বাবার প্রশ্নের উত্তরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল এডমন্ড, আগে আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝে এডগার এরূপ একটা ইঙ্গিত দিত বটে, তবে মনে হচ্ছে। এ চিঠিটা তার লেখা নয়। কেননা জানিলা গলিয়ে এ চিঠিটা কে যেন ভেতরে ফেলে গেছে।
গ্লস্টার বললেন, আমি বলছি চিঠিটা ওরই লেখা। এই এডগারকেই আমি সবচেয়ে বেশি। ভালোবাসতাম। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ও যে এত বড়ো শয়তান। যাও, ধরে নিয়ে এস সেই বর্বরটাকে।
এডমন্ড বলল, আপনি অত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আগে আড়াল থেকে আপনি নিজে সব কথা শুনুন, তারপর না হয় তাকে শাস্তি দেবেন। নইলে তার প্রতি ঘোরতর অন্যায় করা হবে বাবা।
ঠিক আছে, সেই ব্যবস্থাই কর, বললেন গ্লস্টার, ওর আসল ইচ্ছেটা জানার পর তুমি স্বর্গমর্ত-পাতাল-যেখান থেকেই হোক সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের করে আন। পৃথিবীটা বডড পাপে ভরে গেছে। মেহের মধুর সম্পর্কগুলি একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা–সব ক্ষেত্রেই আজ এত চক্রান্ত, শঠতা আর প্রতারণা। বাবার বিরুদ্ধে ছেলে, ছেলের বিরুদ্ধে বাবার বিদ্রোহ, চক্রান্ত আজ ঘোরতর অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েছে। পূর্বে করা ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে আজ। কোনও দাম নেই সততার। আমি বলছি এডমন্ড, নিৰ্ভয়ে এগিয়ে যাও তুমি। যেভাবেই হোক, সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের কর তুমি। কঠিন শাস্তি দেব আমি তাকে। দায়িত্ব এড়াবার জন্য অধিকাংশ মানুষ দোষারোপ করে তাদের ভাগ্যকে। কিন্তু চোর, জোচোর, মাতাল, বদমাশ হবার পেছনে মানুষ নিজেই দায়ী।
বলেই গ্লস্টার চলে গেলেন সেখান থেকে। ঠিক তখনই এডমন্ড দেখতে পেল এডগার এদিকেই আসছে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে।
এডগার বলল ছোটোভাইকে, কী হল এডমন্ড, তুমি এত গম্ভীর কেন?
নিরীহ মুখে বলল এডমন্ড, সে সব ভবিষ্যৎবাণীর কথাই আমি ভাবছি। যাতে লেখা আছে পিতা-পুত্রের সম্পর্কছেদ, মৃত্যু। এছাড়াও আরও কত কথা। যাক, সে সব কথা ছেড়ে দাও। বলতো বাবার সাথে শেষ দেখা তোমার কবে হয়েছে? তার সাথে তোমার আচরণে কি কোনও অসন্তোষের ভাব প্রকাশ পেয়েছিল? এসব আমি জানতে চাইছি কারণ বাবা তোমার উপর খুবই রেগে আছেন। এর কারণ কী হতে পারে?
এডগার খুবই অবাক হল এডমন্ডের মুখে এ কথা শুনে। তারপর বলল, আমার এমন ক্ষতি কে করল? গতকাল রাতেই তো আমি দু-ঘণ্টা ধরে তার সাথে কথা বলেছি। কই, তখন তো তার মুখে কোনও রাগের চিহ্ন দেখিনি!
এডমন্ড বললেন, এতে তুমি ভয় পেও না। বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত শাস্ত না হন, তুমি আমার ঘরে এসে বিশ্রাম করবে। তারপর তোমাকে আমি নিয়ে যাব তার কাছে। আমি ফিরে আসার পূর্বে যদি তোমার বাইরে যাবার দরকার হয় তাহলে অস্ত্র নিয়ে যেও সাথে। তোমার ভালোর জন্যই বলছি এ কথা। নাও, আর দেরি করো না। আমার ঘরের চাবিটা নাও আর এ জায়গা ছেড়ে শীঘ্ৰ পালাও।
এডগার আটকে পড়ল মায়াজালে। সে চলে যাবার পর মনে মনে খুব খুশি হয়ে বলতে লাগল এডমন্ড, আমার বুদ্ধির জোর বেশি আর তোমার আছে শুধু বোকা সততা। সেই সততার সুযোগ নিয়েই আমায় হস্তগত করতে হচ্ছে তোমার সম্পত্তি। তুমি একটা বোকা, নির্বোধ আর তাই ঈশ্বরের কাছে তুমি করুণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নও।
রাজার বড়ো মেয়ে তার প্রাসাদে সে সময় ব্যস্ত ছিলেন প্রধান অনুচরদের সাথে আলোচনায়। দুঃখের সাথে বললেন গনেরিল, অসওয়াল্ড! একথা কি সত্য যে তার বিদূষককে অপমান করার জন্য বাবা মেরেছেন আমার অনুচরকে? ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন অসওয়ান্ড। তখন গনেরিল বলল, সত্যিই অসহ্য হয়ে উঠছে বাবার এই নিত্যনতুন অত্যাচার। আর তার নাইটরাও ৪ হয়েছে তেমনি অসভ্য, বর্বর। বুঝলে অসওয়াল্ড, এবার থেকে তুমি আর অন্য চরেরা সবসময় তার সাথে এমন ভাব-ভঙ্গি করবে যাতে তিনি রেগে গিয়ে বোনের বাড়ি চলে যান। আর আমিও নিষ্কৃতি পাব তাতে। অসুস্থতার ভান করে আমিও কথা বলব না তার সাথে। বোনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেব সে যেন বাবার সাথে আমার মতোই ব্যবহার করে। আর সহ্য হচ্ছে; না। সব বিষয়ে তার অকারণ তিরস্কার। যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে বাচ্চাদের মতো বুড়ে। বাবার এরূপ আচরণ। ঐ শোন, দূর থেকে আওয়াজ আসছে তার আগমনের বাদ্যধ্বনির। এবার তোমরা যাও, আমার আদেশ অনুযায়ী তার সাথে ভালো বা খারাপ ব্যবহার করবে।
তুমি কে? কী তোমার পেশা? সামনে দাঁড়ান ছদ্মবেশী ডিউক অব কেন্টকে প্রশ্ন করলেন। রাজা লিয়ার স্বয়ং।
কেন্ট বললেন, মহারাজ, আমার পোশাকই বহন করছে আমার কর্মদক্ষতার পরিচয়। আমি খুব দরিদ্র তবে কখনও বিশ্বাসের অমর্যাদা করি না। আমি সৎ আর জ্ঞানী লোকদের পছন্দ করি। সামান্য কারণে যুদ্ধ করি না। আর মদও খাই না।
কেন্টের কথা শুনে করুণায় ভরে গেল রাজার মন। কেন্টকে তিনি বললেন, তুমি সত্যিই গরিব। কী চাও তুমি আমার কাছে?
আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি আপনার মুখে প্ৰভুত্বের দীপ্তি দেখে, বললেন কেন্ট, আমি চাই আপনার অধীনে কাজ করতে।
রাজা জানতে চাইলেন, কি কাজ করতে পারবে তুমি?
কেন্ট উত্তর দিলেন, আমি জানি দরকারি কথার গোপনীয়তা রক্ষা করতে, দ্রুত ঘোড়ায় চড়তে। এছাড়া সাধারণ মানুষের অন্যান্য গুণেরও অধিকারী আমি। আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পেছপা নাই, বয়সও সহজে কাবু করতে পারে না আমায়।