ওই অলৌকিক ছুরিটা যে রাজাকে হত্যা করার জন্য তাকে প্রেরণা দিচ্ছে, এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে ম্যাকবেথ ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন। ঘুমন্ত রাজার কক্ষের দিকে। কিছুক্ষণ আগে ঘুমের ওষুধ মেশানো মদ খাইয়ে রক্ষীদের বেন্থশ করে লেডি ম্যাকবেথ যে নিজেই রাজাকে হত্যা করতে তার কক্ষে ঢুকেছেন, সেকথা তখনও পর্যন্ত জানতেন না। ম্যাকবেথ। উদ্যত ছুরিকা হাতে রাজার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন লেডি ম্যাকবেথ। রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে, হল রাজার মুখখানা ঠিক তার বাবার মুখের মতো। মুহূর্তের মধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ল তার মন। রাজাকে হত্যা করতে অপারগ হয়ে তিনি ছিটকে বেরিয়ে এলেন সেই ঘর থেকে। স্বামীকে তার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন করতে ঘণ্টা বাজিয়ে ডেকে পাঠালেন তাকে।
ঘণ্টার আওয়াজকানে যেতেই নিজ মনে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, এবার চরম সময় উপস্থিত। রাজা ডানকান, এই ঘণ্টাধ্বনিই ঘোষণা করছে তোমার জীবনের সমাপ্তির কথা। এবার উপরে যাবার জন্য তৈরি হও। একথা বলতে বলতে ম্যাকবেথ এসে দাঁড়ালেন রাজার কক্ষের সামনে! দেহরক্ষীদ্বয়কে ঘুমে অচেতন দেখে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন তিনি। ধীর পায় এগিয়ে এসে রাজার কাছে দাঁড়ালেন ম্যাকবেথ। নিশ্বাসের সাথে ওঠা-নমা করছে রাজার বুক। রাজার দিকে একবার তাকিয়ে দেখেই ভয়ে কেঁপে উঠল তার সারা শরীর। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন ম্যাকবেথ। খাপ থেকে ছোরা বের করে কোনোদিকে না তাকিয়ে ছোরাটা আমূল বসিয়ে দিলেন রাজার বুকে। সাথে সাথেই থেমে গেল রাজার বুকের ধুকপুকুনি। ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল রক্ত। সেই রক্তে ভিজে গেল সারা বিছানা। একটা চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ঘুমন্ত রাজার ঠোঁট থেকে। তারপর বালিশের পাশে এলিয়ে পড়ল। রাজার মাথা।
কানের কাছে একটা অচেনা আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলেন ম্যাকবেথ। ওই আওয়াজটা যেন বলছে, ম্যাকবেথ! তুমি খুনি। রাতের ঘুম পালিয়ে গেছে তোমার চোখ থেকে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলেন না তিনি।
পরমুহূর্তেই ম্যাকবেথের কানে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর, ঘুমকে খুন করেছে গ্ল্যামিশ, সে আর ঘুমোবে না। ম্যাকবেথ! কডর আর ঘুমোবে না। রক্তমাখা ছুরি হাতে রাজার ঘর থেকে বেরিয়ে স্ত্রীর কাছে এলেন ম্যাকবেথ। স্ত্রীকে বললেন, সব শেষ। রাজার ঘুম আর কখনও ভাঙবে না। কীভাবে রাজাকে খুন করেছেন তা সবিস্তারে স্ত্রীকে বললেন ম্যাকবেথ। সব শোনার পর স্ত্রী বললেন, ওই ছুরিটা নিয়ে এসেছি কেন? যাও, রাজার ঘরের বাইরে পাহারাদারদের হাতের কাছে ওটা রেখে এস। ছোরার ফলার রক্ত মাখিয়ে দেবে প্রহরীদের হাতে। তাহলে সবাই ধরে নেবে মদ খেয়ে ওরাই হত্যা করেছে রাজাকে।
ম্যাকবেথ স্ত্রীকে বললেন, আচ্ছা, তুমি কারও চিৎকার শুনতে পেয়েছ?
