ওষুধের প্রভাব কেটে যাবার পরই চোখ মেলে তাকাল জুলিয়েট। কফিনের বাইরে বেরিয়ে সে দেখল বরফ-ঠাণ্ডা মেঝের উপর শুয়ে আছে রোমিও। বহুবার ডেকেও তার কোনও সারা পেলনা জুলিয়েট। সন্দেহ হতে রোমিওর নাকের সামনে হাত নিয়ে দেখলে নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না। ঠিক সে সময় তার নজরে এলো মেঝের উপরে পড়ে রয়েছে একটা শিশি। শিশিটা কুড়িয়ে নিয়ে শুঁকতেই তীব্র গন্ধে তার নাক জ্বলে যেতে লাগল। শিশিতে যে তীব্র বিষ ছিল এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল জুলিয়েট। রোমিওর কোমরের খাপ থেকে ছোরাটা বের করে সজোরে নিজের বুকে বসিয়ে দিল জুলিয়েট। দু-একবার ছটফট করে চিরকালের মতো নিশ্চল হয়ে গেল তার দেহ।
সঠিক সময়ে সন্ন্যাসী লরেন্স এলেন সেখানে। রোমিও-জুলিয়েটের মৃতদেহ দেখে আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি।
খবর পেয়ে ক্যাপুলেট আর মন্টেগু—উভয় পরিবারের লোকেরা সেখানে ছুটে এল তাদের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে। ভেরোনার রাজাও খবর পেয়ে ছুটে গেলেন সেখানে। সন্ন্যাসী লরেন্স সবাইকে বলতে লাগলেন কীভাবে রোমিও-জুলিয়েট ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করেছিল আর নিষ্ঠুর নিয়তির প্রভাবে কীভাবে তা ধ্বংস হয়ে গেল। কীভাবে অতীতের সামান্য শত্রুতার জেরে তাদের উভয় পরিবারের জীবনে এমন সর্বনাশ নেমে এল সে কথা উপলব্দি করে সবার সামনে কেঁদে ফেললেন রোমিও ও জুলিয়েটের বাবা। হাতে হাত মিলিয়ে তারা ঘোষণা করলেন আজ থেকে সমস্ত বৈরিতার অবসান হল—সেই সাথে শপথ নিলেন ভেরোনা শহরের মাঝখানে তাঁরা রোমিও-জুলিয়েটের মর্মর মূর্তি স্থাপন করবেন।
হ্যামলেট, প্রিন্স অব ডেনমার্ক
এলসিনোর দুর্গ ডেনমার্কের রাজপ্রাসাদের ঠিক লাগোয়। রক্ষী ফ্রান্সিস রাত্ৰিবেলায় পাহারা দিচ্ছিল সেখানে। শীতরাত্রির প্রচণ্ড ঠান্ড পুরু চামড়ার পোশাক ভেদ করে গায়ের চামড়া, মাংস, হাড় সব যেন দীত বসাতে চাইছে, গায়ের রক্ত হিম হবার জোগাড়। রাত্রে পাহারা দেবার ব্যাপারটা খুবই আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছে রুক্ষীদের কাছে। ভীতির কারণ অবশ্য একটাই। কয়েক রাত ধরেই দেখা যাচ্ছে একটা রহস্যময় প্রেতিমূর্তি দুর্গপ্রাচীরে এসে দাঁড়াচ্ছে। সেই মূর্তিটা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে রক্ষীদের দিকে। পাহারাদারদের মধ্যে যারা তাকে দেখেছে, তারা সবাই বলছে কী যেন বলতে চায় সেই রহস্যময় প্ৰেত মূর্তিটা, অথচ পারে না। রক্ষীদের কথা অনুযায়ী সেই মূর্তি দেখতে অবিকল প্রাক্তন রাজার মতো—যিনি মারা গেছেন। অল্প কিছুদিন আগে। প্রতি রাতে ঐ প্রেত মূর্তির দেখা পেয়ে, রক্ষীরা ভয় পেয়ে ব্যাপারটা কানে তুলেছে হোরেশিওর। হোরেশিও ছিল মৃত রাজার পুত্র হ্যামলেটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই আশ্চর্যজনক খবর শুনে খুবই বিস্মিত হয়েছেন হোরেশিও। রক্ষীদের কথার সত্য-মিথ্যে যাচাই করতে তিনি নিজেই আজ দুর্গে এসেছেন রাতের বেলায় পাহারা দিতে।
