বুড়োকর্তার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি বুড়ো মানুষ। তলোয়ার দিয়ে কী করবে? তার চেয়ে বরং সেই ঠেঙ্গোটা পাঠিয়ে দেই যাতে ভরে দিয়ে তুমি চলা-ফেরা কর।’
‘নাঃ নাঃ ঠেঙ্গোতে হবে না, তলোয়ারই চাই আমার। দেখছ না, বুড়ো মন্টেগু তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে ওরও হাতে রয়েছে তলোয়ার।’
ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাকে দেখামাত্রই হেঁকে উঠলেন মন্টেগুদের বুড়ো কর্তা, ‘অ্যাই বদমাস ক্যাপুলেট! যদি বাঁচতে চাস তো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক। মোটেই বাধা দিবি না আমার কাজে।’
স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে মন্টেগু গিন্নিও বলে উঠলেন, ‘সাবধান করে দিচ্ছি তোদের। আর একপাও এগুবি না।’
এবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের বুড়ো-বুড়িদের মাঝে।
সে সময় ভেরোনার রাজা এসকেলাস তার সভাসদদের নিয়ে সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। গণ্ডোগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ঘোড়া থামিয়ে তিনি সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর দাঙ্গাবাজদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আবার তোমরা রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়েছ? ভালো চাও তো সবার হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দাও।’ রাজার আদেশে সবাই তলোয়ার ফেলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
এরপর মন্টেগু আর ক্যাপুলেট—দুই বুড়োর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রাজা বললেন, ‘আপনারা দুজনেই বয়স্ক লোক, কোথায় আপনারা থামাবেন, তা নয়, তলোয়ার হাতে দুজনেই ছুটে এসেছেন। এই নিয়ে পরপর তিনবার এরূপ কাণ্ড ঘটল শহরে। আমি আপনাদের সাবধান করে দিচ্ছি ভবিষ্যতে এরূপ কাণ্ড ঘটলে আমি বাধ্য হব আপনাদের সবার প্রাণদণ্ড দিতে। যান! হাতের তলোয়ার ফেলে নিজ নিজে কাজে চলে যান।’ এরপর ক্যাপুলেটদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি চলুন আমার সাথে। আর হ্যাঁ মন্টেগু, আপনি আজ দুপুরের বিচারসভায় যাবেন। আমার যা বলার সেখানেই বলব’—বলেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন রাজা।
সবাই চলে যাবার পর মন্টেগু পরিবারের বুড়ো কর্তা জিজ্ঞেস করলেন তার ভাইপোকে, ‘আচ্ছা, বলতো কী হয়েছিল? কে আবার নতুন করে ঝগড়াটা বাধাল?’
কাকার প্রশ্নের জবাবে সেনর বেনভোলিও বললেন, ‘সে সময় আমি এপথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দু বাড়ির কয়েকজন চাকর তলোয়ার নিয়ে লড়াই করছে। আমি ওদের ছাড়াতে গেছি এমন সময় কোথা থেকে খবর পেয়ে টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। টিবল্টের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকেও তলোয়ার বের করতে হয়। এরপরই শুরু হল বেজায় লড়াই। ভাগ্যিস সে সময় এপথ দিয়ে আসছিলেন রাজামশাই। তিনি সাবধান করে দিলেন সবাইকে। নইলে দেখতে পেতেন দু-চারটে লাশ রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, রোমিও ছিল না সেখানে—’ বললেন মন্টেগু গিন্নি, ‘তুমি জান এখন সে কোথায়?’
বেনভোলিও বললেন, ‘আমার মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। খুব সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি বেরিয়েছিলাম পথে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম শহরের পশ্চিম অঞ্চলে। তখন দেখলাম একটা গাছের নিচে পায়চারি করছে রোমিও। আমাকে দেখেই পা চালিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। সেসময় নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিব্রত ছিলাম আমি। আতি ওকে আর ডাকিনি। শুনতে পেলাম রোমিওকে নাকি প্রায়ই এই বনে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।’
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০২
২
বৃদ্ধ মন্টেগুর একমাত্র ছেলে রোমিও। সে একজন সুন্দর-সুপুরুষ-স্বাস্থ্যবান যুবক। সে শুধু সুন্দরই নয়, আচার-আচরণেও খুব ভদ্র। তার মতো সাহসী, বীর সে অঞ্চলে খুব কমই আছে। এক কথায় সে একজন আদর্শ তরুণ।
বেশ ক’দিন ধরেই মন খারাপ রোমিওর। এর কারণ এক রূপসি যুবতি—নাম রোজালিন। রোমিও চায় তাকে বিয়ে করতে কিন্তু রোজালিন মোটেও খুশি নয় তার উপর। বেশ কিছুদিন ধরে রোজালিন না আসায় রোমিওর মন এতই খারাপ যে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে পর্যন্ত দেখা করছে না সে। পাগলের মতো শুধু বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধুর মধ্যে একজন মন্টেগু কর্তার ভাইপো সেনর বেনভোলিও, অপরজন রাজার আত্মীয় মার্কুলিসও। দাঙ্গা বন্ধ হবার পর রোমিওকে খুঁজতে খুঁজতে তারা এসে হাজির হল সেই গভীর জঙ্গলে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তারা দেখা পেল রোমিওর। যার জন্য রোমিওর এ অবস্থা, সেই রোজালিনকে নিয়েও হাসি-ঠাট্টা করল তারা। কিন্তু তাতে দমে না গিয়ে বন্ধুদের অনুনয় করে বলল রোমিও, ‘ভাই, যে ভাবেই হোক তোরা ব্যবস্থা করে দে যাতে অন্তত একবার তার দেখা পাই।’
অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসে যখন তারা রাস্তায় কথাবার্তা বলছিল, সে সময় একজন লোক এসে একটা কাগজ মেলে ধরল তাদের সামনে। কাগজটা আর কিছু নয় একটা তালিকা। তারা পড়ে দেখলে ওতে রয়েছে ভেরোনার সব সম্ভ্রান্ত বংশের নারী-পুরুষদের নাম, বাদ গেছে শুধু মন্টেগু পরিবার। যে লোকটা কাগজ নিয়ে এসেছিল সে ক্যাপুলেটদের বাড়ির চাকর—সম্পূর্ণ নিরক্ষর। কাগজে কী লেখা তা সে জানেনা—ক্যাপুলেট বাড়ি কর্তা-গিন্নিরও জানা নেই সেটা। তারা ওর হাতে কাগজটা ধরিয়ে দিয়েই বলেছেন—’এতে যাদের যাদের নাম লেখা আছে তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আসবি। তাদের বিনীতভাবে বলবি তারা যেন আজ রাতে আমাদের বাড়িতে নৈশভোজনের আসরে যোগ দেন। সেই সাথে নাচ-গানের ব্যবস্থার কথাটাও বলে আসবি।’
‘তাই হবে কর্তা’—বলে কাগজখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সে। সে যে সম্পূর্ণ নিরক্ষর একথাটা লজ্জায় জানাতে পারেনি মনিবকে। কাজেই রাস্তা-ঘাটে যাকে পাচ্ছে, তাকে দিয়েই কাগজটা পড়িয়ে নিচ্ছে। ক্যাপুলেটদের সাথে মন্টেগুদের চিরকালীন রেষারেষির ব্যাপারটা জানত চাকরটি। কিন্তু রোমিও ও তার দু-বন্ধুকে জানতে না সে। জানলে কখনই সে কাগজটি তাদের পড়তে দিত না।