কেন্টের কথা শুনে রাজা বললেন, আমার ভূত্য হিসেবে আমি তোমায় মনোনীত করলাম। এরপর তিনি অসওয়াল্ডকে বললেন গনেরিলকে ডেকে আনতে। এমন সময় জনৈক নাইট এসে জানাল যে রাজার মেয়ে অসুস্থ। লিয়ার জানতে চাইলেন, গনেরিলকি আসবে না! নাইট বলল, আমার অপরাধ নেবেন না প্ৰভু! আমার মনে হয় আপনার মেয়ে-জামাই আর তাদের লোকেরা আগের মতো শ্রদ্ধা করে না। আপনাকে। আপনি এখন তাদের কাছে বোঝা ছাড়া আর কিছু নন।
ঠিকই বলেছ তুমি বললেন লিয়ার, আমিও লক্ষ করেছি যে ওরা কর্তব্যে অবহেলা করছে। তবে মনে করেছিলাম যে ওটা আমার মনের ভুল, ভবিষ্যতে এবিষয়ে তীক্ষ দৃষ্টি রাখব। যাই হোক, আমার বিদূষক কোথায়?
নাইট বললেন, কৰ্ডেলিয়ার দুঃখে তিনি খুবই দুঃখিত মহারাজ। এ দুদিন তাই তিনি আসেননি।
তাকে নিরস্ত করে লিয়ার বললেন, থাক থাক আর বলতে হবে না। আমি স্থির করেছি মেয়ের সাথে কথা বলব। যাও, তাকে ডেকে আন তুমি।
এসময় ঢুকে পড়ল। অসওয়ান্ড। তাকে দেখে লিয়ার বললেন, তুমি জান আমি কে?
অসওয়াল্ড উত্তর দিলেন, জানি। আপনি আমার প্রভুপত্নীর পিতা।
রেগে বললেন লিয়ার, কী বললে? এছাড়া আমার আলাদা কোনও পরিচয় নেই? তোমার এত দুঃসাহস আমার মুখের উপর কথা বলছ? এজন্য আমি তোমায় শাস্তি দেব। বলেই রাজা
শুরু করলেন তাকে মারতে।
তখন কেন্ট বললেন অসওয়াল্ডকে, এই মুহূর্তে এখান থেকে দূর হয়ে যাও নির্বোধি। তোমার কি কাণ্ড-জ্ঞান লোপ পেয়েছে? কার সাথে কীরূপ ব্যবহার করতে হয় তা কি তুমি জান না? বলেই কেন্ট গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিল অসওয়াল্ডকে। কেন্টের এই আচরণে রাজা খুব খুশি হয়ে উপহার দিলেন তাকে।
এমন সময় বিদূষক এসে প্রবেশ করল। তাকে দেখে রাজা ব্যগ্র হয়ে বললেন, তুমি কেমন আছে বিদূষক?
কেন্টের দিকে তাকিয়ে বলল বিদূষক, স্যার, আমার টুপিটা আপনি নিন। কারণ যার অধীনে আপনি কাজ করেন। তিনি স্বয়ং তার দুই মেয়েকে নির্বাসন দিয়েছেন আর অনিচ্ছাসত্ত্বেও তৃতীয় মেয়েটিকে আশীৰ্বাদ করেছেন। ভগবান যদি আমায় দুটো মেয়ে আর দুটো টুপি দেন—
তার কথা শেষ না হতেই রাজা জানতে চাইলেন, তাহলে?
