ভোজসভায় উপস্থিত কেউ বুঝতে পারল না। আপন মনে কী সব বলছেন ম্যাকবেথ। তারা সবাই অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে।
অমাত্য রস আমন্ত্রিত অতিথিদের বললেন, মহারাজ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এবার আপনারা দয়া করে উঠুন।
স্বামীর এ হেন অবস্থা দেখে বেজায় মুশকিলে পড়ে গেলেন লেডি ম্যাকবেথ। তিনি তৎক্ষণাৎ হাতজোড় করে অতিথিদের বললেন, না, না, আপনারা উঠবেন না। এটা মহারাজার পুরনো মানসিক রোগ। মাঝে মাঝে তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে সময় তিনি সাময়িক অসুস্থ হয়ে পড়েন। আপনারা যেমন খাচ্ছিলেন সেভাবেই খেয়ে যান। দেখবেন, একটু বাদেই তিনি আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমার অনুরোধ, এখন আপনারা কেউ ওর মুখের দিকে চাইবেন না। তাহলে ওর উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে।
অমাত্য রসের কথায় ইতিমধ্যে অনেক অতিথিই খাওয়া ছেড়ে উঠেছিলেন। এমন তোফা ভোজটা কিনা মাটি হয়ে গেল ভেবে অনেকেরই মুখ বেজার হয়ে গিয়েছিল। এবার রানি নিজে অনুরোধ করায় খুশি মনে খেতে বসলেন সবাই। রানি স্বামীর কাছে গিয়ে তাকে ধমকে চাপা স্বরে বললেন, কী শুরু করেছ তুমি? অতিথিরা সবাই কি ভাবলেন বলতো? ভালো করে চেয়ে দেখ তো কিছুক্ষণ আগে তোমার আসন যেমন খালি ছিল, এখনও তেমনি রয়েছে। তাছাড়া নিজের কানেই তো শুনলে ব্যাংকে মারা গেছে। তাহলে কী করে তিনি তোমার জায়গায় বসবেন? মিছিমিছি ভয় পোচ্ছ তুমি। এ সব তোমার অমূলক ধারণা।
নিজের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে পুনরায় আঁতকে উঠলেন ম্যাকবেথ–দেখলেন আগের মতোই সেখানে বসে আছে ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা।
প্রেতাত্মার দিকে ইশারা করে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন ম্যাকবেথ, যা, পালা! দূর হ এখান থেকে। আমি তোকে একটুও ভয় পাই না।
স্বামীকে ধমকে চাপা স্বরে পুনরায় বললেন লেডি ম্যাকবেথ, তোমার কি কোনও হাঁশ নেই? তোমার হাবভাব দেখে সবাই চাপা স্বরে ফিসফাস করছে। তুমি কি বুঝতে পারছি না তোমার আচরণে তাদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে! ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা যে এখানে আসেনি তার প্রমাণসে এলে সবাই তাকে দেখতে পেত। রাজার মৃত্যুর আগে তুমি যেমন মনের ভুলে হাওয়ায় ছুরি ভাসতে দেখতে, এখনও তেমনি ব্যাংকের প্ৰেতাত্মাকে দেখছি। আমি পুনরায় বলছি এ সব তোমার ভ্ৰম। যাও, তুমি নিজের জায়গায় গিয়ে খেতে বস। নইলে সব কিছু পণ্ড হয়ে যাবে।
