মানসিক রোগে লেডি ম্যাকবেথ আক্রান্ত হবার কিছুদিন বাদেই ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ডের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে স্কটল্যান্ড আক্রমণ করলেন তার প্রধান সেনাপতি সিওয়ার্ড। তার সাথে যোগ দিলেন যুবরাজ ম্যালকম, ম্যাকডাফ, রস এবং অন্যান্য বিদ্রোহী স্কটিশ থেন ও সৈন্যরা।
এখবর পেয়েও নিশ্চিন্তে বসে রইলেন ম্যাকবেথ, কারণ ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণীর উপর ছিল তার অগাধ বিশ্বাস। তিনি জানেন শক্রি তার বাড়ির দোরগড়ায় এসে পড়লেও তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তারা।
শত্রুসৈন্যের দ্বারা দেশ আক্রান্ত হয়েছে আর তাদের আগে রয়েছেন যুবরাজ ম্যালকম, শুধু এটুকু শুনেই মারা গেলেন লেডি ম্যাকবেথ। একটু বাদেই দূত এসে জানাল বার্নাসের জঙ্গল ধীরে ধীরে উঠে আসছে ডানসিনান পাহাড়ে।
খবরটা শুনে দূতকে ধমকিয়ে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, কী বলছিস যা তা? হতভাগা কি দিনদুপুরে নেশা করেছিস? ও বলে কিনা জঙ্গল পাহাড়ে উঠে আসছে। আরে, জঙ্গলের কি আমাদের মতো হাত-পা আছে যে তারা উপরে উঠে আসবে?
দূত বলল, আজ্ঞে মহারাজ, আমি নেশাও করিনি। আর মিথ্যেও বলছি না। আমার কথায় বিশ্বাস না হলে অনুগ্রহ করে আপনি বরং একবার নিজে গিয়ে দেখে আসুন।
দূতের কথা সত্যি কিনা যাচাই করতে ম্যাকবেথ ছুটে এলেন প্রাসাদের বারান্দায়, দেখলেন সত্যি সত্যিই বার্নাসের জঙ্গল উঠে আসছে ডানসিনান পাহাড়ের চূড়ায়। কিছুক্ষণ ভালোভাবে লক্ষ করে দেখার পর ম্যাকবেথ বুঝতে পারলেন। ওগুলো আসল জঙ্গল নয়। ইংরাজ সৈন্যরা বনের গাছ-পালা দিয়ে এমন ভাবে তাদের শরীরকে আড়াল করে ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে পাহাড়চূড়ায় উঠে আসছে, যাতে দূর থেকে তাদের দেখলে মনে হবে সত্যিই যেন একটা গোটা জঙ্গল উঠে আসছে পাহাড়ের উপর।
ডাইনিদের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হতে দেখে বেজায় ভয় পেয়ে গেলেন ম্যাকবেথ।
এমন সময় আরেকজন দূত এসে বলল, মহারাজ, ইংরেজ সেনাপতি সিওয়ার্ড তার বিশাল বাহিনী সহ পৌঁছে গেছেন আমাদের প্রধান ফটকের প্রায় কাছাকাছি —তার সাথে রয়েছেন যুবরাজ ম্যালকম, ম্যাকডাফ এবং অমাত্য রস। এছাড়াও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন দেশের অনেক বিশিষ্ট থেন, অমাত্য এবং সৈনিকেরা।
দূতের কথা শেষ হতে না হতেই বেজে উঠল ইংরেজ সৈন্যদের রণ-দামামা। প্রাসাদে যে কয়জন সৈনিক অবশিষ্ট ছিল, তারাও বাঁপিয়ে পড়ল ইংরেজ সৈন্যদের উপর। প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হল দুন্দলে। কিছুক্ষণ বাদে রক্ষীদের হতাহত করে সসৈন্যে প্রাসাদে এসে ঢুকলেন ম্যাকডাফ তলোয়ার উচিয়ে ম্যাকবেথের সামনে গিয়ে বললেন, শয়তান, তুই এখানে? তোকে নিজ হাতে খুন না করা পর্যন্ত শান্তি পাবে না। আমার মৃত স্ত্রীর-পুত্রের আত্মা।
