কর্ডেলিয়া সম্পর্কে এ কথা বলতেই রাজা তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেলতে চাইলেন কেন্টকে। কেন্ট বললেন, প্রাণের ভয়ে আমি কিছুতেই মিথ্যে, কথা বলতে পারব না প্ৰভু! আপনি যে ভুল করছেন সে কথা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহে প্ৰাণ আছে আমি বলে যাব।
এত রেগে গেছেন রাজা লিয়ার যে স্বাভাবিক জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাই তিনি তার পরম বন্ধু কেন্টকে বলতে পারলেন, তুমি একটা রাজদ্রোহী দুৰ্বত্ত ছাড়া আর কিছু নও। দেশ থেকে আমি তোমাকে নির্বাসিত করলাম তোমার উদ্ধত আচরণের জন্য। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তোমায় এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে, অন্যথায় মৃত্যু হবে তোমার।
কন্যাসম কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ করে চোখের জল মুছতে মুছতে রাজসভা থেকে বিদায় নিলেন কেন্ট।
এ সময় শোনা গেল নেপথ্যে কথাবাতাঁর আওয়াজ। দুই যুবরাজ আর তাদের অনুচরদের নিয়ে প্রবেশ করলেন গ্লস্টার।
রাজালিয়ার তাদের দেখে বললেন, হে বাগন্ডির যুবরাজ! আমার ছোটো মেয়ের পাণিপ্রার্থীদের মধ্যে তুমি অন্যতম। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ। আমার ছোটো মেয়েকে সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ যৌতুক হিসাবে দেব বলে আমি পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সে প্রতিশ্রুতি অর্থহীন। এখন সে পিতার মেহবঞ্চিত ঘৃণ্য এক তুচ্ছ নারী। এবার তুমি বল, এই বঞ্চিত, নিঃস্ব অভিশপ্ত মেয়েকে তুমি কি আগের মতোই বিয়ে করতে আগ্রহী?
সব শোনার পর বাৰ্গান্ডির যুবরাজ অস্বীকার করলেন কর্ডেলিয়াকে বিয়ে করতে। এবার ফ্রান্সের যুবরাজকে উদ্দেশ করে বললেন রাজা, প্রিয় যুবরাজ, এবার বল কর্ডেলিয়া সম্পর্কে তোমার অভিমত কী?
ফ্রান্সের যুবরাজ বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে কিছুক্ষণ আগে যে ছিল পিতার প্ৰাণস্বরূপ, এমন কী কারণ ঘটল যে এই অল্প সময়ের মধ্যে সে বঞ্চিত হল পিতার স্নেহ থেকে।
সে যাই হোক, প্রকৃত ভালোবাসা স্বর্থহীন। কর্ডেলিয়ার প্রতি আমার প্রেম যে কত নিবিড় তা প্রমাণ করার জন্য কর্ডেলিয়ার মতো প্ৰেম-ধন্যা, সততার পূজারি, সবার অবজ্ঞার পাত্ৰ, নিঃস্ব অথচ সুন্দরী মেয়েকে আমি ফ্রান্সের রানি এবং চিরসঙ্গিনী হিসাবে আনন্দের সাথে গ্ৰহণ করছি— বললেন ফ্রান্সের যুবরাজ।
রাজা বললেন, বেশ, তাই হোক। তারপর কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ না করেই তিনি চলে গেলেন রাজসভা ছেড়ে। আর তার সাথে সাথে বেড়িয়ে গেল বাগন্ডি, কর্নওয়াল, আলবেনি, গ্লস্টার ও তার অনুচরেরা।
প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে যেতে কাঁদতে কাঁদতে বললেন কর্ডেলিয়া, আমার দুর্ভাগ্য এই যে বাবা ভুল বুঝলেন আমায়। হে আমার বড়ো বোনেরা! তোমাদের প্রতিশ্রুতির উপরই নির্ভর করছে বাবার ভবিষ্যৎ জীবন। আশা করি কর্তব্য পালনে তোমাদের কোনও ত্রুটি হবে না।
