- বইয়ের নামঃ ট্রাজেডি
- লেখকের নামঃ উইলিয়াম শেকসপিয়র
- প্রকাশনাঃ বসাক বুক সেন্টার (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, নাটকের বই
ট্রাজেডি
কিং লিয়ার
দেশ শাসনের দায়ভার থেকে মুক্তি পাবার জন্য ইংলন্ডের বৃদ্ধ রাজা লিয়ার যখন তার তিন মেয়ে, দুই জামাই ও অমাতাদের সাথে নিয়ে রাজসভায় প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন লর্ড অব কেন্ট এবং লর্ড অব গ্লস্টার। কথার ফাঁকে একসময় গ্লস্টারকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন্ট, আচ্ছা মাননীয় গ্লস্টার, আলবেনিয়ার ডিউক আর কর্নওয়ালের ডিউক, এই দুই জামাইয়ের মধ্যে রাজার কাছে কে সবচেয়ে প্রিয় তা কি আপনি আন্দাজ করতে পারেন?
না, প্রিয় বন্ধু মাথা নেড়ে বললেন গ্লস্টার, এ ব্যাপারে সঠিক অনুমান করা কঠিন, কারণ দুজনেই সমান গুণী, কেউ কারও চেয়ে কম বা বেশি নন।
সে সময় গ্লস্টারের পাশে বসে থাকা এক তরুণকে দেখে বললেন কেন্ট, ওই যুবকটি কি আপনার পুত্ৰ?
গ্লস্টার বললেন, হ্যা। তবে ওকে ছেলে বলে মেনে নিতে আমার লজ্জা হয়। তারপর একটু দোনোমোনোভাবে বললেন, ওর আচার-আচরণ খুবই খারাপ। তবে ওর বড়ো ভাই আমার প্রিয়পাত্র। এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন এডমন্ড, ইনি হচ্ছেন আমার প্রিয় বন্ধু, কেন্টের লর্ড!
আপনি যখন বাবার বন্ধু, তখন আমারও পূজনীয়, বললেন এডমন্ড।
কেন্ট বললেন, আশা করি ভবিষ্যতে তোমার উপর আমার স্নেহ আরও বেড়ে যাবে।
বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে রাজা ঘরে ঢুকেই চলে যেতে বললেন গ্লস্টার ও এডমন্ডকে। তারা চলে যাবার পর রাজা কিছুক্ষণ চোখ বুলোলেন সাথে নিয়ে আসা সীমানাসহ অঙ্কিত রাজ্যের মানচিত্রের উপর। তারপর উপস্থিত সবার সামনে তিন মেয়ে ও দুই জামাইকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার মেয়ে জামাইরা! আমি স্থির করেছি। রাজার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়ে আমার বুড়ো বয়স অর্থাৎ শেষ জীবনটা আনন্দে কাটাব। সে জন্য আমি সমান তিন ভাগে ভাগ করেছি আমার সাম্রাজ্যকে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে তোমাদের মধ্যে বিবাদ না হয় তাই এই তিন ভাগ আমি দান করে দিতে চাই আমার তিন কন্যাকে। সেই সাথে কর্ডেলিয়ার পাণিপ্রার্থী ফ্রান্স ও বাগন্ডির রাজকুমারের প্রতীক্ষার অবসানও করতে চাই আমি। কিন্তু তার আগে বল, তোমরা আমায় কে কতটুকু ভালোবাস?
রাজার বড়ো মেয়ে গনেরিল বলল সবার আগে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হল অন্ধত্ব, বন্দিদশা এবং মৃত্যু। এ জীবনে যদি আপনার স্নেহ না পাই, তাহলে স্নেহহীন সে জীবন আমার কাছে ভীষণ কষ্টকর বলে মনে হবে। সস্তানের প্রতি আমার স্নেহ-ভালোবাসা যে কোনও সন্তানই কামনা করে।
এ কথা শুনে খুব খুশি হলেন রাজা। আনন্দের চোখে তিনি মেয়েকে দান করে বসলেন। শস্যশ্যামলা এক বিশাল রাজ্য। তারপর মেজ মেয়ে রিগানকে বললেন, এবার বল, তুমি আমায় কতটুকু ভালোবাস?
