ঘুম আসেনি ম্যাকবেথের। তিনি জেগেই ছিলেন। চিৎকার চেচামেচি শুনে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। রাজার ঘরে ঢুকে তার রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে এমন স্বাভাবিকভাবে বিলাপ করে উঠলেন যা দেখে উপস্থিত কারও মনে তার প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ জাগল না। বারবার নিজের কপাল চাপড়ে বলতে লাগলেন, হায়, হায়, শেষে কিনা আমার কপালে এই ঘটিল! আমারই অতিথি হয়ে এমন নৃশংসভাবে খুন হতে হল রাজাকে? এই দুৰ্ভেদ্য দুর্গ থেকে সবার নজর এড়িয়ে কীভাবে পালিয়ে গেল আততায়ী? নিজ মনে এসব কথা বলতে বলতে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ম্যাকবেথ। সে সময় তার চোখে পড়ল রাজার দুই দেহরক্ষী ঘরের মেঝেতে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমোচ্ছে। এত হই হট্টগােলেওঁ ঘুম ভাঙেনি তাদের। যদিও ম্যাকবেথ জানতেন যে আগে থেকেই তার স্ত্রী রক্ত মাখানো খুনের হাতিয়ারটি রেখে গেছেন রক্ষীদের পাশে। ছুরির ফলায় লেগে থাকা রক্তও লাগিয়ে দিয়েছেন তাদের হাতে ও জামায়, এসব জানা সত্ত্বেও তিনি এমন ভাব দেখাতে লাগলেন যাতে মনে হবে এই প্রথম এগুলি তার চোখে পড়ল।
এই এরাই মাতাল হয়ে খুন করেছে রাজাকে, বলেই তলোয়ারের এক কোপে দুই ঘুমন্ত দেহরক্ষীর মাথা কেটে ফেললেন ম্যাকবেথ।
পাশের ঘরেই শুয়েছিলেন দুই রাজপুত্র ম্যালকম আর ম্যাকডোনাল্ড। তারা উভয়ের বুদ্ধিমান। সহজেই তারা বুঝতে পারলেন সিংহাসনের লোভে কেউ হত্যা করেছে রাজাকে। তারা ভয় পেলেন এই ভেবে যে এবার হয়তো তারা রাজপুত্রদের হত্যা করবে। রাজার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে যখন ম্যাকবেথ ও অন্যান্য সবাই শোক প্রকাশ করছিলেন, সেই সুযোগে ঘোড়ায় চেপে পালিয়ে গেলেন দুই রাজপুত্র। ম্যালকম পালিয়ে গেলেন ইংল্যান্ডে আর ডোনালবেন আয়ার্ল্যান্ডে। এবার সুযোগ পেয়ে জোর গলায় বলতে লাগলেন ম্যাকবেথ, এই রাজপুত্ররাই খুন করেছে রাজাকে নইলে সমাধি দেবার আগেই কেন তারা পালিয়ে গেল? সে মুহূর্তে সবার মানসিক অবস্থা এরূপ যে কেউ আর প্রতিবাদ করল না। ম্যাকবেথের কথায়।
রাজা চলে যায়। তবুও সিংহাসন খালি থাকে না। দুই রাজপুত্ৰই পালিয়ে গেছেন। একই বংশের রক্ত বইছে তার শিরায় এমন লোক একজনই আছেন, তিনি হলেন ম্যাকবেথ-গ্রামিশা ও কডর এর থেন। আমোত্যরা নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে শেষমেশ শূন্য সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন ম্যাকবেথকে। এবার সফল হল তিনি তৃতীয় ডাইনির ভবিষ্যদ্বাণী।
