শুভ বা অশুভ, যেরূপ প্ৰেতাত্মাই আপনি হন না কেন, চিৎকার করে বলল হ্যামলেট, যে রূপেই আপনি আমার কাছে এসে থাকুন, আমি কথা বলতে চাই আপনার সাথে। আমাকে কিছু বলার থাকলে আপনি স্বচ্ছন্দে তা বলুন, রোজ রাত্রে আপনি কেন এভাবে এখানে আসেন?
চাপা স্বরে জবাব দিল সেই প্রেতিমূর্তি, হ্যামলেট! আমি তোমার নিহত বাবার প্ৰেতাত্মা।
চিৎকার করে বলে উঠল। হ্যামলেট, নিহত? কী বলছেন আপনি?
উত্তর দিল প্রেতিমূর্তি, আমার সব কথা আগে শোন। তোমার কাকা ক্লডিয়াসই হত্যা করেছে আমায়। একদিন আমি যখন বাগানে শুয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলাম, সে সময় সবার নজর এড়িয়ে হেবোনা গাছের বিষাক্ত রস আমার কানে ঢেলে দেয় ক্লডিয়াস। আর ক্লডিয়াসের ঐ চক্রাস্তে তাকে সাহায্য করেছে আমার স্ত্রী, তোমারই গর্ভধারিণী গারট্রড। এ সব কারণে আমি খুব অশাস্তিতে আছি। হ্যামলেট, তুমি আমার একমাত্র সস্তান। সবকিছু বললাম তোমাকে। এ অন্যায়ের প্রতিবিধান তুমি করো, বিদায়! বলেই অদৃশ্য হয়ে গেল সেই প্রেতিমূর্তি, আর বিস্ময়ে হতবাক হ্যামলেট তখন অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ল দুর্গের ছাদের ওপরে। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বিশ্বাস করে প্ৰেতাত্মার মুখে শোনা সব কথা জানালেন বন্ধু হোরেশিও আর মার্সোল্লাস নামে এক রক্ষীকে। সেইসাথে এই প্রতিশ্রুতিও তিনি তাদের কাছ থেকে আদায় করলেন যে তারা কাউকে কিছু বলবে না।
যা দেখলাম আর তোমার কাছে শুনলাম, তা সবই অদ্ভূত, মন্তব্য করলেন হোরেশিও মৃত আত্মা কি কথা বলতে পারে?
আমাদের অজান্তে এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু ঘটছে যার কোনও উল্লেখ বা ব্যাখ্যা বইয়ে নেই। হোরেশিওকে জানালেন হ্যামলেট।
হ্যামলেটের মনে প্রচণ্ড প্রভাব ফেলেছে সে রাতের ঘটনা। একএক বার সে নিজমনে বলছে বাবার প্ৰেতাত্মার মুখে যা শুনলাম তা কি সত্য? সত্যি হলে অবশ্যই এর প্রতিবিধান আমায় করতে হবে, আবার পরীক্ষণেই তার মনে হল, শুধু প্ৰেতাত্মার মুখের কথায় বিশ্বাস করে প্রতিবিধান নেবার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা কি ঠিক? এর চেয়ে হাতে নাতে যুক্তিগ্রাহ্য কোনও প্রমাণ কি সংগ্রহ করা যায় না যাতে আমি নিশ্চিত হতে পারি। কাকার পাপ সম্পর্কে?
হ্যামলেট পাগলের মতো হয়ে উঠলেন রাতদিন এ সব কথা ভেবে ভেবে। রাজ্যের বৃদ্ধ মন্ত্রী পলোনিয়াসের একটি ছেলে ছিল, নাম লিয়ার্টিস আর মেয়ের নাম ওফেলিয়া। দেখতে অপরূপ সুন্দরী ছিল ওফেলিয়া; ওফেলিয়া যেমন মনে-প্ৰাণে ভালোবাসত তরুণ হ্যামলেটকে তেমনি হ্যামলেটও ভালোবাসতেন তাকে। রাজ্যের সবাই মেনেইনিয়েছিল যে হ্যামলেটের সাথে ওফেলিয়ার বিয়ে হবে। হ্যামলেটের হাব-ভাব, কথাবার্তায় অস্বাভাবিকতার লক্ষণ দেখা গেছে —সবার মুখে একথা শুনে খুবই চিস্তার মাঝে পড়ে গেলেন পলোনিয়াস। হোক না হ্যামলেট রাজার ছেলে, কিন্তু বাবার মৃত্যুতে যিনি পাগল হতে বসেছেন, সে কথা জেনে কি তার সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়? আর বিয়ে দিলেও কি তার পরিণতি সুখের হবে? স্বাভাবিক কারণেই এ সব চিস্তা এসে দেখা দিচ্ছে পালোনিয়াসের মনে।
