে সেখান থেকেই বীর বংশের বীজ উৎপন্ন হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। যদি আমার বোন একশো নাইট সহ বাবাকে আশ্রয় দেয়, তাহলে— এই যে অসওয়াল্ড, লিখেছ সেই চিঠি? জানতে চাইল গনেরিল।
অসওয়াল্ড উত্তর দিল, হ্যাঁ, লিখেছি।
গনেরিল নির্দেশ দিল অসওয়াল্ডকে, তাহলে ঘোড়ায় চেপে এখনই এই চিঠি নিয়ে চলে যাও বোনের কাছে। আরও কিছু কারণ দেখিয়ে জোরদার করে তোেল আমার যুক্তিগুলিকে-যাতে সেও ভয় পায়! যাও, এবার চলে যাও। অসওয়াল্ড চলে যাবার পর আলবেনিকে উদ্দেশ করে। বলল গনেরিল, তুমি যত না দুর্বল তার চেয়ে বেশি বোকা।
স্ত্রীর মুখে একথা শুনে আলবেনি বলল, তুমি জান তো অনেক সময় অধিক লোকের দ্বারা ঠকে গিয়ে মানুষ বঞ্চিত হয় তার প্রাপ্যবস্তু থেকে।
তাহলে কী বলতে চাও তুমি? জানতে চাইলে গনেরিল।
আলবেনি তার উত্তরে বলল, কিছুই বলতে চাই না আমি। ভবিষ্যৎই প্রমাণ করবে সব কিছু।
কেন্টের হাতে একটা চিঠি দিয়ে লিয়ার বললেন তাকে, এই চিঠিটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও গ্লস্টারের হাতে। চিঠিতে যা লেখা আছে আর আমার মেয়ে যা জানতে চায়, ঠিক সেটুকুরই উত্তর দেবে, বেশি কিছু মোটেও বলবে না। এটা নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাও। নইলে তার আগেই আমি গিয়ে পৌঁছাব সেখানে।
তাই হবে প্রভু বলল কেন্ট, আপনার আদেশ পালনের আগে আমি অন্য কিছুতে মন দেব না।
এবার বিদূষক বলল, সত্যি কথা বলার জন্য আমায় ক্ষমা করবেন মহারাজ। আপনার কন্যার আচরণ কী হবে সে তো আপনি ভালেই জানেন।