রিগান উত্তর দিলে, বাবা, আমার প্রতি আপনার যে ভালোবাসা তার পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই, আর আমি সে চেষ্টাও করব না। তবে জেনে রাখুন, মানুষের জীবনে যত কিছু আনন্দ আছে, সে সবই আমার কাছে বিষের মতোই মনে হবে, যদি আমি বঞ্চিত হই। আপনার স্নেহ থেকে।
স্নেহ-দুর্বল বাবা খুব খুশি হলেন মেয়ের কথা শুনে। তিনি রিগানকেও দান করলেন সাম্রাজ্যের এক সমৃদ্ধিশালী অংশ। সবশেষে তিনি উৎসাহ আর আনন্দের সাথে আদরের ছোটো মেয়েকে বললেন সে যেন জানায় বাবাকে সে কতটুকু ভালোবাসে।
কর্ডেলিয়া বলল, মেয়ে হিসেবে বাবাকে যতটুকু ভালোবাসা দরকার, আমি ততটাই ভালোবাসি আপনাকে।
আদুরে ছোটো মেয়ের মুখে শোনা কথা কেন জানি অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল রাজা লিয়ারের। তার মনে হল এক ঝটিকায় তিনি যেন স্বপ্ন থেকে ছিটকে পড়েছেন শক্ত মাটিতে। তিনি ছোটো মেয়েকে বললেন, আরও একবার ভেবে বল কর্ডেলিয়া, তুমি কি এর চেয়ে বেশি ভালোবাস না আমায়?
দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল কর্ডেলিয়া, আমার যা বলার ছিল তা আমি ভেবে-চিন্তেই বলেছি। যদি আপনাকেই মন-প্ৰাণ দিয়ে ভালোবাসতে হয়, তাহলে স্বামী ও অন্যান্যদের প্রতি আমার ভালোবাসাকর্তব্য বলে কিছুই থাকে না। আর সেটা হবে খুব অন্যায় কাজ। তাই আমি পারি না সমস্ত মন-প্ৰাণ দিয়ে আপনাকে ভালোবাসতে।
কর্ডেলিয়ার কথা বোধগম্য না হওয়ায় রাজা রেগে গিয়ে বললেন তাকে, তোমার মনের কথা যদি এই হয়, তাহলে ঈশ্বরের দোহাই, আজ থেকে তোমার-আমার সম্পর্ক শেষ। তোমার সাথে আমার আচরণও সেরূপ নির্মম হোক, যে আচরণ অসভ্য স্কাইলিয়া করেছিল রানির সাথে। তুমি এই মুহূর্তে দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।
এর মধ্যে প্ৰভুভক্ত কেন্ট কিছু বলতে যেতেই চিৎকার করে তাকে থামিয়ে দিলেন রাজা লিয়ার। তারপর বললেন জামাইদের, প্রিয় ছেলেরা, এবার শেষ তৃতীয় ভাগটা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নাও তোমরা। আমি পালা করে তোমাদের দুজনের সাথে থাকব একশো অনুচর নিয়ে। আমার মাথায় মুকুটটাকে দু-ভাগ করে সমস্ত সম্পদ ও ক্ষমতা তোমাদের দান করলাম। আমার জন্য রইল। শুধু রাজা উপাধিটা। তারপর সভাসদদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা যে কেউ একজন গিয়ে ডেকে আন ফ্রান্স ও বাৰ্গান্ডির দুই যুবরাজকে।
কেন্ট বললেন, এরূপ অবিবেচকের মতো কােজ আপনি করবেন না প্ৰভু! একটু ভেবে দেখুন, তাহলে বুঝতে পারবেন। আপনার প্রিয় ছোটো মেয়ে আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে।