তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠল রোমিও, ‘আরে! এযে দেখছি চাঁদের হাট বসাবার ব্যবস্থা হয়েছে। শহরের সম্ভ্রান্ত বংশীয় স্ত্রী-পুরুষ কেউ বাদ নেই এতে।’ লোকটিকে কাগজটা ফিরিয়ে দিয়ে রোমিও বলল, তা ভাই এদের কোথায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা হয়েছে?’
লোকটি উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হুজুর, উপরে।’
‘কী বললে, উপরে! তা সে জায়গাটা কোথায়?’ জানতে চাইল রোমিও।
‘আজ্ঞে, রাতের বেলা আমাদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়ার নিমন্ত্রণ করা হয়েছে এদের সবাইকে। কর্তা বলেছেন নাচ-গানের ব্যবস্থাও করা হয়েছে’—উত্তর দিল লোকটি।
‘তা তোমার মনিবটি কে বাপু?’ জানতে চাইল রোমিও।
‘ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাই আমার মনিব’—বলল লোকটি, তবে আপনি যদি মন্টেগুদের কেউ না হন, তাহলে অনায়াসে সেখানে যেতে পারেন বন্ধুদের নিয়ে। সেখানে গিয়ে রাতে খাওয়া-দাওয়া করবেন। আচ্ছা হুজুর! তাহলে আসি’—বলে চলে গেল লোকটি।
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০৩
৩
রোজালিন নামটাই বারবার ঘুরতে লাগল রোমিওর মাথায়। ঐ তালিকায় রোজালিনের নামও রয়েছে। সে স্থির করল যা হয় হোক, শুধু রোজালিনকে দেখতেই ক্যাপুলেটদের নৈশ ভোজের আসরে যাবে। রোমিওর ভাবনা আন্দাজ করে তাকে ঠাট্টা করে বলল বেনভোলিও, ‘আরে এরে ভাববার কী আছে। রোজালিনের জন্য মন যখন এতই খারাপ, তখন ঝুঁকি নিয়েই ক্যাপুলেটদের বাড়ি গিয়ে দেখে এস তাকে।’
বন্ধু যে ঠাট্টা করছে তা বুঝতে না পেরে রোমিও বলল, ‘যাবই তো, গিয়ে প্রাণ ভরে দেখে আসব তাকে।’
বেনভোলিও বলল, ‘বেশ তো, যাও। হয়তো আজই তোমার শেষ দিন। রোজালিনকে দেখার পর এককোপে তোমার গর্দান নামিয়ে দেবে ক্যাপুলেটরা।
কার্কুসিও বলল, ‘যত ঝুঁকি আর বিপদের ভয় থাকুক না কেন, তোমার কিন্তু সেখানে যাওয়া উচিত। ভেরোনার সুন্দরীরা সেজেগুজে জড় হবে সেখানে। তাদের মধ্যে কাউকে মনে ধরে গেলে রোজালিনকে ভুলে যাবে তুমি—কেটে যাবে তোমার মোহ।’
রোমিও স্থির করল মোহ কাটাতে নয়, প্রাণভরে রোজালিনকে দেখার জন্যই ঝুঁকি সত্ত্বেও ক্যাপুলেটদের বাড়ির নৈশভোজের আসরে যাবে সে। তবে সে একা যাবে না, সাথে থাকবে দু-বন্ধু মার্কুসিও আর বেনভোলিও। তিন বন্ধু স্থির করল শত্রুর চোখে-ধুলো দেবার জন্য তারা ছদ্মবেশ ধরে যাবে।
ফুল আর আলোর রোশনাইয়ে সেজে উঠেছে ক্যাপুলেটদের প্রাসাদসম বাড়িটা। ভেরোনার অল্পবয়সি ছেলে-মেয়েরা নাচ-গানে মেতে উঠেছে ভিতরের বিশাল হলঘরে। তাদের দেখলে মনে হবে রূপ-যৌবন যেন উপচে পড়েছে তাদের দেহে—তারা যেন মর্তের মানুষ নয়, রূপকথার কাল্পনিক স্বর্গ থেকে যেন তারা নেমে এসেছে। দামি পোশাক পরিধান করে ক্যাপুলেটদের বুড়োকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছেন হলঘরের দরজায়। তার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাড়ির একজন সুন্দরী পরিচারিকা—তার হাতের সাজিতে সাজানো রয়েছে একগুচ্ছ ফুটন্ত গোলাপ কুঁড়ি।