হ্যামলেট পড়েছেন সমস্যায়। বাবার মৃত্যুর পরও মাকড়সার জালের মতো এক চক্রান্ত যে তাকে ঘিরে ধরছে, সে কথা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কাউকে অপরাধী বা ষড়যন্ত্রের সাথে সরাসরি জড়িত বলে ধরতে পারছেন না। শেষে অনেক ভেবে-চিন্তে এ সমস্যা সমাধানের হদিস পেলেন তিনি–রাজা, রানি, পালোনিয়াস, ওফেলিয়া, সবার উপর আড়াল থেকে কড়া নজর রাখা দরকার। খুঁটিয়ে বিচার করা দরকার এদের সবার আচার-আচরণ, কথাবার্তা। আর সেকােজ সেই করতে পারে যাকে কেউ গ্রাহ্যের মধ্যে আনবেন না। অথচ সে সবার উপর নজর রাখতে পারবে। এই ভেবে হ্যামলেট এমন আচরণ করতে লাগলেন যেন তিনি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন। হ্যামলেটের অদ্ভুত আচরণ আর পাগলাটে কথাবার্তা শুনে রাজপ্ৰসাদের অধিবাসীরা সবাই খুব বিপন্ন হলেন। হ্যামলেটের পাগলামো কিন্তু নিছক পাগলামো নয়, অসংলগ্ন কথার ফাঁকে ফাকে তিনি এমন সব সরস অথচ তীক্ষা মন্তব্য ছেড়ে দেন যার খোঁচায় রাজা, রানি, পলোনিয়াস–সবাই তীব্র বেদনা পান মনে। আর ঠিক তখনই তাদের মনে প্রশ্ন জাগে হ্যামলেট কি সত্যিই পাগল হয়ে গেছেন না। এসব নিছক পাগলামির ভান। এটা যদি পাগলামির ভান হয়, তাহলে নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনও বদ। উদ্দেশ্য আছে! তাহলে সে উদ্দেশ্যটা কী ধরনের, সে চিন্তাও জেগে ওঠে তাদের মনে।
হ্যামলেটের এই ধরনের আচরণে সবচেয়ে বেশি ব্যথা পেল তার প্রেমিক ওফেলিয়া। যেমন দেখতে সুন্দর ওফেলিয়া তেমনি সরল তার খোলামেলা মন। কোনও কুটিলতার ছায়া এখনও পর্যন্ত পড়েনি সেখানে। তাই হ্যামলেটের এই অস্বাভাবিক আচরণে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেল ওফেলিয়া তার মনে।
এভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলি। রাজার প্ৰেতাত্মার আর আবির্ভাব হয়নি এলসিনোর দুর্গ প্রাকারে। হ্যামলেট কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছে না। বাবার মুখ থেকে শোনা সে রাতের হতাশাজনক কথাবার্তাগুলি। তাকে অন্যায়ের প্রতিবিধান করতে বলেছেন বাবার সেই প্রেতিমূর্তি। হ্যামলেট ঠিকই বুঝতে পেরেছেন কাদের অন্যায়ের কথা বলেছেন তার বাবা। কিন্তু তিনি ভেবে পাচ্ছেন না, এক তিনি কী ভাবে সে অন্যায়ের প্রতিবিধান করবেন। অনেক ভেবে শেষমেশ তিনি এক বুদ্ধি বের করলেন। রাজপ্ৰসাদে নাটকের অভিনয় করতে সেসময় শহরে এসে জুটেছে একদল অভিনেতাঅভিনেত্রী। তিনি স্থির করলেন তাদেরই কাজে লাগাবেন রাজা-রানির মনোভাব যাচাই করতে। তাদের সাথে দেখা করে হ্যামলেট বললেন, তিনি একটা নাটক লিখেছেন যা তাদের দিয়ে তিনি অভিনয় করাতে চান রাজপ্রাসাদে। অভিনেতারা সবাই খুশি হল তার কথা শুনে। এতো তাদের কাছে আনন্দের কথা যে যুবরাজের লেখা নাটকে তারা অভিনয় করবেন। অভিনেতারা যে তার লেখা নাটকে অভিনয় করতে রাজি, সে কথা জেনে প্রাসাদে ফিরে এসে হ্যামলেট শুরু করলেন নাটক লিখতে। বিষয়বস্তু যদি জানা থাকে তাহলে কুশীলবদের মুখে সংলাপ বসাতে দেরি লাগে না। আর এক্ষেত্রে বিষয়বস্তু তো আগে থেকেই স্থির হয়ে আছে। বাবার প্ৰেতাত্মার মুখে যে কাহিনি শুনেছিলেন হ্যামলেট, হুবহু তারই আদলে লিখতে হবে নাটক— কীভাবে রাজাকে সরিয়ে সিংহাসন দখল করতে রাজার ছোটো ভাইয়ের সাথে রানির চক্রান্ত, ঘুমন্ত রাজার কানে বিষ ঢেলে তাকে হত্যা করে শূন্য সিংহাসন দখল করা-এ সবই থাকবে নাটকে।