একথা বলেই তিনি চলে গেলেন ফ্রান্সের যুবরাজের সাথে। তারা চলে যাবার পর গনেরিল চুপি চুপি বলল তার বোন রিগানকে, দাখ, বুড়ো হয়ে আমাদের পিতা মানসিক দিক দিয়ে খুবই দুর্বল আর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তার পক্ষে সম্ভব হল প্রিয় কন্যার সাথে এরকম ব্যবহার করার। এটা সত্যিই তার অবিবেচক মনের পরিচায়ক।
রিগান বলল, আর বলিস না! এটাই ওর চিরকেলে স্বভাব।
রিগানের কথা শুনে গনেরিল বলল, সেটা তো তাহলে আরও ভয়ের ব্যাপার। বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে তার এই অভ্যোসটা বেড়ে যাবে আর সেটা সহ্য করতে হবে আমাদের। আয়, আমরা দুজনে পরামর্শ করি ভবিষ্যতে কী ভাবে এর হাত থেকে রক্ষণ পাওয়া যায়।
রিগান বলল, কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। খুব তাড়াতাড়িই পরামর্শটা করতে হবে আমাদের।
অন্যদিকে গ্লস্টারের প্রাসাদে সে সময় দুভাইয়ের মধ্যে লড়াই চলছিল সম্পত্তি নিয়ে। হে ঈশ্বর! সমাজে এমন নিয়ম কেন তুমি করেছ যে বংশের বড়ো ছেলেই সব কিছুরই মালিক হবে? অথচ দেখ, এই বড়ো ভাইয়ের চেয়ে বয়সে আমি হয়তো এক বছর কিংবা তার চেয়ে কম ছোটো, কিন্তু গুণে আর শক্তিতে কম নই। তাহলে আমি কেন বঞ্চিত হব সম্পত্তি থেকে। যদি তোমার এই নিয়ম হয়, তাহলে জেনে রেখ… বলেই চুপ করে যায় এডমন্ড। এরপর বড়োভাইয়ের উদ্দেশে বলল সে, বুদ্ধির জোরে আমিও অধিকার করব তোমার সম্পত্তি। চিঠির মাধ্যমে কৌশলে পিতার মেহ থেকে দূরে সরিয়ে দেব তোমাকে–এই আমার প্রতিজ্ঞা।
মনে মনে এডমন্ড যখন এরূপ মতলব আটিছিল সে সময় প্রবেশ করলেন তার বাবা গ্লস্টার।
ঘরে ঢুকেই এডমন্ডকে বললেন গ্লস্টার, শুনতে পেলাম রাজা নাকি নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন কেন্টকে? তিনি নাকি সমস্ত সম্পত্তি এবং রাজক্ষমতা দু জামাইয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন সামান্য একটা বৃত্তি? ব্যাপার কী এডমন্ড? এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ তুমি?
এডমন্ড বললেন, ও কিছু নয় বাবা, ভাই এডগারের পাঠানো চিঠিটা পড়ছি।
নিশ্চয়ই ওটা বিশেষ গোপনীয়, বললেন গ্লস্টার, তা না হলে তুমি আমার কাছ থেকে ওটা লুকোতে না। দেখি চিঠিটা?
এডমন্ডের হাত থেকে সেই জাল চিঠিটা নিয়ে পড়তে শুরু করলেন গ্লস্টার। পড়তে পড়তে এক সময় রাগে। লাল হয়ে উঠল গ্লস্টারের মুখ। চিঠিটাতে লেখা ছিল, ভাই এডমন্ড, তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে বৃদ্ধরা আমাদের বঞ্চিত করে ধন-সম্পত্তি থেকে, ব্যর্থ করে দেয় আমাদের জীবন-যৌবন। তাই এস আমরা দুজন বুড়ো বাবাকে মেরে ফেলে তার সমস্ত সম্পত্তি সমান দু-ভাগে ভাগ করি আর সেই সাথে সার্থক করে তুলি আমাদের জীবন-ইতি এডগার।