রাতের প্রহর নীরবে গড়িয়ে চলেছে দুর্গের পেটা ঘড়িতে বেজে ওঠা ঘণ্টার আওয়াজের সাথে সাথে। হোরেশিওর উদ্দেশ্য কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। শেষ রাতে সেই প্রেতিমূর্তি আবার এসে দাঁড়াল দুর্গপ্রাচীরে। হোরেশিও নিজেও অবাক হলেন হ্যামলেটের পিতা মৃত রাজার আদলের সাথে প্রেতিমূর্তির অবিকল মিল দেখে।
ঠিক তার পরদিনই তার বন্ধু হ্যামলেটকে সেই রহস্যময় প্রেতিমূর্তির আগমনের কথা জানালেন হোরেশিও। পিতার মৃত্যুকালে হ্যামলেট ছিলেন রাজধানীর বাইরে। বাইরে থেকে ফিরে আসার পর তিনি মায়ের মুখে শুনেছেন যে একদিন দুপুরে তার বাবা যখন বাগানে শুয়ে বিশ্রাম করছিলেন, এক বিষাক্ত সাপ সে সময় দংশন করে তাকে, আর তার ফলেই মারা যান তিনি। বাবার এই অপঘাত মৃত্যুতে হ্যামলেট খুব দুঃখ পেলেন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মানসিক আঘাত পেলেন যখন তার বাবার মৃত্যুর পর কিছুদিন যেতে না যেতেই কাকা ক্লডিয়াস তার বিধবা মা রানি গারট্রডকে বিয়ে করে রাজা হয়ে বসলেন ডেনমার্কের সিংহাসনে। এ ব্যাপারটাকে দেশের লোকেরা খুশি মনে মেনে নিতে না পারলেও ভয়ে তারা মুখ বন্ধ করে রইল। বাবার মৃত্যুর ঠিক পরেই এই বিয়ে আর সিংহাসন অধিকারের ঘটনাকে কিছুতেই মনে-প্ৰাণে বিশ্বাস করতে পারছেন না হ্যামলেট। আবার হদিসও করতে পারছেন না। সত্যিই কী ঘটেছিল। একটা সন্দেহের দোলা! তার বন্ধু হোরেশিও ঠিক এ সময় তাকে শোনালেন সেই প্রেতিমূর্তির নিয়মিত আগমনের কথা। সেই মূর্তিটা নাকি দেখতে ঠিক তার বাবার মতো–কথাটা শুনে হ্যামলেট স্থির করলেন তিনি নিজে দাঁড়াবেন সেই মূর্তির সামনে।
সেদিন রাত প্রায় শেষের পথে, বন্ধু হোরেশিওর সাথে হ্যামলেট এলেন এলসিনোর দূগে পাহারা দিতে। সেই একই জায়গায় অন্যান্য দিনের মতো দেখা দিল প্রেতিমূর্তিটা। সেটা চোখ পড়ামাত্রই হ্যামলেট চেঁচিয়ে উঠে বললেন, বাবা! ডেনমার্কের রাজা! তিনি চেঁচিয়ে ওঠার সাথে সাথে সেই প্রেতিমূর্তিটা হাত নেড়ে ডাকল তাকে। কিছু বুঝতে না পেরে তিনি তাকালেন হোরেশিওর দিকে। তুমি নিৰ্ভয়ে এগিয়ে যাও, হ্যামলেট, তাকে আশ্বস্ত করে বললেন হোরেশিও, উনি হাত নেড়ে তোমাকে ডাকছেন। মনে হয়। উনি তোমাকে কিছু বলতে চান।
মোহাচ্ছন্নের মতো পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন হ্যামলেট। তাকে অনুসরণ করে কিছুদূর যাবার পর তিনি নিশ্চিত হলেন যে এই প্রেতিমূর্তিটা তার বাবারই। তিনি লক্ষ করলেন যে এই মূর্তিটার পরনে সেই একই পোশাক যা জীবিত অবস্থায় রাজা পরতেন।