কই! না তো। জবাব দিলেন লেডি ম্যাকবেথ।
ম্যাকবেথ বললেন স্ত্রীকে, দেখ, আমি যেন কার চিৎকার শুনতে পেলাম। কাজ শেষ হবার সাথে সাথেই কে যেন আমার কানের কাছে চেঁচিয়ে বলে উঠল, ম্যাকবেথ! তুমি খুনি। রাতের আর ঘুম বিদায় নিয়েছে তোমার চোখ থেকে। এর মানে কি বুঝতে পারছি? মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাতে ঘুমোতে পারব না আমি। ঘুমে যতই চোখ বুজে আসুক, চোখ বন্ধ করতে পারব না আমি।
লেডি ম্যাকবেথ স্বামীকে বোঝালেন, আমি তো সেরূপ কিছু শুনিনি। আসলে ও সব তোমার মনের ভুল। ভয় পেয়েছ বলেই তোমার এরূপ মনে হচ্ছে। শোন, এবার যা বলছি তাই কর। রাত শেষ হয়ে আসছে। লোক-জন টের পাবার আগেই ছুরিটা রেখে এস ঘুমন্ত রক্ষীদের হাতের কাছে। মনে করে ওদের হাত ও জামায় কিছুটা রক্ত লাগিয়ে দিও।
স্ত্রীর কথা শুনে চমকে বলে উঠলেন ম্যাকবেথ, আবার তুমি আমায় ওখানে যেতে বলছি? না, না, ওখানে যাবার সাহস আমার নেই। এবার বাধ্য হয়েই স্বামীর হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলেন লেডি ম্যাকবেথ। নিঃশব্দে ছুরিটা নামিয়ে রাখলেন রাজার ঘরের বাইরে ঘুমন্ত রক্ষীদ্বয়ের পাশে।ছুরির ফলায় লেগে থাকা কিছু কাঁচা রক্ত মাখিয়ে দিলেন রক্ষীদের হাতে ও জামায়। এসব কাজ শেষ করে লেডি ফিরে গেলেন তার শোবার ঘরে।
এভাবেই এক সময় শেষ হয়ে এল দুঃস্বপ্নের কালরাত। ম্যাকবেথের অতিথি হয়ে আসার আগের দিন রাজা ডানকান তার বিশ্বস্ত অমাত্য ম্যাকডাফকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তাকে যেন সূর্যোদয়ের আগে ডেকে তোলা হয়। রাজার নির্দেশ অনুযায়ী ভোরের আলো ফোটার আগেই ম্যাকডাফ এসে প্রাসাদের দরজায় জোরে ধাক্কা দিতে লাগলেন। দরজার ফাক দিয়ে ম্যাকডাফকে দেখে নৈশ প্রহরী তার পরিচয় এবং এত ভোরে আসার কারণ জানতে চাইলেন। ম্যাকডাফ তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে আসার কারণ জানালেন। প্রহরী দরজা খুলে দিল। ভেতরে ঢুকে ধীর পায়ে রাজার কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন ম্যাকডাফ। ঘরে ঢুকেই বিছানার উপর রাজার রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি–জোর গলায় বিলাপ করতে করতে তখনই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। অত ভোরে তার গলায় জোর বিলাপের আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল দুর্গপ্রাসাদের বাসিন্দাদের। তাদের জিজ্ঞাসার জবাবে ম্যাকডাফ সংক্ষেপে যা বললেন তা এই –রক্ষীদের নজর এড়িয়ে প্রাসাদের ভেতর ঢুকে কোনও অজানা আততায়ী ঘুমন্ত রাজার বুকে ছুরি বসিয়ে তাকে খুন করেছে। কডর-এর দুর্গে এরূপ ঘটনার কথা শুনে ভয়ে শিউরে উঠল। সবাই।