কিছুক্ষণ বাদে সেখানে এসে পৌঁছালেন কাউন্ট প্যারিস। তাকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্থ হয়ে পড়লেন বুড়োকর্তা। কাউন্ট শুধু দেখতে সুন্দর নন, প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক তিনি। তার সাধ হয়েছে বুড়োকর্তার একমাত্র মেয়ে জুলিয়েটকে বিয়ে করার।
বহুদিন হল মারা গেছে বুড়োকর্তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরা। বেঁচে আছে শুধু চোদ্দ বছর বয়সি জুলিয়েট। কাউন্ট প্যারিসের সাথে জুলিয়েটের বিয়েতে আপত্তি নেই বুড়োকর্তার, কিন্তু তিনি চান না এখনই বিয়ে হয়ে যাক এই ছোট্ট মেয়েটার। তিনি কাউন্টকে বলেছেন মেয়েটার ষোলো বছর বয়েস হলে তিনি তার বিয়ে দেবেন। দু-বছর যথেষ্ট সময়। কাউন্ট ইচ্ছে করলে এ সময় জুলিয়েটের সাথে মেলামেশা করতে পারেন। বুড়োকর্তার তরফে এ নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। আর এ মেলামেশার ফলে কাউন্টকে ভাবী স্বামী বলে মেনে নেবার জন্য মানসিক দিক দিয়ে তৈরি হতে পারবে। এ কথা অবশ্য ঠিক যে জুলিয়েটের মতো বয়েসে তার গিন্নি অনেকগুলি সন্তানের মা হয়েছিলেন।
গায়ক-বাদকদের ছদ্মবেশে অতিথিদের মধ্যে মিশে গিয়ে রোমিও ও তার দু-বন্ধু এক সময় ঢুকে পড়ল ক্যাপুলেটদের প্রাসাদের ভিতরে। এরা কেউ ক্যাপুলেট পরিবারের সদস্যদের ধারেকাছেও ভেড়েনি। বাড়ির মেয়েরা যেখানে সমবেত হয়েছে, তাদের তিনজোড়া চোখ সেখানেই খুঁজে বেড়াচ্ছে রোজালিনকে। কিন্তু রোজালিনকে খুঁজতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটে যাবে তা কল্পনাও করতে পারেনি রোমিও আর তার দুই বন্ধু।
তার দু-বন্ধু বারবার তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছে, ‘ওভাবে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থক না, সামনে এগিয়ে চল।’ কিন্তু সেদিকে কোনও হুঁশ নেই রোমিওর। পলকহীন দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে সে চেয়ে আছে আর মাঝে মাঝে বন্ধুদের বলছে, ‘কে-রে ভাই ওই মেয়েটা? দোহাই তোদের, ওর নামটা একবার জেনে আয় না।’
কিন্তু মন্দ ভাগ্য রোমিওর। তাই মেয়েটির পরিচয় জানার আগেই ক্যাপুলেটরা জেনে গেল রোমিওর আসল পরিচয়। তার পরিচয়টা যে জানল সে হল ক্যাপুলেট পরিবারের সবচেয়ে শয়তান লোক টিবল্ট—মন্টেগুদের নাম শুনলে যে তেলে-বেগুলে জ্বলে ওঠে। সে একটা চাকরকে ডেকে বলল, ‘যা দৌড়ে গিয়ে, আমার তলোয়ারটা নিয়ে আয়।’
চাকরটা তলোয়ার আনতে যাবে এমন সময় সেখানে এসে পৌঁছলেন ক্যাপুলেট বাড়ির বুড়োকর্তা। টিবল্ট যে চাকরকে ডেকে তলোয়ার আনতে বলেছে সে কথাটা শুনেছেন তিনি আর তাতেই বুঝে গেছেন কোনও একটা গুরুতর ব্যাপার ঘটেছে।