তাহলে বিষয়-সম্পত্তি তাদের দিয়ে দেবার পর অন্তত একটা টুপি আমার জন্য রেখে দিতাম–বলল বিদূষক, আপনাকে এখন অন্য মেয়ের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
রেগে গিয়ে লিয়ার বললেন তাকে, এর জন্য কিন্তু তোমায় শাস্তি পেতে হবে।
বিদূষক বললেন, মহারাজ, ভয় পেয়ে যে নির্বোধ সত্যকে এড়িয়ে যায়, সে শুধু মিথ্যাকেই আরও বেশি প্রশ্রয় দেয়। এবার আপনি শুনুন, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তার সঞ্চায়ের পরিমাণ বাইরের কাউকে জানায় না। সে কম কথা বলে, ব্যয়ের চেয়ে তার আয় বেশি। হাঁটাপথে না গিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে, কোনও কিছুতেই সে দমে না। আর বাজি রাখে বিশেষ বিবেচনার সাথে।
রাজা বললেন, এখানে এ সব কথার কোনও মানে হয় না, খুবই শক্ত তোমার কথাগুলি।
এবার বিদূষক বলল, যে লোকটি আপনাকে বিষয়-সম্পত্তি দান করার পরামর্শ দিয়েছিল তাকে আপনি ডাকুন নয়তো নিজে দাঁড়ান। তার জায়গায়, তাহলেই আপনি বুঝতে পারবেন তেতো ভাঁড় আর মিষ্টি ভাঁড়ের পার্থক্য।
ভাঁড়ের কথা শুনে বললেন কেন্ট, তুমি মোটেও বোকা নও।
ভাঁড় বলল, মোটেও নই, কারণ বোকা হলে চলবে না আমার। এই পৃথিবীর কেউ পুরোপুরি বোকা নয়, রাজার উদ্দেশে বলেই চললেন বিদূষক, আপনি কিন্তু বোকামি করে আপনার সম্পদ ও ক্ষমতা দুভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। এরপর বিদূষক তার কথার সারমর্ম বোঝাতে লাগল একটি গান গেয়ে।
লিয়ার বললেন, কবে থেকে তুমি গান গাইছ?
ভাঁড় বলল, যবে থেকে সবকিছু কন্যাদের দান করে নিঃস্ব হয়েছেন আপনি।
রেগে গিয়ে বললেন লিয়ার, তুমি একটা মিথ্যেবাদী। আমি চাবুক মারব তোমাকে।
ভাঁড় বলল, সত্যি কথা বলার জন্য চাবুক মারে আপনার মেয়েরা। আপনি মারেন মিথ্যে কথা বলার জন্য। কী আশ্চর্য মিল আপনাদের মধ্যে। ওই যে আসছে আপনার বুদ্ধির দুর্ভাগ্যের একজন।
গনেরিলকে আসতে দেখে উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন রাজা, কী ব্যাপার গনেরিল! আজিকাল প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি। তোমার গম্ভীর মুখ। এর কারণটা বলবে কি?
বিদূষক বলল রাজাকে, মহারাজ, উনি হলেন মটরডালের ভূসি। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই ওর মধ্যে।
রেগে গিয়ে বলল গনেরিল, শুধুমাত্র ও নয়, আপনার প্রশ্ৰয় পেয়ে আপনার অনুচরেরা পর্যন্ত আমার সাথে ঝগড়া করার সাহস পায়, অভদ্র হয়ে ওঠে তাদের আচরণ। একটু আগে আপনি যে ব্যবহার আমার সাথে করলেন, আমি ভয় পাচ্ছি। এই ভেবে যে আপনার সমর্থনেই ওরা এতটা বেড়ে ওঠার সাহস পেয়েছে। যদিও একথা বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে, তবুও অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়েই বলছি। এর জন্য আপনার শাস্তি পাওয়া উচিত। তাতে হয়তো অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষণ পাওয়া যাবে।
বিদূষক বলল, কোকিল। যেমন তার পালক পিতা কাককে মেরে ফেলে, ঠিক সেইরকম।
গনেরিলের কথা শুনে রাজা খুব দুঃখ পেলেন মনে। তিনি বললেন, আমি কে তা কি তুমি ভুলে গেছ?
উদ্ধত স্বরে জবাব দিল গনেরিল, বাবা, আপনার জ্ঞান-বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।
লিয়ার বললেন, তাহলে কি পাগল হয়ে গেছি আমি? আমি কি আর সেই পূর্বের রাজা লিয়ার নই? কেন এমন পালটে গেছে আমার হাঁটার ধরন? কোথায় আমার সেই দৃষ্টিশক্তি? হায়! আমার বিচার শক্তিও আজ স্নেহবশত দুর্বল হয়ে গেছে? আমি তাহলে কে?