একদিন ফরাসি রাজকুমারী তার তিন সহচরীর সাথে শিকারে বেরিয়েছেন, এমন সময় লর্ড বিরাউনের বিদূষক কস্টার্ড এসে তার হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলল তার প্রভু এই চিঠিটা রোজালিনকে দেবার জন্য পাঠিয়েছেন, মুখ আঁটা খামটা রাজকুমারী তার হাত থেকে নিলেন। খামটা খুলে চিঠি পড়ে দেখলেন রাজকুমারী। সেটা একটা প্রেমপত্ৰ—— জনৈক ডন আড্রিয়ানা আর্মাডো একটা প্রেমপত্র লিখেছে জ্যাকুইনেতা নামে এক গ্ৰাম্য বালিকাকে। প্রেমপত্র পড়ে তার ভাষায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজকুমারী। তিনি আবেগের সাথে সেটায় চুমো দিলেন। কিছুক্ষণ বাদে তিনি চিঠিটা ফিরিয়ে দিলেন রোজালিনকে।
এদিকে তিন বন্ধুর কারও জানতে বাকি নেই। ফরাসি রাজকন্যার প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন রাজা ফার্দিনান্ড। একইভাবে তারাও অস্থির হয়ে উঠেছেন রাজকুমারীর তিন সহচরীকে প্রেম নিবেদন করার জন্য। হাতে লেখা চিঠি নিয়ে তারা হন্যে হয়ে বনের মাঝে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্ৰেয়সীদের। একসময় তারা নিজেরাই ধরা পড়ে গেলেন ফার্দিনান্ডের হাতে। তাঁরা তিনজনেই যে প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন সে কথা স্বীকার করলেন তারা। সেই সাথে তিন লর্ড এও স্বীকার করলেন যে নারীর মুখ না দেখা, সপ্তাহে একদিন উপোস করা এসব উদ্ভট বিধি-নিষেধ আরোপ করে তারা প্রতারণা করেছেন যৌবনের সাথে। তাদের সাথে রাজাও একবাক্যে স্বীকার করলেন নারীই পুরুষের প্রেরণাদাত্রী, নারীই এনে দেয় পুরুষের পৌরুষত্ব। এবার ফরাসি রাজকুমারী ও তার তিন সহচরীর মন জয় করতে তাদের রাশি রাশি দামি উপহার পাঠাতে লাগলেন ফার্দিনান্ড ও তার তিন লর্ড। কিন্তু রাজকুমারী ও তার তিন সহচরী একে নিছক মজা বলেই ধরে নিলেন। অনন্যোপায় হয়ে রাজা ফার্দিনান্ড ও তার তিন লর্ড সরাসরি প্রেম নিবেদন করে বসলেন ফরাসি রাজকুমারী ও তার তিন সহচরীকে। রাজকুমারী বললেন, নিজের শপথ ভেঙে রাজা যে অন্যায় করেছেন সে জন্য তিনি তার প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছেন। তিনি ফার্দিনান্ডকে বললেন বনে গিয়ে একটানা বারো মাস কঠোর তপস্যা করতে। বারো মাস তপস্বী জীবন যাপন করার পরও যদি তার প্রেমের অনুভূতি বজায় থাকে, তাহলে তিনি যেন ফিরে এসে তাকে নতুনভাবে প্রেম নিবেদন করেন। রাজকুমারী কথা দিলেন তখন তিনি তার ডাকে সাড়া দিয়ে তাকে গ্ৰহণ করবেন। রাজকুমারী আরও বললেন ইতিমধ্যে তার বাবা মারা গিয়েছেন। এই বারোমাস তিনি এক নির্জন ঘরে নিজেকে আটকিয়ে রেখে পিতৃশোক পালন করবেন।
রাজা ফার্দিনান্ড বললেন, রাজকুমারীর নির্দেশ পালন করতে তাঁর অবশ্যই কষ্ট হবে, তবুও তিনি যে তার প্রেমের আহ্বানে সাড়া দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সে কথা মনে রেখে এ কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারবেন।
তিন লর্ডের প্রেমের আহ্বানে রাজকুমারীর তিন সহচরীও অনুরূপ শর্ত আরোপ করলেন। রোজালিন লর্ড বিরাউনকে বললেন তিনি যদি একবছর আর্তের সেবায় কাটিয়ে দিতে পারেন তাহলে তিনি লর্ড বিরাউনকে গ্ৰহণ করতে রাজি আছেন।
ক্যাথরিন লর্ড ডুমেনকে বললেন তিনি যদি বারোমাসের মধ্যে সুন্দর স্বাস্থ্য, সততা আর একমুখ দাড়ি—এই তিনটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারেন তাহলে তিনি তাকে গ্রহণ করতে রাজি আছেন।