রাজসিংহাসনে বসে ম্যাকবেথের মনোবাসনা পূৰ্ণ হলেও সংকট দেখা দিল অন্যদিক থেকে। সে সংকটের কারণ আর কেউ নয়, তার একসময়ের সহযোগী সেনাপতি ব্যাংকো। জলার সেই তিন ডাইনি ম্যাকবেথের বংশধরদের রাজা হবার কথা বলেনি, বলেছিল ব্যাংকের বংশধরদের অনেকেই স্কটল্যান্ডের সিংহাসনের বসবে। ব্যাংকের বংশধররা রাজা হবে, এই ভবিষ্যদ্বাণীই ম্যাকবেথের মনকে অহরহ খোঁচা দিতে লাগল। তিনি স্থির করলেন ভাড়াটে খুনির সাহায্যে হত্যা করবেন ব্যাংকে আর তার ছেলে ফ্লিয়ানসকে। রাজা হবার আনন্দে ফরেস-এর প্রাসাদে এক ভোজসভার আয়োজন করে আমন্ত্রণ জানালেন অমাত্য, সেনাপতি আর থেনদের। ব্যাংকে জানালেন একটা বিশেষ কাজে ছেলেকে নিয়ে তিনি দূরে যাচ্ছেন। ফিরতে হয়তো কিছুটা দেরি হবে। তবে কথা দিলেন দেরি হলেও তিনি অবশ্যই ভোজসভায় যোগ দেবেন। ইতিমধ্যে দু-জন ভাড়াটে খুনির ব্যবস্থা করে রেখেছেন ম্যাকবেথ। সে দুজন এমনই লোক যাদের অপরাধের দরুন এক সময় হত্যা করতে চেয়েছিলেন ব্যাংকো। পরে অবশ্য কোনও কারণে তিনি তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সেই থেকে তারা বেজায় রেগে আছে ব্যাংকের উপর, একথা জানতেন ম্যাকবেথ। তাই ম্যাকবেথ ভাবলেন নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এবার তাদের কাজে লাগাবেন। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন ব্যাংকো তার কাজ সেরে আসার মাঝপথেই তারা যেন ব্যাংকো আর তার ছেলেকে খুন করে, কাজ সেরে ম্যাকবেথের ভোজসভায় যোগ দেবার জন্য ফিরে আসছিলেন ব্যাংকো। পথের মাঝেই ম্যাকবেথের ভাড়াটে খুনিদের হাতে খুন হলেন তিনি। ছুরির ঘা খেয়ে ব্যাং লুটিয়ে পড়ার আগে ব্যাংকে তার ছেলে ফ্লিয়ানসকে পালিয়ে যেতে বললেন–সেই সাথে আরও বললেন ভবিষ্যতে সে যেন তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়। ভাড়াটে খুনিদের কাছ থেকে ব্যাং বেঁচে নেই কথাটা শুনে যতটা খুশি হলেন ম্যাকবেথ, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষুব্ধ হলেন অক্ষত দেহে ফ্লিয়ানস পালিয়ে যাওয়ায়।
ওদিকে ফরেসের প্রাসাদে শুরু হয়েছে। নৈশভোজ। চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে। ভোজন কক্ষের বিশাল লম্বা টেবিলের দুপাশে সারি দিয়ে বসেছেন রাজার অমাত্য, বিশিষ্ট থেন আর সেনারীরা, তাদের বউ আর মেয়েরাও সুন্দর পোশাক আর দামি গয়না-গাটি পরে হাজির হয়েছেন সেখানে। নতুন রাজা হবার আনন্দে আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের কাছে গিয়ে সৌজন্য বিনিময় করছেন ম্যাকবেথ। কিছুক্ষণ বাদে অবাক হয়ে ম্যাকবেথ দেখলেন তার নির্দিষ্ট আসনে বসে আছেন ব্যাংকো–দরদরি করে রক্ত ঝরিছে তার শরীর থেকে। চারিদিকে তাকিয়ে ম্যাকবেথ লক্ষ করলেন তিনি ছাড়া আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না ব্যাংকোকে–এমন কি তার স্ত্রী লেডি ম্যাকবেথ পর্যন্ত নয়। ওটি যে ব্যাংকের প্ৰেতাত্মা সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেন তিনি। প্রচণ্ড ভয় আর উত্তেজনায় যেন পাগল হয়ে গেলেন ম্যাকবেথ। ব্যাংকের প্ৰেতাত্মার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় তিনি বলতে লাগলেন, কেন এখানে এসেছ তুমি? যে যাই বলুক, তুমি কখনও বলতে পারবে না। এ কাজ আমি করেছি! কবরের ভেতর থেকে মড়াগুলি যদি এভাবে বেরিয়ে আসে, তাহলে তো সমাধিস্তম্ভগুলিও ডানা মেলে আকাশে উড়ে বেড়াবে।