স্ত্রীর কাছে বকুনি খাবার পর কিছুটা সুস্থ বোধ করলেন ম্যাকবেথ। নিজের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেটা বিলকুল ফাকা— ধারে-কাছেও নেই ব্যাংকের প্রেতাত্মা। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী সবার মঙ্গল কামনা করে তিনি যখন পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দেবেন। ঠিক সে সময় তার সামনে হাজির ব্যাংকের প্রেতাত্মা। স্ত্রীর ধমক, হাঁশিয়ারি ও পরিস্থিতির কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন ম্যাকবেথ, ব্যাংকের প্ৰেতাত্মাকে প্রচণ্ড গালাগাল দিয়ে বললেন, বাঘ, সিংহ, গণ্ডার তুমি যাই হও না কেন, আমি একটুও ভয় পাই না তাতে। কিন্তু তোমার ওই বীভৎস প্রেতিমূর্তি আমার চোখে অসহ্য। যাও, দূর হয়ে যাও..আমার সামনে থেকে। আর কখনও
ম্যাকবেথের চিৎকার-চেঁচামেচিতে তার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় অতিথিরা বিরক্ত হয়ে খাওয়া শেষ হবার আগেই আসন ছেড়ে উঠে পড়লেন। রাজার সন্দেহজনক আচরণের ব্যাপারে কথা-বার্তা বলতে বলতে ফরেসএর রাজপ্রাসাদ ছেড়ে গেলেন তারা।
নিমন্ত্রিতদের মধ্যে একমাত্র ম্যাকডাফই আসেনি, তা নজরে পড়েছে ম্যাকবেথের। তিনি গোপনে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলেন মৃত রাজা ডানকানের বড়ো ছেলে ম্যালকম ইংল্যান্ডে পালিয়ে গিয়ে সেখানকার রাজা এডওয়ার্ডের আশ্রয়ে রয়েছেন। ম্যাকডাফও রয়েছেন সেখানে।
সিংহাসনে বসেই প্ৰজাপালনের বদলে ম্যাকবেথ শুরু করলেন নিপীড়ন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। স্কটল্যান্ডের লোক। রাজা ডানকানের হত্যা, দুই ছেলের ইংল্যান্ডে পলায়ন, ব্যাংকের মৃত্যু, এরূপ ঘটনা দেখে ম্যাকবেথের উপর নানারূপ সন্দেহ জাগল প্রজাদের মনে।
ম্যাকবেথের অত্যাচারে তার বিরুদ্ধে প্ৰচণ্ড ক্ষোভ জমা হতে লাগল প্রজাদের মনে। তাদের অনেকেই ঈশ্বরের কাছে এই বলে প্রার্থনা জানাতে লািগল ম্যালকম যেন ইংল্যান্ডের রাজার সাহায্য নিয়ে ম্যাকবেথকে সিংহাসনচ্যুত করেন। তার বিরুদ্ধে জনতার আক্রোশ যেদিন দিন বেড়ে চলেছে তা জানতে পেরে ঘাবড়ে গেলেন ম্যাকবেথ।
রাজা হবার ব্যাপারে যে তিনজন ডাইনির ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে, তাদের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠলেন ম্যাকবেথ। তাদের খোঁজে চারদিকে লোক পাঠালেন তিনি। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন প্রাসাদ থেকে দূরে বনের ভেতর এক পাহাড়ি গুহায় তাদের ডেরা। কিন্তু স্ত্রীকে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র জানালেন না তিনি। একদিন রাতে যখন তার স্ত্রী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তিনি প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ঘোড়ায় চেপে রওনা হলেন সেই পাহাড়ের উদ্দেশে।
সাধনার উপকরণ হিসেবে ডাইনিরা তাদের আস্তানায় নরকের আগুন জেলে তাতে বসিয়েছে লোহার এক বিরাট কড়াই। তাতে সেদ্ধ হচ্ছে বিষধর সাপের দাঁত, কুকুরের জিভ, ব্যাং-এর ঠ্যাং, নেকড়ের দাঁত, ছাগল, চমরি গাই, নাস্তিক ইহুদির লিভার, তুর্কি সেপাইর কাটা নাক কতোর সৈনিকের কাটা ঠোট— এমনই আরও কত জিনিস। ম্যাকবেথ যে তার ভবিষ্যৎ জানতে আসবে একথা আগেই ডাইনিদের জানিয়ে দিয়েছেন উপদেবী জ্যাকেট— যিনি আবার অশুভ ও অমঙ্গলের নিয়ন্ত্রক।