সন্ন্যাসীর কথায় আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে এল জুলিয়েট। বাবাকে ডেকে সে বলল, ‘বাবা! কাউন্টকে বিয়ে করতে রাজি আমি। তুমি যেদিন বলবে সে দিনই বিয়ে হবে।’
বাবা ভাবলেন সম্ভবত বাড়ি ছাড়ার ভয়েই জুলিয়েট রাজি হয়েছে কাউন্ট প্যারিসকে বিয়ে করতে। যাই হোক, এবার তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়ের বিয়ের দিন-ক্ষণ স্থির করলেন।
সে দিন তার বিয়ে হবে তার আগের রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তার ঘরের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল জুলিয়েট। রোমিওর সাথে প্রথম পরিচয়ের রাতে যে গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে রোমিও সারারাত তার সাথে কথা বলেছিল, সে দিকে তাকিয়ে বহুক্ষণ দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে সন্ন্যাসী প্রদত্ত ওষুধটা খেয়ে ফেলল সে। একটু বাদেই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বাদেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে।
পরদিন সকালে জুলিয়েটকে ডাকতে এসে ধাই দেখতে পেল মড়ার মতো নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে জুলিয়েট। কাছে গিয়ে সে দেখল তা নিশ্বাস-প্রশ্বাস বইছে না, বুকের ধুকপুকুনি নেই, চোখের মণি ওপরে উঠে গেছে। ভয় পেয়ে তৎক্ষণাৎ খবর দিল জুলিয়েটের বাবা-মাকে। তারা এসে মেয়ের অবস্থা দেখে বেজায় ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথেই জুলিয়েটের বাবা চাকরকে পাঠিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। জুলিয়েটকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে ডাক্তার জানালেন বহু আগেই মৃত্যু হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে বাড়িময় কান্নার রোল উঠল। বাড়ির সবাই বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এমন সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে।
মেয়ের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে তার মৃতদেহটিক ফুলে সাজিয়ে কবর দেবার জন্য গির্জায় পাঠিয়ে দিলেন জুলিয়েটের বাবা-মা। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী জুলিয়েটের মৃতদেহটি একদিন সমাধি ক্ষেত্রে রাখার ব্যবস্থা করা হল।
সন্ন্যাসী লরেন্সও চুপচাপ বসে ছিলেন না। একজন বিশ্বস্ত লোককে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিলেন মান্টুয়ায় রোমিওর কাছে। কথা ছিল সেই লোক রোমিওকে সব কিছু খুলে বলবে এবং জুলিয়েটের মৃতদেহ সমাধিকক্ষে রাখা হলে সে রোমিওকে সেখানে নিয়ে আসবে। সন্ন্যাসী লরেন্স জানতেন জুলিয়েট যে ওষুধ খেয়েছে তার মেয়াদ কখন শেষ হবে। তিনিও রাতের বেলা সেখানে চলে আসবে যাতে ঘুম ভেঙে জুলিয়েট দেখে তাকে আর রোমিওকে। এরপর জুলিয়েটকে ভেরোনার সীমান্ত পার করিয়ে মান্টুয়ায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তারই।
অথচ রোমিওর দুর্ভাগ্য এমনই যে সন্নাসীর লোক পৌঁছাবার আগেই ভেরোনা ফেরত অন্য এক লোকের মুখে জানতে পারল জুলিয়েট মারা গেছে। জুলিয়েটের বাবা-মা তার বিয়ে ঠিক করেছিল কাউন্ট প্যারিসের সাথে। কিন্তু বিয়র নির্দিষ্ট দিনে ভোরের আলো দেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি জুলিয়েটের। আগের রাতেই মারা গেছে সে। জুলিয়েটের মৃত্যুর কথা শুনে মন ভেঙে গেল তার। সে স্থির করল আত্মহত্যা করবে। এক ওঝার কাছ থেকে মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করে ভেরোনায় এসে পৌঁছাল সে। অনেক খোঁজ করেও সন্ন্যাসী লরেন্সের লোক খোঁজ পেন না রোমিওর।
আবার রোমিওর মত ঠিক একই অবস্থা হয়েছে কাউন্ট প্যারিসের। জুলিয়েটের অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল প্যারিস। এবার জুলিয়েটের মৃত্যু-সংবাদ শুনে সে যেন সত্যিই পাগল হয়ে গেল। পরদিন সকালেই জুলিয়েটকে সমাধি দেওয়া হবে শুনে তাকে এক ঝলক দেখার জন্য সে রাতেই কাউন্ট এসে হাজির সেই সমাধিক্ষেত্রে। কিন্তু নিয়তি কী নিষ্ঠুর! তিনি আসার কিছু আগেই রোমিও এসেছে সেখানে। সমাধিক্ষেত্রে ঢোকার আগে সে চারপাশে খুঁজে দেখছিল সেখানে কেউ পাহারা দিচ্ছে কিনা।
কাউন্ট প্যারিস সমাধিকক্ষে ঢোকার সময় রোমিওকে হঠাৎ সেখানে দেখে বেজায় চমকে উঠলেন। তিনি জানেন তোমিও ক্যাপুলেটদের চিরশত্রু। কিছুদিন আগে ক্যাপুলেট বংশের টিবল্টকে হত্যার দরুন ভেরোনার রাজার যে রোমিওকে মান্টুয়ায় নির্বাসনে পাঠিয়েছেন সে কথাও অজানা নেই তার। স্বভাবতই কাউন্টের মনে হল সীমান্ত পেরিয়ে এত রাতে এখানে কেন এসেছে রোমিও? নিশ্চয়ই তার কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আছে নইলে সে এখানে ঘোরাঘুরি করছে কেন। জুলিয়েটকে বিয়ে করতে না পারলেও কাউন্ট নিজেকে ক্যাপুলেটদের আত্মীয় বলেই মনে করেন। সে কথা মনে রেখে কাউন্ট তখনই তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন রোমিওর উপর। সাথে সাথে রোমিও পালটা আক্রমণ করল কাউন্টকে। এ ধরনের চোরা-গোপ্তা আক্রমণের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে এসেছিল রোমিও। কিন্তু তলোয়ারবাজিতে তার সাথে মোটেই পাল্লা দিতে পারলেন না কাউন্ট প্যারিস। কিছুক্ষণ বাদেই তিনি রক্তাক্ত দেহে লুটিয়ে পড়লেন সমাধিকক্ষের দোরগোড়ায়। জুলিয়েটের নামটা কোনওমতে আউড়ে চিরকালের মতো নীরব হয়ে গেলেন তিনি।
শত্রু নিধনের পর রোমিও প্রবেশ করলেন জুলিয়েটের সমাধিকক্ষে। সেখানে ঢুকে মোমবাতির মৃদু আলোয় দেখতে পেলেন সামনেই একটা কফিনে শুয়ে আছে জুলিয়েট—প্রাণের স্পন্দন নেই শরীরে। সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের প্রভাব তখনও কাটেনি। জ্ঞান ফিরে আসতে দেরি আছে। কিন্তু রোমিও তো জানে না সন্ন্যাসীর দেওয়া ওষুধের কথা। তাই সে ধরে নিল জুলিয়েটের মৃত্যু হয়েছে। ওঝার দেওয়া বিষের শিশিটা বের করে শেষবারের মতো জুলিয়েটের ঠোঁটে চুমু খেল রোমিও। তারপর শিশির পুরো বিষটা ঢেলে দিল নিজের গলায়। বিষের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কিছুক্ষণ বাদেই জুলিয়েটের কফিনের পাশে শেষ নিশ্বাস ফেলল রোমিও।