ম্যাকবেথ বললেন, আমাকে অযথা ভয় দেখিও না ম্যাকডাফ। মাতৃগৰ্ভ থেকে স্বাভাবিক ভাবে জন্ম নিয়েছে এমন কেউ আমার ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ আমার দেহ মায়াবলে সুরক্ষিত। ম্যাকডাফ বললেন, তাহলে তুমিও শুনে রাখা ম্যাকবেথ, আমি অযোনিসস্তুত। অকালে সময়ের আগেই মাতৃগৰ্ভ ভেদ করে জন্ম হয়েছে আমার।
ম্যাকবেথ বললেন, তাহলে ম্যাকডাফ, তুমিই আমার একমাত্র শত্রু। তোমার কথা শুনে আমার সংশয় মিটে গেছে। আমি চাই না তোমার সাথে যুদ্ধ করতে।
তাহলে তুমি আত্মসমর্পণ করা, বললেন ম্যাকডাফ। তোমার হাত-পা শেকল দিয়ে বেঁধে খাচায় বন্দি করে রাখব তোমাকে। তিলতিল করে মৃত্যু-যন্ত্রণা সহ্য করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে তুমি।
দোহাই তোমার, মিনতি জানিয়ে বললেন ম্যাকবেথ, অমন শাস্তি তুমি আমায় দিও না। মানছি, অনেক অপরাধ করেছি আমি। তবুও খাঁচার মধ্যে বন্দি জানোয়ারের মতো ঘৃণ্য জীবনযাপন করতে পারব না আমি। তার চেয়ে আমায় মেরে ফেল, তবু ওরূপ সাজা দিও না।
মনোবল বলতে তখন আর কিছুই নেই ম্যাকবেথের। ভয়ে ভয়ে তলোয়ার হাতে নিয়ে থারথার করে কাঁপিতে লাগলেন তিনি। তৎক্ষণাৎ ম্যাকডাফ কাঁপিয়ে পড়লেন তার উপর। ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ম্যাকবেথ। শত্রুকে বাগে পেয়ে ম্যাকডাফ এসে দাঁড়ালেন তার পাশে, এক কোপে কেটে ফেললেন ম্যাকবেথের মাথা। সেই কাটা মাথা হাতে নিয়ে ম্যাকডাফ গেলেন ম্যালকমের কাছে। ম্যালকমকে মাথাটা উপহার দিয়ে বললেন, এই সেই শয়তানের কাটা মুণ্ডু যে আমার বাবাকে হত্যা করেছিল, গুপ্ত ঘাতক পাঠিয়ে আমায় না পেয়ে মেরে ফেলেছিল আমার স্ত্রী-পুত্রকে। যুবরাজ, আজ থেকে স্কটল্যান্ডের সিংহাসনের অধিকারী আপনি।
সমস্বরে সবাই জয়ধ্বনি করে উঠল, জয়! স্কটল্যান্ডের রাজা ম্যালকমের জয়।
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট – ০১
রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
ভাষান্তর: অজয় দাশগুপ্ত ও অরবিন্দ চক্রবর্তী
১
ইতালি দেশের এক সুন্দর শহর ভেরোনা—প্রাচীনত্ব আর ঐতিহ্যপূর্ণ। রাজা ছাড়াও এদেশে রয়েছে আরও দুটি অভিজাত পরিবার, ধন-সম্পত্তি আর ক্ষমতার দিক দিয়ে রাজার চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নয়। এ দুটি বংশের একটি ক্যাপুলেট, অন্যটি মন্টেগু।
বংশ দুটি ধনী ও অভিজাত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে চিরকালীন শত্রুতা। এ শত্রুতা যে কবে শুরু হয়েছিল তা সবার অজানা। উভয়ের সম্পর্কটা ঠিক সাপে-নেউলের মতো। উভয় পরিবারের শত্রুতার প্রভাব তাদের চাকর-বাকরদের মধ্যেও পড়েছে। রাস্তা-ঘাটে যখনই যেখানে দেখা হয়, কোনও না কোনও অজুহাতে একে অপরের সাথে ঝগড়া বাধায়, মারামারি করে—যার পরিসমাপ্তি হয় রক্তপাতে।