মারিয়া অবশ্য অন্যদের মতো লর্ড লঙ্গাভিলের উপর কোনও শর্ত আরোপ না করে বললেন, রাজকুমারীর সহচরী হিসেবে তাকেও একবছর কালো পোশাক পরে থাকতে হবে। একবছর পর তিনি কালো পোশাক ত্যাগ করে লর্ড লঙ্গাভিলকে গ্রহণ করবেন।
রাজকুমারী তার সহচরীদের সাথে বিদায় নেবার সময় লর্ড বিরাউন তাদের বললেন, এক বছর সময় খুব কম না হলে পরে সেটা মিলনাত্মক হবে এই আশায়, তঁরা হাসিমুখেই কাটিয়ে দেবেন। সে সময়টা।
রাজকুমারী ও তার তিন সহচরী এবং রাজা ফার্দিনান্ড ও তার তিন লর্ড – সবাই পরস্পরের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিলেন।
সিমবেলিন
একবার ফিরে তোকানো যাক দু-হাজার বছর আগের দিকে। আজকের মতো সেদিনও ইংল্যান্ড বিভক্ত ছিল কতকগুলি ছোটো বড়ো রাজ্যে। ইংল্যান্ডের দক্ষিণাংশে সাগরতীরে যে বড়ো রাজ্যটি ছিল তার নাম ব্রিটেন। সে সময় ইউরোপের অধিকাংশ দেশই ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। রোমান বাহিনী এসে ঘাঁটি গেড়েছে ব্রিটেনের সীমাস্তে। তখনও রোমের সম্রাট হননি জুলিয়াস সিজার। রোমান সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে তিনি তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। সারা দুনিয়া। ব্রিটেনের রাজা কেসিবেলান তার কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে রোমের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। কিছুদিন বাদে দেশে ফিরে যান জুলিয়াস সিজার। পরবর্তীকালে তিনি নিহত হন। রোমান সেনেটের সদস্যদের হাতে। তার মৃত্যুর সাথে সাথেই ক্ষমতা দখলের লড়াই শুরু হয়ে যায় রোমান শাসকদের মাঝে। স্বভাবতই দুর্বল হয়ে পড়ে রোমান রাজশক্তি। ততদিনে মারা গেছেন ব্রিটেনের রাজা কেসিবেলান। তার ভাইপো সিমবেলিন বসেছেন সিংহাসনে। রোমান শক্তির দুর্বল অবস্থা দেখে তাদের রাজকর দেওয়া বন্ধ করলেন সিমবেলিন।
সিমবেলিনের সেনাপতি ছিলেন বেলারিয়াস। বহু যুদ্ধে পারদর্শিতা দেখিয়ে রাজার প্ৰিয়পাত্র হয়েছিলেন তিনি। ওদিকে রাজসভায় এমন অনেক অমাত্য ও সভাসদ ছিলেন যারা বেলারিয়াসকে একদম সহ্য করতে পারতেন না। তার সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধি দেখে হিংসায় জুলে–পুড়ে মরতেন তাঁরা। বেলারিয়াসকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ওই সব অমাত্য ও সভাসদরা তার বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্র করলেন। তাঁরা সবাই মিলে রাজার কাছে গিয়ে বেলারিয়াসের নামে মিথ্যে অভিযোগ জানিয়ে বললেন যে রাজাকে সরিয়ে দিয়ে সিংহাসনে বসার জন্য বেলারিয়াস গোপনে ষড়যন্ত্র করেছেন রোমানদের সাথে। তাদের অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণ করতে তারা রাজার কাছে কিছু জাল প্ৰমাণপত্র পেশ করলেন। তাদের অভিযোগ সত্যি বলে মেনে নিলেন সিমবেলিন। তিনি বেলারিয়াসের সেনাপতির পদ, জমিদারি, বিষয় সম্পত্তি, টাকা-কড়ি সবকিছু কেড়ে নিয়ে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিলেন তাকে। রাতারাতি সবকিছু খুইয়ে পথের ভিখারি হয়ে গেলেন নিরপরাধ বেলারিয়াস। দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করে গেলেন সময়-সুযোগ এলে একদিন তিনি এই অন্যায়ের প্রতিশোধ নেবেন। সিমবেলিনের রাজত্বের সীমানা ছেড়ে ওয়েলসের জঙ্গলে গিয়ে নতুন নামে আস্তানা গাড়লেন তিনি।